বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম।
আল্লাহ তায়ালা মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই পথের দিশা দিতে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন এবং কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। সর্বশেষ নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন মুহাম্মাদ (সা) কে। তাঁর প্রতি নাযিল করেছেন সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ আল কুরআন। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী এর পরে আছে মহাপ্রলয় এবং পুনরুত্থান। যখন পৃথিবীতে আগত প্রত্যেকটি মানুষকে সৃষ্টিকর্তার সামনে উপস্থিত করা হবে।
প্রত্যেক পরবর্তী নবী তাঁর পূর্বে আসা নবীদের সত্যায়নকারী। প্রত্যেক পরবর্তী কিতাব পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যায়নকারী। সুতরাং, কুরআন শুধু নবী মুহাম্মাদ (সা) এর নবুওয়াতেরই সাক্ষ্য দেয় না। মুসা (আ)এবং ঈসা (যিশু) (আ) কেও সত্য নবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। মূলত তাঁদের সকলের চলার পথ ছিল অভিন্ন।
প্রত্যেক নবীকে আল্লাহ কিছু অলৌকিক নিদর্শন দিয়ে সাহায্য করেছেন। যারা তাঁকে অস্বীকার করবে বা প্রমাণ চাইবে তাদের জবাব দিতে। মুহাম্মাদ (সা) এর ক্ষেত্রে কুরআনই ছিল প্রধান অলৌকিক নিদর্শন। যে কারণে আল্লাহ গোটা মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন-
"হে মানুষ! তোমরা উপাসনা করো তোমাদের সেই প্রতিপালিকের যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা আত্মরক্ষা করতে পার।
যিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আকাশকে ছাদ করেছেন, আর তোমাদের জীবিকার জন্য আকাশ থেকে পানি ঝরিয়ে ফলমূল উৎপাদন করেন। সুতরাং জেনেশুনে কাউকেও তোমরা আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করিয়ো না।
আর আমি আমার বান্দাহর প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকলে তোমরা তার মতো একটি সূরা আনো। এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সব সাক্ষীকে ডাকো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।" (২:২১-২৩)
দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, বর্তমানে একশ্রেণীর বাতিকগ্রস্ত লোক কুরআন সম্পর্কে না জেনে হাস্যকর সব কথা বলে। কেউ বলে, মুহাম্মাদ (সা) সব ধর্মগ্রন্থ থেকে চুরি করে কুরআন লিখেছেন। অথচ নবীর প্রতিবেশী মদীনার ইহুদীরা কোনদিন এ অভিযোগ করেনি। কেউ বলে, নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের লেখা কোরআনের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। অথচ তারা কখনো এ দাবী করেন নি যে তাদের লেখা স্রষ্টার বাণীর তুল্য। নজরুলতো নিজে কোরআনের কাব্যানুবাদ করেছেন। কেউ কেউ আবার কুরআনের চ্যালেঞ্জ ভূয়া প্রমাণ করতে নিজেই সূরা রচনায় নেমে পড়েছে।
ভাবার বিষয় হচ্ছে, মনুষ্য রচনা কি কখনো আল্লাহর বাণী সমতুল্য হতে পারে?
আল্লাহর কুরআনতো এমনই এক বিস্ময়কর নিদর্শন যা একটি ভাষার গতিপথকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দিয়েছে। সপ্তম শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত চৌদ্দশত বছর যাবত ভাষাটি তার অবস্থানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এ বিষয়টি নিয়েই আজ সামান্য আলোকপাত করতে চাই।
আমরা জানি সময়ের আবর্তনে ভাষা বিবর্তিত হয় এমনকি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভাষার এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় কারো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ, এতে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু তিনিও বাংলা ভাষাকে তাঁর সময়ের রীতিতে আবদ্ধ করে রাখতে পারেন নি। রবীন্দ্রোত্তর যুগে শতাব্দিরও কম সময়ে আজকের বাংলা ভাষা অনেক পরিবর্তিত।
