নয়তলা ফ্লাটের আটতলার বারান্দায় বসে এক কাপ কফির সাথে পড়ন্ত বিকাল উপভোগ করার মত সুন্দর মুহূর্ত জীবনে থাকেই বা কয়টা ! মনটা বিষন্ন হয়ে যায়। গোধূলীতে লাল রঙ ছাঁটা মেঘ। এই বিষন্ন পরিবেশটা আমার মনের বিষন্নতাটাকে আরও বোধ হয় বাড়িয়ে তুলছিল। আমি আসলে মানুষ চিনতে পারিনা কখনও। প্রতিদিন দেখেও চিনতে পারিনা।
বারান্দার দেয়ালের রঙটা ঘি এর মতন। এক্রোলিক পেইন্টিং। আলোর হালকা প্রতিফলন পড়ে। চকচক করে সারাক্ষণ। আমার কাছে বিরক্ত লাগত আগে। এখন আর লাগে না। তানি প্রথমবারের মতন যেদিন বাসায় এল, খুশিতে ওর চোখমুখ ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল, এই বারান্দায় রঙের খেলা দেখে। এরপর থেকে আমারও ভাল লাগে।
তানির কথা গুলোই ঘুরেফিরে মাথায় আসছে। মানুষ আসলে একা থাকতে পারে না। যখন একা থাকে, তখনও মনে মনে সে সবার সাথেই থাকে। অনেকের কথা ভাবে। যখন মানুষ কারও প্রেমে পড়ে, তখন একা থাকার সময় আর কনফিউশন থাকে না যে কার কথা ভাবব এখন। এমনিই তার কথা মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে। ছোট রাগটা বড়ো হয়ে যায়, ছোট খুশিগুলো আরও উজ্জ্বল লাগে। নিজে নিজেই সন্দেহ হয়, নিজে নিজেই তার পক্ষ থেকে অজুহাত গড়ে।
একটা ট্রাকের বিকট হর্ণে আবার ঘোর ভাঙল। কফির কাপটা প্রায় শেষ। কিছু যায় আসে না। উঠে ভরতে পারব না। সারাটা দুপুর পার করে, বিকাল শেষেও বুয়ার ঘুম ভাঙ্গেনি। এখন হয়ত ভাঙবে। তানি যেদিন আসবে, কত কষ্ট করেই না বুয়াকে বাইরে পাঠাতে হয়েছিল। “বুয়া এই ঔষধটা এনে রাখ, প্লিজ। দেখছই ত পা টা মচকে গেছে।”, এই সেই হাবিজাবি বলে বুয়াকে বাইরে পাঠানো। সেই ঔষধ পাওয়াটা সহজ না। বুয়াকে বলা আছে ড্রাইভারের সাথে যেতে। সুযোগ পেয়ে সেও যে একটু গাড়িতে ঘোরাঘুরি করবে সেটাই স্বাভাবিক। হাতে আনুমানিক দুটো ঘণ্টা। শুনলে মনে হয় কিছুই না। কিন্তু, পরীক্ষার মাঝে প্রথম ১০ মিনিট মুহূর্তে শেষ, পরের ১০ মিনিটে শত লাইন লিখে ফেলা। এটাও তেমন।
তানি এসেছিল। বারান্দা দেখে অবাক। আমি হেসে ফেলেছিলাম। আমার রুমটা ওর খুব একটা পছন্দ হয় নি। স্লিপনটের পোস্টার তার প্রধান কারণ। স্লিপনটের বিভৎস রকমের মুখোশের ছড়াছড়ি দেখে বেচারী তানি ভয়ে আর আমার রুমেই ঢোকেনি। বারান্দায় ছিলাম আমরা। তখন একবার মনে হল সময় আসলেই দ্রুত যায়।
