অফিসের গাড়ী (ধারাবাহিক) -দশ
তখন ?
জোহরা উম্মে হাসান
মিস বেগমকে নিয়ে অফিসে ভালোমন্দ –এ দু ‘ ধরণের কথাই প্রচলিত আছে । কথা মানে তাঁর সামনে বা পেছনে তাঁকে নিয়ে যেসব কথা হয় সেসব আর কি ! সে সব কথার মূল কথা হোল , তিনি আজও কেন অবিবাহিতা , কেন একা থাকেন আর তার কারণটাই বা কি ? মিস বেগম এসব সব জানেন । শুনেন , বোঝেন ! কিন্তু যে যাই বলুক , এমন একটা ভাব নিয়ে এসব কথার প্রতি উত্তরে তিনি কোন উচ্চবাচ্য বা মাতামাতি করেন না !
মিস বেগমকে মেয়েরা একটু এড়িয়েই চলে । হাসি খুশী একটু সাজু গুজু করা মেয়েদের তিনি সাধারণত একটু অপচ্ছন্দই করেন। কিন্তু যেসব মেয়েরা তাঁর মতই রাতদিন গাধার মতো ঘর সংসার প্রায় বাদছাদ দিয়ে অফিস অফিস কোরে মাথা ঘামিয়ে মরে তিনি তাদেরকে নিয়ে খুব তারিফ করেন । তাঁরা যাতে বিভিন্ন ট্রেনিং , সেমিনার বা ওয়ার্ক শপে যোগ দিতে পারে , তার জন্য জোর সুপারিশ করেন বসের কাছে । অবশ্য সত্যি কোরে বলতে গেলে এই ট্রেনিং উইং এ তাঁর উপরে কেউ নাই । তিনিই সর্বেসর্বা । তার উপরে পরিচালকের যে পদ সে পদের বিপরীতেই তিনি কাজ করেন অনেকদিন ধরেই । যদিও তাঁর নিজের পদবীটা এর একটু নীচে ।
অফিসের সব পুরুষ সহকর্মীরা মিস বেগমকে একটু সমঝে চলেন । না চললে বিপদ । মিস বেগমের কলমের এক খোঁচায় তাদের ভাগ্যের সিকা নড়বড় হয়ে যাবে । মিস বেগম এর সবটাই বুঝতে পারেন আর মনে মনে হাসেন । পুরুষদেরকে একটু কাবু রাখতে পারাটায় তাঁর যেন বেজায় সুখ । এসব দেখেশুনে আড়ালে আবডালে কেউ তাঁকে বলে নারী বিদ্ধেসী কেউবা পুরুষ এসব কথা বলে বটে কিন্তু এ ধরনের আলতু ফালতু কথায় মিস বেগমের কিছু যায় আসে না ।
মিস বেগমের আসল নাম আতিকা বেগম পারুল । কিন্তু কবে কখন কোথা থেকে যে তিনি তাঁর পিতা প্রদত্ত নামটা একেবারে খুইয়ে জন্মের মতো মিস বেগম হয়ে গেলেন – তা তিনি নিজেও জানেন না । একজন মেয়ে কিংবা পুরুষ মানুষ আজীবন বিয়ে না কোরে কাটিয়ে দিতে পারেই । এসব তাঁর ব্যক্তিগত অধিকার বা ইচ্ছের মধ্যেই পড়ে , কিন্তু তাই বলে আসল নামটাম সব বাদছাদ দিয়ে একেবারেই মিস বেগম ! এই নামে ডাকা মানে আর দশজনকে জানিয়ে দেয়া –তোমরা দেখ , এই মহিলার বিয়ের বয়স হয়ে গ্যাছে কিনবা পেরিয়ে গ্যাছে অথচ আজও তিনি মিস ।
এটা যদি য়ুয়োরোপ বা আমেরিকা হোত , তাহলে কোন কথা ছিল না । সেসব দেশের বিবাহিতা , কিংবা ডিভোর্সি অথবা সিঙ্গল বা কুমারী রমণীরা মিসেস এর ধার ধারে না । মিস বলাতেই তাঁরা বেশী শ্বাচ্ছন্দ ফিল করে । কিন্তু বাবা , আমাদের এই ভারতবর্ষে একজন নারী আজীবন মিস থাকলো মানেই তাঁকে নিয়ে এটা ওটা যাবর কাটা । ফেনা তোলা !
মিস বেগম –তাঁর এই মিস টাইটেলটা খুব একটা পছন্দ করেন না বটে কিন্তু এই ডাকাডাকির বিষয়টা খুব একটা তোয়াক্কাও করেন না । এমন ভাব করেন -হয়েছে তাতে কি ? মিসকে মিস বলা । কিন্তু মনে মনে ভীষণ রাগ হয় তাঁর তখুনি , যখন অবিবাহিত পুরুষগুলোর নামের ডগায় কেউ ‘কুমার’ শব্দটা ব্যবহার করেন না !
