১.
মালয়েশিয়া থাকা কালিনই অফিস থেকে খবর পেলাম আমার ভিসা বাংলাদেশস্হ লিবিয়ান দূতাবাসে চলে এসেছে। এখন শুধু বাংলাদেশে এসে দূতাবাসে পাসপোর্ট জমা দিব আর পরের দিন লিবিয়ায় উড়াল দিবো। সব শুনে বউ এর গাল গেল ফুলে। ওর এক কথা, "আমি যে দিন তোমাকে যাবার অনুমতি দিব সেই দিন তুমি যেতে পারবে তার আগে না"
কেন ? তোমার আবার কি সমস্যা ?
বউ চোখ বড় বড় করে বলে, পনের ষোল দিন পর রোজার ঈদ, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে যে কয়েকটা দিনের জন্য ঈদ না করে আমাকে একা রেখে তুমি চলে যাবে !
আচ্ছা রোজার ঈদ করেই যাব।
না শুধু রোজার ঈদ করলেই হবে না ! রোজার ঈদের দশ বার দিন পরে আমার জন্মদিন। তার তিনদিন পর তোমার জন্মদিন। এগুলো কোন ভাবেই মিস করা যাবে না। তার বিশ বাইশ দিন পর আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। এটার আগে তো কোন ভাবেই আমি তোমাকে ছাড়বো না।
মনে মনে প্রমাদ গোনলাম ! বললাম, সবচেয়ে ভাল হয় একে বারেই না গেলে, কি বলো?
আমার সাথে তামাসা করছ ?
আরে নাহ্, তোমার সাথে তামাসা করার মত সাহস কি আমার আছে না কি?
অদ্ভুত সুন্দর তার চোখ, বড়বড় টানা টানা, একেবারে মা দূর্গার মত, এই চোখের দিকে তাকালে আমার দুনিয়া উলট পালট হয়ে যায়। হঠাৎ এই চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু একটা চিৎকার দিয়েই বললো, "আরে ! তার বিশ বাইশ দিন পর তো আবার কুরবানীর ঈদ" । প্লিজ প্লিজ তুমি একেবারে কুরবানীর ঈদ করে যাও, তাহলে সবকিছু শেষ করে যেতে পারবে।
সাঁতার না জানা এই আমি তখন সেই চোখের গভীর দিশেহারা।
২.
দেশে এসে প্রথমবার লিবিয়ান দূতাবাসে গিয়ে বিশাল একটা ধাক্কা খেলাম। দূতাবাসগুলো বাংলাদেশী পাসপোষ্টধারীদেরকে কি পরিমান তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্ট জমাই দিতে পারলাম না। প্রতিদিন যাই ঘন্টা তিনেক লাইনে দাড়িয়ে থাকার পর একসময় ভীতর থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়; আজকে কোন কাজ হবে না, আগামীকাল বা পরশু আসেন।
একেকটা দিন পার হয় আর আমার উৎকন্ঠা বাড়ে, সেই সাথে নতুনভাবে প্রাণিত হয় বউ এর পটোলচেরা চক্ষুদয়। একেকটা দিন পার হয় আমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি, আর ওর আনন্দ ধরে না। একেকটা দিন পার হয় আর আমার অস্হিরতা বাড়তে থাকে, সেই সাথে বাড়তে থাকে বিবাহবার্ষিকীকে ঘিরে তার নিত্যনতুন পরিকল্পনার । শুধু তার চোখের দিকে তাকিয়ে বিশ্রান্ততা পাই, এই চোখের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর সব কষ্ট, সব না পাওয়া, সব ব্যর্থতাকে ভুলে থাকা যায়।
রোজার ঈদ গেল, বউ এর জন্মদিন গেল, আমার জন্মদিন গেল, একরকম মনস্হির করেই ফেলেছি যে একেবারে কুরবানীর ঈদ করেই যাব, ঠিক এমন সময় সাত তারিখের সাতদিন আগে আচমকা ভিসা হয়ে গেল। সাথে সাথে অফিসকে মেইল করে জানালে, ঐদিনই ওয়েষ্টার্ন ইউনিউনের মাধ্যমে টিকেটের টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বলল যেন তাৎক্ষণিক ফ্লাইট ধরে চলে আসি।
এয়ারলাইন্সে ফোন করে জানতে পারলাম চার তারিখের আগে ঢাকা-ত্রিপলী কোন ফ্লাইট নাই, তার পরের ফ্লাইট এগার তারিখে।
ফোনটা রেখে তাকালাম তার দিকে, দেখি ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কাঁপছে, চোখ ধীরে ধীরে লাল হচ্ছে আর তার কোনায় জমছে বিন্দু বিন্দু জল। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে কাপড়ে ভাঁজ ঠিক করতে করতে বললাম, "চার তারিখেই যেতে হবে কিছু করার নেই, ব্যাপারটা জরুরী"
৩.
খুব কষ্ট হচ্ছিলো, একদিকে বউ এর আবদার আরেক দিকে অফিস; দায়িত্ব, কিছু করার নেই যেতেই হবে।টিকেট কাটতে যাচ্ছি এমন মোবাইল বেজে উঠলো, সে ফোন করেছে। মনটাকে শক্ত করলাম, ধরলাম না ফোনটা, জানি এখনো শেষবারের মত চেষ্টা করছে আমাকে আটকাতে। এখন ফোন ধরলে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা কষ্টকর হবে। চার পাঁচবার ফোনটা কেটে দেওয়ার পর একটা এস.এম.এস পেলাম।
"Plz don't go. Plz"
বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো, মুহুর্তের কেমন একটা দূর্বলতা এসে ছেয়ে গেল মন, ভাবলাম "কি হয় দশ দিন পরে গেলে? তিন দিনের জন্য জীবনের প্রথম বিবাহবার্ষিকীটা ছেড়ে চলে যাবো ? গিয়ে না হয় কোন কিছু একটা বানিয়ে বলে দেবো" । মুহূর্তের জন্যেই, সাথে সাথে মাথা ঝাড়া দিয়ে ক্ষণিকের এই দূর্বলতা ঝেড়ে ফেলে চার তারিখের টিকেট কেটে ফেললাম।
৪.
বিছানায় দু'দিকে মুখ করে শুয়ে আছি পাশাপাশি দু'জন, কারও চোখে ঘুম নেই। টের পাচ্ছিলাম একটু পর পর মৃদু কেঁপে কেঁপে উঠছে তার পিঠ, খুব নিবিড় ভাবে কান পেতে শুনা যাচ্ছিলো তার চাপাস্বরে কান্নার শব্দ। চুপচাপ তাকে কাঁদতে দিচ্ছিলাম, তার ঐ কান্নাভেজা চোখের দিকে তাকানোর মত শক্তি আমার ছিলো না। কাঁদুক, কাঁদলে কষ্ট কিছুটা হলেও হালকা হবে।তোমাদের কত সুবিধা, একটু কষ্ট পেলেই কেঁদে মনটা হালকা করতে পার, আর আমরা ! আমরা তো কাঁদতেও পারি না, আমরা কিভাবে মন হালকা করবো ? আমাদের কষ্টগুলো কিভাবে প্রকাশ করবো? আমাদের কষ্টগুলো কিভাবে লাঘব হবে?
----------------------------------------------------------------
দেবদূতের বিবাহনামা ----- ৫
---------------------------------------------------------------
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ৮:৩৭