এই মেয়েটাকে নিয়ে এখন আর ভাবতে ইচ্ছা করছে না। তবুও মাথায় কেন যেন ঘুরপাক খাচ্ছে ও। ওর যে জিনিসটা আমার সবচেয়ে ভাল লাগত, সেটা হল ওর স্বার্থহীনতা। আমাকে একবার একটা ছোট ভাই জিজ্ঞাসা করেছিল, “ ভাই, আপনারা ত হেব্বি মজায় আছেন, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরেন। আমরা শুধু নদীর পানি খাই। আর চাইয়া চাইয়া দেখি। এক্ষন একটা জোগাড় করে দেন। শালী নাই আপনার?” হেসে ফেলেছিলাম। “ নাহ, নেই। এটাই আফসোস। শালীর সাথে পরকীয়ার চরম ইচ্ছা ছিল। তাই শালী থাকলেও তোমাকে দিতাম না।” হাসতে হাসতেই সেদিন ওর সাথে অনেক কথা হল। একবার আমাকে ও প্রশ্ন করে, “ আচ্ছা বস, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে কি প্রতিদিন চাইনিজে বসেন? আমার সব বন্ধু দুই দিন পর পর চাইনিজে যেয়ে ফকির হয়ে যাচ্ছে। আপনার কী অবস্থা? ” তখন কেমন যেন একটু গর্ব হয়, “ নাহ, তানির সাথে ত তোমার কথা হইছে। তুমি ত জানই ও কেমন। আমার ওপর ও কোনদিনই প্রেশার পড়তে দিবে না। আমি চাইনিজে একবার নিতে চেয়েছিলাম। ঢুকতেই দেয় নি। বলেছে আমার পকেট কাঁটার জন্য ও আসে নি। তাছাড়া, আমি যদি ওকে পাড়ার ঢাবায় বসতে বলি, সেখানেই বসবে। আমার কথা ফেলার সাহস ওর নেই।” ছেলেটা হয়ত অবাক হয়েছিল। হয়ত তার সেই বন্ধুদেরও বলেছিল ব্যাপারটা। কী জানি ! ছেলেটাকে আরও কিছু বলতে পারতাম তানির আর আমার ব্যাপারে। বেশি পার্সোনাল হয়ে যাবে ভেবে বলিনি।
তানির সাথে কী পরে ওর কখনও কথা হয়েছিল ! এসব নিয়ে কী কিছু বলেছে আদৌ ! কী জানি ।
“এই কী হচ্ছে, এসব কী স্বভাব?”, লজ্জায় চোখমুখ লাল করে বলত তানি। “কেন কী হইছে? আমার বউয়ের গালে আমি চুমু খেতেই পারি।” আমি জোর দিয়ে বলতাম। “ আহা! কী ভাবখানা। বিয়ে আগে হোক ত।”, তানি হেসে ফেলত। “ওহ, খেয়ালই থাকেনা। আচ্ছা, বিয়ে হলে কী হবে আর এখন কী হবে?” আমি বলতাম। “এই সব যত স্বভাব আছে সেগুলা তখনকার জন্য রেখে দাও।” তানি আমার চুলে হাত দিয়ে বলত। “ তখন যা ইচ্ছা করতে পারব?”, হাসতে হাসতে ওকে ধরে বলতাম। “ এই মোটেও না। তখনও কিচ্ছু পারবে না।”, তানি আরও লজ্জায় লাল হয়ে যেত।
ছোট ছোট রাগ, খুনসুটি ত থাকতই। মাঝে মাঝে বড় ঝগড়াও হয়েছে। একদিন কথা বন্ধ। দুজনেরই অপেক্ষা। অপরজন কল দিবে কখন? শেষে কারও না কারও নতি স্বীকার। কল দিয়ে ভাব নেয়া, “ ভেব না তোমার রাগ কমাতে কল দিছি, দোষ ত তোমার। আমি কল দিছি অন্য কারণে। একটা খবর জানাতে, ওই যে আমার বান্ধবী ছিল না, ওই যে রিমি, ও করছে কি ………… । ” আবার সব ঠিক।
