খালেদ মোশাররফ ১লা নভেম্বর তারিখে শাফায়াত জামিলকে ডেকে বললেন, তুমি কি এখনও 'চেইন অব কমান্ড' পুণঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য আগ্রহী? জামিল সম্মতি জানালে খালেদ তাঁকে বললেন, পরিস্থিতি সীমার বাইরে চলে গেছে। আমাদের এখনই পাল্টা আঘাত করা উচিত। সেদিনই বিকেলে ঢাকা স্টেডিয়ামের কাছে একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁয় গোপন বৈঠকের আয়োজন করা হয়। খালেদ ও জামিলের সঙ্গে আরও দুজন বিশ্বাসভাজন জুনিয়র অফিসারও উপস্থিত ছিলেন এই বৈঠকে। সেই বৈঠকে পাল্টা অভ্যূত্থানের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। জুনিয়র অফিসাররা জেনারেল জিয়াকে হত্যা করার কথা বললে, খালেদ অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে, পরদিন বঙ্গভবন আক্রমন করে বিদ্রোহী মেজরদের এবং তাদের ট্যাংক বহরকে বের করে এনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে হবে। জেনারেল জিয়াকে গ্রেফতার করে পরবর্তীকালে অবসর প্রদান করা হবে।
পরিকল্পনা মোতাবেক ২রা নভেম্বর বিকেলে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানী কমান্ডার মেজর ইকবালকে তার সৈন্যসহ বঙ্গভবন থেকে সেনানিবাসে ফিরে আসতে নির্দেশ দেয়া হয়। মেজর ইকবাল মধ্যরাতে তার অধীনস্থ প্রায় ৩০০ সৈন্যসহ ঢাকা সেনানিবাসে চলে আসেন। প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাহকে অর্ডার দেয়া হল, জেনারেল জিয়ার বাসভবনে যেতে। হাফিজউল্লাহ ক্ষিপ্র গতিতে সৈন্যদের নিয়ে জিয়ার বাসভবনে ঢুকে পড়েন। এর আগে রশিদের টেলিফোন পেয়ে জিয়া জেগেই ছিলেন। ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কি হচ্ছে? ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাহ জিয়ার বুক বরাবর বন্দুক তাক করে বললেন, স্যার আপনি বন্দী। হাফিজউল্লাহ জিয়াকে গৃহবন্দী করে রাখলেন।
১৯৭৫ সালের ২রা নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের শাসন ক্ষমতা বেশ কিছু ওলট পালট হয়ে গেল। সেই সঙ্গে বেশ কিছু রোমাঞ্চকর নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেল বঙ্গভবনে। মরহুম জেনারেল ওসমানী অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য সংঘর্ষ এড়াতে তিনি মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকাও পালন করেন। উল্লিখিত কয়েকদিনের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেল। জেনারেল ওসমানী ১৯৮১ সালে সেই কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা বর্ণনা করেন দু'জন সাংবাদিকের কাছে। ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন উপলক্ষ্যে প্রকাশিত 'সর্বাধিনায়ক ওসমানী' গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, ২রা ও ৩রা নভেম্বর '৭৫ -এর মধ্যবর্তী রাতে মোশতাক আহমদ কয়েকজনকে নিয়ে সংবিধান পরিবর্তন করে সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ বের করার জন্য আলোচনায় বসেন। