বউ আবার একটু বই পোকা শ্রেণীর প্রাণী... হুমায়ূন আহমেদ এর বিশাল ভক্ত... বায়না ধরেছে এই বই মেলা থেকে তাকে কিছু উল্লেখযোগ্য লেখকের বই উপহার দিতে হবে... যে কথা সেই কাজ, রাতেই লিস্ট বানিয়ে আমার সামনে হাজির.. লিস্টে ছিলো,
হুমায়ূন আহমেদের কিছু উপন্যাস
ইবনে বতুতার ভ্রমন কাহিনি নিয়ে বই
সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর বই
... লিস্ট দেখে মোটামুটি ঘাবড়ে গেছি.. বউকে বললাম, "এত আগের লেখকদের বই এখন কোন প্রকাশক ছাপায় নাকি!! কিনলে পুরাতন কিনা লাগবে..."
বউ বললো, "আমি এত কথা বুঝিনা!! আমার ঝকঝকে তকতকে নতুন বই চাই...!"
নিরুপায় আমি বইমেলায় গিয়ে হতাশ... কারোরই বই পাচ্ছি না... একটা স্টলে দেখলাম মানুষ বই কেনার চাইতে লেখকের সাথে সেলফি তোলা নিয়ে ব্যস্ত..! প্রচন্ড ভীড়!
এক আপু পাশ দিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে সেই ভীড়ের দিকে দৌড়ে যাচ্ছিলো.. উনাকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলাম---
- আপু উনি কে?? সবাই এত হুমড়ি খেয়ে পড়ছে কেন উনার উপর?!!
আপুটা চোখ বড় বড় করে বললো---
- "ইয়া আল্লাহ! আপনি উনাকে চিনেন না??! উনি এই যুগের হুমায়ূন আহমেদ!! আমাদের সাদাত হোসেন ভাইয়া!! (ভাইয়া বলে চার আলিফ টান)... আমার সব গুলা প্রোফাইল পিকচারের ক্যাপশন উনার ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেয়া...!"
আমি ভাবলাম যাক! বউ তো সারাজীবন আগের যুগের হুমায়ুন আহমেদ পড়লো, এবার একটু এই যুগের হুমায়ূন আহমেদ পড়াই... স্বামী হিসেবে এটুকুন দ্বায়িত্ব পালন না করলেই নয়.. তাই দেরি না করে একটা বই নিয়ে নিলাম... এখন বাকী থাকলো ইবনে বতুতার ভ্রমন কাহিনী আর সমাজ সংস্করণ নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বই...
এক স্টলে গিয়ে বললাম---
"ভাই ইবনে বতুতার কোন বই আছে??"
বিক্রেতা বললো, "ইবনে বতুতা কেডা ভাই??"
বুঝলাম এই লোকের সাথে কথা বাড়ানো ঠিক হবেনা... তাই আরেকটু সোজা বাংলায় বললাম, "দেশবিদেশ ভ্রমণ নিয়ে কোন জনপ্রিয় বই আছে??"
লোকটা ঠোঁটের এক পাশে সূক্ষকোণ এঁকে তীর্যক হাসি দিয়ে বললো---
"আফনে কি তৌহিদ আফ্রিদির কথা কইতে চাইতেছেন?? আগে কইবেন না? এই লন, ভ্রমণ নিয়া সব থেকে জনপ্রিয় বই এইবার বইমেলায়... বেস্ট সেলার, টপ সেল..!
এই বলে দোকানদার আমার হাতে একটা " ৩০ দিনে ইংরেজি শিখুন" টাইপ পাতলা বই ধরিয়ে দিলো... আমি কিছু না বলে নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করে দিয়ে আসার সময় ঐ লোক আবার বললো, "ভাই, বইটা পড়ে ভাল লাগলে অবশ্যই ইউটিউব চ্যানেলটি সাচক্রাইভ (সাবস্ক্রাইব) করবেন..."
বইয়ের সাথে ইউটিউব চ্যানেলের কি সম্পর্ক তার হিসাব কষতে কষতে মনে পড়লো, আমার আর একটা বই কেনা হলেই বাঁচি.. এই আজাব থেকে বের হতে পারবো...
স্টলে স্টলে ঘুরছি আর খুজছি, কোথাও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর কোন বই নেই... খুঁজতে খুঁজতে এক স্টলে গিয়ে পেলাম... সেলসম্যান আমাকে জিজ্ঞেস করলো---
"স্যার আপনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কোন বইটা খুঁজছেন একটু বলবেন প্লিজ?"
আমি যেহেতু স্পেসিফিক নাম জানিনা আর বউও কিছু বলেনি, তাই বললাম---
"সমাজসংস্কারক হিসেবে যেহেতু উনি পরিচিত, তাহলে ঐ টাইপের একটা বই দিন আমাকে...!"
লোকটা বললো,
"স্যার আপনি এই ডিজিটাল ফাংফুং যুগের মানুষ হয়ে সেই আদি যুগের সমাজ সংস্কার এর বই দিয়ে কি করবেন!! আপনি চাইলে আমরা আপনাকে মর্ডান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বই সাজেস্ট করতে পারি... যিনি একসাথে লেখালেখি, ইউটিউবিং, মোটিভেশনাল স্পিচ, স্ন্যাপচ্যাট, ইন্সটাগ্রাম, এবং বিভিন্ন কন্ট্রোভার্সির মাধ্যমে সমাজ সংস্করণ এর কাজে নেমেছেন... এক কথায় তরুণ সমাজের আইডল! বলতে পারেন উনি একজন সব্যসাচী বিদ্যাসাগর!"
