সাধারণত আমি হাসপাতালে যাওয়াটা এড়িয়ে চলি। হঠাৎ করে এতগুলো দুঃখী মানুষের সামনে যেতে ভাল লাগে না। পারতপক্ষে একেবারে না হলেই না, এমন অবস্থায় আমি যাই। ব্যাপারটা এমন না যে রোগীর প্রতি আমার টান নেই, কিন্তু হাসপাতালে গেলে সবসময়ই আমার আনইজি লাগে।
আমার এক নানুভাই অসুস্থ। আম্মুর মামা হন। উনাকে দেখতে গতকাল গেলাম। আমি মনে হয় বহুদিন পরে হাসপাতালে গেলাম। পুরুষদের ওয়ার্ডে নানু একটা বেডে শুয়ে আছেন। আশেপাশের সবার বেডের পাশে তাদের আত্মীয় স্বজন ভীড় করে আছেন। নানুকে দেখতে যাবার অভিজ্ঞতাটা একটু অন্যরকম। সত্যিকার অর্থে ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন যে উনি টিকবেনা। খুব বেশি বয়স হয়নি। ৫০ বছর। দুই সপ্তাহ টিকবে কী না সেটা নিয়ে তাদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ব্যাপারটা সবাই জানে। কেউ নিশ্চিত না পরে এসে তাকে দেখা যাবে কী না। পুরুষদের ওয়ার্ডে ঢুকেই শুনলাম একটা বাচ্চার প্রচণ্ড চিৎকার। আমি যেখানে বসে ছিলাম সেখান থেকে চিৎকার শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু বাচ্চাটাকে দেখা যাচ্ছিল না।
টানা চিৎকার হচ্ছে। “আম্মু আম্মু” ,“এগুলা কেন দেয়” – এসব বলে প্রচণ্ড চেঁচামেচি। ভাবতে খারাপ লাগে এই পিচ্চী মাকে এভাবে ডাকতেছে, ওর মা-ই ওকে জোর করে ধরে রেখেছেন যেন ডাক্তার অষুধ দিতে পারে। বাচ্চাটার কেমন যে লাগতেছে !! সে নিশ্চয়ই সবাইকে খুব নিষ্ঠুর ভাবতেছে। আমি ভাবি,এত চিৎকার করার শক্তি যার আছে, সে অসুস্থ কী হিসেবে !! এবার এগিয়ে যেয়ে দেখি ওকে স্যালাইন দিতেছে। একদম রুগ্ন একটা শরীর। এই শরীর থেকে এই চিৎকার বের হচ্ছে মানে সে যে কী কষ্ট পাচ্ছে তা পরিষ্কার। আর পরবর্তী সময়ে যতক্ষণ ছিলাম, ও চিৎকার করেই গেছে।
নানুর কথায় ফেরত আসি। বেডে শুয়ে আছেন। প্যারালাইসিস। নড়তে পারছেন না। পেটে আর মুখে নল দেয়া। স্যালাইন দেয়া। কিন্তু মনের জোর আছে সেটা বুঝা যায়, এখনও খাওয়ার রুচি আছে। উনি গত দুই বছর ধরে চিকিৎসা করছেন। ইন্ডিয়া গেছেন ২ বার। বাংলাদেশেও অনেক জায়গায় চিকিৎসা করা হল। সমস্যা সিম্পল। বেশ কোমড় ব্যাথা। ডাক্তাররা ব্যায়ামের নির্দেশ দেন, এটা সেটা ঔষধ দেন। সবই উনি করেন। সাইকেল চালানো, জগিং, সাঁতার কাটা – তাও ব্যাথা আর যায় না। আজ দুই বছর পরে ধরা পরল উনার শ্বসনতন্ত্রে একটা টিউমার আছে। সেটা ফেটে গেছে। আর সেখান থেকে ক্যান্সার। আর এসব রোগ সাধারণত একটা আসে না। পাশাপাশি কয়েকটা হয়ে ব্যাপারটা জটিল করে তোলে। এভাবেই অন্য আরেকটা রোগের সিম্পটম্প হল কোমড় ব্যাথা। শ্বসনতন্ত্রের কোন সমস্যা উনি টের পান নি। তবে মাঝে মাঝে হাঁপাতেন, বয়স হলে সবাই ত হাঁপায়। এখন নানুর কোমড় থেকে প্যারালাইসিস।
এত দেশের এত ডাক্তার কেউ কিছু ধরতে পারল না। উনি টাকা ঢালতেও কার্পণ্য করেন নি। আম্মুর মামারা ৪ ভাই। মোটামুটি সবার কাছাকাছি সমস্যা। শ্বসনতন্ত্রজনিত অন্যান্য। খুব হাঁপান। আগে ভাবতাম, মোটা বলে। কিন্তু ডাক্তাররা বলছেন ঘটনা অন্যরকম। মোটামুটি কেউ সুখে নেই। একেকজন একেক সমস্যায় ভুগছেন। বাপের বিশাল সম্পত্তি ছিল। সব বেঁচে খেয়ে শেষ। না, শুধু উড়িয়ে না, বরং চিকিৎসা করেই। একদিন এই ভাণ্ডার শেষ হবে না? এখনই ত টান পড়ছে। তখন টাকা কোত্থেকে আসবে? যাদের নাই, তারা কী করে? দুর্নীতি, ভিক্ষা, ধার ? রাস্তায় অসুস্থতার কথা বলে ভিক্ষা করলে কয়জন বিশ্বাস করে? আমি ত করি না।
এগুলা কেন হয়? জীবাণুর কাছে জীবন এতই অসহায়?
