১.
অনেক আগে থেকেই আমি বাংলা নাটকের ঘোর ভক্ত। দেশের বাইরে এসেও সেই ভক্তি অটুট ছিলো, আছে এবং আশা করি ভবিষ্যতেও থাকবে। ল্যাবের হাইস্পিড নেট ব্যবহার করে প্রতিদিন দশ বারটা নাটক ডাউনলোড করে নিয়ে যেতাম আর রাতে বসে বসে দেখতাম। গোল বাঁধলো বউ আসার পর, ও বাংলা নাটক দেখে না, ওর পছন্দ হিন্দী সিরিয়াল। সেই কারনে আমার নাটক দেখায় কিছুটা বাঁধা পড়লো, নাটকের পাশাপাশি এখন ইংলিশ ও হিন্দী মুভিও ডাউনলোড করা শুরু করলাম। রাতে খেয়েদেয়ে দুজনে বিছানায় শুয়ে শুয়ে চলতো মুভি দেখা। একটা মুভি দেখা শেষ হলে আমি নাটক দেখা শুরু করতাম, আর বউ মুখ ভার করে পাশে বসে থাকতো অথবা পাশে বসে গল্পের বই নিয়ে বসে যেতো, আবার বেশি বিরক্ত হলে খোলা বারান্দায় বাতাস খেতে চলে যেত।
বিরক্ত হওয়ার সাথে সাথে একটু কষ্টও পেলাম, আমাদের বাংলা নাটক কত বৈচিত্রময়, কত জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী বাংলা সংস্কৃতির একটা ধারা আর আমার বউই কিনা বাংলা নাটক দেখে না ! মনে মনে একটা জিদ চেপে গেলো, তাকে বাংলা নাটকে ফেরাতে মুটামুটি একটা পরিকল্পনা করে ফেললাম। একদিন শুক্রবার আমার নাটক ডট কম থেকে আনিসুল হক এর "সিক্সটি নাইন" নাটকটার একশত পর্ব নামিয়ে দশটি দশটি পর্বে ভাগ করে মোট দশটি ফোন্ডারে সাজিয়ে প্রথম তিনটি ফোল্ডার বাদে বাকি আটটা ফোল্ডার হিডেন করে রেখে দেই ল্যাপটপে।
রাতে খেয়ে দেয়ে বিছানায় আসতেই বউ বললো, আজ কি মুভি দেখাবে ?
উফ্ ! তোমাকে বলতে ভুলে গেছি, আজকে ল্যাবে নেট ডাউন ছিলো, তাই কোন মুভি ডাউন লোড করতে পারিনি। অভিনয় প্রতিভা শূন্যের কোঠায়, কিন্তু বাঙ্গালি জাতির ঐতিহ্য বলে কথা ! মুখে করুন গোবেচারা একটা ভাব ফুঁটিয়ে তুললাম, অনেক কষ্টে।
তাহলে আজকে কি দেখবো ?
দেখি হার্ডডিস্কে পুরনো কোন কিছু পাই কি না। ওহ ! একটা নাটক পেয়েছি, আনিসুল হকের, "সিক্সটি নাইন", দেখবে না কি ? সুপার হিট নাটক, দেখতে পার।
ধুর ! বাংলা নাটক, ফালতু কাহিনী আর ন্যাকা ন্যাকা ডাইলগে ভরা।
হুমম, তোমার হিন্দী সিরিয়াল তো একেকটা ক্লাসিক কাহিনী আর সুপার ডুপার ডাইলগে ভরা !
তুমি কি এখন নাটক দেখা নিয়ে ঝগড়া করবে ?
ঠিক আছে, ক্ষ্যামা দিলাম মাপ চাই, আমি দেখা শুরু করলাম, আর আগামি দুই দিন কিন্তু ছুটি, তাই এ নাটকই দেখতে হবে সারাদিন। বলেই আমি প্রথম পর্ব থেকে দেখা শুরু করলাম।
বউ পাশে বসে গাল ফুঁলিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে শেষে হ্যারিপটারের বই নিয়ে পড়া শুরু করলো, ঐ দিকে আমার কোন বিকার নেই, আমি গভীর মনোযোগে সিক্সটি নাইন দেখছি।
বিছানায় আরাম করে পা দুলিয়ে দুলিয়ে নাটক দেখছি, চোখ স্ক্রিনের দিকে কিন্তু মনোযোগ বউ এর দিকে। কিছুক্ষণ পরে খেয়াল করলাম, যখনই কোন সাসপেন্স সীন আসছে তখনই ও বই থেকে মাথা তুলে মিনিট দুয়েক নাটক দেখছে। তারপর আবার বই এ ফিরে যাচ্ছে । আমি মনে মনে হাসছি, যাক মাছ টোপ না গিললেও ঠুকরাচ্ছে।
টানা দশ পর্ব দেখার পর মনে হলো, শেষের দিকে তার মনোযোগ নাটকে আরও বেড়ে গিয়েছে। নাটকের চরিত্র গুলোকে মুটামুটি চিনে ফেলেছে । ছেড়ে ছেড়ে দেখার কারনে কিছু না বুঝলে আমাকে মাঝে মাঝে প্রশ্নও করছে। আমি উত্তরে হালকা ঝাড়ি দিয়ে বলেছি, "নাটক দেখার সময় বিরক্ত করবে না তো, হয় তুমি মনোযোগ সহকারে পুরা নাটক দেখ না হয় বই পড়, আমাকে জ্বালাবেনা"
ঝাড়িটা ওর ইগোতে লাগলো মনে হয়, সাথে সাথে মুখটা ভার করে বই এ পূর্ণ মনোযোগ দিলো।
২.
