দেখতে দেখতে ৫ বছরের অধিক সময় সৌদি আরবে কেটে গেল। আলো ঝলমলে নগরীতে হাসি আছে, আনন্দ আছে, দুঃখ ও বেদনাও আছে। রাতগুলো কারো কাছে যেমন দীর্ঘ, পাশাপাশি অনেকের কাছে তা খুবই ছোট।
আমি দেখছি- আরব বিশ্ব নিয়ে আমাদের প্রায় সবার মাঝেই মিশ্র অনুভূতি আছে। অস্বীকার করার উপায় নেই। ভালো মন্দে মেশানো যেকোন সমাজ। দিনশেষে আপনি নিজে কিভাবে নিজের জীবনটাকে দেখতে চেয়েছেন তাই বড় হয়ে দাঁড়ায়।
আমার এই অল্প সময়ে সৌদি আরবকে যেমনটা দেখেছি তার কিছু ভালো দিক আজকে তুলে ধরলাম।
সালাম ও নামাজঃ
আমার এমনও হয়েছে ঢাকা হতে ট্রেনে সিলেট যাচ্ছি অথচ পাশের সিটের যাত্রীর সাথে একটি কথাও হয়নি। কিন্তু সৌদি আরবে এটা কল্পনাও করা যাবেনা। কেউ কাউকে চেনেনা- সালাম দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে যাচ্ছে। সালাম দেয়ার সাথে সাথে তাদের মাঝের দূরত্ব দূর হয়ে যায়।
মরুভূমির মাঝ দিয়ে গাড়ী যাচ্ছে। নামাজের সময় হয়ে গেল। সৌদিরা গাড়ী থামিয়ে মাদুর বিছিয়ে নামাজ আদায় করে নেয়। তার দেখাদেখি অন্যান্য গাড়ীগুলো থেমে যায়।
এখানে হাইওয়েগুলোর পাশে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্যাস স্টেশন, খাবার দোকান ও একটি মসজিদ থাকবেই। দুইজন লোক হলেই এর জামাত বানিয়ে নামাজ পড়বে। যদিও এখানে ধর্মীয় পুলিশ আছে, তারা নামাজের তাগাদা দেয়। কিন্তু রাস্তায় গাড়ী থামিয়ে নামাজ পড়াটা নিজের ভেতর থেকেই আসে।
নিমন্ত্রণঃ
সাথে ফ্যামিলি না থাকলে, কোন সৌদি খাচ্ছে এবং আপনি তাকে সালাম দিলেন অথচ তার সাথে খেতে বলবেনা তা ভাবাই যায় না। খাওয়ানোটা পূন্যের কাজ। মসজিদগুলোতে অনেকেই পানির বাক্স রেখে যায় শুধুমাত্র সন্তুষ্টি লাভের আশায়। রোজার সময় পানি দান করাটা অনেক বেড়ে যায়। পৌর অফিস রাস্তার পাশে শহর জুড়ে রেফ্রিজারেটর বসিয়েছে-সৌদিরা সেখানে খাবার, ফলমূল, জুস ও পানি রেখে দেয় যাতে যে কেউ প্রয়োজনমত নিয়ে খেতে পারে।
সাহায্য প্রাপ্তিঃ
আমি ৫ বছরেও ভালোমত আরবি বলতে পারিনা। সঠিক আরবি না জানার কারনে আমরা কোনকিছু সৌদিদের বুঝাতে পারিনা। অথচ তারা অনেক সাহায্যপরায়ন। ঠিকমত বুঝাতে পারলে সাহায্য করবেই। একবার বৃষ্টির মাঝে সাঈদের গাড়ীর চাকা পাংচার হয়ে যায়। ইশারা করতেই অল্পবয়সী দুই সৌদি বৃষ্টিতে নেমে এল, কাঁদা মাখানো চাকা পাল্টাতে নেমে গেল।
সস্তা খাবারঃ