উনাকে কেমোথেরাপি দেয়া হবে। কিন্তু তার আগে ২ সপ্তাহ রেডিওথেরাপি দিতে হবে। ডাক্তাররা বেশ শঙ্কিত যে উনি এত দিন টিকবেন না। বাস্তবতা আরও কঠিন। চারপাশের সব আত্মীয়রা টাকা দিয়ে সাহায্য করছেন। গ্রামের আত্মীয়রা জমিও বন্ধক দিয়ে দিচ্ছেন। উনি সুস্থ হবেন। একসময় সবাইকে হয়ত টাকা দিয়েও দিবেন।
কিন্তু উনি যদি সুস্থ না হন? ২-৩ লাখ টাকা, মধ্যবিত্তদের সঞ্চিত টাকার একটা বড় ভাগ। প্রায় মৃতকে না দিয়ে সবাই চায় তাদের সন্তান বা নিজেদের বিপদের জন্য রেখে দিতে। অন্তত রোগী সুস্থ হবার বেশ সম্ভাবনা থাকলেও মানুষ সাহস পায়। কিন্তু এখন টাকা ঢালা মানে ত আসলেই ফেলে দেয়া।
কিন্তু লজিকে সব হয় না। নিজেদের আত্মীয়, রক্তের সম্পর্ক, বৃথা জেনেও সবাই চেষ্টা করছে।
আমি বুঝতেছি, বাস্তবতা বড় জটিল। নানুর যেহেতু প্যারালাইসিস কোমড়ের নিচ থেকে সুতরাং খাওয়া দাওয়া, বাথরুম করানো সব দায়িত্ব উনার স্ত্রীর উপরেই। উনার মেয়ে সম্ভবত বি এ পাশ করেছেন মাত্র। আচ্ছা, আল্লাহ না করুক নানুর সত্যিই কিছু হয়ে গেলে এই পরিবার দেখবে কে? এটা কী শুধু আমার প্রশ্ন? উনার পরিবারও কী সেটাই ভাবছে না? আমি জানি উনারা সব চেষ্টাই করবেন। কিন্তু এই প্রশ্নটা কী কারও মাথায় আসে নি যে যেই টাকা সবাই উনাকে দিচ্ছে উনার চিকিৎসার জন্য, সেই টাকাটা উনার পরিবার কিছুটা হলেও নিজেদের হাতে রাখার চেষ্টা করবে, যেন পরবর্তীতে অন্তত ২ মাস দাঁড়া থাকতে পারে।
হয়ত বলবেন যে আমি বেশি বলতেছি। বাস্তবে এমন হয় না। আমি জানি, এমন হবেও না। সবাই ঠিকই সব দিয়ে চেষ্টা করবে। কিন্তু আমার প্রশ্নটাও বাস্তবতার নিরিখেই। এই প্রশ্ন বিপদগ্রস্ত পরিবার এড়িয়ে যেতে পারে না।
কেউ বলেই নাই জীবনটা ফেয়ার। সারাজীবন পাপ করে শেষে মন্ত্রী হতেই পারেন। হয়ও ত। আর ভাল কাজ করে শেষে ট্রাক এক্সিডেন্টে মরতে পারেন। মরেও ত। দিনকে দিন বেঁচে থাকাটাই অনেক প্রশ্ন হয়ে যাচ্ছে। অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাহলে কেন আপনি ব্যাপারটাকে আরো জটিল করছেন?
