আসমানের উজ্জ্বলতা ফিকে হয়ে আসছে।ইফতারের সময় হয়ে এল। চারদিক বুন্দিয়া,ছোলা, পেঁয়াজু বড়া, বেগুনী, বাখরখানি, হালিম, গরুর চাপ, নানা বিরিয়ানি, কালভুনা, জালি কাবাব, বটি কাবাব, খাসির পায়া, মগজ ভাজির গন্ধে ভুরভুর করছে। হাওয়াই লাড্ডুর পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ছোট বেলায় একসময় জিহ্বায় জল আসত, ইফতারি দেখে তেমনি মনে হল মেরাজের। দলে দলে মুসল্লির দল সারা দিনের সংযম যজ্ঞ পালন করে বাজারে এসেছে ইফতারি কিনতে। তাদের অভুক্ত মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এই গরমের লম্বা দিনে রোজা রাখতে তাদের খুবই কষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে দুপুর থেকে বিকেলের সময়টা। বুকে পাথর আর পেটে খিল দিয়ে আসে।
মেরাজ প্রতিবার সব রোজা করে। তার মা বাবা পরহেজগার লোক ছিলেন। ছোটবেলায় মেরাজ বাবার সাথে রোজা রাখত। অর্ধেক, সোয়া, সকাল দুপুরবেলা পর্যন্ত। সে কথা মনে এলে মেরাজের হাসি আসে।
রাস্তার দুধারে লোকে ভরে গেছে। সাদা পাঞ্জাবী পড়া একজন সুঠাম লোকের চোখে চোখ মিলে গেল তার। চেনা চেনা মনে হল কিন্তু চিনতে না পারলেও স্মৃতির দীঘিতে ঠিকি ঢিল পড়ল। কিন্তু কোন কিছু বোঝে ওঠার আগেই এক মহিলার কন্ঠে ডাক এল অ্যাই সিএনজি!
মেরাজঃ জ্বী মেডাম বলেন?
মেডামঃ গুলশান যাবা?
মেরাজঃ জ্বী যামু। তয় ভাড়া মিটারে দিতে হবে।
মেডামঃ মিটারে কেন? ও বুঝছি। জ্যামে ফেলায় ভাড়া বাড়াইবা।
মেরাজঃ জ্বী না ম্যাডাম, আমি মিটারে ছাড়া যাই না।
মেডাম ইতিউতি তাকাল। দূর থেকে দূর রাস্তার মাথা মানুষে ভরা। সব পরহেজগার মানুষ। মেডাম লাল ঠোটে ফোঁড়ন কাটলেন। বিড়বিড় করে কি জানি বললেন তারপর বললেন-
ঠিক আছে চল চল। দ্রুত যেতে হবে কিন্তু। দেরী করবা না বুঝলা। আমাকে গিয়ে এঞ্জেলিনার খাবার ওষুধ দিতে হবে।
কত নিবা বল?
মেরাজ বলে ঠিক আছে ঠিক আছে! আপনি ঊঠেন। ভাড়া যা মনে হয় দিয়েন।
মেরাজ দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দেয়। গেট খুলে দিলে মেডাম গাড়িতে উঠে বসে। মেরাজ সাধারনত গাড়িতে যাত্রী উঠিয়ে তাদের দিকে একবার গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। গভীর ভাবে নাক টেনে গন্ধ শুঁকে নেয় বনের পশুদের মত। এই মানুষের জংগলে পশুর অভাব নেই। বহুরূপে ঘুরে বেড়ায় এরা। একবার ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে কোর্ট টাই প্যান্ট গায়ে চোখে দুর্দান্ত সানগ্লাস লাগিয়ে এক নারী গাড়ীতে উঠেছিল। সারা রাস্তায় গল্প। কিসব মেশিনগান, ট্যাংক নিয়ে গল্প। মেরাজ ভেবেছিল মহিলা সেনা কর্মকর্তা হবে। কিন্তু মিরপুর এক টালারবাগ পানির ট্যাংকির গলি দিয়ে ঢুকলেই ওই নারী ও তার দলবল মিলে মেরাজের সব টাকা ছিনতাই করে নেয়। এরপর থেকে মেরাজ সাবধান। যে কেঊ গাড়িতে উঠলে সে অস্বাভাবিক বোধ করে। মনে হয় এই বুঝি পিস্তল বের করে বলবে, শালা যা আছে দে।
এসব ভাবতে ভাবতেই গাড়ি নিয়ে সে মহাখালীতে চলে আসে। মহিলা কাকে জানি ফোন দেয়।
হ্যালো হ্যালো, এই যে শফিক, তুমি ভাল আছ?
