প্রথম পর্বের লিঙ্ক - Click This Link
এইবার ব্যাকট্র্যাক করে একটু পেছনে যাওয়া যাক। কেননা এই সিরিজের প্রথম পর্বপাঠে সবাই এই বস্তুটিকে যেভাবে ভ্রমণকাহিনী, ঢাকা-কাহিনী নাকি আমার নিজের জীবনের কোন রোমান্টিক কাহিনী ইত্যাদি নামকরণ করে আকাশ-কুসুম চিন্তা শুরু করে দিয়েছেন তাতে সকলের বিভ্রান্তির অবসান করতে বোধকরি এইবেলায় আমাকে বাংলা সিনেমার লায়িকাদের মত ফ্ল্যাশব্যাকে না গেলেই নয়... [সুতরাং ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে শুরু করেছে - টু টু টু টু... দেখা হ্যায় প্যাহলিবার সাজান কি আখোন ম্যায় প্যায়ার... টু টু টু টু... এবং আমি ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্যে...]
একদম শুরুর কথাঃ
কাহিনীর সূচনাকাল আসলে ২০০৭ সালের জুলাই- আগস্ট মাসের দিকে। আমরা এক মাস হল ফোর্থ ইয়ারের ক্লাস শুরু করেছি। ল্যাব, প্রজেক্ট, এসাইনমেন্ট, থিসিস প্রপোজাল সাবমিশান, ইনকোর্স সব মিলিয়ে পুরা লে-হালুয়া দশা। স্যারেরা সবাই মিলে কি এক কন্সপিরেসি থিওরাম শুরু করেছেন তারাই জানেন আর মাঝ দিয়ে আমাদের মত নিষ্পাপ শিশুগুলোর জীবনের ভাজা ভাজা কুড়মুড়ে হালাত (এতই ক্রিস্পি যে বোধকরি হাতে নেওয়ার আগেই ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবে!!!)। কিন্তু আমাদের দেখে কারও বাপেরও তা বুঝবার উপায় নেই। কেননা তখন আমাদের সকল চিন্তাচেতনা জুড়ে একটিই নাম - স্টাডি ট্যুর, স্টাডি ট্যুর , স্টাডি ট্যুর (যাতে স্টাডি শুধু নাম কা ওয়াস্তে... পুরোটাই ঝাক্কাস এক ট্যুর...)। সুতরাং তোড়জোড় শুরু হল স্টাডি ট্যুরের। হর্তাকর্তারা প্রতিদিনই গম্ভীর মুখে মিটিং এ বসছেন। স্যুভিনির কমিটি তাদের মুখে আতলামির ছাপ লাগিয়ে উদাস উদাস ভাবে কলম দৌড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। এড কমিটি চিন্তায় চিন্তায় তাদের মস্তকে স্টেডিয়াম বানিয়ে ফেলেছে অল্পদিনেই। আর আমরা যারা কিছুতেই নেই তারা ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মত তিরিং বিরিং করছি। যাই হোক সকল জল্পনা কল্পনার অবসান করে ঠিক হল পূজোর ছুটির প্রথম দিকেই অর্থাৎ অক্টোবরের শেষদিকে আমরা ট্যুরে যাচ্ছি। কিন্তু বিধিবাম। এতদিন শুধু শেক্সপিয়ারের গল্পেই পড়েছি, "ম্যান প্রপোজেজ, গড ডিসপোজেজে।" এবার নিজেদের জীবনেও তার উত্তম প্রয়োগ হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেলাম। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, কন্সার্নড টিচারের অভাব, সিডরের প্রভাব, মন্দার বাজারে স্পন্সরের আকাল এবং পাসপোর্ট-ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা এড়িয়ে যখন ঘর থেকে ব্যাকপ্যাক কাঁধে চাপিয়ে রওয়ানা হলাম তখন তাকিয়ে দেখলাম ক্যালেন্ডারের পাতায় ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসের পাতাটা ঝুলছে। আর তাতে লাল সাইনপেন দিয়ে গোল করা ২ তারিখটি আমার দিকে তাকিয়ে প্রহসনের হাসি হাসছে।
যাবে না যাবে না করেও শেষতক আমরা মোট ২২ জন দুষ্টু ছেলেমেয়ের দঙ্গল (ইয়ে মানে এইসকল পিচকে ফাজিলের মাঝে আমি যে সবচেয়ে শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট সে কথা না বললেই নয়!!!) যাচ্ছি স্টাডি ট্যুরে। রাখাল যেমন গরু চড়িয়ে বেড়ায় এবং তেড়িং বেড়িং করলে গরুর পশ্চাৎদেশ বরাবর বেত্রাঘাত করতে কার্পণ্য করে না তেমনি আমাদের মত লেজবিশিষ্ট শাখামৃগের দলকে কাবুতে রাখতে আমাদের সফরসঙ্গী হলেন রাখালরূপী ফারহান স্যার, রোমানা ম্যাম, জাবের স্যার এবং তার সহধর্মিনী অথৈ ম্যাম। কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে ঠিক হল জাবের স্যার এবং অথৈ ম্যাম সরাসরি কাঠমুন্ডুতে আমাদের সাথে দেখা করবেন। তাই আপাতত কাঠমুন্ডু যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদেরকে ফারহান স্যার আর রোমানা ম্যামের হাতে সঁপে দিয়ে জাবের স্যার পর্দার অন্তরালেই থেকে গেলেন...