গত পরশুর দিকে কীভাবে যেন বড় মাপের একটা ঝগড়া বেঁধে যায়। কনফারেন্সে রাতে ছিলাম ৩ জন। এসাইনমেন্ট নিয়ে ক্যাচাল। টুকটাক নোট লিখে রাখা। আবার ক্যাচাল। এর মাঝে অন্য কাউকে দেয়ার মত সময়ও ছিল না। তানির কলটা ধরেই ওকে বললাম যে আমি ব্যস্ত। তাড়াহুড়ায় ছিলাম কী নিয়ে যেন। “ আজকে সারাটা দিন আমার সাথে কথা বলনি তুমি। এত ভাব নিচ্ছ কেন? আমাকে এভাবে ইগনোর করার মান কী? ”, অভিমানগুলো রাগ হয়ে বেড়িয়ে আসে ওর। এক কথায় দু কথায় ব্যাপারটা বড় হল কীভাবে বুঝলাম না। তবে রাগের বশে বলে ফেলেছি অনেক কিছু। কত কথাই ত থাকে, “ এইবার যে তোমাকে এত করে বললাম তখন ত গেলা না। আর এখন এত ভাব নাও কেন? ” “ তুমি এখনও এসব মনে রাখছ। বলেছি না কতবার, আমার কাজিন অসুস্থ ছিল। হাসপাতালে গিয়েছিলাম আরেক কাজিনকে নিয়ে। তোমরা ছেলেরা কী সবাই তাদের গার্লফ্রেন্ডের সাথে এমন কর?” আরও কত কথা।
দুদিন কথা হল না। রাতে কল আসল। লাফ দিয়ে ছুটে গিয়ে কল রিসিভ করেছি সেদিন।“ এই কী হইছে?এত ভাব নেয়ার কী আছে? কল দাও না কেন? যেই ইগনোর করা নিয়ে এত ঝগড়া করলাম, সেই ত আবার শুরু করলা।”, মোবাইলের ও পাশ থেকে কণ্ঠ ভেসে আসে।আমার পুরোনো রাগটা ফেরত আসে আবার। কথায় কথায় আরও কত কথা। “ কী হয়েছে তোমার? দেখা কর আমার সাথে। প্লিজ।”, মোবাইল সেটের ভেতর থেকে ভেসে আসে। “ পারব না। বিজি এদানীং। টাইম হলে পরে জানাবো। এখন রাখি।”, এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলি।
আরও একদিন কথা বন্ধ। আমার মন আসলে শক্ত বোধহয় খুব। তানির কথা মনে না করেই দিব্বি কাটিয়ে দিতে পারি দিন। শুধু মাইকেল লার্নসের গান গুলো শুনলে কেমন যেন লাগে। তানিকে মাথা থেকে বের করে দিয়েছি একদম। দরকার নেই কাউকে।
গতকালকে দুপুরে ওর কল এসেছিল। না আসলেই বোধহয় ভাল ছিল। ওর জন্য আমার শেষ টানটুকুও মুছে গেছে। ওরও একটা রূপ আছে। ভুল চিনেছি এতদিন। হয়ত আমার সামনেই ছিল সব। খেয়াল করিনি। অন্ধ ছিলাম। “শোনো, আমার একটু হেল্প লাগবে। আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে হবে। পারবা? হাজার তিনেক। লাগবেই। না বোল না।” মোবাইল সেটটা বোধ হয় আমার দিকে তাকিয়ে বলছিল যে আমি অতদিন চিনি নি কিছুই। এই সময়ে এই পয়েন্টে আমার গায়ে এসব লাগছিল না। টাকা পয়সা নিয়ে কারবার আমার পছন্দ না।লাগলে সে নিতে পারে। কিন্তু, এটা সময় না। এই সময়ে মানায় না।
সন্ধ্যার আলো দেখতে দেখতে ঠিক করে ফেলি, কারো কথায় আমার কিছুই যায় আসে না। কালকে বিকালে আমি যাচ্ছি না। সেট অফ করে বসে থাকব। কিছু যায় আসে না আর।
একটা রাত ঘুম দেই। নিশ্চিন্তে। কত স্বপ্ন ঘুরল চোখে। কনসার্টের। আড্ডার। একটা চেহারা আসতে চেয়েছে কয়েকবার, স্বপ্নেও ঠেকিয়ে রেখেছি ওকে।