কি অবস্থা বলত?
আমার মেয়ে কেমন আছে?
ও ঠিক থাকবে তো! অসুস্থ হবেনা তো।তুমি কিন্তু বাসায় থাকবা? বের হবা না আমি না আসা পর্যন্ত। মেরাজ ভয় পায়। মহিলাকে আয়নায় দেখার চেষ্টা করে।
মাঝ বয়েসি। গাঢ় মেকাপ করা। দামী শাড়ি। উঁচু চোখের অশান্ত চাহনী কিন্তু মাঝে মাঝেই কেপে উঠছে চোখের পাতা। মেয়ের অসুস্থতায় খুব দুশ্চিন্তায় আছে।
ভাল ভদ্রঘরের মানুষ। মেরাজ স্বস্তি ফেলে। মানুষ যে চেনা কত দায়, মেরাজ তা হাড়ে হাড়ে বোঝেছে। শহর গ্রাম সব খানেই মানুষগুলো কেমন জানি অস্থির। কিন্তু এই মহিলার সুরুত দেখেই বোঝা যায় অনেক শান্ত, ঠান্ডা। মেরাজ গুলশান রোডে সিএনজি উঠিয়ে দেয়। রাস্তা ফাকা। ইফতারের দোকানে সব মানুষ তাই রাস্তায় শুন্যতা। ইফতার করতে হবে। কিন্তু তার আগে পেসেঞ্জার কে তার মেয়ের কাছে নিরাপদে পৌঁছাতে হবে। সে নিশ্চয় রোজা আছে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝা যায় মেয়ের জন্য তার উদ্দিগ্নতা।
এই সিএনজি থাম।
গুলশান ক্লাবের সামনে দুটো মোটর সাইকেল দ্রুতগতিতে সিএনজির পাশে এসে দাঁড়ায়। মেরাজ কিছুই বোঝে ওঠতে পারছে না। কেন সিএনজি থামাবে। গাড়িতে পেসেঞ্জার তোলা তবুও কেন সিএনজি থামাতে হবে বোঝেনা সে। আলতো করে স্পিড টা কমিয়ে নেয় সে।
পেছনের সিটের মহিলা চিৎকার করে বলে দ্রুত যাও, দ্রুত যাও। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।
মেরাজের গায়ে বিদ্যুৎ খেলে যায়। মুহুর্তেই গাড়ির গিয়ারিংটা বাড়িয়ে সোজা টান মারে। বা দিকের বাইকটা বেয়াড়া হতে সামনে আসার চেষ্টা করলে বামে একটু চেপে দেয় মেরাজ।ব্যাস চলন্ত রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে থাকে বাইকটা। আরেকটা বাইক সামনের দিকে দ্রুত গতিতে ছুটে যায়। বাইকের পেছনের লোকটি পিছনের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। সিএনজি ও সিএনজিওয়ালাকে।
শান বাধানো দশতলা বাড়ির সামনে মহিলার হাতের ইশারায় গাড়ি থামায় মেরাজ। সিএনজি থামলেই বাড়ির দারোয়ান দৌড়ে এসে গাড়ির গেটে টান মারে আর বারবার বলতে থাকে-
স্লামালিকুম ম্যাডাম, স্লামালিকুম ম্যাডাম।
বলেই মেরাজের দিকে তাকিয়ে একটা প্রতিযোগীমূলক হাসি দেয়। আসলে এই এলাকার দারোয়ান গুলা এক একটা কুত্তা। ওদের কাজ হল পাচাটা।
মেরাজ ওর দিকে থেকে চোখ সরিয়ে বাসার দিকে নজর দেয়। ঝকঝকে মার্বেল পাথর দিয়ে বাধা গেটের ভেতরের প্রতিটি দেওয়াল, মেঝে। সাজানো সবুজ ফুলের টবে বাহারিয়া ফুল, ঝিরঝির জল ঝরে পড়ছে আঙিনার মাঝখানটার চৌবাচ্চায়।
মহিলা নেমেই চেঁচাতে চেঁচাতে প্রায় দৌড়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
এই আব্দুল এই আব্দুল??