কয়েকটি দেশ ভ্রমণের কারনে বুঝতে পেরেছি সৌদি আরবের লিভিং কষ্ট খুবই কম। এখানকার চেয়ে সস্তা খাবার আর কোথাও পাওয়া যাবেনা। তেলের দাম কম হওয়ায় আনুষাঙ্গিক অনেক কিছুর খরচই কমে যায়। ১ রিয়ালে ৬ টি রুটি অথবা ১টি বিশাল সাইজের আফগানি রুটি (তমিজ) পাওয়া যায়। কেউ নূন্যতম ৩ রিয়াল খরচ করলে খুব সহজেই পেট ভরে নাস্তা করতে পারবে। শর্মা এখানে খুব সাধারণ একটি খাবার। আমরা অন্য কিছু না পেলে ১টা শর্মা খেয়ে থাকি। আমাদের দেশে শর্মা খেতে গিয়ে সেলফি তোলে নাই এমন লোক বিরল, ফেসবুকে সাথে সাথে স্ট্যাটাস চলে আসে।
বিভিন্ন দেশের লোক থাকার কারনে সব দেশের খাবারই এখানে পাওয়া যায়। সৌদিতে এসে কখনো বাংলাদেশি খাবার মিস করিনি। আমার এক পরিচিত টিএ স্কলারশিপ নিয়ে ইউকে পড়তে গেছে। তার সাথে কথা হল। ওখানে লিভিং কস্ট এত বেশী যে সে হিমশিম খাচ্ছে। পাস্তা, নুডুলস কিনতেই নাকি তার বারবার পাউন্ডের হিসাব কষতে হয়। আর স্কলারশিপের একটা বড় অংশই এ্যাপার্টমেন্ট ভাড়ার পেছনে চলে যায়।
উপভোগ্য জীবনঃ
অলসদের তালিকায় সৌদি আরব তৃতীয় হয়েছিল। এদের মতো টেনশন ফ্রি জীবন কেউ বোধয় লিড করেনা। ১৫ জন ধরে এমন সাইজের জিএমসি গাড়ী নিয়ে বাসা হতে বের হয়ে যাবে, রাস্তার ধারে কিংবা পার্কে বসে ফ্যামিলির সাথে অলস সময় পার করবে। গাড়ী ও মোবাইল সেট পাল্টানো সাধারণ ব্যাপার। সামাজিক নিরাপত্তা থাকার কারনে হাতে যা টাকা আসে, সবটাই প্রায় খরচ করে ফেলে।
লং ড্রাইভ, কার ড্রিফটিং, রাত জেগে ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে শিসা টানা এদের শখ।
ইনফ্রাস্ট্রাকচারঃ
টাকা থাকলেই যে তার সঠিক ব্যবহার হবে তা নয়। তবে সৌদি আরব তার যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ ভালোভাবেই গড়ে তুলেছে। এখানে একটি গ্রামের রাস্তা ঢাকা-চিটাগাং রোডের চেয়েও ভালো। হাইওয়েতে একেক পাশেই ৮টি করে লেইন থাকে।
যদিও সম্প্রতি তেলের দাম কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু তা হাতের নাগালেই। এখন ১ লিটার তেলের সর্বোচ্চ দাম ৯০ পয়সা। এত সস্তায় ভ্রমণ আর কোথাও সম্ভব নয়। সবাই গাড়ী নিয়ে দূরে কোথাও চলে যায়। পাহাড় পেড়িয়ে সমূদ্রের তীরে ভীড় লেগেই থাকে।
জ্ঞান চাইঃ
বিগত ৫০ বছর বিত্ত বৈভবের অপচয় হয়েছে অনেক। কিন্তু প্রয়াত বাদশাহ আবদুল্লাহ সমাজ সংস্কার ও প্রচলিত ব্যবস্থার সমন্বয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেন। উনি সৌদি স্টুডেন্টদের জন্য “কিং আব্দুল্লাহ স্কলারশিপ” চালু করেন। প্রায় ৬০,০০০ সৌদি স্টুডেন্ট শুধুমাত্র আমেরিকায় লেখাপড়া করছে। এভাবে সারা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে সৌদি স্টুডেন্টরা ছড়িয়ে আছে। দেশের