somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রেডিয়াম গার্লদের বেদনাদায়ক ইতিবৃত্ত

২৬ শে জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ২:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



শখের তোলা আশি টাকা। সেই শখ মেটাতে অনেকেই অনেক কিছু কিনে থাকেন। সৌখিন এই সকল মানুষদের তালিকার মধ্যে একসময় ছিলো একটি রেডিয়ামের হাত ঘড়ি অথবা দেয়াল ঘড়ি। এখনো কিছু মানুষ আছেন যারা অ্যান্টিক রেডিয়াম ঘড়ি কিনে থাকেন। এই রকম একটি ঘড়ি সংগ্রাহকদের সংগ্রহশালাকে আরো সমৃদ্ধ করে। পৃথিবীতে মানুষের শখ মেটাতে অনেক মানুষকে তাদের জীবন দিতে হয়েছে। ঠিক যেমন দিয়েছিলেন রেডিয়াম ঘড়ির কারখানার সুন্দরী নারী কর্মীরা। ক্যান্সার থেকে শুরু করে নানা রকম শারীরিক জটিলতায় তাদের মৃত্যু হয়েছিলো। "দ্য রেডিয়াম গার্লস: দ্য ডার্ক স্টোরি অফ আমেরিকা’স সাইনিং ওমেন'' বইটির লেখিকা কেট মুর বলেছেন "জীবিত অবস্থায় রেডিয়ামের তেজস্ক্রিয়তায় নারী শ্রমিকদের শরীরের হাড়গুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলো এবং মহিলাদের চোয়ালগুলিতে গর্তের সৃষ্টি হয়েছিলো।" তবে যারা এই ঘড়ি নিয়মিত ব্যবহার করতেন তারা অনেকটাই নিরাপদ ছিলেন।




১৮৯৮ সালে নোবেল বিজয়ী মেরি কুরি এবং তার স্বামী পিয়েরে কুরি আবিষ্কার করেন রেডিয়াম। রেডিয়াম আবিষ্কারের পর থেকেই আশা করা হয়েছিল, রেডিয়াম খুব দ্রুত মানব কল্যাণে ব্যবহার হবে। ব্যবহার করা হবে ক্যান্সারের নিরাময় হিসেবে। মানুষের এই প্রত্যাশা এক সময়ে পূরণ হয়েছিল ঠিকই তবে তা বহুলাংশেই ছিল মানব দেহের জন্য ক্ষতির কারণ। সেই ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর চিকিৎসায় রেডিয়ামের সরাসরি প্রয়োগ বন্ধ হয়ে যায় এবং পরে মানব তৈরি রেডিয়াম রেডিয়েশন দিয়ে ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু হয়।




রেডিয়াম আবিষ্কারের পর থেকে এটি ব্যবহার হয়ে আসছিলো আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় টুথপেস্ট থেকে ব্যয়বহুল প্রসাধনী, খাবার এবং পানীয়তে। রেডিয়াম দিয়ে তৈরি পণ্যের মধ্যে একটি পণ্যের নাম ছিল রেডিথর যা ১৯২০ সালের দিকে বিক্রি হত ১ ডলারে। রেডিথর মূলত এক ধরনের এনার্জি ড্রিংক। রেডিথরে মিশ্রিত রেডিয়াম খুব সহজেই খাবার পানির সাথে মিশে যেতো। রেডিথরের বিজ্ঞাপনে বলা হতো, "এটি মৃতপ্রায় মানুষের জন্য একটি চিকিৎসা ও যৌবন ধরে রাখার মাধ্যম"। এই বিজ্ঞাপনে প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হতো আর্থ্রাইটিস থেকে শুরু করে বাতের ব্যথা পর্যন্ত নিরাময়ের। তবে রেডিয়াম কখনোই রোগ নিরাময়ের মাধ্যম ছিলো না বরং ছিলো একটি নীরব ঘাতক।



উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে আমেরিকান অভিজাত ব্যক্তি এবং অ্যাথলেট ইবেন বায়ার্সের কথা। তিনি তার ক্রীড়া সাফল্যের জন্য যতটা না খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তার মারা যাবার কারণ নিয়ে আরো বেশি কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি বছরের পর বছর ধরে প্রতিদিন এক বোতল রেডিথর পান করার ফলে ১৯৩৩ সালে বীভৎসভাবে মারা গিয়েছিলেন। রেডিয়ামের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ক্যান্সার হয়ে মৃত্যু বরণ করা ইবেন বাইয়ার্স এর চোয়ালটি মুখ থেকে খুলে খসে গিয়েছিলো। সেসময় মানুষ রেডিয়ামের সরাসরি ব্যবহারে অত্যন্ত অভ্যস্ত হয়ে পরেছিলেন। স্বয়ং মেরি কুরি রেডিয়ামের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় মারা গেলেও, রেডিয়ামের বিপদজনক বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছিলো বিশাল মাত্রায়।



রেডিয়াম গার্লস



১৯২০-এর দশকের প্রথম দিকে, অন্ধকারে ঘড়ির কাটা জ্বল জ্বল করা ছিলো আভিজাত্যের প্রতীক। শুধু তাই নয় অনেকের কাছে জাদুর মতো মনে হত এই ধরণের ঘড়ি। ১৯১৬ সালে আমেরিকার নিউ জার্সিতে, এই ঘড়ি উৎপাদনের প্রথম কারখানাগুলোর একটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের অনেক কারখানায় বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়। ৭০ জন নারী শ্রমিক দিয়ে প্রথম এই ঘড়ি তৈরির কাজ শুরু করে তারা। শুধু তাই নয়, সেই সময়ে এই চাকরি ছিল স্বপ্নের মতো। কারণ কারখানাগুলোতে ভাল বেতন দিতো এবং ওয়ার্কিং ক্লাস নারীদের কাছে এটি ছিল একটি গ্ল্যামারাস কাজ।