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন মনোরঞ্জন ধর, মালেক উকিল, ইউসুফ আলী, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী প্রমুখ। আলোচনার এক পর্যায়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন; যে সংসদ বাকশাল কায়েম করেছিল, সেই সংসদই গণতন্ত্র কায়েম করবে। ওসমানী এতে সন্দেহ পোষণ করলে, তাঁকে বলা হয়, সংসদের মাধ্যমে এটা করা সহজ এবং সামরিক আইনের মাধ্যমে এটা করা উচিত হবে না। আলোচনার শেষে ওসমানী তাঁর বাসভবনে চলে যান। গাড়ির ড্রাইভার তাঁকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যেয়েই টেলিফোনে জানায়, বঙ্গভবন থেকে সেনাবাহিনীর প্রহরা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে জিয়াউর রহমানকে টেলিফোন করেন। জিয়া তাঁকে জানান, তিনিও খোঁজ নিচ্ছেন কি হলো? এরপর ওসমানী জেনারেল খলিলুর রহমানকে ঘটনা জানান এবং নির্দেশ দেন প্রয়োজন বোধে বিডিআর দিয়ে প্রহরার ব্যবস্থা করার জন্য। পরে আবার টেলিফোন করেন জিয়াকে। বেগম খালেদা জিয়া টেলিফোন ধরলে তিনি জিয়াকে চান। বেগম জিয়া আমতা আমতা করলেন। টেলিফোন ছেড়ে দেন ওসমানী। পরে তিনি টেলিফোন করলেন খালেদ মোশাররফকে। উত্তর নেই। তার পর টেলিফোন করলেন কর্ণেল শাফায়াত জামিল ও আমিনুল হককে। উত্তর নেই। আবার জিয়াকে টেলিফোন করলেন। বেগম জিয়া ধরলেন- তাকে তেমন উদ্বিগ্ন মনে হল না। কিন্তু ফোনে জিয়াকে পাওয়া গেল না। আবার চীফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফ এবং আমিনুল হককে টেলিফোন করলেন। খালেদ মোশাররফ বললেন, তিনি কিছুই জানেন না। ইতিমধ্যে ওসমানী টেলিফোন পেলেন বিমান বন্দর, টেলিফোন কেন্দ্র, বেতার কেন্দ্র দখল করা হয়েছে।
আবার টেলিফোন করলেন খালেদ মোশাররফকে। জিজ্ঞেজ করলেন কি হচ্ছে? খালেদ মোশাররফ আশঙ্কা করে বললেন যে, ট্যাংক বাহিনী সম্ভবতঃ আক্রমণ করতে পারে। জবাবে ওসমানী বললেন, ট্যাংক বাহিনী আক্রমণ করে কিছুই করতে পারবে না। খালেদ মোশাররফ জানালেন, তিনি দেখছেন কি করা যায়। কিছুক্ষণ পর খবর পাওয়া গেল জঙ্গী বিমান টেক অফের। এরপর গ্রুপ ক্যাপ্টেন হকের সঙ্গে তাঁর গাড়িতে চড়ে ওসমানী বের হয়ে এলেন। তার আগে ডিজিএফআই এয়ার কমোডর আমিনুল ইসলামকে ফোন করে বললেন, এটা খুব খারাপ হচ্ছে। এভাবে জাতি ধ্বংসের পথে চলে যাবে। গৃহযুদ্ধও শুরু হয়ে যেতে পারে। এয়ার কমোডর বললেন যে, তিনি বা তাঁর লোকজন ঢুকতে পারছেন না। ওসমানী বের হয়ে এসে তেজগাঁ বিমান বন্দরের সামনে এয়ার ফোর্সের কে. এম সালামের বাংলোতে ঢুকে পড়লেন। ঢুকে দেখলেন, সেখানে আর এক ব্যক্তি বসা। সেই ব্যক্তি তাঁকে অনুরোধ করলেন, তিনি যে ওখানে গিয়েছেন তা যেন কেউ না জানে। ওসমানী যখন বের হয়ে আসছেন তখন আর একজন ভিআইপি কে দেখলেন। সেখান থেকে ওসমানী এলেন বঙ্গভবনে। খোন্দকার মোশতাক তখন শুয়ে এক সোফায়। রেসকোর্সের ট্যাংক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে টেলিফোন এল জেট বিমানটি গুলি করে নামানোর অনুমতি চেয়ে। এসমানী সে অনুমতি দেননি। টেলিফোন করে খালেদ মোশাররফকে বললেন বিমানটি নামিয়ে নিতে। খালেদ মোশাররফ এর জবাব, তিনি চেষ্টা করছেন।
(আমিই খালেদ মোশাররফ- এম. আর. আখতার মুকুল গ্রন্থ হতে উদ্ধৃত)