সাত সকালে মা জননীর ধাক্কা খাইয়া ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠিয়া কি হেতু আমার সাধের ঘুম ভাঙ্গিয়াছ সুধাইতে গিয়া হাতে বাজারের থলের উপর চোখ আটকাইয়া গেলো।আমি আবার বিছানায় একটা গড়ান দিয়া বলিলাম, "সাত সকালে যদি আমাকেই বাজারে যাইতে হইবে তাহলে সুরুজ আলীকে কেন আনিয়াছি !!"
মায়ের জবাব শুনিয়া আমার ব্রক্ষ্মতালু পর্যন্ত গরম হইয়া উঠিলো ! আমি তোতলাতে তোতলাতে আবার জিজ্ঞেস করিলাম, "কি ? সুরুজ বলিয়াছে বাজারে যাওয়া হারাম ?"
মা মুচকি হাসিয়া হতভম্ভ আমার হাতে বাজারের থলে গুজিয়া প্রস্হান করিলো।
অতঃপর আমি মস্তিষ্ক শীতল করিবার নিমিত্তে কবি গুরু স্মরনাপণ্য হইলাম এবং গুন গুন করিয়া আপন মনে গান ধরিলাম ,
"সখি বহে গেল বেলা
শুধু হাসি খেলা
একি আর ভালো লাগে
সখি বহে গেল বেলা"
কিন্তু এই চার লাইনের অধিক স্মরন করিতে না পারিয়া মেজাজ আরও বিগড়িয়া গেল। মনে মনে বলিলাম, চুলোয় যাক কবি গুরু আমার এখন সুরুজ বেটাকে সায়েস্তা করিতে হইবে। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনিত হইলাম যে তাহাকে আমি সাহিত্য অনুরাগী হিসাবে গড়িয়া তুলিবো। ইহাতে তাহার অন্তঃদৃষ্টি প্রসারিত হইবে এবং মানষিকতার বিকাশ ঘটিবে। শুধু মাত্র পন্ডিত হিসাবে গড়িয়া তুলিতে পারিলেই তাহার হারাম বাতিক হইতে পরিত্রান পাইবো।
২.
সুরুজের চোখের কোনায় খুশির একটা আভা ঝিলিক মারিয়া উঠিল, আমি তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া না থাকিলে হয়তোবা তাহা আমার চক্ষু ফাঁকি দিয়া যাইতো। আমি আস্তে আস্তে চাপিয়া রাখা নিঃশ্বাস ছাড়িলাম কারন, আমি অতিশয় দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম এই ভাবিয়া যে, এই না জানি সুরুজ আলী বলিয়া উঠে "বই পড়া হারাম"।
তাক থেকে তাকে তাহার চোখ চলিতে চলিতে হঠাৎ একটা বইয়ের উপরে এসে দৃষ্টি আটকাইয়া গেলো। সে আমাকে সুধাইলো, "ভাইজান, এইডা কি বই?"
আমি ভাবিয়া পাইলাম না এত শত শত বাংলা বই থাকিতে তাহার চক্ষু কি করিয়া একমাত্র ইংরেজী বইটির উপরই পড়িলো !
বইটির লেখকের নাম শুনিয়া সুরুজ আলী মুচকি হাসিয়া কহিলো, "এই ব্যাডা কি লুইচ্চা আছিলো ?"
আমার তো চক্ষুচড়ক গাছ ! আমি রাগত স্বরে বলিলাম, "মানে ? কি বলিতে চাস ?"
সে বলিলো, "না মাইনে হইলো গিয়া, এই ব্যাডা কি খুব সেক্স পছন্দ করতো ?" কেমন নাম ! শেক্স!! পিয়ার !! মানে শেক্সেরে খুব পিয়ার করে !!
আমি বলিলাম, দুই ক্লাস মাদ্রাসা আর তিন পাতা বাংলা বিদ্যা ও বানান করিয়া ইংরেজী পড়িতে পারার জ্ঞান দিয়া শেক্সপিয়ারের নামের ব্যবচ্ছেদের চেষ্টা তোর শোভা পায় না। এখন থেকে তোর কাজ হলো, যখনই সময় পাবি তাক থেকে বই তুলিয়া অধ্যয়ন করবি ।
সুরুজ আলী মাথা ঋজু করিয়া নাড়িয়া কহিলো, "আমি শেক্সপিয়ারের বই পড়ুম"
আমি একখানা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলাম, "ঠিক আছে আগামীকল্য তোর জন্য কোন একখান বঙ্গানুবাদ লইয়া আসিবো।"
৩.