জত্ত সব অনাচার , এটা মিস বেগমের মুখ নিঃসৃত কমন বাক্য । কিছুতে উস্মা প্রকাশ করলে তিনি এ ধরণের বাক্য ব্যবহার করতে ভালবাসেন ! অনাচার শব্দটা বলতে গিয়ে তার সাদা ফরসা মুখটা বেশ একটু লালচে হয় , তাতে তাকে আর একটু ভালই দেয়া যায় । আর একটু জেল্লাময়ী । এটা অবশ্য ছ ‘ তলার তানজিলার ভাষ্য ।
তানজিলাকে মিস বেগমের তেমন পচ্ছন্দের নয় । অথচ তার সঠিক কারণটা কি তা আজতক জানতে পারলো না সে । আসলে খুব হাসিখুশী মিশুকে মেয়েদের মিস বেগমের সব সময় ভারী অপছন্দ । আর এই তালিকা দিন দিন বাড়ছেই । এই যেমন তিন তলার রেহানা । সে খুব সুন্দরী বলে এ অফিসে তাঁকে নিয়ে যেসব প্রশংসা বানী চাউর আছে , তাই বোধহয় তাঁকে মিস বেগমের অপচ্ছন্দের মুল কারণ । এরপর আছে নীলা । সে অবশ্য মাঝারী তালিকায় , মানে কখনও পচ্ছন্দ আবার কখনবা অপচ্ছন্দের ।
কেবল আফরিনকেই ভয়ানক পচ্ছন্দ মিস বেগমের । আর সেই পচ্ছন্দের পারদ আরও উপরে ঊঠছে সম্প্রতি আফরিনের জীবনে্র সেই ঝড়টা বয়ে যাবার পর ।
অনেকদিন বাদে আফরিন আজ কয়েকদিন হয় রেগুলার অফিশ করছে । সেই কোথায় সেই আগেকার আফরিন ? এ ফ্লোর ও ফ্লোর ঘুরে ঘুরে বেড়ানো নেই । নেই কানকথা শোনার সেই প্রবল আগ্রহ । এমন আফরিনকে এ অফিসের কেউ জানে না , চেনে না , মিস বেগম তো নয়ই !
মাঝে মাঝে ইন্টার কমে আফরিনকে ডেকে পাঠান মিস বেগম কথা বলার জন্য । কিন্তু আলাপ জমে না । এই আফরিন তো আগেকার সে আফরিন নয় । তাই মিস বেগম অল্পক্ষণ পরেই আফরিনকে তার নিজের রুমে পাঠিয়ে দেন । ভারী গলায় বলেন , নাহ তোমাকে তো এমন হাল্কাপল্কা ভাবিনি কোনদিন আফরিন । যে লোকটা চলে গ্যাছে , সেতো অনেকদিন হয় তোমাকে ছেড়ে চলে গ্যাছে । তারজন্য এত কান্নাকাটি বা মন খারাপ করার মানে হয় নাকি ? আমাকে দেখ । আমাকে দেখে শেখ ! বলিনা তাই , এই আমার নিজের উপর দিয়েও কি কম ঝড় ঝাপ্টা গেছে । বলিনা তোমাদের কাউকে কিছু । হাসি হাসি মুখে থাকি একটা কাজের লেবাস পড়ে তাই -তাইই । ভেতরটা আমার যদি দেখতে---------!
এসব বলে কিনবা বলতে যেয়ে মিস বেগম বেশ একটু খাবি খান । বেশী বেশী বলে ফেললাম নাকি ? মনে মনে ভাবেন । আফরিন যদি এসব সবাইকে বলে দেয় । নাহ , বলবে না সে । তাঁর এখন যে রকম মনের অবস্থা তাতে তাকে এটুকু রিলাই করাই চলে !
আফরিন তার রুমে চলে গেলে , মিস বেগম একটু নিজেকে নিয়ে ভাবেন । আফরিন নামের এই মেয়েটিকে দেখেই বোধকরি তাঁর নিজের সেইসব পুরানো দিনের কথা উপছে ঊঠলো ।
কি ছিল না তাঁর ? রুপ লাবন্য , লেখাপড়া , বাবামার আথিক সংগতি । কিন্তু এত কিছু থাকার পর তাঁর আর কৃষ্ণেন্দুর বিয়েটা হোল না মূলতঃ ধর্মের কারণেই । দু জনার দুই ধর্ম । কেউ যার যার নিজের ধর্ম বদলাবে না। তাই বিয়েটা ভার্সিটিতে এতো বছর চুটিয়ে প্রেম করার পরও ভেঙ্গে গেল ।
এরপর নিজেকে কুমারী রাখাটাই ভালো বলে মনে করছে আতিকা । আর কৃষ্ণেন্দু সেও নাকি আজতক বিয়ে করেনি । এসব অবশ্য শোনা কথা । অনেকদিন হয় তাঁর খোঁজ খবর জানে না বটে মিস বেগম ওরফে আতিকা ! তবে সত্যি কোরে বলতে কি আতিকার মনে সবসময় একটা ক্ষীণ আশা , একদিন কৃষ্ণেন্দু সমাজ সংস্কার ধর্ম – এসব সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াবে । কিন্তু তা আর হোল কই ? এতকাল পরে কৃষ্ণেন্দু হয়তো ভুলেই গ্যাছে আতিকাকে মানে তাঁর পারুলকে আর আতিকা কৃষ্ণেন্দুকে । যাগকে সেসব অনেক আগেকার কথা । কাকেই বা দোষ দিতে পারে সে শুধুমাত্র নিজের ভাগ্যকে ছাড়া !