তিনি আব্দুলকে খোজতে ব্যস্ত। কিছুক্ষনেত মধ্যেই মাগরীবের আজান। ইফতারি করতে হবে। মেরাজ দাড়োয়ানকে ভাড়ার টাকার কথা বলতে বলে। দারোয়ান বলে উপরে ফোন দিতে হবে, বাইরে দাড়া তুই।
মেরাজ বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে। মিনিট খানেক পড়ে ম্যাডামের ডাক আসে। বাসার ম্যানেজার ডেকে বলে- এই সিএনজি উপড়ে এসো।
মেরাজ ধীর পায়ে উপরে উঠতে থাকে। চকচকে মেঝে। আয়নার মত ছবি দেখা যায়। মেরাজ এই প্রাসাদের সৌন্দর্য দেখে আবিভূত হতে থাকে। জীবনেও এত সুন্দর বাসা দেখেনি সে। নাটক সিনেমায় বহু দেখেছে কিন্তু এত সুন্দর নয়। দরজার কারুকাজ, দেওয়ালে টাংগানো নকশা, সিঁড়ির বনেদিপনা, চোখকাড়া কারবার। হুট করে সে অনুভব করে তার খিধেটা নিভে গেছে।
দরজা খুলে বাসার অন্দর মহলে ঢুকতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। বিশাল অন্দরমহল! ঝাউবাতি, আলিশান টেবিল, সাজানো কত খাবার। এবার মেরাজের ক্ষুধা দ্বিগুন হয়ে যায়।
টেবিলে খাবার নিয়ে মহিলা ও তার মেয়ে বসে আছেন। মেয়েটি অসুস্থ। চোখের নিচে কালশিটে পড়েছে। হরর ছবির নায়িকার মত লাগছে। কিন্তু তবুও মেয়েটার হাসিটা যে সুন্দর সেটা কিন্তু স্পষ্ট।
হলরুমের পাশেই রান্নাঘর। মেরাজকে ম্যানেজার সেদিক পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে।
শফিক, এই শফিক ওকে এদিকে নিয়ে এসো। মেরাজ ম্যাডামের টেবিলের দিকে এগিয়ে চলে। টেবিলটা অনেক মজবুত আর ভারী। দেখেই বোঝা যাচ্ছে জাদরেল কোন গাছ কেটে এটা বানানো।
টেবিলের পাশে গিয়ে লজ্জিত ভঙ্গীতে দাড়ায় মেরাজ। এতদিন রাস্তাঘাটে কি খেয়েছে সেটা শুধু সে জানে। আজ একাদশে বৃহস্পতি। মহিলা তার দিকে তাকিয়ে বলে-
এখানে বস। তুমি আমাদের সাথে ইফতারি করবে। এই যে বুয়া ওকে খাবার তুলে দাও তো। শফিক তুমি ইফতার করে আমার এপয়েন্টমেন্ট বুকটা নিয়ে এসো।
আজান হল। সবাই ইফতারি খাচ্ছে। মেরাজ ইফতারি মুখে দিয়ে ভাবল, আজ জান্নাতি খাবার খাচ্ছে সে। আনন্দে তার চোখে পানি এসে গেল। মহিলা সেটা দেখে ফেলল।
কি ব্যাপার বল তো? তুমি কাঁদছ কেন? খাবার ভাল লাগেনি?
