বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা আল্লাহর যার হাতে আমার প্রাণ। অসংখ্য দুরুদ ও সালাম সর্বশেষ ও চুড়ান্ত নবী মোহাম্মদ সাঃ এর উপর।
-------------------------------------------------------------------------
১. আপনি না হলে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতাম না
এ ধরণের বানোয়াট কথগুলির একটি হলো:
لـولاك لما خـلقـت الأفـلاك
“আপনি না হলে আমি আসমান যমিন বা মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতাম না।”
আল্লামা সাগানী, মোল্লা আলী কারী, আব্দুল হাই লাখনবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস একবাক্যে কথাটিকে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ এই শব্দে এই বাক্য কোনো হাদীসের গ্রন্থে কোনো প্রকার সনদে বর্ণিত হয় নি।
এখানে উল্লেখ্য যে, এই শব্দে নয়, তবে এই অর্থে দুর্বল বা মাওযূ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করছি।
=============================================
২. আরশের গায়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ) -এর নাম
একটি যয়ীফ বা বানোয়াট হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لما اقترف آدم الخطيئة قال يا رب أسألك بحق محمد لما غفرت لي فقال الله يا آدم وكيف عرفت محمدا ولم أخلقه قال يا رب لأنك لما خلقتني بيدك ونفخت في من روحك رفعت رأسي فرأيت على قوائم العرش مكتوبا لا إله إلا الله محمد رسول الله فعلمت أنك لم تضف إلى اسمك إلا أحب الخلق إليك فقال الله صدقت يا آدم إنه لأحب الخلق إلي ادعني بحقه فقد غفرت لك ولولا محمد ما خلقتك
“হযরত আদম (আ যখন (নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ করে) ভুল করে ফেলেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেন: হে প্রভু, আমি মুহাম্মাদের হক্ক (অধিকার) দিয়ে আপনার কাছে প্রার্থনা করছি যে আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। তখন আল্লাহ বলেন, হে আদম, তুমি কিভাবে মুহাম্মাদকে (সঃ) চিনলে, আমি তো এখনো তাঁকে সৃষ্টিই করিনি? তিনি বলেন, হে প্রভু, আপনি যখন নিজ হাতে আমাকে সৃষ্টি করেন এবং আমার মধ্যে আপনার রূহ ফুঁ দিয়ে প্রবেশ করান, তখন আমি মাথা তুলে দেখলাম আরশের খুঁটি সমূহের উপর লিখা রয়েছে: (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ)।
এতে আমি জানতে পারলাম যে, আপনার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি বলেই আপনি আপনার নামের সাথে তাঁর নামকে সংযুক্ত করেছেন। তখন আল্লাহ বলেন, হে আদম, তুমি ঠিকই বলেছ। তিনিই আমার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি। তুমি আমার কাছে তাঁর হক্ক (অধিকার) দিয়ে চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। মুহাম্মাদ (সঃ) না হলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না।”
ইমাম হাকিম নাইসাপূরী হাদীসটি সংকলিত করে একে সহীহ বলেছেন। কিন্তু সকল মুহাদ্দিস একমত যে হাদীসটি যয়ীফ। তবে মাউযূ কিনা তাতে তারা মতভেদ করেছেন। ইমাম হাকিম নিজেই অন্যত্র এই হাদীসের বর্ণনাকারীকে মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন।
আমি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ইমাম হাকিম অনেক যয়ীফ ও মাউযূ হাদীসকে সহীহ বলেছেন এবং ইমাম ইবনুল জাওযী অনেক সহীহ বা হাসান হাদীসকে মাউযূ বলেছেন। এজন্য তাদের একক মতামত মুহাদ্দিসগণের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়, বরং তাঁদের মতামত তাঁরা পুনর্বিচার ও নিরীক্ষা করেছেন।
এই হাদীসটির সনদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে সনদটি খুবই দুর্বল, যেকারণে অনেক মুহাদ্দিস একে মাউযূ হাদীস বলে গণ্য করেছেন। হাদীসটির একটিই সনদ: আবুল হারিস আব্দুল্লাহ ইবনু মুসলিম আল-ফিহরী নামক এক ব্যক্তি দাবী করেন, ইসমাঈল ইবনু মাসলামা নামক একব্যক্তি তাকে বলেছেন, আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম তার পিতা, তার দাদা থেকে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা থেকে বর্ণনা করেছেন।
বর্ণনাকারী আবুল হারিস একজন অত্যন্ত দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। এছাড়া আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম (১৮২ হি) খুবই দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী ছিলেন। মুহাদ্দিসগণ তাঁর বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করেন নি। কারণ তিনি কোনো হাদীস ঠিকমত বলতে পারতেন না, সব উল্টোপাল্টা বর্ণনা করতেন। ইমাম হাকিম নাইসাপূরী নিজেই তার ‘মাদখাল ইলা মা’রিফাতিস সহীহ’ গ্রন্থে বলেছেন: “আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম তার পিতার সূত্রে কিছু মাউযূ বা জাল হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাদীস শাস্ত্রে যাদের অভিজ্ঞতা আছে, তারা একটু চিন্তা করলেই বুঝবেন যে, এ সকল হাদীসের জালিয়াতির অভিযোগ আব্দুর রাহমানের উপরেই বর্তায়।”
