পার্বত্য অঞ্চলগুলো তো বাংলাদেশেরই, তাই না?
কিন্তু আপনি কি জানেন, খাগড়াছড়িতে গাড়ি ঢুকতে হলে চাঁদা দিয়ে টোকেন নেওয়া লাগে? কারা নেয় চাঁদা বা এই আনঅফিসিয়াল শুল্ক, জানেন? জ্বি, শান্তির বাবা নেন। অথচ পাহাড় তো বাংলাদেশেরই, না?
রাঙামাটিতে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানকে চাঁদা দিতে হয়, জানেন? উচ্চপর্যায়ের যত চাকুরিজীবী আছে ওখানে, কার বেতন কত, তার হিসাব আছে তেনাদের কাছে, একটা পার্সেন্টেজ সেখান থেকে বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হয়, শুনেছেন এমনটা? আমার চাকরির সুবাদে এই চাঁদা সময়ে সময়ে এ্যাপ্রুভ করতে হয়েছে শোরুম অপারেশন চালাতে গিয়ে, ডিলারকে বাড়তি কমিশন দিতে হয়েছে টোকেন ইস্যু সলভ করে প্রোডাক্ট পাঠানোর জন্য। সম্প্রীতি নষ্ট হয়, তাই এসব কখনও বলি না। আমরা নৃগোষ্ঠী কোটা দেই, বুক দেই কাঁধ দেই, কখনও মুখে আনতেই চাই না ভেতরে কোথাও তেল আর জলের একটা হিসাব যে আছে!
এটুকু পড়ে আপনার আমাকে পাহাড় বিদ্বেষী মনে হতে পারে। তাহলে আরেকটু পড়ুন, আমি একচোখা কথা বলি না। পাহাড় আসলে কাদের? পাহাড় উপজাতিদের, বা আদিবাসীই বললাম নাহয়, তাদের। তাদের কালচার স্বতন্ত্র, সেখানে আর কেউ অনুপ্রবেশ করলে সেটা আসলেই পীড়াদায়ক ঠেকবে আদিবাসীদের কাছে। যারা পাহাড়ে জীবিকার সন্ধানে গিয়ে বাস করতে শুরু করল, তাদের সঙ্গে এই কালচারের কনফ্লিক্ট শুরু হল। বহিরাগতদের কেউই আপন করতে চায় না, তাদের শস্যে বহিরাগতরা এসে ভাগ বসাচ্ছে এটা তারা মানতে চায়নি। এরপর ওই যে কালচারের তফাত, অনেক উপজাতির নারীরাই ছড়ায় প্রকাশ্যে গোসল করেন, তাদের কাছে একজন মা, স্ত্রী, বোন, কন্যার প্রকাশ্যে গোসল করাটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়, কিন্তু সেখান দিয়ে একজন বহিরাগত হেঁটে যাবার সময় স্বভাবগতভাবেই কৌতূহল নিয়ে তাকাবে, এতে যে মা বোনের আব্রুর অবমাননা হয় এই বিষয়টা তো হজম করার নয়। এমন ইস্যুতে শুকর জবাই করা চাপাতি দিয়ে কল্লা ফেলে দেবার নিমিত্তে সেটেলারকে তাড়া করার ঘটনাও ঘটেছে বান্দরবানে! আব্রু নিয়ে কটাক্ষ হবার অস্বস্তির ফলে সেটলারদের কারণে উপজাতিদের আরো গহীনে যেতে হল, আরো দুর্গমতা, আরো পরিশ্রম! যদিও আমি যে প্রেক্ষাপট বললাম, তা শুরুর দিকের, এখন এই প্রেক্ষাপট অনেক পাল্টেছে।
আমরা পাহাড়কে আমাদের অংশ মনে করি, উপজাতিদের আদীবাসীদের আমাদের অংশ মনে করি, কিন্তু তারা আমাদের অনুপ্রবেশ কোনকালেই মেনে নিতে পারেনি। মাতৃভূমি হাতছাড়া হয়ে গেল এমন একটা বোধ এদের মধ্যে কাজ করে। এখন আপনি যদি মনে করেন, পাহাড়কে আলাদা করেই দেওয়া হোক, তারা আলাদা জাতিসত্তা, তাদের আলাদা রাষ্ট্র বা প্রদেশ বানিয়ে দেওয়া হোক, তাহলে ঠিক আছে, ঢাকাকেও আলাদা করে ফেলতে পারেন, সিলেটকেও আসামে দিয়ে দিতে পারেন, দিনাজপুর পঞ্চগড়কে ভারতে আর চট্টগ্রামকে আরাকানের অংশই করে দিতে পারেন উদারচিত্তে!
