শুধুমাত্র একটি কবিতা দিয়ে কি একজন কবিকে ভালবেসে ফেলা যায়? শুধুমাত্র একটি কবিতা কি একজন মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখাতে পারে জীবনের মানে? হয়ত পারে!!! হয়ত পারে না!!! আসলে প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু যদি সে কবিতা হয় হৃদয়ের খুব কাছাকাছি তাহলে?
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
-শামসুর রাহমান
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খান্ডবদাহন?
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাংক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হল। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে ব’লে, বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার
ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে একটানা চিৎকার করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতা- মাতার লাশের উপর।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খান্ডবদাহন?
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে থুত্থুরে এক বুড়ো
উদাস দাওয়ায় ব’সে আছেন- তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাড়িঁয়ে আছে
নড়বড়ে খুঁটি ধ’রে দগ্ধ ঘরের।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
ব’সে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্টদাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী বলে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাধেঁ বনে- জঙলে ঘুরে বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হ’তে চলেছে-
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি- প্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।
আমি বসে আছি- তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা! আমি বসে আছি... ... ... সগীর আলী, কেষ্টদাস, মতলব মিয়া, রুস্তম শেখ, সেই তেজী তরুণের মত আমিও বসে আছি- তুমি আসবে বলে। যার জন্যে এদেশের তিরিশ লক্ষ মানুষ নির্দ্বিধায় বিলিয়ে দিতে পারে তাদের জীবন, সে দেশে না এসে কি তুমি পার? তাই যে তোমাকে আসতেই হবে, তোমাকে যে এবার আসতেই হয়... ... ...
কিন্তু হায়! খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গি এল দেশে... ... ... ৭১ এ শুরু আর আজ- আজ ২০০৭। পদ্মা- মেঘনায় গড়িয়ে গেল কত জল! ভোল পালটে কত বর্গি এল গেল- শুধু তুমিই এলে না! তবুও আমরা বসে থাকি... ... ... বসে থাকা যেন আজ আমাদের নিয়তি! আমি বসে আছি- আমরা বসে আছি- তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা!
কিন্তু বেলা যে অনেক গড়িয়ে গেল... ... ... তবুও আমার প্রতীক্ষার প্রহর যে ফুরায় না... ... ... তবে কি সাকিনা বিবিদের সব ত্যাগ বৃথা যাবে? তবে কি হরিদাসীর সিঁথির সিঁদুর মুছে যাওয়ার কালে যে কথা তুমি দিয়েছিলে তা মিথ্যে হয়ে যাবে? তবে কি সেদিন পিতৃস্মৃতিহীন যে শিশুটি হামগুড়ি দিয়েছিল তার পিতার লাশের উপর- তাকে গভীর মমতায় জড়িয়ে তুমি যে বলেছিলে, “আমি আসব”- তা কি কথাই থেকে যাবে? তবে কি সগীর আলী, কেষ্টদাস, মতলব মিয়া, রুস্তম শেখদের সাথে কোন কালেই তোমার দেখা হবে না? শুধুমাত্র একটি কথা, তোমার একটি কথা- “আমি আসব” শুনে যে তরুণটি সেদিন জন্মদাত্রী মা, প্রানপ্রিয় প্রিয়াকে তুচ্ছ করে রাইফেলস কাধেঁ তুলে নিয়েছিল- সে কি শুধু দেখে যাবে জীবনের পরাজয়? এই কি ছিল তার প্রাপ্য? প্রতিনিয়ত এক শত্রু থেকে অন্য শত্রুর কাছে নিজেদের দেহ- আত্মা বিকিয়ে দেওয়া- এই কি আমাদের নিয়তি? এই কি তুমি? এই কি তুমি- স্বাধীনতা!
হায় স্বাধীনতা! আমি আজও বসে আছি... ... ... আমি বসে আছি... ... ... তুমি আসবে বলে... ... ... তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা... ... ...
কিন্তু এমন তো কথা ছিল না! কথা ছিল- হরিদাসীর কপালে কুমকুমের ফোঁটায় তুমি থাকবে সুদীপ্ত সূর্যের মত। যে সূর্য অস্ত যাওয়ার কালে কোনদিনের সমাপ্তি ঘোষণা করেনা। বরং সে সূর্য অস্ত যায় এক নতুন দিনের আগমনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। কিন্তু সে সূর্যের যেন আজ গ্রহণ লেগেছে! কবে কাটবে এই গ্রহণ? কবে হবে আমাদের সূর্যস্মাণ? আমাদের প্রশ্ন আমাদেরই মনের দেয়ালে বাধাঁ পেয়ে ফিরে ফিরে আসে আর আমরা- আমরা কেবল কাপুরুষের মত প্রতীক্ষাই করে যাই... ... ... আমরা কেবল বসে থাকি- কবে তুমি আসবে- কবে তুমি আসবে, হে স্বাধীনতা... ... ...
আর না- এবার বোধ হয় উঠে দাঁড়ানোর সময় হয়ে এল। এবার আর প্রতীক্ষা নয়, এবার আর আমি ভিড়ের অংশ নই, এখন আর আমি অনেকের মত একজন নই। ভালবাসা! ভালবাসা নয়, কি প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে বসবাস করলে একসময় জীবনের চেয়ে দেশ বড় হয়ে উঠে- আজ তা আমি জানি! আর তাই আজ আমি প্রচন্ড উত্তাপে সবকিছু পুঁড়িয়ে দিতে প্রস্তুত। কেননা আজ বুক আমার বাংলাদেশের হৃদয়... ... ...
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০০৮ সকাল ১১:৩৭