১৯০০ সালের ১০ই মে, ততদিনে ইংল্যান্ডে অস্তমিত হচ্ছে ভিক্টোরিয়ান সূর্য। গ্রামীণ ইংল্যান্ডের এক সুশিক্ষিত পরিবারে জন্ম হলো ছোট্ট শিশু সেসিলিয়ার। নিয়তির ফেরে ৪ বছর বয়সে ব্যারিস্টার বাবাকে হারিয়ে মায়ের কাছে বড় হচ্ছিলো কৌতূহলী শিশুটি। সেই সময়ের ইংল্যান্ডে নারী শিক্ষার সুযোগ এবং সম্ভাবনা ছিল খুবই সীমিত। সমস্ত প্রতিকূলতার বিপক্ষে গিয়ে সেসিলিয়া প্যেনের মা চেয়েছিলেন সন্তানদের সুশিক্ষিত করতে।
শৈশবেই সেসিলিয়া অনুপ্রেরনা পেয়েছিলেন প্রকৃতির রহসগুলো জানতে। লন্ডনের বরেণ্য সেন্ট পলস গার্লস স্কুলে পড়ার সময় গতিবিদ্যা, তড়িৎক্রিয়া, চৌম্বকত্ব, তাপগতিবিদ্যায় আগ্রহী হতে থাকেন তিনি। মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়ায় সেসিলিয়া কৈশোরের শেষের দিকে পেয়ে যান ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা নিউহ্যাম কলেজ স্কলারশিপ।
মজার ব্যাপার হলো, জ্যোতির্বিজ্ঞানের সবচেয়ে মেধাবী পি.এইচ.ডি থিসিস লেখার কৃতিত্ব পাওয়া সেসিলিয়া, নিউহ্যাম কলেজে উচ্চশিক্ষা শুরু করেছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানে। তবে পদার্থ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে সেসিলিয়ার বরাবরই বিশেষ আগ্রহ ছিলো। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানে সেসিলিয়ার চূড়ান্ত মনোনিবেশ ঘটে মহারথী আইনস্টাইনের কল্যাণে।
ক্যামব্রিজের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ স্যার আর্থার এডিংটানের থিওরী অফ রিলেটিভিটি নিয়ে বক্তৃতা দিতে আসেন নিউহ্যাম কলেজে। সেসিলিয়া প্যেন নিজের আত্মজীবনীতে সেই দিনটিকে অত্যন্ত আবেগপ্রবন ভাবে সরন করেছেন। তার বক্তব্য অনুসারে, থিওরি অফ রিলেটিভির বিশালতা অনুভব করে সেসিলিয়ার নার্ভাস ব্রেকডাউন হন। তিনি পরবর্তী তিন রাত ঘুমাতে পারেননি। অবশেষে বোটানী ছেড়ে চূড়ান্তভাবে সেসিলিয়া চলে আসেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের পৃথিবীতে। নিউহ্যামের স্বল্প সুযোগের মধ্যেই রাতের আকাশে তদন্ত চালিয়েছেন মাসের পর মাস।
মেধাবী এই শিক্ষার্থীকে চিনতে একটুকুও ভুল করেননি স্যার আর্থার এডিংটন। এডিংটনের নেতৃত্বেই সেসিলিয়া শুরু করেন নক্ষত্রের গঠন সম্পর্কিত একটি প্রজেক্ট। উদ্দেশ্য ছিলো, একটি নক্ষত্রের গঠন কাঠামো গানিতিক যুক্তি সমূহদ্বারা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু একটি জটিল গানিতিক সমস্যার সমাধানে ব্যার্থ হন সেসিলিয়া। বছরের পর বছর স্বয়ং স্যার আর্থার এডিংটনও ওই সমস্যাটিতেই আটকে ছিলেন।
আরনেস্ট রাদারফোর্ডের সাথে তিক্ত স্মৃতি রয়েছে সেসিলিয়া প্যেনের। তৎকালীন সমাজে উচ্চ সিক্ষায় ব্রতী নারীদের নানাভাবে হেয় বিদ্রুপ করা হতো। যদিও রাদারফোর্ডের ক্লাসে একমাত্র নারী শিক্ষার্থী হিসেবে সেসিলিয়া সেসব গায়ে মাখেননি। পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং একাগ্রতাই সেসিলিয়াকে উপহার দিয়েছে সময়ের শ্রেষ্ঠত্ব।
ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সময়ে নারীদের আনুষ্ঠানিক ডিগ্রী দেওয়ার রীতি ছিলো না। ওদিকে পশ্চিমের আরেক সম্রাট আমেরিকায় নারী শিক্ষায় প্রতিকূলতা দিন দিন দ্রুত কমে আসছিলো। তাই হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিকেরিং ফেলোসিপের জন্য আবেদন করেন সেসিলিয়া। মেধাবী এই মানুষটিকে আমেরিকায় আমন্ত্রণ জানিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাগ্যই পাল্টে দেয় হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
