somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নজরুল সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণা
(প্রথম খণ্ড)

২৫ শে মে, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকীতে কিছু একটা লিখব বলে ভাবছিলাম কাল থেকে। কিন্তু কী যে লিখব তা-ই স্থির করতে ব্যর্থ হলাম। হ্যাঁ ব্যর্থই হয়েছি, কারণ নজরুল জীবনী এত গভীর আর ইম্প্রেশানে ঋদ্ধ যে, দুয়েক কথায় তা আলোচনা করে শেষ করা অসম্ভব। আমার ভয় যে, যা-ই লিখব অসম্পূর্ণ হবে তা।

কবির জীবন তো, আর দশটা জীবনের মতো সহজে তা ব্যাখ্যা বা চিত্রায়ণ করা সম্ভব নয়। আমি নজরুলকে নিয়ে ভিন্ন কিছু করার সংকল্প নিলাম এবার। এবার বড়ো আকারের কিছু করব। হয়ত সম্পন্ন করতে বছর দুয়েক লাগবে এতে।

যাইহোক, কিছু না কিছু তো আজ অন্তত লেখা উচিত। ভাবলাম তবে ভ্রান্ত ধারণা নিয়েই লিখি। নজরুল সম্পর্কে সাধারণ পাঠকের জানাশোনা নেই বললেই চলে। জানাশোনা আসানসোলের রুটির দোকান, চুরুলিয়া, সৈনিক জীবন আর নার্গিস-প্রমীলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কবি নজরুলের যে দর্শন, যে মানসিকতা, তা যেমন আমাদের অজানা, তা উপলব্ধি করার মতো ক্ষমতাও বোধকরি আমাদের নেই। নজরুল এমন একটা মানুষ, যিনি সম্পূর্ণই ছিলেন মানবতার কবি। মানুষের জন্য নিরন্তর লড়েছেন তিনি। উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন মেহনতি বঞ্চিত মানুষের কথা। মিছিলে মিটিংয়ে পায়ে হেঁটে পথে পথে গান করেছেন তিনি, মুক্তির গান। নারীকে দিয়েছেন তিনি নরের সমকক্ষ সম্মান। নজরুলের মতো অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি গোটা বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়টি আর নেই। এবং বাংলা সাহিত্যের দরবারে তিনিই প্রথম অসাম্প্রদায়িক কবি।

১. কাফের?

নজরুলকে অতি আবেগী ধার্মিকগণ কাফের বলেন। শক্তিমান ইসলামপন্থী কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন তাঁর ঘোর বিরোধী। ইসলামী চেতনার কবি গোলাম মুস্তফাও তাঁকে নিয়ে হাস্যকর ছড়া কেটেছেন।

অথচ ইসলামী ঐতিহ্যকে নজরুলের মতো আর কোন কবিই এতটা সোচ্চার আর গর্বিত কণ্ঠে ঘোষণা করতে পারেননি! "কোরবানী" কবিতাটিতে তিনি কোরবানীতে পশু হত্যার বিষয়ে মানবতাবাদীরা মুসলিমদের উপর যে নিষ্ঠুরতার অভিযোগ এনেছিল তার দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছেন। এছাড়া মহররম, কামাল পাশা, আনোয়ার, রণ-ভেরী, শাত-ইল-আরব, খেয়াপারের তরণী প্রভৃতি কবিতা দিয়ে তিনি গোটা ইসলামের গৌরবোচিত ঝাণ্ডা সমুন্নত রেখেছেন।

অপরদিকে তিনি হিন্দু ঐতিহ্য ও স্তবরচনায়ও সম্যক অবদান রেখেছেন। অথচ হিন্দুবাদী কবিলেখকগণও তাঁকে সর্বোপায়ে যন্ত্রণা দিয়ে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করেছেন। এ ভূমিকায় সজনীকান্ত দাশ, হেমন্ত চট্টোপাধ্যায়, অশোক চট্টপাধ্যায় এবং যোগানন্দ প্রমুখের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সজনীকান্ত তো অত্যন্ত নিকৃষ্ট প্যারোডিও রচনা করেছেন নজরুলকে নিয়ে।
সেসব হাস্যকর প্যারোডির উদাহরণ দিয়ে লেখা দীর্ঘ করব না। অনেক কাজের কথাই বাকি।

নজরুলের খ্যাতির প্রতি ওইসব লেখকের তীব্র ও সুস্পষ্ট ঈর্ষার পরিচয় আমরা পাই। তাঁরা নিজেরা অত ভালো কিছু করতে পারেননি বলে, নিজেরা উপরে উঠতে পারেননি বলে, নজরুলকেও তাঁদের পর্যায়ে টেনে নামাতে চেষ্টা করেছেন।

আসলে নজরুল কোন দলের অনুগামী ছিলেন না। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা। একারণেই তাঁকে কেউ পাতে তোলেনি। মুসলিমেরা বলেছে কাফের, হিন্দুরা বলেছে ভণ্ড, পুঁজিবাদীরা তাঁকে বলেছে মার্ক্সবাদী শত্রু, অথচ মার্ক্সবাদী সমাজবাদীরাও তাঁকে বলেছে দালাল! নিরপেক্ষতার এ বড়ো দারুণ বিড়ম্বনা।
আরো নির্লজ্জ ব্যাপার হল, তাঁর শ্লোগান এবং সঞ্চারক পঙ্ক্তিকেই আবার ওইসব নিন্দুকেরা নিজ নিজ সুবিধামত ব্যবহার করেছে!

