সি ট্রাক ইগলে বসে বন্ধু, সহকমর্ী, আত্মীয়দের একের পর এক ফোন, কণ্ঠে উৎকণ্ঠা_ 'ভালো আছ তো তুমি? টিভিতে দেখছি তোমাদের এনটিভি, আরটিভি, আমার দেশ পুড়ে যাচ্ছে। হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার করা হচ্ছে ভবনে আটকে পড়া মানুষদের। 11 তলার ছাদের ওপর আটকে আছে অনেকে। তুমি কোথায়? বিল্ডিং থেকে বেরিয়েছ তো?'
এমন প্রশ্নের জবাবে একটা কথাই রোবটের মতো বলে গেছি বারবার_ আমি ভালো আছি। কিন্তু আমরা ভালো নেই!
..............................
অাঁচ করতে পারছিলাম সবকিছু। কয়েকজন সহকমর্ীর সঙ্গে কথা বলে যেটুকু বুঝেছি, তা হলো আবারো আমাদের শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। আমার দেশ-এর সব কিছুই শেষ। এসব ভাবতে ভাবতেই 26 ফেব্রুয়ারি দুপুরে আমরা পেঁৗছে গেলাম সেন্ট মার্টিনে, ভূ-স্বর্গে!
বাংলাদেশের একমাত্র ছোট এই প্রবাল দ্বীপে পা দিয়েই মনটা ভালো হয়ে গেল। আমার দেশ ভবনে আগুন লেগেছে_বিষয়টা ভুলে গেলাম ওই মুহূর্তে। চারদিকে সবুজ আর সমুদ্রের নীল জল। যে কারণে এই দ্বীপে আসা সেই শার্ক ক্রসিং বাংলা চ্যানেল এক্সপিডিশনের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি বেঞ্চ মার্কের মিডিয়া ম্যানেজার মোস্তফা কামাল অরু দেখালেন_ ওই যে মানুষগুলো দেখছেন, সবাই আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে দাঁড়িয়ে আছে। যারা উত্তাল বঙ্গোপসাগরের বুকে সাঁতরাবে সেই ঢাকা বেজ ক্যাম্পের উপদেষ্টা, প্রশিক হামিদুল হকের উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়ে আমরা রওনা দিলাম 'সীমানা পেরিয়ে'র দিকে। সমুদ্রের ঠিক তীরের এই রিসোর্টই নারকেল জিনজিরায় আমাদের ঠিকানা।
আশপাশ দেখবো কি, ঢাকা থেকে যাওয়া আমাদের মিডিয়া টিমের সবার চোখেই তখন রাজ্যের ঘুম। সি ফাইভের বড় রুমটিতে আমার সঙ্গী আমাদের দুই ফটো সাংবাদিক আলিম ও রেকু ভাই এবং প্রথম আলোর শামসুল হক টেংকু।
..............................
সমুদ্রের গর্জনে ঘুম ভাঙল বিকেলে। যুগান্তরের সাংবাদিক তিতাশ ভাই বললেন, সময়টা কাজে লাগানো উচিত। ইন্ডিপেন্ডেটের সবুজ ভাইয়ের প্রস্তাব_ চলো ছেড়াদ্বীপে ঘুরে আসি। সেন্ট মার্টিনে এসে ছেড়াদ্বীপে যাব না, তা কি হয়? সঙ্গে যোগ দিলেন সাপ্তাহিক 2000-এর কনক, নীলয় এবং বাংলাভিশনের প্রদীপ, জনকণ্ঠের সোহেল।
বেঞ্চ মার্কের অ্যাকাউন্টস অফিসার রাজীব সব কাজেই বেশ তৎপর। দ্রুত দরদাম চুকিয়ে ঠিক করে ফেললেন একটা ট্রলার। আমরা রওনা হলাম জনবসতিশূন্য দ্বীপে। পেঁৗছতে পেঁৗছতে 40 মিনিটের মতো লেগে গেল। সেখানে পেঁৗছে আমাদের সঙ্গে থাকা ফটো সাংবাদিক টেংকু ভাই, রেকু ভাই, আলিম ভাই আর মেহদি (ফোকাস বাংলা) মহা খুশি। সূর্যাস্তের এমন আবীর রাঙানো সূর্যকে ফ্রেমে বন্দি করার সুযোগ কমই মেলে। প্রবাল জমে ছেড়াদ্বীপও বড় হচ্ছে প্রতিদিন। কে জানে সেন্ট মার্টিনের মতো একসময় এখানেও হয়তো গড়ে উঠবে জনবসতি।
নিঝুম চুপচাপ দ্বীপটাকেই ভালো লাগল আমার। পড়ন্তবেলায় আমরা কয়েকজন ঘুরে বেড়ালাম। আর গোধূলিবেলায় ফিরলাম অন্যরকম এক ভালোলাগা নিয়ে।
ছেড়াদ্বীপে যাওয়া হয়নি বলে, আেেপর শেষ নেই রেডিও টুডের সাংবাদিক রোকসানা আমিনের। তার কারণে সমুদ্রপারের সুন্দর একটা বিকেল দেখা হয়নি যায়যায়দিনের সাংবাদিক হাসিবা আলী বর্নারও।
..............................