মেরাজঃ জ্বী না ম্যাডাম, মনে হল জান্নাতি খাবার খাচ্ছি, আল্লাহু বরকত দিচ্ছে তার বান্দার উপর। কিন্তু বাসায় বউ বাচ্চার কথা মনে পড়ে গেল। তাই একটু চোখে জল এল।
মহিলাঃ আহারে!!
আচ্ছা সিএনজি তোমার নাম টা কি বল তো? সেটাই তো জানা হল না।
- জ্বি আমার নাম মেরাজ। ঢাকায় আসছি তিন মাস।
- হুম। তুমি আর কি কি চালাতে পার।
- জ্বী আমি তেমন কিছু চালাতে পাড়িনা।
- কার চালাতে পারবে?
- জ্বী জানি না!
মেরাজ অবাক হয়। কেন এসব প্রশ্ন। তবে কি এ বাসায় গাড়ি চালাতে হবে। হোক না তাতে মন্দ কি! যদি রোজগার কটা বাড়ে তো মন্দ কি? ঢাকায় বউ বাচ্চা নিয়ে একটা ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে পারবে।
ইফতার শেষ হলে ম্যানেজার শফিক আসে। ম্যাডাম আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক বলে সে বইটা এগিয়ে দেয়।
শফিক তুমি কাল থেকে মেরাজের এখানে থাকার ব্যবস্থা কর আর গাড়ি চালানো শেখাও। আঘামী মাস থেকে ও আমার গাড়ি চালাবে বুঝেছ।
শফিকঃ জ্বী জ্বী জ্বী ম্যাডাম! অবশ্যই! অবশ্যই!
মেরাজ মনে মনে ভাবে, রিজিকের মালিক আল্লাহ। কখন কার কপালে কি আসে কোন ঠিক নাই। এই যে, এই মহিলাকে সিএনজিতে ওঠানোর আগে সে ভাবতেও পারেনি যে এই মহিলা তার সামনের দিনগুলিতেও এভাবেই তার কাছে পরিবহন সেবা পেতে চাইবে।
মেরাজ ম্যাডামের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে আসে। কাল থেকে তার নতুন চাকুরী। মনে শিহরণ জেগে ওঠে।
দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামে মেরাজ। গেট খুলে বাইরে আসে। দারোয়ান কে দেখে মুচকি হেসে বলে- এরপর থেকে আমার আসা যাওয়ার জন্য প্রতিদিন গেট খোলা লাগবে তোর। বুঝলি!
লুকিয়ে দেখে সে দারোয়ানের মুখ ঝুলে গেছে। দারোয়ান জীবনেও যা ভাবেনি দেখেনি আজ তা দেখল। তার মাথায় এখন কিছুই ঢুকবে না। জ্বী জ্বী করা লোকদের মাথায় কোন সুবুদ্ধিই নেই কুটনামি ছাড়া। যার কারনে যখন তারা হেরে যায় বা তাদের থেকে কেউ ভাল কিছু করে তখন তাদের পিত্তি জ্বলে যায়।
মেরাজ সে কথা ভাবছে না। সে ভাবছে কতদ্রুত সে বউ বাচ্চা নিয়ে একসাথে থাকতে পারবে। আপাতত এটাই তার আসল লক্ষ্য। আর সে জন্য সে ম্যাডামকে না বলতে পারেনি।
এই মহিলার সাথে কাজ করা যে জীবনের জন্য ঝুঁকিপুর্ন সেটা সে ভালই বোঝেছে। রাস্তায় দাড় করানো সিএনজিটা তখন তাকে ডাকছে। কাল থেকে এটা গ্যারেজে পড়ে থাকবে সেটা তার মন বিষাদে ভরিয়ে দিল। ঠিক তখনি একটা লালসাদা হোৎকা মোটরসাইকেলে দুজন লোক সাঁ করে তার দিকে ছুরি চালিয়ে ভয় দেখিয়ে ছুট লাগাল।
মেরাজ দ্রুতগতিতে সিএনজি স্টার্ট দিয়ে ওদের পিছু নিল। বাম দিকের গলি দিয়ে গাড়িটা ভো ভো করে উড়ে যেতে লাগল।
চলবে--
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৩