নজরুল প্রমীলাকে বিয়ে করে ধর্ম জলাঞ্জলি দেননি মোটেও। যাঁরা এমনটি বলেন, তাঁরা অন্ধ আবেগী মাত্র। যখন নজরুল-প্রমীলার বিয়ে পড়ান হয়, তখন বিয়ে কোন রীতিতে পড়ানো হবে- এ নিয়ে সংশয় বাঁধে। হিন্দু রীতি অপ্রযোজ্য, তাই সিভিল ম্যারেইঝ-এর কথা ভাবা হয়। কিন্তু সে নিয়মে বিয়ে করতে হলে পাত্রপাত্রীকে নিজ নিজ ধর্মকে অস্বীকার করার কথা ঘোষণা অন্তত ওই মজলিশের সামনে দিতে হবে। নজরুল মোটেও তা মানতে পারেননি। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে, তাঁর গায়ে মুসলমানের রক্ত বইছে এবং শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এ তিনি অস্বীকার করতে পারবেন না!
নজরুল যে কতটা ধার্মিক ছিলেন এতেই কি আপনাদের কাছে তা সুস্পষ্ট হয় না??

নজরুল ধার্মিক ছিলেন এবং অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। বিয়ের অজুহাতে প্রমীলার ধর্মান্তরের প্রস্তাবকেও তিনি সমর্থন দেননি।

তিনি হিন্দুর সঙ্গে সমান ঔদার্যে থেকেছেন, তাঁরই বাড়ির চিলেকোঠায় শাশুরি গিরিবালাদেবীর পুজোঘর ও কালীমূর্তি ছিল। নজরুলের ধর্ম যায়নি এতে। নজরুল ইসলামের প্রতি প্রবল ভক্তিস্বরূপ যে সকল গজল রচনা করেছেন তার তুলনা কি সারা বিশ্বে আছে?
ধার্মিকেরা এরচেয়ে ভালো গজল আর কোথায় পাবেন?
ধর্ম কিসে যায়, যায় কি যায় না- এ বিষয়ে হুমায়ূন মানস প্রবন্ধেই আমি যথার্থ উত্তর দিয়ে রেখেছি। আগ্রহীগণ দেখে নেবেন।
সবশেষে আবার বলি, নজরুলই ছিলেন প্রকৃত মানবতাবাদী এবং ধর্মের মর্মার্থ তিনি যথার্থ উপলব্ধি করেছিলেন বলেই যাবতীয় গোঁড়ামি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন। আর তাঁর কবর যে মসজিদের পাশে কেন- তা নিশ্চয়ই কারোই অজানা নয়।

অসাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে নজরুলের স্বীকারোক্তিটি দেখুন-

"আমি হিন্দু মুসলমানের মিলনে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের কুসংস্কারে আঘাত হানবার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দু দেবদেবীর নাম নিই।"

অন্যত্র তিনি বলেছেন-

"কেউ বলেন আমায় বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ওদুটোর কিছুই নয়। আমি শুধু হিন্দু মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।"

সেকালের সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার সময়ে এরচেয়ে ভালো চেষ্টা আর কী হতে পারে?


২. রবীন্দ্রনাথ নজরুল বিরোধ?

"শ্বশুর না হইলে রবি
আমি হতাম বিশ্বকবি!"

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের শ্বশুর ছিলেন- এই ধারণা বাঙালির মনে কোত্থেকে উদিত হল তা আমার জ্ঞানের অতীত। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের শ্বশুর তো ননই, প্রমীলার পূর্বপুরুষ পঞ্চানন জমিদারের সঙ্গে রবীঠাকুরের পূর্বপুরুষ পঞ্চানন ঠাকুর যদি এক ব্যক্তি হনও (ব্যাপারটি অনিশ্চিত এবং গবেষণা সাপেক্ষ), তাতেও রবীঠাকুরের পরিবারের সঙ্গে গিরিবালার পরিবারের কোন সংসর্গের আভাস কোথাও পাওয়া যায় না। কোন দলিল দস্তাবেজ বা চিঠিপত্রেও এমন কিছু নেই।

আগামী খণ্ড দ্রষ্টব্য।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৫০
৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×