26 ফেব্রুয়ারি রাতের বেলা ঘুমুতে যাওয়ার আগেই অরু জানিয়ে গেলেন পরের দিনের ভ্রমণ সূচি_
ট্রেকিংয়ে এসে ঘুমিয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। ভোর 5টা 30 মিনিটেই উঠে গেলাম। স্কাউটদের মতো কোয়ার্টার মাইল হেঁটে সেন্ট মার্টিন বন্দরে পেঁৗছার পর জানলাম, এখন গন্তব্য শাহপুরী দ্বীপ। টেকনাফের কাছাকাছি এই দ্বীপ থেকেই শুরু হবে শার্ক ক্রসিং বাংলা চ্যানেল এক্সপিডিশন, সাগরের উত্তাল জলের বুকে সাঁতার! আয়োজকদের একজন যখন ট্রলার খুঁজতে ব্যস্ত, তখন আমাদের চোখ পুবাকাশে। কমলা রংয়ের আভা ছড়িয়ে সমুদ্র থেকে উঠে আসছে সূর্য। সেন্ট মার্টিনে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত সবকিছুই ঘটে যায় চোখের পলকে। এ কারনেই ওই দৃশ্য হয়তো এতোটা চোখ জুড়ানো!
ছোট ট্রলারটিতে উঠে বসার পরই সবার হাতে তুলে দেয়া হলো লাইফ জ্যাকেট। প্রথম আলোর সাংবাদিক পিয়াস যখন সেটা গায়ে দিতে যাবেন, মাঝি রমজান বলে উঠলেন_ 'এইসব গায়ে দিয়া লাভ নাই; সমুদ্র টাইনা নিলে কেউ ধরে রাখতে পারবে না। একটানে চইল্যা যাবেন পানির নিচে।'
অাঁতকে ওঠার মতোই কথা। কিন্তু ওই 10 সাঁতারু_ লিপটন, সিনা, সালমান, সামিউল, রশিদ, রুবেল, বিপু, সেলিম, হোসেইন আর নূর মোহাম্মদের কথা ভেবে স্বস্তি পেলাম। তাদের কাছে তো এই লাইফ জ্যাকেটও নেই। উত্তাল জলের বুকে সাঁতার কাটতে হবে তাদের। আমাদের পেঁৗছানোর আগেই সেখানে চলে গিয়েছিলেন সাঁতারুরা। সকাল 7টা থেকে শুরু হয় তাদের স্নোকার্ল সুইমিং। চোখেমুখে যাতে নোনাজল যেতে না পারে, সেজন্য ছিল বিশেষ মাস্ক। নিঃশ্বাস নিয়েছেন বিশেষ নল দিয়ে। এভাবেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভেসে থেকেছেন জলে। সুযোগ বুঝে এগিয়ে গেছেন সামনে। আমরা ট্রলারে বসে দেখছিলাম তাদের সাঁতার। বঙ্গোপসাগরের সেই উত্তাল সমুদ্রে ট্রলারে বসেও আমরা যখন প্রতি মুহূর্তে ডুবে যাওয়ার শঙ্কায়, তখনো নির্বিকার ভাবে সাঁতরে গেছেন তারা। এতদিন টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে সার্ফিং। আমাদের নিজেদের ট্রলারটিকেই মনে হচ্ছিল যেন, সার্ফিং বোট। দুলছিল ক্রমাগত! মনে হচ্ছিল এই বুঝি ডুবে যাচ্ছে!!!
পেশাগত দায়িত্ব বলে কথা_ ওই সাগর বুক থেকেই সরাসরি রিপোর্ট করলেন রেডিও টুডের সাংবাদিক রোকসানা আমিন। ঝুঁকি নিয়েই ভিডিওতে সাঁতারের দৃশ্যগুলো ধারণ করলেন চ্যানেল আই-এর নাঈম ভাই। আর এসব কিছু স্পিডবোট দিয়ে ঘুরে ঘুরে পর্যবেণ করেছেন ঢাকা বেইজ ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা এই অ্যাডভেঞ্চারের উদ্যোক্তা হামিদুল হক। সঙ্গে ছিল কামাল আনোয়ার বাবুদের সাপোর্টিং টিম।
রোদের উত্তাপ যত বাড়তে থাকল, ঢেউও উত্তাল হতে থাকলো আরো। কিন্তু হার মানলেন না সাঁতারুরা। জিংক ওয়াটারে গলা ভিজিয়ে সাঁতরে গেছেন, আর জীবন হাতের মুঠোয় রেখে আমরা সাী হয়েছি অন্যরকম অ্যাডভেঞ্চারের, যা শুধু এতদিন সিনেমার পর্দাতেই দেখতাম।
একসময় এমন হার মানলাম আমরাও। টেংকু ভাই বললেন, তীরে চলো, আর পারছি না!