কেন সিগারেট খাচ্ছেন? সিগারেটের সংজ্ঞা কী? একটা কাগজের রোল, তার একপাশে আগুন আরেক পাশে একটা বোকা লোক, যে আস্তে আস্তে আগুনের দিকে মুখ নিয়ে যাচ্ছে।
সিগারেট আপনার কী ক্ষতি করে এগুলা বহু শুনছেন। সবাই জানে। আমি আর বলব না। শুধু এ কারণে আপনার জীবনে কী মোড় আসতে পারে সেটাই ভাবুন।
ঠিক তাই। নানুর এই রোগের কারণ সিগারেট। তার ভাইদের সমস্যা, সেই কারণ সিগারেট। ভালভাবে খেয়াল করেন, বছর পাঁচেক আগেও মানুষ হাসপাতালে যেয়ে মারা গেছে মানেই স্ট্রোক, হাই প্রেশার। আর এখন তার জায়গা অনেকটুকুই দখল করে নিয়েছে ক্যান্সার। মানুষ ক্যান্সার নিয়ে অনেক সচেতন তাও এই অবস্থা। ২০০৯ এর ব্যাচে একটা ছেলে মারা গেল কয়েক দিন আগে। বিভিন্ন সোর্সে জানতে পারলাম, শ্বসনতত্রের সমস্যা। ধরা হচ্ছে টানা সিগারেটই এর কারণ।
আমার ৩ টা ডাক্তার বন্ধুর ৩টাই চেইন স্মোকার। একটা হৃদয় ঘটিত কারণে,আরেকটা সম্ভবত মোটা থেকে চিকন হবার ইচ্ছায়, যেটা প্রথম ৪ বছরেও হতে পারে নি। পরে, হলে থেকে না খেয়ে দৌড়াদৌড়ির কারণে এখন শুকাইছে, সিগারেটের জন্য না। আসলে জীবনের উপর মায়া উঠে গেছে এদের। আপনারও কী সেইম কেইস? জীবনের প্রতি মায়া নাই?
আমি জানি, এখন এমন পরিস্থিতি থাকতেও পারে যে জীবন নিয়ে আপনার তেমন টান নেই। কিন্তু সময় বদলাবে। আপনার বয়স একদিন ৫০ হবে (হয়ত)। তখন আপনার জীবন শুধু আপনার না, আপনার বয়স্ক বাবা মা, স্ত্রী, আপনার ছেলে মেয়ে সবার অংশ হয়ে যাবে, যারা উপার্জনে এখনও অক্ষম। তখন শুধু নিজেই আফসোস করবেন। আর শাস্তি ভোগ করবে আপনার পরিবার। আশেপাশের আত্মীয়রা বলবে, “ইসস কত নিষেধ করছি। শুনে নাই। খালি সিগারেট টানছে। এখন বুঝতাছে ঠেলা।”
চিত্রঃ একজন ধূমপায়ীর শরীরের ভিতরের অংশ এমনই। অন্য ধূমপায়ীদের জন্য আপনার শিশুও হতে পারে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আপনি কী আপনার শিশুর এমন ভয়াবহ ক্ষতি চান? তাহলে ধূমপান বন্ধে জোর গলায় আওয়াজ তুলুন।
আগে সিগারেট থেকে দূরে সরাতে মানুষ টাকার কথা শুনাতো। প্রতিদিন ১০০ টাকা বাঁচলে ১ মাসে ৩০০০ টাকা। ১ বছরে ৩৬৫০০ টাকা। ১০ বছরে ৩৬৫০০০ টাকা। এখন আর টাকার কথা শুনিয়ে লাভ নেই। মাসে ৩০০০ টাকা মানুষ এমনিই উড়াইতেছে, কই পায় কে জানে !! টাকা সেইভের কথা বললাম না তাই আর, শুধু বলি টাকা না নিজের ফুসফুসটাকেই বাঁচান।
ওহ, এখন নিশ্চয়ই ভাবতেছেন ওই যে ছেলেটা এত চিৎকার করছিল, ওই পিচ্চী ত সিগারেট খায় না। তাহলে? আরে, আমি নিজে দেখছি ওর বাবা (মনে হল হয়তো বাবা, আসলে অন্য কেউও হতে পারে) নিচে যেয়ে সিগারেট টানছিল। আপনার সিগারেটের ধোঁয়া হয়ত আপনার বাচ্চার কাছে পৌঁছে না, নিচে যেয়ে খাচ্ছেন – কিন্তু নিচে কী আরেকজনের বাচ্চা নেই? আরেকজনের বয়স্কা মা নেই?
