সুরুজ আলী, ১২ বছর যাবৎ ধরনী বক্ষে পদযোগলে হাটিয়া বেড়াইতেছে। যদি ধরিয়া নেই জন্মের প্রথম ৫ মাস বিছানায় শুয়ে শুয়ে, পরবর্তী ৩ মাস মা খালাদের কোলে কোলে চড়িয়া এবং পরবর্তী ৪ মাস বসিয়া ও হামাগুড়ি দিয়া তাহার কাটিয়াছে তাহা হইলে তাহার বয়স এখন ১৩ হইবে। আর গায়ের রং, সে কি আর লিখিয়া প্রকাশ করা যায় ? সে একেবারে দুধে আলকাতরা ! উল্লেখ করার মতো একটাই বৈশিষ্ট তার, আমার চোখে পড়িয়াছিলো, তাহা হইলো তাহার কুঁচকানো কপাল। সে এক শিল্পই বলিতে হইবে। দুই চোখ দুই পাশদিয়া একটু চাপিয়া ধরিয়া কপালে গুনিয়া গুনিয়া ২ টা ভাঁজ ফেলিয়া রাখিতো, সেইটা যে অনেক দিনের সাধনা বলিতেই হইবে।
এই সুরুজ আলীর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ গত কুরবানীর ঈদের আগের ঈদে মহিষের মাংসের তিন ভাগের এক ভাগ মিসকিনদের মাঝে বন্টন করিবার ঠিক আগের মহুর্তে।
তাহার পিতা আমার সামনে বসিয়া সেই কি আহাজারি! বলিতে লাগিলেন, বাবা আপনেরা বড়লোক মানুষ, আপনেরা যদি আমরারে না দেহেন তাইলে আমরা কৈ যামু ?
আমি বলিলাম, তো কি দেখিতে হইবে?
তিনি বলিলেন, আমার এই পোলাটারে যদি কোন একটা কামে লাগাইয়া দিতেন? এই বলিয়া তিনি বিকট একটা ধমক দিয়া সুরুজ আলীকে বলিলেন, "আহম্মক কোনহানকার, ভাইজানের পায়ে ধইরা সেলাম কর!"
আমি, কি করিস, আরে করিস কি বলিয়া পিছাইতে লাগিলাম, কিন্তু সুরুজ গোখরার মতো ক্ষিপ্রতায়, কেঙ্গারুর মতো লাফাইয়া আমার পদযুগল আকড়াইয়া ধরিলো। আর সেই যে ধরিয়া রহিলো তো রহিলোই আর ছাড়িবার কোন লক্ষন দেখিতে পাইলাম না। আমার বুঝিতে আর বাকি রহিলোনা যে এই রত্নধনের কোন গতি করিবার প্রতিশ্রুতি না দিয়া আমি এই যাত্রায় রক্ষা পাইবোনা।
বলিলাম, পড়াশুনা কতটুকুন করিয়াছিস?
সে উত্তর দিলো, ৩ বছর মাদ্রাসায় পড়ইরা শেষে ঐখান থেকে উস্তাদের মাইর খাইয়া পলাইয়া চইলা আয়া পরি। তাহার পর আব্বা আমারে ইস্কুলে ভর্তি কইরা দেয়, সেইখানে কেলাস ফাইব পর্যন্ত পড়ছি।
সুধাইলাম, তাহলেতো তুই বাংলা, ইংরেজী ও আরবী এই তিনটি ভাষাই লিখিতে ও পড়িতে পারিস?
সে সুধু উত্তরে একটু মাথা ঝাকাইলো, আমিও বুঝিতে পারিলাম দৌড় বেশি না হইলেও অন্ততঃ বানান করিয়া হইলেও ৩ টি ভাষা পড়িতে পারে।
জিজ্ঞেস করিলাম, কী ? বাসা বাড়ির কাজ করিতে পারবি ? মানে বাজার করা, বাড়িঘর ঝাড়ু দেওয়া, কেউ আসিলে গেট খুলিয়া দেওয়া, কী পারবি না ?
সুরুজের বাবা বলিলেন, পারিবেনা মানে? ১০০ বার পারিবে। আর যদি না পারে তাইলে, বটি দিয়া দুই টুকরা কইরা বুড়িগঙ্গায় ফেলাইয়া দিবেন, তবুও গ্রামে আর ফিরিয়া আনিবেন না।
২.