..............................
উত্তাল বঙ্গোপসাগরের বুকে 14 কিলোমিটার সাঁতরে প্রথম তীরে উঠেন লিপটন সরকার। গতবারও সবাইকে টপকে গিয়েছিলেন তিনি। তীরে বেইজ ক্যাম্পের কমর্ীরা তাকে দিয়েছেন অন্যরকম এক সংবর্ধনা। অবশ্য এতটাই কান্ত ছিলেন যে, গা এলিয়ে দিলেন সি বিচের বালিতে।
এরপর একে একে বাংলা চ্যানেল অতিক্রম করে এসেছেন বাকি সাঁতারুরা। বাংলা চ্যানেল নামটা নতুন মনে হচ্ছে? হওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা, টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনের ওই সমুদ্র পথের নাম 'বাংলা চ্যানেল' দিয়েছেন হামিদুল হক। স্বপ্ন দেখছেন এই নাম একসময় ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে। এই স্নোকার্ল সুইমিংকে জনপ্রিয় করে তোলাই লক্ষ্য তার।
..............................
এতসব রোমাঞ্চ আর আনন্দ কিছুই যেন আমাদের কয়েকজনকে টানতে পারছে না। ঢাকা থেকে সাড়ে 500 কিলোমিটার দূরে থেকেও বুঝতে পারছিলাম, ঢাকায় হয়তো অপো করছে খারাপ কোনো খবর।
সমুদ্রের পাড়ে বন ফায়ার, অ্যালকোহল, সমুদ্রস্নান, চাঁদের আলোয় বেইজ ক্যাম্পের খসরু ভাইয়ের অসাধারণ সব গান কিছুতেই সান্ত্বনার অনুষঙ্গ পাচ্ছিলাম না আমি, রেকু ভাই, আলিম ভাই আর চয়ন।
যার যায়, কষ্টটা তো তাকেই ছোঁয়।
..............................
ঠিক করছিলাম 27 ফেব্রুয়ারি রাতেই ধরব ঢাকার পথ। কিন্তু শার্কের সেলস ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন জানিয়ে দিলেন কাল, মানে 28 ফেব্রুয়ারি তিনটার আগে কোনো লঞ্চ নেই। কী আর করা!
..............................
পর দিন সকালে লেখক হুমায়ূন আহমদের বাড়ি 'সমুদ্র বিলাস' দেখে রিসোর্টে ফিরেই দেখলাম দারুচিনি দ্বীপের নায়িকারা হাজির। তৌকীর আহমেদের পরিচালনায় হুমায়ূন আহমেদের লেখা দারুচিনি দ্বীপের শুটিং হবে সেন্ট মার্টিনে।
তৌকীর আর তার সঙ্গে আসা সুন্দরী মেয়েদের জন্য রুম ছেড়ে দিতে হলো। অবশ্য সময়ও হয়ে এসেছে লঞ্চের। তিন দিনেই কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে সবকিছুর ওপর। লঞ্চ কেয়ারি সিন্দবাদে উঠে মনটা হু হু করে উঠল আমার! সাগরের নোনা জল চোখে উঠে আসলো কেন?
কে জানে পুড়ে যাওয়া অফিস আর প্রিয় সহকমর্ীদের জন্যই হয়তো!
----********-----
কৃতজ্ঞতা অথবা যে কথা না বলেই নয়
আসলে এটা কাটপেস্ট। লেখাটি ছাপা হয়েছিল আমাদের পত্রিকায়। তাও মাসখানেক হয়ে গেছে! আগুনের ওই ধাক্কা আমরা প্রায় সামলে উঠেছি। লেখার আবেদন কেমন থাকলো কে জানে?
ধন্যবাদ আলীম আর টেংকু ভাইকে, ট্রেকিংয়ের এই ছবিগুলোর বেশিরভাগই তাদের দুজনের তোলা। বেঞ্চ মার্কের অরু ভাইকে এবং ঢাকা বেইজ ক্যাম্পের কর্তাদেরও ধন্যবাদ। এই টু্যরের আমন্ত্রণটা তো তাদেরই!
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০০৭ সকাল ৮:২৩