ঘুম থেকে উঠেছি আজকে অনেক বেলা করে। মনটা তিতা। সামনের রাস্তায় যথারীতি কোলাহল। ভার্সিটি যাব না। ইংলিশ ক্লাস আজকে। করলাম না, কী হবে ! যদিও নিজেই জানি, ক্ষতি ত হবেই। তবুও, ব্যাপার না।
নিজেকে অনেকভাবে বুঝাই আমি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ি গুলা দেখি। মনটা দিন দিন শক্ত হচ্ছে।আসলে সব কিছুই সাময়িক। ব্যাপারনা এসব।
গ্রিলের উপর দুটো দোয়েল পাখি। এদের দেখি আর ভাবি। নাহ, টাকাটা দিয়ে আসি। শেষ। সমস্ত দাবী-দাওয়া। যেন কখনও কিছু বলতে না পারে। কখনও কোন কথা না থাকে। আগডুম বাগডুন কোন কথা না। যাব, দিয়ে বলব, “ এটা ফেরত দেবার দরকার নেই। তোমার থেকে আমি কোন কিছু পাওয়ার মেন্টালিটি নিয়ে ঘুরি না। ”
অসহ্য দুপুরটা এত আস্তে কাঁটে। বিকালটার জন্য অপেক্ষা। সেই সকাল থেকে।
অবশেষে মুখোমুখি। একটা বুটিকের পাশে একহারা লম্বা একটা ছিমছাম রেস্টুরেন্ট। বুটিকেরই। দুটা কলামের মতন একটার পিছে আরেকটা, এভাবে টেবিল আর সাথে তিনটা করে চেয়ার। আমরা আসি এখানে। অনেকেই আসে। কিন্তু, সবাই চেনে না। একদম কোনার টেবিলা তানি বসে ছিল। হালকা নীলের ভেতর হালকা বেগুনী একটা ড্রেস। ভালভাবে খেয়াল করার মানসিকতা ছিল না।
“ বাহ, আজকে দেখি আমার আগেই এসে পড়েছ। অবশ্য এখন ত আসবেই। প্রয়োজন বলে কথা। ”, মেজাজটা তিতা করে বললাম। “ তানি অবাক চোখে আমার দিক তাকাল। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল। খুব আস্তে করে বলতে থাকে, “ আমার কিছু লাগবে, সেটা তোমাকে জানালে তুমি আসবেই। আমি জানতাম। এমনি ডাকলে তুমি আসতে না।তাই এসব বলে ডাকতে হল। আজকে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। তোমার থেকে কিছু পাওয়ার মেন্টালিটি নিয়ে আমি ঘুরি না।”
আমি ফেরত আসি।
বিষন্ন একটা সন্ধ্যায় এসে বারান্দায় বসি।প্যাকেটটায় একটা স্কেচবুক ছিল। সাথে স্কেচের সব কিছু। বাসায় এসে আমার আঁকা কিছু ছবি দেখেছিল ও। ভোলে নি। অভ্যাসটা আবার নতুন করে শুরু করার জন্য। সাথে একটা ডায়েরীও।
সন্ধ্যার মিলিয়ে যাওয়া আলোয় মেঘটা দেখছি। ডায়েরীটায় কিছু লিখতে হবে। লিখে ভরে ফেলব। তানিকে আবার কল দিতে হবে। সন্ধ্যার বিষন্নতায় আমি কথা পাচ্ছি না। আমি আসলে মানুষ চিনতে পারিনা কখনও। প্রতিদিন দেখেও চিনতে পারিনা।
কফির কাপটা প্রায় শেষ। কিছু যায় আসে না।
আমার আচরণে একটা মেয়ে বালিশে মুখ গুজে কাঁদছে সেটার শব্দই শুনছি খালি। সেই বালিশে হয়ত সবুজ রঙের মেঘের ছবি আঁকা।
© আকাশ_পাগলা
[email protected]
ফেইসবুক আইডিঃ Aakash Paglaa
[এই গল্পটা ফেইসবুকের গ্রুপে পাঠাবো বলে ঠিক করেছি। তাই ইমেইল আইডি আর ফেইসবুক আইডি সংযুক্ত করে দিলাম। ]