পরবর্তী দিন পনের সুরুজ আলী শেক্সপিয়ারের "রোমিও এন্ড জুলিয়েট" লইয়া পড়িয়া রহিলো। ইত্যবসরে তাহার মধ্যে একটা গুরুগম্ভীর ভাব চলিয়া আসিয়াছে। মাঝে মাঝে তাহাকে আশেপাশের এপার্টমেন্টের কাজের ছেলেমেয়েদের সহিত উচ্চস্বরে বক্তৃতারত অবস্হায় আবিষ্কার করিতে লাগিলাম। সে মুটামুটি তাহাদের নেতা হিসাবে নিজেকে ভাবিতে লাগিলো।
হঠাৎ একদিন সে আসিয়া আমাকে সুধাইলো, "ভাইজান, শেক্সপিয়ারতো কোন লেখকের জাতই না ! হে আবার এত বিখ্যাত হয় কেমনে ?"
নতুন কোন আশংকায় আমার হৃদপিন্ড একটু কাঁপিয়া উঠিলো। আমি জিজ্ঞেস করিলাম, "কেন ? কি হইয়াছে ?"
সে বলিলো, "কি আর কমু, লেখার মধ্যে কোন আগা মাথা নাই, কোন রস নাই, খালি একটানা গাবরের মতো লেইখা গেছে !"
আমি একখানা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলাম, "শোন সুরুজ, শেক্সপিয়ার ঠিকঠাক মতন বুঝিতে হইলে তোকে ইংরেজী নিগূঢ়ভাবে জানিতে হইবে, সমসাময়ীক অন্য লেখকদের লেখা পড়িতে হইবে, ঐ সময়কে বুঝিতে হইবে। আর যদি এই বইটা ছন্নছাড়া মনেই হয় সেইটাতো অনুবাদকের সমস্যা"।
সুরুজ মাথা ঝাকাইতে ঝাকাইতে বলিলো, "ঠিক আছে, কিন্তু দেখেন, প্রথম লাইনেই কত গুলা ভুল! এইযে দেখেন,
------টাইবল্ট, বেনভোলীয়কের উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলে উঠলো, "কাপুরুষ, কাপুরুষ, কিসের শান্তি? আমি শান্তি শব্দটিকে তেমনই ঘৃনা করি যেমন ঘৃনা করি জাহান্নাম, তেমনি ঘৃনা করি সকল মন্টিগদেরকে আর তেমনি ঘৃনা করি তোকে, চালা তোর তরবারী, কাপুরুষ ! কাপুরুষ "--------
এইখানে কাপুরুষ এতবার কেন বলতে হবে ? এইটা কি ভুল না ? আর শেক্সপিয়ার তো আর মুসলমান আছিলো না , তাইলে হে জাহান্নাম কেন লিখবো ? আর অনেকগুলা ব্যাকরনের ভুলও আছে আমার মনে হইতাছে !!
আমি মৃদু হাসিয়া বলিলাম, তোকে আমি ইংরেজীটা পড়ে শুনাই ,
-----"What, drawn, and talk of peace! I hate the word
As I hate hell, all Montagues, and thee:
Have at thee, coward! " ------
এইখানে ভুলের কোন অবকাশ তো নাই বরং ইহা খুবই শ্রুতিমধুর, কিন্তু যেহেতু তোর ইংরেজী জ্ঞ্যান সীমিত তাই তুই ইহাতে কোন রস খুঁজিয়া পাবি না। আর এইখানে কাপুরুষ শব্দও বার বার নাই, নাই তোর জাহান্নাম শব্দ খানাও, আর ব্যাকরনগত ভুলও !! একেবারেই অবান্তর !!
সুরুজ আলী কপালে তাহার সেই বিখ্যাত দুখানা ভাঁজ ফেলিয়া ঠুটে খানিকটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটাইয়া এইবারের মত প্রস্হান করিলো। ভাবখানা এমন, আমার মত মূর্খ সে ইহজনমে দ্বিতীয়টি আর দেখিতে পাইবে না !!
৪.
ভাইজান !! ভাইজান !! করিয়া চিৎকার করিতে করিতে সুরুজ আলী আমার পাশে হাজির ! দেখিতে পাইলাম তাহার চক্ষুদয় খুশিতে ঝলমল ঝলমল করিতেছে। মারাত্মক কিছু ঘটিয়াছে নিশ্চই ! সুধাইলাম, "আবার কি হইয়াছে ?"