হারভার্ড কলেজ অবসারভেটরির পরিচালক হারলো স্যাপলের তত্ত্বাবধানে ডক্টরাল থিসিস শুরু করেন সেসিলিয়া প্যেন। সেই সময়েও নক্ষত্রের গঠন কাঠামো নিয়ে বিজ্ঞানী মহলের যথেষ্ট সন্দেহ ছিলো। অনেকে ভাবতেন নক্ষত্রগুলোতে অস্তিত্ব আছে ভারী মৌলিক পদার্থের। কিন্তু, এই চিন্তার একটি সমস্যা আছে। নক্ষত্রের বহিরাবরণে ভিন্ন ভিন্ন মৌলিক পদার্থের উপস্থিতি থাকলে শতশত নক্ষত্রের শতশত রঙ বৈচিত্র্য দেখা যাওয়ার। কিন্তু রাতের আকাশে শুধুমাত্র সাত প্রকার নক্ষত্রের খোঁজ পাওয়া যায়। তাহলে প্রশ্নটি হলো, কোন কোন মৌলিক পদার্থ নিয়ে সৃষ্টি হয় নক্ষত্রেরা? এই বিতর্কেরই কূল কিনারা আবিষ্কার করেন আমাদের সেসিলিয়া প্যেন। আর গর্বের সাথেই বলতে হয়, এই আবিষ্কারের গল্পে জড়িয়ে আছে বাঙ্গালির গর্ব মেঘনাদ সাহার নাম।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে মেগনাদ সাহার হইচই ফেলা আবিষ্কার, নক্ষত্রের বিখ্যাত তাপ- আয়নায়ন তত্ত্ব। সোজা অর্থে যার মানে, উত্তপ্ততা এবং রাসায়নিক ঘনত্বের সাথে সম্পর্ক আছে নক্ষত্রের আয়নিক অবস্থার। হারভার্ডের উন্নত আলোক বর্নালি সমূহ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে প্যেন বুঝতে পারেন যে, প্রতিটি নক্ষত্রই শুধু মাত্র হাইড্রোজেন- হিলিয়াম দিয়ে গঠিত! তবে বিভিন্ন তাপমাত্রা এবং আয়নিক অবস্থার কারনে নক্ষত্রের মধ্যে সীমিত সংখ্যক রঙ বৈচিত্র্য দেখা যায়।
সুতরাং, নক্ষত্রে ভারী মৌলিক পদার্থের উপস্থিতি নাকচ করে দেন সেসিলিয়া প্যেন। যার মানে, মহাবিশ্বের প্রাথমিক মৌল হাইড্রোজেন এবং অসংখ্য হাইড্রোজেন মিলিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে অন্যান্য মৌলিক পদার্থ। মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বে এই ধারনার গুরুত্ব আশা করি পাঠক উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
১৯২৫ সালে প্রকাশিত এই থিসিসটিকেই অনেকে বলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং যুগান্তকারী পি.এইচ.ডি থিসিস। গবেষণাগারে হাইড্রোজেন-হিলিয়ামের বিভিন্ন কৃত্রিম বর্নালী পরীক্ষা করে প্যেনের থিসিস সঠিক প্রসানিত হয়। তবে এই আবিষ্কারটি সরাসরি প্রত্যাখান করেছিলেন তখনকার বিজ্ঞানী মহলের একাংশ। তবে ধীরে ধীরে এই আবিষ্কারটির ভিত্তি মজবুত করেন সমসাময়িক অন্যান্য জ্যোতির্বিদরা। থিসিসটির জন্য রাডাক্লিফ কলেজ থেকে Ph.D ডিগ্রী লাভ করেন সেসিলিয়া প্যেন।
সেসিলিয়া প্যেন পরবর্তী জীবনে জ্যোতির্বিজ্ঞানে অপরিসীম অবদান রেখেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্বামী সের্গেই গাপোসকিনের সাথে মিলে তৈরি করেছিলেন অজস্র নক্ষত্রের তথ্যভাণ্ডার। একসময় বিশ্বব্যাপী জ্যোতির্বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের কাছে যা ছিলো আদর্শ টেক্সটবুক রেফেরেন্স। হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৬ সালে প্যেন পান প্রফেসরের মর্যাদা। ওই বছরই দায়িত্ব পান হারভার্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগে। জীবনের প্রতিকূলতা জয় করা নারীদের ইতিহাসে যা ছিলো একটি তাৎপর্যপূর্ন ঘটনা। সারা জীবনে অজস্র পদক এবং সম্মাননা পাওয়া এই মহীয়সী নারী আজো পৃথিবীতে অসংখ্য বিজ্ঞান শিক্ষার্থী নারীর অনুপ্রেরনা। ১৯৭৭ সালে এই মহান জ্যোতির্বিজ্ঞানীর সম্মানে সৌরজগতের একটি মাইনর গ্রহকে ''প্যেন গাপোসকিন'' নামে নামকরন করা হয়।
তথ্যসূত্র:
www.aps.org/ publications/apsnews/201501/physicshistory.cfm
owlcation.com/humanities/ The-Pioneering-Woman-Astronomer-Cecilia- Payne-Gaposchkin
https://en.wikipedia.org/ wiki/Cecilia_ Payne-Gaposchkin
ছবি: উইকিপেডিয়া থেকে নিয়ে নিজের এডিট করা
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:২২