এই কাজে নিয়োগ প্রাপ্ত নারীদের কাজের একটি বিশেষ ধরন ছিলো। সূক্ষ ডায়ালগুলোতে নিখুঁতভাবে রেডিয়ামের প্রলেপ লাগানোর জন্য তুলিটিকে ঠোঁটের সাহায্যে সরু করার নির্দেশ দিয়েছিলেন কারখানার মালিকেরা। তবে কখনোই এই নারীদের রেডিয়ামের ঝুঁকির কথা বলা হয়নি। পক্ষান্তরে কারখানায় কাজ করা পুরুষেরা ঠিকই দস্তার অ্যাপ্রন পরে কাজ করতেন। প্রসাধনী হিসেবে বহুল জনপ্রিয় রেডিয়াম সব নারীই ব্যবহার করতে চাইতেন। তুলি মুখে দিয়ে অনেক নারী তাই একটু রেডিয়াম খেয়ে ফেলতেন, কেউ বা লাগাতেন দাঁতে। রেডিয়াম এভাবে ব্যবহারের কারণে এই নারী শ্রমিকদের শরীরও অন্ধকারে জ্বলজ্বল করতো।

ততদিনে রেডিয়ামের তেজস্ক্রিয়তার ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষ সচেতন হয়ে উঠেছিলো। দেরিতে রেডিয়ামের বিষক্রিয়া সম্পর্কে অবগত হবার কারণ, এটি মানুষকে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। রেডিয়াম নিয়ে কাজ করা ঘড়ি কারখানায় কর্মরত শ্রমিকের শরীরে এই তেজস্ক্রিয়তার নেতিবাচক লক্ষণ বিকশিত হওয়ার আগেই বছরের পর বছর চলে যেত।



অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেডিয়াম কর্পোরেশনের কিছু কর্মচারীর ক্লান্তি এবং দাঁত ব্যথার মতো লক্ষণগুলি প্রকাশ হতে শুরু করে। প্রথম মৃত্যুটি ১৯২২ সালে রেকর্ড করা হয়েছিল, যখন প্রায় এক বছর ধরে দুর্ভোগের পরে ২২ বছর বয়সী মলি ম্যাগিয়া মারা গিয়েছিলেন। যদিও তার মৃত্যুর শংসাপত্রটিতে সন্দেহজনকভাবে বলা হয়েছিল যে, তার মৃত্যুর প্রধান কারণ সিফিলিস। তবে পেছনের ঘটনা হল, তিনি আসলে "Radium Jaw" নামক এক রোগে ভুগছিলেন ঠিক যেমনটা ঘটেছিল ইবেন বাইয়ার্সের সাথে। মলি ম্যাগিয়ারের সম্পূর্ণ নীচের চোয়ালটি এতই নাজুক হয়ে গিয়েছিল যে চিকিৎসক সেটিকে সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন। সবচেয়ে দূর্ভাগ্যজনক বিষয়টি হলো, প্রায় দুই বছর ধরে রেডিয়াম ঘড়ির কোম্পানি নারী শ্রমিকদের এই অসুস্থতার জন্য কোন প্রকার দায় নিতে অস্বীকৃতি জানায়। রেডিয়াম এর সাথে এই অসুখের যোগাযোগ থাকার কথা নিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত হওয়ার পর, কোম্পানি টাকা খরচ করে নতুন ভুয়া রিপোর্ট ও বের করতে চেয়েছিলো।



১৯২৫ সালে নিউ জার্সি কারখানার অন্যতম কর্মী গ্রেস ফ্রায়ার, রেডিয়াম ঘড়ি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি দুই বছর অতিবাহিত করেন একজন নির্ভরযোগ্য আইনজীবীর জন্য যিনি তাকে এই মামলায় সাহায্য করতে ইচ্ছুক। অবশেষে তিনি চারজন সহকর্মীকে সাথে নিয়ে ১৯২৭ সালে মামলা দায়ের করেন এবং সারা বিশ্বে খবরের শিরোনামে চলে আসেন। তবে এর মধ্যেই গ্রেসের অনেক সহকর্মী মৃত্যু বরণ করেছিলেন।

১৯২৮ সালে আদালত গ্রেস ফ্রায়ার এবং তার সহকর্মীদের পক্ষে রায় দেয়। একই সাথে আদালত ঠোঁট দিয়ে তুলি সূক্ষ করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং সকল কর্মীদের যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের আর্থিক সহযোগিতা এবং মৃত ব্যক্তিদের মৃত্যুর সঠিক কারণ শংসাপত্রে লেখার নির্দেশ দেয়া হয়। ১৯৬৮ সাল থেকে ঘড়িতে রেডিয়াম ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।

____________________________________
ছবি: (দি টেলেগ্রাফ)(সামান্থা উইল কক্সসন ব্লগার, ব্লগস্পট)(মেরি কুরি.ওরগ)()(মেডিয়াম)(টুডে ইন হিস্টরি.কম)(বাজফিড)(হাউ উইট ওয়ার্স ডেইলি)(ক্রাইম মিউসিয়াম)
-------------------------------------------------------------

আমার অন্যান্য লেখা:
সেসিলিয়া প্যেন: বিজ্ঞানের নক্ষত্র, নক্ষত্রের বিজ্ঞান
বেতারের আটলান্টিক ভ্রমণ
এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স এবং হাইজেনবার্গের দুঃস্বপ্ন


আমার ফেসবুক পেজ
আমার ইউটিউব চ্যানেল
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ২:১৯
১৫টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×