পাহাড়ের উগ্রতাবাদ নিয়ে আমরা কখনই কথা বলি না, সম্প্রীতি নষ্ট হবে বলে! শান্তিবাহিনী একসময়ে মানুষ ধরে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ আদায় করত, হিলট্র্যাকে বদলি করে দেব, কল্লা থাকবে না এই টাইপ হুমকি একসময় সিনেমায়ও দেখানো হত, কিন্তু আমরা এর সবই চাপা দিয়ে দিয়েছি। সেটলাররা পাহাড়িদের অত্যাচার করে বলা হয়, কিন্তু বাস্তবতা হল সেটেলাররা পাহাড়িদের সঙ্গে লাগতে ভয় পায়। তাদের বিবিধ শারীরিক প্রশিক্ষণ থাকে, অস্ত্রের অভিজ্ঞতা থাকে, যা সেটলারদের নেই। তারপরও সেটলাররা দাপট নিয়ে চলে কেবল মূল শহরগুলোতে। দাপট নিয়ে চলার ব্যাপারটা আরম্ভ হবার পেছনেও ওই যে অনুপ্রবেশের পর থেকেই সেটলারদের প্রতি আদিবাসীদের অসন্তোষ! এ জিনিস নিয়ে কোন সৌহার্দ্য সম্প্রীতির উল্লেখযোগ্য কোন চেষ্টা করাই হয়নি। না সেটলাররা পাহাড়িদের সম্মান সমীহ করেছে, না পাহাড়িরা সেটলারদের কখনও আপন ভেবেছে। বরং সেটলাররা পাহাড়িদের নাপ্পি, সাপ-ব্যাঙখেকো বলে পরিহাস করেছে! বিরোধ কখনও শেষ হয়নি, বিরোধ থামানোও হয়নি। এটাকে বিজনেস হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছে। আপনার এলাকায় আমি গিয়ে উঠলে আপনি আমাকে আপন করে নিতে পারেন, আবার একঘরে করেও রাখতে পারেন। সেখান থেকে প্রজন্মে প্রজন্মে আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্কের জের হবে!
পাহাড়ে কেন বাঙালি যেতে হল?
এটার উত্তর বোধ করি দিতে হবে না। তবু সংক্ষেপে বলি তাদের জন্য যারা একদম কিছুই জানে না বোঝে না। পাহাড়ে সেটলার না ঢোকালে পাহাড় স্বতন্ত্র জুমল্যান্ড হয়ে যেত আরো আগেই। তাদের পৃথক না করে বাংলার অংশ করতেই বাংলার মিশ্রণ করতে চেষ্টা করা হল! পাহাড়ে অষুধ খাবার ত্রাণ পাঠানো হল সেনাবাহিনী দিয়ে, অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেষ্টা করা হল, শিক্ষার ব্যবস্থা করা হল এবং পাহাড়িদের কর্মসংস্থানের চেষ্টাও করা হল। তবু অসন্তোষ গেল না। শান্তিবাহিনী এই সেনাবাহিনীর কব্জা হঠাতে সেই থেকে বিদ্রোহ ও প্রোপাগান্ডা চালাতে লাগল! এরপর হল শান্তিচুক্তি। লোকদেখানো অস্ত্র জমা অনুষ্ঠান হল। কিন্তু ওই যে ট্যাক্স, আর কর্তৃত্ব তা গোপন স্বীকৃত এবং অমীমাংসিতই রয়ে গেল! যার জের আমরা আজও টেনে বেড়াচ্ছি! চট্টগ্রাম ইপিজেডের চল্লিশ ভাগ কর্মীই পাহাড়ি উপজাতি! কই, কোন বাঙালি কি বলেছে কখনও যে, কেন ওরা এসে চাকরি নিচ্ছে, কেন আমাদের চাকরির ভাগ ওদের কাছে চলে গেছে? আমরা তাদেরকে বাংলাদেশি হিসেবে মানতে চাই, কিন্তু তারা আগে উপজাতি তারপর কী কী সুবিধা স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে এর প্রেক্ষিতে সে কতটা বাংলাদেশি তার আলোচনা আসে। আমরা এইখানে জাতিগত চেতনা ও একাত্মতা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছি। যদি সেটলাররা তাদের কালচাররের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হত, তাহলে এটা আরো সহজ হত। সর্বোপরি, ওই যে জাতিগত সম্প্রীতির চেষ্টা সেটা খুব একটা করাই হয়নি।