প্রথম দশ পর্ব দেখা শেষ, পরের দিন পরের দশ পর্ব শুরু করলাম। এই অংশটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এই দশ পর্বের পরেই হয় সে বাকী আশি পর্ব দেখার আগ্রহ পাবে অথবা বাংলা নাটকের প্রতি আকর্ষণ চিরতরে শেষ হয়ে যাবে।
ঘুম থেকে উঠে, সকালে জম্পেস নাস্তা করে আমি "সিক্সটি নাইন" নিয়ে বসে গেলাম, রাতে ভালো ঘুম হয়েছে, তাই দুইজনের মনটা ফুরফুরে, দেখলাম ও নিজ থেকেই আমার সাথে বসে গেলো নাটক দেখতে অবশ্য হাতে বই ছিলো । কিছুক্ষণ পরেই দেখি সে বইটা বন্ধ করে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে যেটুকু পড়া হয়েছে সেখানে মার্ক করে পুরা মনোযোগ দিয়ে নাটক দেখা শুরু করলো ! আসলে টোপ হিসাবে "সিক্সটি নাইন" নাটকটা পছন্দ করাটা ছিলো আমার খুব ভালো একটা সিদ্ধান্ত, এই নাটকটা তিন চারটা পর্ব দেখলে যে কারও পক্ষে এর আবেদন উপেক্ষা করা অসম্ভব। বেশ কিছুক্ষণ দেখে আবার বই পড়া শুরু করলো, আবার মজাদার কোন সীন বা ডাইলগ আসলেই নাটক দেখা শুরু করে
এক ফাঁকে, যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে তাকে বললাম, "নাটকা খুব জমেছে, তাই না"
হুমম, আনিসুল হক তো ভালো নাটক লেখে !
তাহলে কি আবার প্রথম পর্ব থেকে শুরু করবো ?
নাহ ! থাক ।
বিশতম পর্ব পর্যন্ত একটানে শেষ করে দুপুরের খাবার খেতে গেলাম। খাবার টেবিলে আমি কৌশলে এই নাটক সম্বন্ধে গল্প শুরু করলাম, নাটকের চরিত্রগুলো কোনটা কেমন, কার অভিনয় সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, কোন চরিত্রটা সবচেয়ে মজার ইত্যাদি।
রাতের ডিনার শেষে যখন ল্যাপটপ নিয়ে বসে টুকটাক কাজ করছি তখন সে বললো, "নাটক দেখবে না ?"
ইচ্ছে হচ্ছিলো খুশিতে একটা লাফ দেই, অনেক কষ্টে অনুভূতিটা ঢেকে রেখে বললাম, "তুমি দেখলে দেখবো"
তাহলে শুরু কর।
কিন্তু সবগুলো পর্ব তো ডাউনলোড করা নাই, আর মাত্র দশটা অদেখা পর্ব আছে হার্ডডিস্কে, আর সম্পূর্ণ নাটক একশ পর্বের।
সমস্যা নাই, যতগুলো আছে ততগুলোই দেখি, পরেরটা পরে দেখা যাবে।
বুঝলাম, ওকে বাংলার নাটক ঠিক মতোই পেয়ে বসেছে।
রাতের মধ্যেই ত্রিশ পর্ব পর্যন্ত হজম করে ফেললাম। পরের দিন সকালে উঠে বউ নাস্তা বানাচ্ছে আর আমি টেবিলে বসে নাস্তার জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ শুনি ও গুনগুন করে গান গাচ্ছে, একটু মনোযোগ দিতেই গানের কথাগুলো কানে আসলো,
"তুমি চেয়ে আছ তাই, আমি পথে হেঁটে যাই
হেঁটে হেঁটে দূর বহুদূর যেতে চাই
আনন্দ হাসি মুখ, চেনা চেনা সবখানে
এরই মাঝে চলো মোরা হারিয়ে যাই
তুমি চেয়ে আছ তাই আমি পথে হেঁটে যাই
হেঁটে হেঁটে দূর বহুদূর যেতে চাই"
সিক্সটি নাইন নাটকের ভয়ংকর সুন্দর একটা গান, সে এই গানটা গুনগুন করছে ! যাক, সে এখন পুরাপুরি নাটকের মধ্যে ঢুকে গেছে, মিশন একোমপ্লিশ !
