১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
বাংলাদেশি ভাই আমাদের জানালেন খুব কাছেই কুয়াগুলো আছে। আর সেখানকার পাহাড়েই ছবি ও লিপিগুলো দেখা যাবে। আমরা কোন রিস্ক নিতে চাইলাম না, ভাইকে আমাদের সাথে নিয়ে নিলাম। ২/৩ মিনিটের মাঝেই আমরা কুয়াগুলোর কাছে পৌছে গেলাম।
কাউকাব পাহাড়সারির বিশাল এলাকা জুড়ে পাহাড়ে খোদিত লিপি আর ছবি পাওয়া গেছে। আরো পাওয়া গেছে ৬ টি প্রাচীন কুয়া (কুপ)। এই প্রত্নত্বাত্তিক নিদর্শনগুলোর কোন কোনটি প্রায় ৯০০০ বছরের পুরনো, কিছু ইসলাম পূর্ববর্তী সময়ের নিদর্শনও আছে। ১৮৮০ সালে অস্ট্রিয়ান ভদ্রলোক এডওয়ার্ড গ্লিজার নাজরানের পাহাড়গুলোতে বিভিন্ন ধরনের লিপি ও ছবি খুঁজে পান। তারপরেই তা আধুনিক বিশ্বের সামনে প্রকাশিত হয়। লিপিগুলো ছিল মূলত Himyarite (প্রাচীন ইয়েমেনের ভাষা) ও Egyptian হায়ারোগ্লিফিকস।
কুয়াগুলোকে সবাই ‘বির হিমা’ নামে চিনে। পাহাড়ের মাঝখানের মনোরম একটি ভ্যালিতে বিশাল কুপগুলোর অবস্থান। আমরা অবাক বিষ্ময়ে দেখলাম। আমাদের অবস্থা এমন যে, কিছু একটা দেখলেই অবাক হয়ে যাই। কিন্তু সত্যি বলছি, জীবনে এধরনের সুযোগ কমই আসবে।
সাঈদ পর্যন্ত স্বীকার করল, এখানে আসাটা সঠিক কাজ হয়েছে। আসলে সে যেহেতু গাড়ী ঠিক করেছিল, তাই সে মাইলেজ নিয়ে চিন্তিত ছিল। অতিরিক্ত ৩০০ কিমি ভ্রমণ করা চাট্টিখানি কথা না। পাশাপাশি ড্রাইভার সাহেব রাজি হবেন কিনা, সেটাও ভাবনার বিষয় ছিল। আমরা ‘বির হিমা’ আসার জন্য ড্রাইভার সাহেবকে অতিরিক্ত টাকা দেই, যাতে সাঈদের দুঃশ্চিন্তা দূর হয়েছিল।
আমরা কুয়ার কাছে গেলাম। কুয়াগুলোর উপরের দিকটা উঁচু করে দেয়া হয়েছে যাতে কোন অঘটন না ঘটে । ভেতরে তাকিয়ে দেখলাম এখনো পানি আছে, নীচ থেকে যে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল, তা বুঝতে পারছিলাম। কয়েকটি কুয়া বালিতে ভর্তি, অল্প স্যাতস্যাতে পানি। ২ টি কুয়া এখনো অনেক গভীর, পানি অনেক টলটলে । এইদুটি কুয়ার পানি আশেপাশের অধিবাসীরা ব্যবহার করে ও নাজরান নিয়ে যাওয়া হয়। অবাক হলাম, রুব-আল-খালি’র পাশের এই মরুতে কিভাবে এত পানি আসে! নিশ্চয়ই অনেক গভীরে কোন নদী আছে, যেখানে বৃষ্টির পানি জমা হয়। আর তা হতে এই কুয়ায় পানি আসে। আর এজন্যই এখানে একসময় বসতী গড়ে উঠেছিল।
একদিন সুপেয় পানির জন্য যুদ্ধ হবে। লিবিয়াতে নাকি ভূঅভ্যন্তরে বিশাল এক নদীর সন্ধান পাওয়া গেছে যা দিয়ে পুরো আফ্রিকার চাহিদা মেটানো সম্ভব।
একটি গ্রুপ ছবি তোলার জন্য কুয়ার পাশে দাঁড়ালাম। আলীমকে আমার নতুন কেনা নিকন ক্যামেরাটি দিলাম। মাদায়েন সালেহ ভ্রমণে আমার আগের ক্যামেরাটি নষ্ট করেছি। তাই একটু সতর্ক ছিলাম, কিন্তু লাভ হলো না। আলীম আমার ক্যামেরা নিতে গিয়ে ফেলে দিল। আঁতকে উঠলাম, কিন্তু ক্যামেরাটি বালিতে পড়ায় তেমন কিছু হলো না- তবে আঁচড় থেকে গেল।
দীবাকে দেখলাম একা ঘুরে ঘুরে দেখছে। মিলন, লিজা ছবি তোলায় ব্যস্ত। আমি ও শাকিলা কুয়াগুলোতে উঁকি মেরে দেখছিলাম। এদিকে সাইফুল ভাইয়ের দেখা নেই। ওনাকে আর বাংলাদেশি ভাইকে খুঁজে পেলাম একটি সংরক্ষিত এলাকার ভেতর। পাহাড়ের একটি অংশ তারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। একটি জায়গায় ফাঁকা, আমরা সেখান দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। পাহাড়ের গায়ে বিভিন্ন লিপি, ছবি আঁকা আছে। পাহাড়ে আঁকা ছবি দেখে বুঝা গেল এ এলাকায় একসময় উট, গরু, ভেড়া, হরিণ, উটপাখি, কুকুর পাওয়া যেত। শিকারিরা তীর ধনুক দিয়ে শিকার করছে – এমন ছবি আঁকা আছে। এক যোদ্ধার ছবিও আঁকা আছে।
আমরা সবাই ছবি তুললাম। এমন সুযোগতো বারে বারে আসেনা। রাজীব ভাই আগেরবার এখানে ঢুকেননি। ওনার জন্যও নতুন অভিজ্ঞতা। এদিকে সূধা যেন একেবারে বাচ্চা মানুষ হয়ে গেছে। বারবার একই প্রশ্ন-‘তারা কেন পাহাড়ে খোদাই করে লিখল?’ যেন সে চাইছিল- প্রিন্টারে কগজ ঢুকিয়ে প্রিন্ট দিলেইতো পারত। না হেসে পারলাম না। আরো একটি পাহাড় পেলাম, কিন্তু তারের বেড়া দিয়ে ভালোভাবে ঘেরা। ফাঁকফোকড় না থাকায় ঢুকতে পারলাম না।
অবিষ্মরনীয় এক অনুভূতি বুকে নিয়ে আল-ওখদুদের পথে চললাম।
যদিও আমরা কেউই নিশ্চিত নই- ৯০০০ বছর প্রাচীন ছবি, লিপি আর কুয়াগুলো আ’দ জাতির কিনা, আদৌ তারা এখানে বসবাস করতো কিনা। কিন্তু কুয়ার আকার আর প্রাচীন ছবির কারনে আমার মনে হয়েছে আ’দ জাতি কোন একসময় এখানে থেকেও থাকতে পারে। একসময় ইয়েমেন ও নাজরানের বিশাল এলাকা নিয়ে হযরত হুদ (আঃ) এর আ’দ জাতি বসবাস করত যারা আল্লাহকে অমান্য করায় ধ্বংস হয়ে যায়।
প্রাসঙ্গিক হওয়ায় আগামী পর্বে আ’দ জাতির কাহিনী বর্ণনা করার লোভ সামলাতে পারছি না।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১৩ রাত ২:০২