সেই কৃষ্ণেন্দু যখন হঠাৎ কোরেই একদিন সরাসরি আতিকার বস হয়ে গেল , তখন নিজের কান আর দুচোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না আতিকা !
কৃষ্ণেন্দু চটোপ্যাধায় পরিচালক প্রশিক্ষণ । আর একেবারে সরাসরি বস ? কি বলে কি লোকে । এটা কি একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা হোল ! আজগুবি যত কথা ! কিন্তু তার সবটাই সত্যি ! ইচ্ছে কোরে কি তাঁকে দেখতে এসেছে নাকি এদ্দিনবাদে কৃষ্ণেন্দু ? কিন্তু সে এখানে আছে তা তাঁকে জানালোই বা কে ?
মে আই কাম্নিং স্যার বলে –আর দশজনের মতো আতিকাকে ডুকতে হল বসের রুমে । তেমন খুব একটা পরিবর্তন হয়নি কৃষ্ণেন্দুর চোখে মুখে বা কথাবার্তায় বা চেহারায় । যেমন সবাই বলে , আতিকা এখনও আগের মতই আছে । পঞ্চাস কাছাকাছি বয়সে যেটুকু পরিবর্তন হয় আভাসে ইঙ্গিতে ঠিক তেমনিই !
আতিকার মনটা কেমন যেন একটা অজানা আনন্দ পুলকে ধুকপুক করছিলো এদ্দিনবাদে কৃষ্ণেন্দুকে নিজের এত কাছ থেকে দেখতে পেয়ে! সে আড়চোখে দেখতে চাইলো , কৃষ্ণেন্দুর মুখটা । সেখানে পড়ন্ত বিকেলের কোন রোদ ঝিক মিক করছে কি না ? নাহ , নাতো । বড়ই নির্বিকার প্রশয়হীন আর নিরাশক্ত সে মুখভঙ্গি । আতিকার অনেকদিন আগে দেখা কৃষ্ণেন্দু যেন নয় এ মুখের মানুষটা ।
সবাই যে যার মতো চলে গেলে , এক্ষণে আতিকা একা । তাঁর বস কৃষ্ণেন্দু চটোপ্যাধায় এর সামনে বসে । যে মানুষটার জন্য আজতক একা একাকী আতিকা । মিস বেগম ।
নাহ , যা ভেবেছিল আতিকা তা নয় । কৃষ্ণেন্দু চটোপ্যাধায় অনেক কাল আগে বিয়ে থা করে সুখী সংসারী মানুষ একজন । আর আতিকা একা , ভয়ানক একা !
একা থাকো কি করে পারুল ? কৃষ্ণেন্দু চটোপ্যাধায় আতিকার কাছে জানতে চায় ।
সবাই যেভাবে থাকে সেভাবেই !
ওহ , ভেরি স্যাড । জানতো, ইউরোপের মহিলারা একাকীত্ব কাটানোর জন্য কুকুর পোষে !
এহেন কথাটা শুনেই প্রচণ্ড রাগে উত্তেজনায় মাথাটা ঝন ঝন কোরে উঠে আতিকার । এক লহমায় উঠে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণেন্দুর চোখে চোখ রেখে অগ্নি মূর্তি মেয়েটি বলে উঠে -হা , পোষে , এ্যাজ বিকজ আ ডগ ইজ মোর লয়াল দেন এ ম্যান , বিশেষত এই তোমাদের মতো বিশ্বাসঘাতক হতচ্ছাড়া পুরুষ মানুষগুলোর চেয়ে ! বলেই সেই রক্তলাল মুখ নিয়েই হন হন করে চেম্বার ছাড়ে ।
উহ , আজোও তাহলে পারুল ঠিক তেমনিই আছে । হয়তো সেও তেমনি করেই তার কথাই ভাবে ! তেমনি রাগ , উস্মা , অভিমান – সব সব তেমনি !
কিন্তু এইসব মিছেমিছি কথা বলা আর কতদিন ? একদিন তো তার কাছে সব সত্য খুলে বেলার সময় আসবেই আসবে ! তখন ?
**সব চরিত্রই কাল্পনিক
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৫০