'আমি আদর্শ পুরুষ নই। আদর্শ পুরুষের জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবটুকুই এক নিরবচ্ছিন্ন সূত্রে গাঁথা। সবটাই চির পরিচিত রেলগাড়ির লাইন; কোন স্টেশনে গাড়ি কতক্ষণ দাঁড়াবে তাও আগে থেকেই জানা। কোথাও অপ্রত্যাশিত বিস্ময় বা অজ্ঞতার চমক নেই। সুতরাং আমি আদর্শ পুরুষ নই। চরিত্র যথেষ্ট বলীয়ান নয় বলেও বটে, মনের স্বাভাবিক প্রবণতাও কিছুটা অন্যদিকে প্রবহমান বলেও বটে।' [ রশীদ করিম / উত্তম পুরুষ, ১৯৬১]
বিমল করের কিকিরা সমগ্রে একটা পরিচিত নাম দেখলাম। মোহন। দীর্ঘদিন আমাদের ভোজন রসিক পরিবারে রুই কাতল সরবরাহের কাজটি করেছিলেন মোহন আংকেল। টুকরিতে করে মাছ নিয়ে ফেরি করে বিক্রি করতেন তিনি। সে বছর দশেক আগের কথা। আমাদের বাসার নিচে এসে কলিংবেল দিতেন। আমি আমাদের বটিটা নিয়ে নামতাম। উনি মাছ কেটে নিজের সাথে ময়লাও নিয়ে যেতেন। ব্যাপারটা আমার দারুণ লাগতো। তাছাড়া, ওনার সাথে আমাদের ঐ যাকে বলে 'টাকার সম্পর্ক', সেটা ছিলো না। আমরা (মূলত আমি আর মা) ওনার পরিবারের বিষয়ে জানতাম। ওনার ছেলে তখন পড়াশোনা করছিলো। আংকেল প্রায়ই বলতেন, ছেলে পড়াশোনা শেষ করে সংসারের হাল ধরলে মাছ বিক্রি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যাবেন। চাষবাস করবেন। তখনই দুটো গরু ছিলো তাদের। একবার ওনার চাষের তরিতরকারিও নিয়ে এসেছিলেন আমাদের জন্য। আংকেলের গ্রামে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। মোহন নামটা আমার তাই খুবই পরিচিত। তবে আমার মনে হয়না তিনি আমার নামটা মনে রেখেছেন। তিনি তখনও আমার নাম জানতেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। আংকেলের ছোট ভাইকে কিছুদিন আগে দেখলাম এলাকায়। তিনিও মাছ ব্যবসায় আছেন। অনেকদিন পরপর কোথা থেকে যেনো এসে কদিন মাছ বিক্রি করে চলে যান। এবার ঈদের আগে এসেছিলেন। কথা হয়েছিলো ওনার সাথে। মোহন আংকেলরা সবাই ভালো আছেন বাড়িতে। আমার ইচ্ছা করছে একদিন চলে যাই আংকেলকে দেখতে। নওগাঁয়।
কিকিরা সমগ্র থেকে দুইটা উপন্যাস পড়লাম। আর পড়বোনা। কিকিরা একজন পঞ্চাশ পেরোনো সাবেক স্টেজ ম্যাজিশিয়ান, এবং বর্তমানে গোয়েন্দা এমন একজন চরিত্র। তার সাথে ছানবিন করতে সাথে যায় তারাপদ আর চন্দন নামের দুই যুবক। অত্যন্ত লাইট রিড। পড়লে পড়ে ফেলা যায়। কিন্তু জীবনে সময় কম। সবকিছু পড়ে শেষ করতে পারবো না। তার উপর আমার যোগ হচ্ছে মনে না থাকার অসুখ।
ঈদের আগে রশীদ করিমের 'উত্তম পুরুষ' উপন্যাসটা শেষ করলাম। এক দিনে একশো ষাট পৃষ্ঠা। রশীদ করিমের ব্যাপারে গত বছরও কিছু জানতাম না। তবে আমাদের লাইব্রেরিতে আগামী বছর রশীদ করিম আর সর্দার ফজলুল করিমের জন্ম শতবর্ষ পালন করা হবে দেখে কিনা একটু গরজ নিয়ে পড়া শুরু করলাম। ওনার লেখা বই পড়ার আগে বাংলা একাডেমী থেকে বের হওয়া ওনার জীবনীটা পড়ে নিয়েছিলাম। অনেকে বলেন উত্তম পুরুষ লেখার পর আর কোনোদিন কিছু না লিখলেও রশীদ করিম বাংলা সাহিত্যে মর্যাদার আসনে থাকতেন। কাজটির জন্য তিনি পেয়েছিলেন আদমজী সাহিত্য পুরস্কার। আমার দারুণ লেগেছে বইটা। রশীদ করিমের বাকি কাজগুলো পড়ে একটা প্রবন্ধ লেখাই যেতে পারে।
তবে ভবিষ্যতে কি হবে কি করবো, এই বিষয়ে আমি আর খুব একটা মাথা ঘামাই না। ভবিষ্যতটা খুবই অনিশ্চিত। এই যেমন ইসরাইলে ইরানের হামলা। যুদ্ধ, বিগ্রহ, বাণিজ্য, মহামারী, সফটওয়্যার। পৃথিবীর বড় বড় ঘটনাগুলোইতো খুব অনিশ্চিত। সেখানে মানুষের জীবনটাই আর কতটুকু নিশ্চিত। জীবনের সব অনিশ্চয়তার মাঝে নিশ্চিত হওয়া যায় শুধু এই বিষয়টায় যে, পৃথিবীতে কেউ অমর নয়। কিছু কিছু জীবন দর্শনে মানুষের মৃত্যুকে খুব তাৎপর্য দেওয়া হয়। এমনও নজির আছে যে, মৃত্যুর চূড়ান্ত পরিণতির কথা মনে রাখতে বিশেষ লকেট ও আংটি ব্যবহার করা হতো একসময়। প্রতিদিন মৃত্যুকে স্মরণ করে বিনয়ী এবং সাদামাটা জীবন যাপন করতে উৎসাহ দেবার প্রবণতা থাকে এই দর্শনধারায়। খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মে সরাসরি এমন চিন্তাভাবনা পাওয়া যায়। মৃত্যুর সাথে বিনয়ের সম্পর্কটা কি প্রধানত ধর্মীয় এবং পরলৌকিক? আমি যখন থাকবো না তখন মানুষ আমাকে নিয়ে কি ভাবলো সেটা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ?
হয়তো গুরুত্বপূর্ণ। পরিচিত সব নশ্বরতার মাঝে মৃত্যু একটা বড় ঘটনা। আপনজনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে অনেকে যুদ্ধে যায়। যুদ্ধে যাওয়ার পেছনে তখন দেশপ্রেমের বোধ কাজ করেনা। পরিবারের উপার্জনকারী ব্যক্তির মৃত্যু অনেক সময়ই বাকি সদস্যদের জীবনে বাজে ফলাফল নিয়ে আসে। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের চরিত্রহানী হয়েছে মৃত্যুর পরে তাদের গোপন করে যাওয়া তথ্য টথ্য ফাঁস হওয়ার মধ্যে দিয়ে। তাই মরেও যে খুব শান্তি আছে সেটাও নির্ধারিত ভাবে বলা মুশকিল। অন্তত সমাজ সংস্কৃতির দিক দিয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:১৯