অভ্যন্তরে তৈরি হয়েছে একাধিক মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়। কিং আব্দুল্লাহ ইউনিভার্সিটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রিসার্চ বেসড ইউনিভার্সিটি হিসাবে অল্প কয়েকদিনেই বেশ নাম করে ফেলেছে। তেমনি কিং ফাহাদ ইউনিভার্সিটি অব পেট্রোলিয়াম এণ্ড মিনারেলস বিশ্বের অন্যতম ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি।
উট হতে মার্সিডিজ হাতে পাওয়া সৌদিরা বর্তমান সময়ে একটি knowledge based Economy’র দ্বারপ্রান্তে।
ব্যাংক একাউন্টঃ
একটা ব্যাংক একাউন্ট খুলতে এখানে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট লাগে, সাথে সাথেই ভিসা কার্ড দিয়ে দেয়। রেফারেন্সের বালাই নাই, প্রাথমিক ডিপোজিটের দরকার নাই। প্রতিটি নাগরিক ও এক্সপেট এখানে স্বতন্ত্র রেসিডেন্ট আইডি বহন করে। এই আইডি ছাড়া এখানে কোন কিছুই করা সম্ভব নয়।
ট্যাক্স ফ্রি ইনকামঃ
ট্যাক্স ফ্রি কান্ট্রি হিসাবে যে কয়টি দেশের নাম সামনে আসে তার প্রায় সবগুলোই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ। সৌদি আরব একটি অন্যতম ট্যাক্স ফ্রি কান্ট্রি। আমরা যা আয় করি তার পুরোটাই নেট ইনকাম। অনেক ইউরোপিয়ান, আমেরিকান শুধুমাত্র এই সুবিধাটুকো নেবার জন্য এ অঞ্চলে চাকরি করতে আসে। এমনকি আমরা সরকারের দেয়া বিভিন্ন ভর্তুকি সুবিধাগুলো পর্যন্ত ভোগ করে থাকি।
অনেকে আছেন যারা এই দেশকে বিভিন্নভাবে গালিগালাজ করেন, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন কিন্তু বছরের পর বছর চাকরি করে যান, সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন। একটি দেশ পরিচালনার জন্য সরকারকে অনেক অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আর মধ্যপ্রাচ্যের মত একটি অগ্নিগর্ভ জায়গায় দেশ পরিচালনা বিশ্বের অন্যান্য জায়গার চেয়ে অনেক বেশী কঠিন। এই সত্যটি আমাদের সবাইকে অনুধাবন করতে হবে, তাহলেই সম্পূর্ণ চিত্রটি আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হবে।
সার্ভিস বেনেফিটসঃ
আমরা বছরে ২ মাস পেইড গ্রীষ্মের ছুটি পাই, হজ্জ্বের সময় ১০ দিন ছুটি থাকে এবং সেমিস্টারের মাঝে ১ সপ্তাহ করে ছুটি পাই। ইউনিভার্সিটি আমাদের এয়ার টিকিটের ব্যবস্থা করে, হাউজিং এলাউন্স দেয়। আমাদের মেডিকেল খরচ সম্পূর্ণভাবে বহন করা হয়। পাশাপাশি কেউ চাকুরি ছেড়ে দিলে গ্রাচুইটি দেয়া হয়। এমনকি প্রথমবার চাকরিতে জয়েন করার সাথে সাথে ফার্নিচার কেনার জন্য এককালীন টাকা দেয়া হয়।