চাচাতো ভাইকে বলিলাম, আমাদের দুইজনকে হোন্ডায় করিয়া একটু রেলষ্টেশনে পৌছিয়ে দিয়ে আয়। সবকিছু ঠিকই ছিলো হঠাৎ করিয়া সুরুজ আলী বাকিয়া বসিলো।
সে বলিলো ভাইজান, এই হোন্ডা তো কোরিয়ানরা বানাইছে, আর ঐ বেটারাতো কুত্তা খাওরা পাবলিক, এইসব হারাম জিনিষ খাইয়া কি হালাল জিনিষ তৈয়ারি করা সম্ভম ? তাই এই হোন্ডাতে চাড়াই হারাম।
আমিতো হতবাক ! ছেলে ইহা কি বলিলো ? আমি ভাবিতে লাগিলাম ইহা কি তাহার ২ বছর মাদ্রাসায় পড়িবার ফালাফল , না কি ইতর মস্তিষ্কের ইতরামি?
অবশেষে পকেট হইতে ২০ টাকা হালাল করিয়া হালাল রিকসায় চড়িয়া রেলষ্টেশনে পৌছাইলাম।
আমি বলিলাম, কি রে? এখন যে ট্রেনে আমরা যাইবো ইহাতো সুইজারল্যান্ড, ইহুদি নাসারাদের দেশ হইতে আনা হইয়াছে ! তাহলে কি এই রেলে চড়াও হারাম?
সে বলিলো, ভাইজান যে কি সব বলেন না ! আরে এই ট্রেন যে তেল দিয়া চলে সেই তেল সৌদি হইতে আনা। আর তেলই তো ট্রেনের খাওন, মাইনে শক্তি আহে এই তেল থেইকা, তেলই হইলো ট্রেইনের কইলজা,
বুঝিলাম সে বলিতে চাহিতেছে, হৃদয় ঠিক থাকিলে কর্মও হালাল হইয়া যায়।
৩.
এই ডাব, এই....ই ডাব, এইদিকে আসেন। কত করিয়া রাখিবেন প্রতি পিস?
স্যার, একদাম ১৫ টেকা কইরা প্রতি পিস।
বলিলাম, মিঞা....... বোকা পাইয়াছেন আমাকে ? ২০ টাকা দিবো ২ টা ডাব, পুষাইলে দিয়া জান না হইলে যান।
ডাব ওয়ালা বলিল স্যার ঠিক আছে আপনার কাছে কিনা দামেই ডাব বেচিবো।
মুচকি হাসিয়া বলিলাম বেশ বেশ, তাই করেন।
সুরুজ বলিয়া উঠিলো, ভাইজান এই ডাবতো খাওয়া হারাম।
এইবার আমার চক্ষুদয় উল্টিয়া গেল ! বলিলাম, কেন হইবে ? এই ডাবতো আর কুকুর খাদকদের দেশ হইতে আসে নাই ?
সে বলিল, ডাব ওয়ালা মিসা কতা কইছে, হে অবশ্য অবশ্য কিনা দরে আপনেরে ডাব দিবো না। আর যেহেতু হে মিসা কতা কইয়া ডাব বেচতেছে সুতরাং এই ডাব খাওয়া আমাদের ঠিক হইবো না।
সুধাইলাম, তুই কি করিয়া নিশ্চিত হইলি? সে তো সত্যি কথাও বলিতে পারে?
উত্তরে সুরুজ বলিলো, সে যদি হাছা কতা কইয়াও থাকে তবুও এই ডাব হারাম, কারন হইলো গিয়া তার মুঞ্জুরি আপনি দিতাছেন না। আর শ্রমিকের মুঞ্জুরি তাহার ঘাম শুকাইয়া যাইবা আগেই দিয়া দেওন ইসলামের বিধান। আর আপনি মুঞ্জুরি ছাড়া, বিনা লাভে তার কাছ থাইকা ডাব কিনবেন?
আমার মাথায় আগুন ধরিয়া গেল, কারন ট্রেনে উঠিয়া ডাব খাই নাই এমন ট্রেন জার্নি করিয়াছি বলিয়া মনে পড়িতেছে না! আমি রাগিয়া বলিলাম , ঠিক আছে তোর ডাব খাইতে হইবে না। আমিই এই হারাম ডাব ২ টা হালাল করিয়া ফেলি। আর তুই ঝালমুড়ি খা, ঠিক আছে ?
