সাম্প্রতিক ইস্যু নিয়ে আমি সাধারণত লেখালেখি করিনা। আমার পছন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্য কবিতা। কিন্তু কবিতাদি দিয়ে তো আর অর্থনীতি বোঝা চলে না। অর্থনীতি বোঝার জন্য জানা চাই একটু সমসাময়িক ব্যাংক রেট, জিডিপি, রিজার্ভ, ট্যাক্স, রেপো, রিভার্স রেপো রেট, বিভিন্ন চুক্তিনামা।
সেই অর্থনীতির হালকা হাল বুঝতে গিয়ে দেখলাম ( যদিওবা সব মাথার উপ্রে দিয়ে যায়) আমাদের বানিজ্য এখনো অন্যদেশের হালহকিকতের উপর নির্ভরশীল। এই যেমন দেখুন আমাদের পোশাক শিল্পটির ৭৩ ভাগ আমেরিকা আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের গন্তব্যে যায়। তাই দেশ বিদেশের ব্যবসা বানিজ্য নিয়ে আমাদের মাথা খাটাতেই হয়। কারণ ওদের ভাল তো আমাদের ভাল। হিসাবটা কাটা বাংলায় খুবই সহজ। ওদের টাকা হলে তবেই না তারা আমাদের পণ্য কিনবে। যদি ওদের টাকা না থাকে তবে কিনবে না। তখন আমাদের ব্যবসার বাত্তি লাল হয়ে যাবে। আর আমাদের ব্যবসার বাত্তি লাল হলে কি হয় তা ভেবে দেখতে ১৯৯০ সালের দিকের অর্থনীতির হাল বুঝতে গেলেই পরিষ্কার বুঝা যায়।
যাকগে আসল কথায় আসি, আমি কোন অর্থনীতিবিদ নই, অর্থনীতির কিছুই বুঝি না। একজন আম পাবলিক। তাই ব্রিটিশ জনগণ সম্পর্কিত আমার আইডিয়া ছিল তারা মাথা মোটা, নাক উঁচু জাতি। সে হিসেবেই তাদের মুল্যায়ন করেছিলাম। কিন্তু ইতিহাসে সবচেয়ে সফল জাতির নাগরিকগণ কতটা সচেতন সেটা আমার মত তৃতীয় বিশ্বের একজন চুনোপুটির মাথায় ছিল না। কেন কবিতা লেখা বাদ দিয়ে ব্রিটিশদের মত হাড়ে হারামীদের (bad to bone) গুনগান গাইলাম সেটা বাকি লেখাটা পড়লেই বুঝবেন।
ব্রেক্সিট
ব্রেক্সিট জিনিসটা যখন প্রথম শুনি মাথার উপ্রে দিয়ে গিয়েছিল। বিষয়টা সিরিয়াস হল যখন আমার বন্ধুবর একদিন বললেল ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটিশরা বিদায় নিল বন্ধু এবার আমাদের কি হবে? আমি তো অবাক! এই যুগে ব্রিটিশরা এমন ভুল ক্যামনে করল আহারে! মাথা মোটা বলে গালিও দিলাম। তবুও মনের খুচখুচি মেটাতে কেন বিদায় নিল দেখতে গুগলে সার্চ দিলাম। হাজার হাজার লেখা। ইকোনোমিস্ট, গার্ডিয়ান, ডেইলি মিরর, ওয়াশিংটন পোষ্ট, সানডে টাইমস ইত্যাদি হালের অনলাইন জার্নাল পড়ে, দেশী প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ, যুগান্তর, বনিক বার্তা ইত্যাদি পড়ে বুঝলাম ব্রিটিশ জনগন এক মহাকান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। তেইশে জুলাইয়ে ৫১. ৯ ভাগ জনগন ইইউ ত্যাগ করার পক্ষে ভোট দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন তারা তাদের স্বাধীন সার্বভৌম দেশে ভীনদেশী রিফিউজি দেখতে চান না। তারা চান না তাদের স্বাস্থ্যসেবা, চাকুরী, সুযোগ সুবিধায় অন্য কেউ ভাগ বসাক। তবে এর মধ্যে অনেক কিছুই আছে। সে সব লেখতে গেলে একখানা ৮০০ পৃষ্ঠার বইও কম হয়ে যাবে।