আমার একবার ৫০ পয়সার হিসাব মেলানোর জন্য একটি স্যালারি দিতে ৩ মাস দেরী করেছিল। আমি বলেছিলাম আমাকে ৫০ পয়সা ছাড়াই বেতন দাও, কিন্তু তারা তা করেনি। হিসাব মেলাতেই হবে। ব্যক্তিখাতে অনিয়ম থাকলেও সরকারি চাকরিতে কড়ায়গণ্ডায় হিসাব বুঝিয়ে দেয়া হয়। আমার ওয়াইফ চাকরি ছাড়ার ১ সপ্তাহের মাঝে ব্যাংকে সকল টাকা চলে আসে। এরকম সুবিধা কয়টি দেশে আছে? বাংলাদেশে সার্ভিস বেনেফিটস উঠাতে জুতোর তলা ক্ষয় হয়ে যায়।
ব্যবসায়ঃ
এদেশে অনেকেই মাত্র ৫০০ রিয়াল বেতনের চাকরি নিয়ে আসে। যারা বুদ্ধিমান তারা কোনভাবে একটা ব্যবসায় শুরু করে দেয়। যাদের স্পন্সর ভালো, তারা ব্যবসায়ে অনেক উন্নতি করে। এদেশে ব্যবসায়’র চেয়ে ভালো আর কিছু নেই। এমন অনেককেই দেখেছি যিনি এখানে কৃষি ক্ষেত করেন অথবা একটা মুদি দোকান আছে যারা কোটি কোটি টাকার মালিক।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যঃ
আমার সৌভাগ্য হয়েছে এই পাঁচ বছরে সৌদি আরবের বেশ কিছু জায়গা ঘুরে দেখার- আল উলা’র সামুদদের শহর, নাজরানের আল উখদুদ, অপরূপ সুন্দর ফারাসান আইল্যান্ড, জিজানের ওয়াদি লাজাব। ভ্রমণ বিধিনিষেধ থাকার কারনে বহিঃবিশ্বের পর্যটকেরা এসব জায়গা খুব একটা এক্সপ্লোর করতে পারেনি। তাই জায়গাগুলো এখনো প্রকৃতির আদি রুপেই আছে।
মরুর সৌন্দর্য্য, ওয়াদি, বুনো ঝোপ, নগরায়ন সব কিছুই নতুন ভ্রমণপিপাসুদের নয়ন জুড়াবে।
নিজের জন্য অঢেল সময়ঃ
আমাদের অফিস সাধারণত দুপুর ২ টায় শেষ হয়ে যায়। তারপর নিজের প্রিয়জনদেরকে দেয়ার মতো সারাদিন অনেক সময় পরে থাকে। সপ্তাহে দুইদিন ছুটি থাকে। এমন আয়েশি জীবন আমাদের প্রায় সবাই ঢাকাতেও পায়নি। তারপরও অনেকেই সময়কে খুঁজে পায় না, কিছু করার জন্য সময় হাতড়ে বেড়ায়। এরা আসলে তারুণ্যের মায়াজালে বৃদ্ধের প্রতিরূপ। সময় কখনো থেমে থাকে না। অঢেল এ সময়কে আমরা কতটুকো সঠিক ব্যবহার করতে পারছি?
মক্কা ও মদীনাঃ
ইসলাম ধর্মপ্রান মুসলমানদের জন্য মক্কা ও মদীনা তাদের চিন্তা ও চেতনায় বিশাল জায়গা জুড়ে থাকে। সৌদি আরবে যারা থাকেন স্বভাবতই তারা অন্যদের তুলনায় এ স্থানদুটিতে ঈবাদতের জন্য বেশী বেশী ভ্রমণ করার সুযোগ পান। মক্কা ও মদীনা হৃদয়কে আলোড়িত করে, শুদ্ধভাবে বেঁচে থাকার পথ দেখায়।
আগামী কোন একপর্বে “নেগেটিভস” নিয়ে লেখা যাবে। আমার আরব ডায়েরি’র ১০০ তম পর্বে আপনাদের সবাইকে স্বাগতম। আপনাদের ভালোলাগা, ভালোবাসা আমাকে এতদূর লিখতে সাহায্য করেছে।
(ছবিঃ ইন্টারনেট)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:৪১