৩.
পরবর্তী ছয় সাত দিন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম দুইজন, প্রতিদিন দশটা পর্ব করে দেখি আর তার পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করি। একদিন ও বলে কি ব্যাপার তুমি দশ পর্ব দশ পর্ব করে ডাউনলোড করো কেন ? একবারে সবগুলো ডাউনলোড করতে পারো না ?
বউ এর আইটি জ্ঞান শূন্যের কোঠায়, বললাম ল্যাবে ডাউনলোড লিমিটেড করা একজন পাঁচশ মেগাবাইটের বেশি একদিনে ডাউনলোড করতে পারে না।
ও! বলে মনটা বিষণ্ণ করে চলে যায় সে।
এটা আমি ইচ্ছা করেই করছিলাম এজন্যে যে, দুই তিন দিনের মধ্যে সব পর্ব শেষ করে ফেললে ঘোর কাটতে না কাটতেই চলে যাবে সময়টা, ফলে হৃদয় দিয়ে উপভোগ করা হয়ে উঠবে না । এটাই যদি দশ সময় নিয়ে দেখা হয় তাহলে অনেক উপভোগ্য ও মনে দীর্ঘ স্হায়ী একটা ছাপ পড়বে ওর।
ক্রমেই জটিল জটিলতর হচ্ছিলো কাহিনী, আমারা তাড়িয়ে তাড়িয়ে গলাধঃকরন করছিলাম প্রতিটি পর্ব । পচাঁনব্বই পর্বের পরে দেখি বউ এর মুখ ভারি হয়ে যাচ্ছে, কাহিনীর এমন করুন টার্ণ নিবে সে মনে হয় কল্পনাও করতে পরেনি। একেবারে শেষ পর্বের আগের পর্ব দেখার সময় তার দিকে তাকিয়ে দেখি ছোখ ছলছল করছে, শেষ পর্বে এসে ক্যান্সারে আক্রান্ত তৃষা যখন মারা যায় তখন তার চোখ দিয়ে ঝড়ছে অশ্রু ধারা !
আমি ডান হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে বুকের মধ্যে চেপে রেখে বা হাতটা পিঠের উপর বুলাতে বুলাতে বললাম, "ধুর বোকা ! নাটক দেখে কেউ কি কাঁদে ?" এগুলা তো মিথ্যা কাহিনী।
আমার বুকের মধ্যে এসে মূহূর্তেই তার চাপা কান্ন হাওমাউ কান্নায় রূপ নিল, গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বললো, মানুষের এত কষ্ট কেন ?
মানুষের মন বড়ই বিচিত্র, অনুভূতিগুলোও ভাইরাসের মত সংক্রামক, তার কান্নার চোটে আমার মনটাও কেমন ভারী হয়ে উঠলো। নারী তোমার এই রূপতো আগে দেখি নাই ! যতই দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি । অদ্ভুত ! শত রঙের শত আবরনে জড়ানো এক হৃদয় তোমার, একেকটা আবরন খুলছি আর অপার্থীব এক রঙের ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে ! অন্তর্দেশীয় হৃদয়ের রঙের দেখা কি এই জনমে পাবো ?
মনে পড়ে গেলো, লুকিয়ে সিগারেট খাওয়ার কারনে রিকসা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছিলে, তারপর তিন দিন কোন ফোন পর্যন্ত রিসিভ করোনি। তোমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনিনি বলে বেড রুম থেকে বের করে দিয়েছিলে, ড্রয়িংরুমের সোফায় তিন ঘন্টা শুয়ে ছিলাম। সেই তুমি আজ নাটকের চরিত্রের কষ্টে কেঁদে বুক ভাসাও !
কি জানি ! আমরা মনে হয় নাটকের চরিত্র থেকেও কম গুরুত্বপূর্ণ ! আমরা তো আসলে স্বামী !
নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে হাসি বের হয়ে গেলো ।
মুখ তুলে বউ অবাক হয়ে বললো, " কি ব্যাপার ? হাসলে কেন ? "
নাহঃ ! এই মধ্যরাতে বেডরুম থেকে বের হয়ে তিন ঘন্টার জন্য ডাইনিং রুমে গিয়ে বসে থাকতে পারবো না, তার গালের উপর থেকে কান্নার জলটা মুছতে মুছতে বললাম "মানে কাঁদলে তোমাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগে তো তাই দেখছিলাম"
----------------------------------------------------------------------------
দেবদূতের বিবাহনামা ----- ৪র্থ পর্ব
বি:দ্র: তিন মাস আগের ঘটনা, অর্ধের লিখে ড্রাফট করে রেখেছিলাম। আজ কমপ্লিট করে পোষ্ট করলাম ।
আর, অবশেষে অর্ধ শতক পূর্ণ হলো
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০০৯ ভোর ৬:৪৫