এখানে তিনটি পৃথক দৃষ্টান্তের মাধ্যমে ভাষার পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি তুলে ধরছি।
একবিংশ শতাব্দীর বাংলা ভাষা:
"একদিন বসে আছি। টিভিতে খবর দেখছি। হঠাৎ চোখ গেল নিনিতের দিকে। সে হামাগুড়ি পজিশন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তার ছোট্ট শরীর টলমল করছে। যেকোনো সময় পড়ে যাবে এমন অবস্থা। আমি ডান হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিতেই সে হাঁটা বাদ দিয়ে দৌড়ে হাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশ্বজয়ের ভঙ্গিতে হাসল। তখনই মনে হলো, এই ছেলেটির সঙ্গে আরও কিছুদিন আমার থাকা উচিত।"
-"নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ", হুমায়ুন আহমেদ (পর্ব-৩)
বিদ্যাসাগরীয় বাংলা (উনবিংশ শতাব্দী):
"কিয়ৎ ক্ষণে রথ মৃগের সন্নিহিত হইলে, রাজা শরনিক্ষেপের উপক্রম করিতেছেন, এমন সময়ে, দূর হইতে, দুই তপস্বী উচ্চৈঃস্বরে কহিতে লাগিলেন, মহারাজ ! এ আশ্রমমৃগ, বধ করিবেন না, বধ করিবেন না । সারথি, শুনিয়া, অবলোকন করিয়া কহিল, মহারাজ ! দুই তপস্বী এই মৃগের প্রাণবধ করিতে নিষেধ করিতেছেন । রাজা,তপস্বীর উল্লেখশ্রবণমাত্র, অতিমাত্র ব্যস্ত হইয়া, সারথিকে কহিলেন, ত্বরায় রশ্মি সংযত করিয়া রথের বেগসংবরণ কর।"
-"শকুন্তলা", ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
একাদশ শতকের বাংলা:
“গঙ্গা জউনা মাঝেঁরে বহই নাঈ
তহিঁ চড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলে পার করেই ।।
বাহ তু তোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা
সদ্গুরু পাও-পসাএঁ জাইব পুণু জিণউরা ।।
পাঞ্চ কেডুআল পড়ন্তেঁ মাঙ্গে পীঠত কাছী বান্ধী
গতণ দুখোলে সিঞ্চহু পাণী ন পইসই সান্ধি ।।
চান্দ সূজ্জ দুই চাকা সিঠিসংহার পুলিন্দা
বাম দাহিণ দুই মাগ ন চেবই বাহ তু ছন্দা ।। "
-চর্যাপদ, ডোম্বীপা > পদ নং- ১৪
স্পষ্টতই সময় যত গড়িয়েছে, প্রাচীন বাংলা তার রূপ বদলের প্রক্রিয়ায় আজকের এ অবস্থানে এসেছে।
বিষয়টি পৃথিবীতে অস্তিত্বশীল সব ভাষার ক্ষেত্রেই সত্য।
আধুনিক ইংরেজির উদ্ভব ঘটে ষোড়শ শতকে। তখন থেকে এ পর্যন্ত ভাষার মূল রূপ খুব একটা বদল না হলেও প্রাচীন ইংরেজি এবং মধ্যযুগীয় ইংরেজির সাথে এর ব্যবধান অনেক। শেক্সপীয়রের রচনা আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের অংশ। তবুও পাঁচশত বছরের ব্যবধানে তা বোঝা কিছুটা জটিল। চতুর্দশ শতকে জিওফ্রে চসারের লেখা "দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস" আজকের দিনে অনুবাদ ছাড়া বোঝাই সম্ভব নয়।
কুরআন অবতীর্ণ হয়ছে সপ্তম শতাব্দীতে আরবি ভাষায়। সে সময় পৃথিবীতে যেসব ভাষা প্রচলিত ছিল তার অনেক ভাষাই এখন বিলুপ্ত। যেসব ভাষা টিকে আছে তাও এতটা পরিবর্তিত যাকে নতুন ভাষা বলা চলে (যেমন, ফার্সি ভাষা)। কিন্তু আরবিই একমাত্র ভাষা যা সেসময় থেকে আজ পর্যন্ত কোন রকম পরিবর্তন ছাড়াই টিকে আছে। এর মূল কারণ হচ্ছে কুরআন। কিয়ামত পর্যন্ত মানুষকে সরল পথে চলতে কুরআনের শিক্ষা ধারণ করতে হবে। এ ভাষাটি পরিবর্তিত হয়ে গেলে কুরআন বোঝাই কঠিন হয়ে যাবে। অথচ আল্লাহ বলেছেন, "আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি"।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে আজকের দিনে এসেও আরবি ভাষার সবচেয়ে সহজ গ্রন্থ হচ্ছে আল কুরআন। কোন অনারব ব্যক্তি যদি আরবি ভাষার প্রাথমিক জ্ঞান ২৫% অর্জন করে। এর দ্বারা সে কুরআন বুঝে ফেলবে ৫০%। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। কুরআন মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সব আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করেছে, যেখানে সমগ্র কুরআনে মাত্র ১৭৮৯টি শব্দমূল ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ ভাষার এই সহজবোধ্যতা এর আভ্যন্তরীণ ভাব-গাম্ভীর্যকে বিন্দুমাত্র দুর্বল করেনি। কোন মানুষের রচনা কি ভাষার গতিকে ১৪০০ বছর যাবত থামিয়ে রাখতে পারে?