অবাক হইয়া দেখিলাম, সে নিশ্চিন্ত মনে ঝলমুড়ি খাইতেছে, কোন রকম হালাল হারাম বিবেচনা না করিয়া। আমি আর কোন কথা বাড়াইলাম না।
৪.
বলিলাম সুরুজ, ট্রেন মনে হয় ক্রসিং-এ পড়িয়াছে। কমপক্ষে ৪০ মিনিট। চল ঐ যে স্টেশনের পাশে মসজিদটা দেখা যাইতেছে ঐখানে আসরের নামাজটা পড়িয়া আসি।
জবাবে সুরুজ বলিয়া উঠিলো ভাইজান, মসজিদ যদি হালাল টাকায় না বানানো হইয়া থাকে তা হইলে এই মসজিদে নামাজ পড়া হারাম।
শুনিয়া আমার মস্তিষ্কে যেন হাতুড়ির বাড়ি পড়িলো। অনেক কষ্টে মেজাজ ঠিক রাখিয়া বলিলাম, ঠিক আছে চল আগে মুসুল্লিদেরকে জিজ্ঞাসা করিয়া লইবো, মসজিদটা কে বানাইয়াছেন।
হযরত মাওলানা হাজী মোহাম্মদ সৈয়দ কলিমদ্দিন সাহেব প্রায় ১০০ শত বছর আগে এই মসজিদ বানিয়েছেন। তিনি শুধু নিজের জমির ধান বেচিয়া এই টাকা দিয়া এই মসজিদ বানাইয়া ছিলেন। বড়ই কামেল আদমি ছিলেন এই মাওলানা সাহেব" - ইহা বলিয়া ঐ মুসুল্লি সাহেব চোখ মুছিতে মুছিতে চলিয়া গেলেন।
আমি দেখিলাম, সুরুজের মুখমন্ডল আমবস্যার চাঁদের ন্যায় হইয়া গিয়াছে। বুঝিতে পারিলাম না, কারন কি? এখন নামাজ পড়িতে হইবে সেই জন্যে নাকি মসজিদ বানানোর টাকার উৎসের ব্যপারে তাহার সন্দেহ এখনও রহিয়া গিয়াছে ?
সে হঠাৎ বলিয়া উঠিলো, ভাইজান দেখেন অজুখানা আর টাট্টিখানা পাশাপাশি। এইখানেতো অজু করা হারাম।
বলিলাম ঠিক আছে, চল ঐ পুকুর থেকে অজু করিয়া আসি।
মুখ ভার করিয়া সে আমার সহিত অজু করিয়া আসিলো।
মসজিদে ঢুকার ঠিক আগের মূহুর্তে সে বলিয়া উঠিলো ভাইজান, এই মসজিদতো নাপাক হইয়া গিয়াছে!
মানে ?
ঐ যে দেখেন, মিনারের উপরে মাইকের উপর একটা কাক বসিয়া আছে। এই মাত্র কাকটা মাইকের উপরে হাগিয়া দিয়াছে। আর গু, মুত তো অবশ্যই নাপাক জিনিস, ঠিক না ? তাহলেতো পুরা মসজিদটাই নাপাক হইয়া গিয়াছে, কি বলেন ?
আমি কিছুক্ষন চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলাম ঠিক আছে, তুই ট্রেনে গিয়ে বসিয়া থাক আমি নামাজ শেষ করিয়া আসিতেছি।
৫.
এই সুরুজ আলী আমার সাথে আছে প্রায় পোনে দুই বছর। অনেক চেষ্টা করিয়াও এখন পর্যন্ত তাহার এই হারাম হালাল বিষয়টা ক্লিয়ার করিতে পারি নাই। পরে অবশ্য জানিতে পারিয়াছিলাম নামাজ পড়িবার সময় হাসিয়া দিবার কারনে মাদ্রাসার হুজুর তাকে বেদম মাইর দিয়াছিলো। তার ফলাফল ঐ মাদ্রাসা পলায়ন এবং নামাজ না পড়িবার নানা বাহানা। আরও জানিতে পারিয়াছিলাম যে প্রতিবেশীর গাছের ডাব চুরি করিবার সময় একবার হাতেনাতে ধরা খাইয়া বেদম মাইর খাইয়া ছিলো। তবে এখন পর্যন্ত তাহার হোন্ডা বিদ্বেষের কারন বাহির করিতে পারি নাই।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০০৮ সকাল ৯:৫৭