এই হাদীসটি উমার (রা) থেকে অন্য কোন তাবেয়ী বলেন নি, আসলাম থেকেও তাঁর কোন ছাত্র তা বর্ণনা করেন নি। যাইদ ইবনু আসলাম প্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন। তাঁর অনেক ছাত্র ছিল। তাঁর কোন ছাত্র এই হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। শুধুমাত্র আব্দুর রহমান দাবী করেছেন যে তিনি এই হাদীসটি তাঁর পিতার নিকট শুনেছেন। তার বর্ণিত সকল হাদীসের তুলনামূলক নিরীক্ষা করে ইমামগণ দেখেছেন তাঁর বর্ণিত অনেক হাদীসই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা পর্যায়ের। এজন্য ইমাম যাহাবী, ইবনু হাজার ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে মাউযূ বলে চিহ্নিত করেছেন। ইমাম বাইহাকী হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বলেছেন যে, এই কথাটি মূলত ইহূদী-খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত শেষ নবী বিষয়ক কথা; যা কোনো কোনো সাহাবী বলেছেন। অন্য একটি দুর্বল সনদে এই কথাটি উমার (রা) এর নিজের কথা হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আব্দুর রহমান অন্যান্য অনেক হাদীসের মত এই হাদীসেও সাহাবীর কথাকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর কথা হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
======================>
এই মর্মে আরেকটি যয়ীফ হাদীস আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাসের কথা হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। এই হাদীসটিও হাকিম নাইসাপূরী সংকলন করেছেন। তিনি জানদাল ইবনু ওয়ালিক এর সূত্রে বলেন, তাকে আর্ম ইবনু আউস আল-আনসারী নামক দ্বিতীয় শতকের এক ব্যক্তি বলেছেন, তাকে প্রখ্যাত তাবে তাবেয়ী সাঈদ ইবনু আবূ আরূবাহ (১৫৭ হি) বলেছেন, তাকে প্রখ্যাত তাবিয়ী কাতাদা ইবনু দিআমাহ আস-সাদূসী (১১৫ হি) বলেছেন, তাকে প্রখ্যাত তাবিয়ী সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব (৯১হি) বলেছেন, তাকে ইবনু আব্বাস (রা) বলেছেন:
أوحى الله إلى عيسى يا عيسى آمن بمحمد وأمر من أدركه من أمتك أن يؤمنوا به فلولا محمد ما خلقت آدم ولولا محمد ما خلقت الجنة ولا النار ولقد خلقت العرش على الماء فاضطرب فكتبت عليه لا إله إلا الله محمد رسول الله فسكن
“মহান আল্লাহ ঈসা (আ)-এর প্রতি ওহী প্রেরণ করে বলেন, তুমি মুহাম্মাদের উপরে ঈমান আনয়ন কর এবং তোমার উম্মাতের যারা তাঁকে পাবে তাদেরকে তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নের নির্দেশ প্রদান কর। মুহাম্মাদ () না হলে আদমকে সৃষ্টি করতাম না। মুহাম্মাদ () না হলে জান্নাত ও জাহান্নামও সৃষ্টি করতাম না। আমি পানির উপরে আরশ সৃষ্টি করেছিলাম। তখন আরশ কাঁপতে শুরু করে। তখন আমি তার উপরে লিখলাম: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’; ফলে তা শান্ত হয়ে যায়।”
---------------------------
ইমাম হাকিম হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ। ইমাম যাহাবী তার প্রতিবাদ করে বলেন, “বরং হাদীসটি মাউযূ বলেই প্রতীয়মান হয়।” কারণ এই হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী এই ‘আর্ম ইবনু আউস আল-আনসারী’ নামক ব্যক্তি। সে প্রসিদ্ধ কয়েকজন মুহাদ্দিসের নামে হাদীসটি বর্ণনা করেছে। অথচ এদের অন্য কোনো ছাত্র এই হাদীসটি তাদের থেকে বর্ণনা করেনি। এই লোকটি মূলত একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। তার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। এই জানদাল ইবনু ওয়ালিক ছাড়া অন্য কোনো রাবী তার নাম বলেন নি বা তার কোনো পরিচয়ও জানা যায় না। এজন্য ইমাম যাহাবী ও ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী বলেন যে, এই হাদীসটি ইবনু আব্বাসের নামে বানানো জাল বা মিথ্যা হাদীস।
এই অর্থে আরো জাল হাদীস মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন।
আল্লাহ আমাদের কোরআন ও সহীহ হাদিসের অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
মূল ঃ হাদীসের নামে জালিয়াতি: প্রচলিত মিথ্যা হাদীস ও ভিত্তিহীন কথা
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
পি-এইচ. ডি. (রিয়াদ), এম. এ. (রিয়াদ), এম.এম. (ঢাকা)
অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স
ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