ইউনাইটেড ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টির নাইজেল ফারাজ এই ব্রেক্সিটকে বলেছেন "স্বাধীনতা দিবস"। তা তো বলবেনই। যে জাতি অন্যদের উপর ছড়ি ঘুরিয়েছে তারা কি কারো আদেশ নিষেধ মানতে পারে। ব্রাসেলসের কর্তাবাবুদের বানিজ্যনীতি, শিক্ষা সংস্কৃতির ছবক লন্ডন নিবে কেন? ব্রিটিশ জনগনের গায়ে এসব জ্বালা ধরিয়েছে। তবে সবাই এক নন। যেমন দেখুন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ার, ফুটবলার ডেভিড ব্যাকহাম, বেচারা ডেভিড ক্যামেরুন। এরা সবাই চেয়েছিলেন ব্রিটেনবাসী ইইউতে থাকুক। সভ্যতা এগিয়ে যাক। কিন্তু ব্রিটিশ জনগন তাদের আঙিনায় পূর্ব ইউরোপের মাইগ্রেনিং জনগন, সিরিয়া, ইরাক, আফগানি শরণার্থী জনগনের উপস্থিতি মেনে নিতে চান নি। অনেকে বাংলাদেশী তাদের এই ইস্যুতে গালাগাল দিতে পারে কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা ধরা খেয়ে যাবে।
১৯৫৭ সালে "ইস্পাত ও কোল কমিউনিটি" প্রতিষ্ঠা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপের ঘুরে দারানোর প্রচেষ্টা মাত্র। এরপর বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্সও ইটালি মিলে গঠন করে "ইউরোপিয়ান ইকোনোমিক কমিউনিটি। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে ব্রিটিশরা যোগ দিল। ১৯৮৬ সালে অবাধ চলাচলের জন্য শেনজেন চুক্তি এবং শেষে ১৯৯৩ সালে ম্যাসট্রিচট চুক্তি হয়েই ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত হয়। এরপর ১৯৯৯ সালে রবার্ট মুন্ডেল ইউরো চালু করলেন। কিন্তু ব্রিটিশরা ইউরো নয়, ঐতিহ্যবাহী পাউন্ডশিলিং চালু রাখলেন। এ এক অনন্য জাতিসত্তার স্বকীয়তার অনুপম নিদর্শন।
আধুনিক যুগে যখন বিশ্ব বড় বড় জোট গঠিত করে বিশ্বকে নতুন পথে নিতে আগুয়ান তখনি ব্রিটিশ জনগনের প্রথাগত সেকেলে প্রবল জাত্যভিমান, স্বকীয়তা, নাক উঁচু গর্ব বোধকে অনেকের মত আমিও গোঁয়ার্তুমির শেষ বলে ধরে নিয়েছিলাম কিন্তু অবশেষে সেটা আমার কাছে ভালই লেগেছে। যে জাতিসত্তার প্রবল আগুনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হল, বিশ্ব পুড়ে ছাড়খার হল, সেই জাতিসত্তাই হতে পারে ইউরোপের নতুন মুক্তির সনদ। তাই বলে আমি কিন্তু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিপক্ষে নই। বিষয়টা অনেকটাই জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি ভাবনার খোরাক।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে উপমহাদেশীয় মানুষগণ বুঝেছে ব্রিটিশ কি জিনিস। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৫০০ মিলিয়ন মানুষের বাজার হতে, ২৮টি দেশের, ২৪টি জাতির, ২০টি ভিন্ন ভাষাভাষী গোষ্ঠীর মিলনমেলায় ব্রিটিশ জাতি ব্রেক্সিট করে নিজেদের সংস্কৃতি, নিজেদের ঐতিহ্য, নিজেদের উঁচুদরের নাক, আর ব্যবসা বানিজ্য বাচায় নি বরং পথ দেখিয়েছে ফ্রেক্সিট (ফ্রান্সের ইইউ লিভ), নেক্সিট ( নেদারল্যান্ডের ইউ লিভ), ইতালিভের ( ইতালির ইইউ লিভ), ইউরোপের হাজার বছরের সংস্কৃতির সংরক্ষনের। খুব শীঘ্রই হয়ত আরেকটি দেশ ইইউ লিভের জন্য রেফারেনডাম দিলে অবাক হব না।
(ব্রেক্সিট নিয়ে হালকা কিছু পড়ে লেখাটি লেখা। তবে অনেক কিছুই লেখা বাকি রয়ে গেছে। পরবর্তী দু তিন পর্বে ব্রেক্সিট ও স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে লেখব ভাবছি। আগ্রহীরা সাথেই থাকুন।)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৫:৩৯