“ওক্কে কাল থেকে খাবো না”, “এই টাই শেষ আর খাবো না” – এসব যত বলবেন তত ব্যর্থ হবেন। আমার বন্ধু মোটামুটি দিনে কয়েকবার সিগারেট ছাড়ে এসব ডায়লগ দিয়ে। হাতে যেটা আছে, সেটাই ফালান। এখনই, আধ খাওয়াটাও শেষ করা লাগবেনা (কিনার সময় করেন নাই এখন আর টাকার মায়া করা লাগবে না)। শক্ত করে মনটাকে ধরে রাখেন, আশেপাশের সবাইকে বলতে থাকেন, যে আর জীবনেও সিগারেট খাবেন না। যত বলবেন মানসিক শক্তি তত বাড়বে। যখনই খেতে ইচ্ছা করবে, তখনই পাশে কেউ না থাকলে বন্ধুদের কল দেন। ওদের সাথে প্যাঁচান যে সিগারেট খাওয়া কেন খারাপ। মানসিক শক্তি বাড়বে, লাভ আপনারই। আর আপনার পরিবারের। জানেন, বছর দুয়েক সিগারেট খাওয়ার পর আপনার ফুসফুসটাকে একটা চিপা দিলে এক কাপ আলকাতরা বের হবে? এখন বুঝেন বুকে কত আলকাতরা নিয়ে ঘুরছেন। অনেক ত হল। আর কত?
যখন সিগারেট খেতে মন চাবে, টাকাটা বের করে দোকানদারকে এমনিই দিয়ে দেন। কী? ভাবতে কষ্ট লাগে? এমনি এমনি আমরা কেউ টাকা দিতে চাই না, বাসের ভাড়া একটাকা বাড়ালে রাগে গা জ্বলে। আর সারাদিন যে এমনি এমনি টাকা পুড়াচ্ছি সিগারেট কিনে? এটা ত ক্ষতি করে, বরং এমনি এমনি টাকা বিলালে ক্ষতি হবে কী? আরে ভাই, সিগারেটের ৫ টাকা দিয়ে না হয় বন্ধুদেরই সিঙ্গারা খাওয়ান। সিগারেট খেয়ে ভাব নেয়ার চাইতে সারাদিন সিঙ্গারা খাওয়ালে মানুষ পাত্তা দিবে বেশি। দুই দিনেই আপনার ভুলে দোকানের সামনে যেয়ে টাকা বের করার অভ্যাস পালটে যাবে। আর, সিগারেটের জন্য টাকা বের করেই ফেললে বৃদ্ধ কোন ফকিরকে দিয়ে দেন। যেই টাকায় ধোঁয়া গিলতেন, সে টাকায় ক্ষুধার্ত অসহার কেউ ভাত গিলুক।
আর আপনার আশেপাশের কাজিন বন্ধু সবার মাঝে ছড়িয়ে দিন। আরেকটা জিনিস, ভাল কথা বললে মানুষ কথা শুনেনা। বোর ফিল করে। এই পেইজে লাইক দেন। ডেইলি সিগারেট নিয়ে কিছু জোক্স দেয়ার চেষ্টা করব।আশা করি জোক্সের মাধ্যমে সহজে টপিকটা তোলা যাবে।
Click This Link
(১৮+ নিয়ে যাদের অরুচি আছে, উনাদের জন্য নয়। এখানে আপত্তিকর জোক্স থাকতেই পারে।)
আরও একটা কথা। ইন্টারনেটে দেখলাম, গাঁজা একমাত্র ধোঁয়ার নেশা যা ফুসফুসের খুব কম ক্ষতি করে। সিগারেটের তুলনায় ত কমই। খুব একটা খুশি হয়ে না, একটা একমাত্র ধোঁয়ার নেশা যা পার্মানেন্টলি ব্রেইনের ক্ষতির কারণ।
পূর্বে আমার ব্যক্তিগত ব্লগে প্রকাশিত।
http://wings.rizvanhasan.com/archives/478
সবাইকে স্বাগতম।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১১ রাত ৯:১২