ইসলাম ধর্মের যাবতীয় বিধি-বিধানের মূল উৎস দু'টি, কুরআন এবং হাদীস। মুহাম্মাদ (সা) এর কথা, কাজ ও সম্মতি যা তাঁর সাথীদের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়েছে তাই হাদীস। সূতরাং কুরআন যদি মুহাম্মাদ (সা) এঁর রচনা হত তবে হাদীসের সাথে কুরআনের ব্যাপক মিল পাওয়া যেত। অথচ উভয়ের ভাব, প্রকাশভঙ্গী এবং বাক্যশৈলীর মাঝে রয়েছে আকাশ পাতাল ব্যবধান। আরবি ভাষায় কারো সামান্য জ্ঞান থাকলে সে বিষয়টি বুঝতে পারবে।
সাহিত্যিক তিনি যত বড়ই হোন না কেন, ব্যাকরণ অনুসারেই তাকে লিখতে হয়। অথচ কুরআন কোন ব্যাকরণ অনুসরণ করেনি। কুরআনকে অনুসরণ করেই আরবি ব্যাকরণ রচিত হয়েছে।
কুরআন নিউ টেস্টামেন্ট বা ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে চুরি করা হয় কিভাবে? অথচ কুরআন ওইসব গ্রন্থে উল্লেখিত অনেক বিষয়ে সম্পূর্ণ নতুন তথ্য দিয়েছে। বাইবেল বলে, যিশুখ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে কুরআন বলে, নিশ্চিতভাবেই তাকে হত্যা করা হয় নি। বরং আল্লাহ তাকে উঠিয়ে নিয়েছেন।
কুরআন এখানেই থেমে থাকেনি। কুরআন জানিয়েছে, কিয়ামাতের পূর্বে যিশুখ্রিস্ট পুনরায় পৃথিবীতে আসবেন। সে সময়ের খ্রিস্টানরা তাঁকে দেখে নিজেদের ভুল বুঝবে এবং নতুন করে ঈমান আনবে। এটা কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী যা এখনো ঘটেনি। যারা কুরআনের সত্যতাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে চান তারা কি একটু অপেক্ষা করবেন? কারণ কুরআন যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছে তার অনেকগুলি ইতোমধ্যে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। যেমন- পার্সিয়ানদের হাতে রোমানরা পরাজিত হলে কুরআন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল-
"রোমানরা পরাজিত হয়েছে নিকটবর্তী এলাকায়। আর তারা তাদের পরাজয়ের পর অতিসত্বর বিজয়ী হবে, কয়েক বছরের মধ্যে। অগ্র-পশ্চাতের কাজ আল্লাহরই হাতে। সেদিন মুমিনগণ আনন্দিত হবে।" [সূরা রুম (৩০),২-৩]
কুরআনের বেধে দেয়া সময়ের মধ্যেই (৯ বছর) রোমানরা বিজয়ী হয়েছিল।
কুরআন নিঃসন্দেহে আল্লাহর বাণী যা মুমিনের জন্য রহমত ও শেফা (আরোগ্য)। কিন্তু কাফেরদের জন্য তা একমাত্র ক্ষতি বৃদ্ধিরই কারণ।
যারা আরবি জানেন তাদের বোঝার সুবিধার্থে দুই যুগের আরবির তুলনামূলক দৃষ্টান্ত-
সপ্তম শতাব্দীর আরবি ভাষা:
وَلِلّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاللّهُ عَلَىَ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاخْتِلاَفِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لآيَاتٍ لِّأُوْلِي الألْبَابِ الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىَ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذا بَاطِلاً سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ - কুরআন (৩:১৮৯-১৯১)
একবিংশ শতাব্দীর আরবি ভাষা:
بحث صاحب السمو الملكي الأمير محمد بن نايف بن عبدالعزيز، ولي العهد نائب رئيس مجلس الوزراء وزير الداخلية - حفظه الله - مع رئيس جمهورية فنزويلا البوليفارية نيكولاس مادورو موروس سبل دعم العلاقات الثنائية بين البلدين في مختلف المجالات خاصة ما يتعلق بتعزيز التعاون في المجال الأمني لمكافحة التطرف ومحاربة الإرهاب
-সৌদি আরবের দৈনিক পত্রিকা থেকে চয়নকৃত
ওয়াল হামদু লিল্লাহি রব্বিল আলামীন।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৩৩