ঝাননন... [চমকে উঠে] ফ্ল্যাশব্যাক থেকে মূলকাহিনীতে ফেরা যাক।
..................ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে চাপিয়ে আমার প্রিয় "ক্যানন এস থ্রি - আই এস" কে বগলদাবা করে রওয়ানা হলাম কল্যাণপুরে শ্যামলী বাসকাউন্টারের দিকে। অতঃপর...
বাস পর্বঃ
পথিমধ্যে আমার দায়িত্ব ছিল তারেককে পিক করা। তাই যখন ৭:৩০ এ তারেককে তুলতে গিয়ে দেখি বান্দা হাজির তখন মনে মনে "ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি" না পড়ে পারলাম না। এ যে রোজ কেয়ামতের আলামতরে ভাই! মামু আর সময়মত! এরচেয়ে সূর্য্যিমামা পশ্চিমে উঠে অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য। যদিও মামুর তিনদিনের অধিক কাল অবধি সেভ না করা খোঁচা খোঁচা দাড়ির জঙ্গল আর দৃষ্টিতে সদ্য ছ্যাঁক খাওয়া দেবদাস ভাব দেখে খানিকটা চমকে গেলাম। তারপরও মুখে মোনালিসা হাসি ফুটিয়ে আমি বললাম, "মামু, খবর কি?" মামু তার স্বভাববিরুদ্ধ গাম্ভীর্যে বলল, "১০৩ জ্বর। যাব?" কিছু না বলে শুধুমাত্র একবার তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমি গাড়ির দরজা খুলে দিলাম। সামনে আয়না ছিল না বিধায় নিজ দৃষ্টিতে কি ছিল আজ তা বলতে পারছি না তবে সত্যযুগ হলে যে সে অগ্নিদৃষ্টিতে যে কেউই ভস্মীভূত হয়ে যেত তা তারেকের কাচুঁমাঁচু মুখটা দেখেই বুঝে গেলাম। সুতরাং কথা না বাড়িয়ে "ইয়ে মানে, ইয়ে মানে" করতে করতে তারেক উঠে বসল। গাড়ি চলতে লাগল। গন্তব্য কল্যাণপুর।
ঠিক ৮:০০টায় আমরা বাস কাউন্টারে পৌঁছে গেলাম। এই কাউন্টার থেকে আমাদের সঙ্গী হওয়ার কথা ফারহান স্যার আর রোমানা ম্যামের। কিন্তু ৮:৩০ বাজতে চলল; স্যার- ম্যামের টিকিটারও দেখা নাই। অগত্যা আমি আর তারেক হতাশ ভঙ্গিতে গা এলিয়ে দিলাম কাউন্টারের কুৎসিত চেয়ারে।
এদিকে যুগান্তরের গলির মোড়ে শ্যামলীর অন্য কাউন্টারেও তখন জমে উঠেছে এক জটিল নাটক। টান টান উত্তেজনা। শ্বাসরুদ্ধকর এক পরিস্থিতি। ওখান থেকে উঠার কথা ছিল আমরা দু'জন ছাড়া বাকি ২০ জনের। সবই ভালয় ভালয় হয়ে গেছে। বাসও ছাড়ি ছাড়ি করছে। কিন্তু আমাদের হাসি যেন উপরওয়ালার চোখের বালিসম। তাই ঝামেলাটা তখনি বাধল যখন টের পাওয়া গেল মুফের কাছে রাখা ২২টা টিকিটের একটা মিসিং। আর ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস টিকিট খুঁজতে যাওয়া মাত্র পর্দায় লোড শেডিং এর আবির্ভাব। যাকে বলে মিল্লা গেল খাপে খাপ। মুফতির একটাই কথা, "আমি যাচ্ছি না।" সবাই যতই বোঝায়, "দোস্ত ব্যাপার না, চল তো আগে উঠি।" তার হুংকার ততই বাড়তে থাকে, "না, না, না।" অতঃপর গঙ্গা- যমুনায় অনেক পানি গড়িয়ে কারেন্টের আগমন, লিসার ভালমানুষি মুখ করে বলা, "এই দেখ না, এই টিকিটটা আমার ব্যাগে কি করে এল!", ২ বছর NDC তে পড়া সত্ত্বেও জামির পুলিশ ফাঁড়ি না চিনতে পেরে "আমারে ছাইরা জাইসনা" বলে কান্নাকাটি, বাসের চলা শুরু - সব মিলিয়ে একতা কাপুরের পারফেক্ট মিরচ- মাশালাদার ডেইলি সোপ রেডি। শুধু লাইট, ক্যামেরা, একশান বলার অপেক্ষা এখন...
যাই হোক ঠিক ৯:০০ টায় বাস এসে পৌঁছল কল্যাণপুরে। সবার হৈ হৈ করে বাসে ওঠলাম বাক্স- প্যাটরা নিয়ে। অতঃপর সবাই যখন প্রাথমিক উত্তেজনা কাটিয়ে যার যার সিটে হেলান দিয়ে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, "তাহলে আমরা সত্যিই যাচ্ছি!" তখন শহরতলীটাকে পেছনে ফেলে কুয়াশার বুক চিঁড়ে বাস এগিয়ে গেছে অনেকটা দূর...
(চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০০৮ বিকাল ৩:২৩