লোকটার কথা শুনে রীতিমত ইম্প্রেসড হয়ে গেলাম! আই উইশ আমার বউও বইটা পেয়ে ইম্প্রেসড হয়ে যাবে... তাই দেরি না করে বইটা তাড়াতাড়ি কিনে নিলাম... (উনি আবার হাজারো তরুণীর ক্রাশ, তাই নাম উল্লেখ করে আমার নারী ভক্তদের মনে কষ্ট দিতে চাইনা...)
যাইহোক, এ যুগের তিন বিখ্যাত লেখকের তিন খানা বই নিয়ে আমি বাসায় হাজির... হাসিহাসি মুখে ব্যাগ থেকে কাগজে মোড়ানো বই তিনখানা বের করে দিয়ে বউকে বললাম, "সারপ্রাইজ!!"
বউ বই হাতে নিয়ে বললো, "এখানে সারপ্রাইজের কি হলো... আমি নিজেই তো তোমাকে বই এর লিস্ট দিলাম!"
আমি বললাম, "আরে খুলেই দেখো না!! তুমি আনন্দে লাফিয়ে উঠবে...!"
বউ কৌতূহল নিয়ে প্যাকেট খুলে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে বইগুলোর প্রচ্ছদ দেখছে... এক একটা বই দেখছে আর কপালে একটা করে ভাঁজ বাড়াচ্ছে... ব্যাপার কি!! ঘটনা বুঝে উঠার আগেই বউ চেঁচিয়ে বললো---
"আরে ভাইরে ভাই! কে তুমি?? কি নিয়ে আসছো এসব হাতে করে... তোমাকে আমি কাদের বই আনতে বললাম আর তুমি এসব কি নিয়ে এলে!! লেখক চিনোনা! লেখক!!"
আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হাসি দিয়ে বউকে বললাম---
"আরে বোকা, এরা এবার বইমেলায় বেস্ট সেলার কবি সাহিত্যিক!! একজন এযুগের হুমায়ূন, আর দুজন এই যুগের ইবনে বতুতা আর বিদ্যাসাগর!! আমার বউ হয়ে তুমি কেন সেকেলে বই পড়বা??"
বউ কিছু না বলে বইগুলো প্রণয়ার পড়ার টেবিলের উপর রাখলো... টেবিলের পাশ থেকে হেলান চেয়ারটা সরিয়ে নিয়ে কোত্থেকে খুজে একটা প্লাস্টিকের টুল এনে মেয়ের টেবিলের পাশে রাখলো... এবার আমার কাছে এসে বললো---
- "তুমি জানি কতদিন ছুটি নিয়েছো অফিস থেকে?!?"
- চার দিন!
- আর কত দিন বাকি আছে??
- তিন দিন!! কিন্তু কেন?!?
. . .বউ কিচ্ছু না বলে আমার শার্ট ধরে টেনে টুলটা দেখিয়ে বললো, এখানে বসো... আমিও নির্বোধের মত বসে বউএর দিকে তাকিয়ে আছি... বইগুলো আমার সামনে টেবিলের উপর আরেকটি আছাড় দিয়ে রেখে বললো---
"এই নাও তোমার এ যুগের বিশিষ্ট তিন কবি সাহিত্যিকের বই.. এই তিনটা বই আগামী তিন দিনে পড়ে আমার কাছে আসবা... দৈনিক একটা বই পড়ে শেষ করতে না পারলে তোমার খাওয়া বন্ধ... আর যদি তিন দিনে তিনটা বই শেষ না করতে পারছো, চতুর্থ দিন আমি প্রণয়াকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যাবো... সো সাধু সাবধান! পড়তে বসো!!"
আমাকে প্রণয়ার পড়ার টেবিলে এভাবে পড়তে বসাতে দেখে মেয়ে আমার মুখে হাত দিয়ে হাসছে... বউ সোজা মেয়ের হাত ধরে টেনে পাশের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো... আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সব থেকে ছোট বইটা বইটা বেছে নিলাম... আজ দুপুরে তো এটলিস্ট খাওয়া লাগবে...
টেবিলে বসে গুনগুন করে পড়ছি আর ভাবছি, "এই যাত্রায় বোধয় বেচে গেলাম... ব্যাগে এ যুগের নারীজাগরণের বইও ছিলো... বেগম রোকেয়ার চাইনিজ ভার্সন! বই মেলায় স্টলম্যান আমাকে বলেছিলো---
"স্যাr, Upনি Upনার Wiফকে এই boiটা গিফট korতে paরেন! She উইলbe হ্যাppy!!"
. . . ভাগ্য আমার সুপ্রসন্ন বলতে হবে! এই বই বের করলে আমাকে না খেয়েই মরতে হতো তবু বই পড়ে শেষ করা যেতো না!
বলতে না বলতেই হঠাৎ ডাইনিং থেকে প্রণয়া চিৎকার দিয়ে বলছে,
"আম্মু!! আম্মু!! আব্বুর ব্যাগের ভিতর আরেকটি বই আছে!!"
ফেসবুকে আমার ফেইক প্রোফাইলঃ http://www.fb.com/ZRShuvoo
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১:১৫