সুরুজ আলী বলিলো ভাইজান, আমি প্রতিবার কিছু ভুল ভাল বাইর করি আর আপনি হাইসা উড়াইয়া দেন ! এইবার আমি সত্যি সত্যি মারাত্মক একখান ভুল বাইর কইরা ফালাইছি ! এক্কেবারে বেআইনী কাজ কারবার। দেখেন এইখানে জুলিয়েটের মায়ে জুলিয়েটরে কইতাছে,
----- "আমার হিসাব মতে, তোমার মত চোদ্দ বছর বয়সে আমি তোমার মা হই"---- দেখেন এইখানে শেক্সপীয়ার মাত্র চোদ্দ বছর বয়সের একটা মাইয়ারে আর একটা মাইয়ার মা হওয়াইছে। তার মানে বিয়া হইছে বার কিংবা তের বছর বয়সে। কিন্তু আইনে না আছে আঠারো বছরের নিচে মাইয়াগো বিয়া দেওয়া যাইবো না !
আমি বলিলাম সুরুজ, আমি তোকে মূল লেখাটা পড়িয়া শুনাই,
-------" By my count, I was your mother much upon these years that you are now a maid " ---------
এইখানে কোন বয়সের উল্লেখ নাই। আর আইনতো কয়েকদিন পরপরই বদলাইয়া যায়। আজ আঠারো বছর নির্ধারন করিয়াছে আগামীকল্য বাইশ বছর করিবে। সেইজন্যে কালের ন্যায় অন্যায় ঐ কালের গন্ডির মধ্যেই বিচার করাটা সমীচীন।
আমার এই কথাখানা মনে হইলো সুরুজ আলীর মনপুত হইয়াছে। আমি এতটুকুতেই আনন্দিত হইলাম যে এই যাত্রায় তাহার হাত হইতে নিস্তার পাইয়াছি। তবে একটুখানি কষ্ট পাইলাম এই ভাবিয়া যে, সে তাহার মেধা, শ্রম ও সময়কে শুধুমাত্র অন্যের ভুলত্রুটি খুজিবার নিমিত্যে ব্যায় করিতেছে।
৫.
দিন দশেক নিশ্চিন্তেই অতিক্রান্ত হইয়াছে, মাঝখানে কোন এক দিন সুরুজ আলী শুধুমাত্র একবার আসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছে "পটল" ইংরেজী কি ?
আমি অভিধান ঘাটিয়া তাহাকে বলিয়াছিলাম, "Pointed Gourd".
সে বলিলো, "আমার মনে থাকবো না, আপনে লেইখা দেন"
আমি একখানা কাগজে তা লিখিয়া দিলাম এবং ভুলক্রমেও জিজ্ঞাস করিলাম না পটলের ইংরেজী তাহার কি দরকার পরিয়াছে। কি জানি ! জিজ্ঞাস করিয়া আবার কোন বিপদে পতিত হই, কোন আপদ ডাকিয়া আনি।
হঠাৎ করিয়া সুরুজ আলী আজকে আসিয়া বলিতেছে, "পাইছি , আমি পাইছি। আর রক্ষা নাই, এইবার পাইয়া গেছি"
আমি সুধাইলাম , "কি পাইয়াছিস ?"
সে উত্তর দিলো, "ভুল"
আমার অনেক কষ্টে রোষ সংযম করিয়া বলিলাম, "এইবার কি ভুল পাইয়াছিস ?"
সে বলিলো এইখানে দেখেন,
-----"জুলিয়েট বলিলো, এখন একমাত্র মৃত্যুই আমাদের মিলন ঘটাতে পারে এই বলে সে ছুরিটা নিজের বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো ও আস্তে আস্তে পটল তুললো"-----
আর আপনি আমাকে লেইখা দিছিলেন পটল ইংরেজী "Pointed Gourd". আমি মুল ইংরেজী বই সারাটা খুইজা ভাজা ভাজা কইরা ফালাইছি কিন্তু "Pointed Gourd" নামে কোন শব্দ পাইনাই, এমুন কি এর কাছাকাছি কোন শব্দও পাই নাই।এখন আপনেই কন এইটা কি ভুল না ?
আমি কিছুক্ষন হতম্ভম হইয়া থাকিয়া অবশেষে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলাম এবং মনে মনে নিজের মাথার চুল ছিড়িতে ছিড়িতে বলিলাম ,"মানুষ খাল কাটিয়া কুমির আনে , আর আমি আনিয়াছি পন্ডিত"
-------------------------------------------------------------------
সুরুজ আলীর আগের লেখা পড়তে চাইলে নিচের লিংকে যান
সুরুজ আলীর -- এ হালাল জার্নি উইত সুরুজ আলী
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:২১