লোকালয়ের পরিবেশগত ভিত্তিতে সেখানকার মানুষের মধ্যে কিছু বেসিক ইনস্টিংক তৈরি হয়, যেমন উপকূলবর্তী কোন মানুষ, বিশেষ করে টেকনাফ চকোরিয়া কক্সবাজারের কোন মানুষকেই আপনি বোকা দেখবেন না, সেখানকার অশিক্ষিত রাখালটাকেও আপনি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী ও চতুর দেখবেন। ঢাকার মত জনবহুল শহরে আপনি ঠগ প্রতারক বেশি দেখবেন, ঘনবসতি লোকসংখ্যা ও সম্পদের লড়াইয়ের কারণে এমনটা হয়, কোন একটা অভাবগ্রস্ত জনপদের মানুষদের মধ্যে আপনি স্বার্থপরতার প্রবণতা দেখবেন। আর যেখানে লোকসংখ্যা যত কম সেখানে তত বেশি সরল মানুষ দেখবেন। ইয়েস, আমি পাহাড়িদের কথাই বলছি। পাহাড়িরা অত্যন্ত সরল মানুষ। কিছু কুচক্রী রাজনীতিকের কারণে এই জাতিগত একাত্মতার মাঝখানে একটা ফাটল এরা করে রেখেছে। পাহাড় থেকে সেনা হঠাও নামক একটা এজেন্ডা চালানো হচ্ছে তখন থেকেই, যাতে শান্তিবাহিনী অস্ত্রচর্চা করতে পারে, খুন গুম রাহাজানি করতে পারে, এই উদ্দেশ্যেই জুমল্যান্ডের স্বপ্ন দেখানো হয় পাহাড়ের সরল সন্তানদের! আর তার ফলাফল আজও এই রক্তারক্তি! অথচ শান্তিবাহিনীর এই আগ্রাসন ও অত্যাচার থেকে খোদ পাহাড়িরাও কিন্তু নিরাপদ নয়! এ কথা না কেউ কোথাও লেখে, না কেউ কোথাও স্বীকার করে।
পাহাড়ের ভাইগণ, এই দেশ তোমাদের গুরুত্ব দেয়, এই দেশের সার্বভৌমত্বকে আপন করে নিলেই দেশটা এগুবে। ভাঙনের খেলা খেললে তোমাদেরই বঞ্চিত হবার আশঙ্কা বেশি। যে বাইক চোর বা ফার্নিচার ব্যবসায়ী মামুনকে তোমরা মেরে ফেললে, তা তোমাদের বর্বরতাকে যেমন নির্দেশ করে, কালকের তাণ্ডবের সূচনাকেও নির্দেশ করে। সূত্রপাত করানো হয়েছেই দেশটাতে অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করার জন্য। দেশ তো তোমারও, তাহলে কেন এই অশান্তির ফাঁদে পা রাখছো??? আর্মি তোমাদের সাহায্য করতে যায় আর তোমরা তাদের গালাগাল কর, ঢিল ছোঁড়ো, কেন??? পাহাড় থেকে আর্মি হঠাও স্লোগান দেওয়ার মানে না তুমি এদেশের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করছ, না এদেশের জাতীয়তাকে স্বীকার করছ! কেন পাহাড়কে আইনশৃঙ্খলা বহির্ভূত করে রাখতে চাও ভাই?? কেন এই আত্মপ্রবঞ্চনা???
এবার সমতলের সুশীলদের একটু বলি, গ্রাফিতির মধ্যে কল্পনা চাকমা, পাহাড়ি আর সেটলারদের বিভাজন, উপজাতিদের চাংমাং বলা ইত্যাদি টাইপ উস্কানিমূলক কথা লিখতে মানা করার জন্য কী লিখতে চায় তা দেখাতে বলা হল, আপনারা সেটাকে ইস্যু করে গরম করতে চাইলেন, পারলেন না, ব্যর্থ হলেন। কিন্তু দমলেন না, খাগড়াছড়িতে নেট বন্ধ করা হয়েছে (গতমাসে) এই গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করলেন, তাতেও তখন লাভ হল না! আপনারা গণহারে পোস্ট করলেন, পাহাড়ে নেট বন্ধ করে কী না কী চক্রান্ত হচ্ছে, বাট কিছুই হল না। আপনারাও মিচকে হেসে পরের চাল চালার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন! আপনারা পাহাড় নিয়ে প্রোপাগান্ডা তৈরিতে নামলেন! আপনারা কী চান, পাহাড় আলাদা হয়ে দেশটা আরেকটু ছোট হয়ে যাক?? নাহলে কেন এই ইন্ধন দিচ্ছেন?? পাহাড়ে একটু শব্দ হলেই চেঁচিয়ে মানবতা মাটিতে নামিয়ে ফেলছেন, কাল যে চোরটাকে পিটিয়ে মারা হল তা নিয়ে কেন একজনও কিছু বললেন না??????
কেন রে সুশীল ভাই, কেন এই চোগলখোরি?????
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৩