একফালি মাটির কাচা গন্ধে ভুরভুর করছে চারিপাশ। সকাল থেকে অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে গেছে সবকিছু। এই বৈশাখের আগমনী দিন গুলো বড়ই পাগলামি জানে। ঠিক যেন ষোড়শীর মত গাল ফুলিয়ে তেড়ে আসে, এরপর ঘন ঘন করাৎ করাৎ করে বিজলি নামায়। তারপর তার ঘনকাল চুলের মত মেঘেদের গাম্ভীর্য। তারপর টুপটাপ বৃষ্টি। এমনি দিনে ইচ্ছেরা ডানা মেলে শখ হয় বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে নাচতে। কিন্তু মেরাজ পারে না। বড়ই বেমানান লাগে এই ইটকাঠের শহরে ভিজতে। অবশ্য গ্রামে থাকতে সে প্রায়ই দল বেধে এমন দিনে ভিজত। আম কুড়াতো। কত মজাই না করত। সিএনজির চালকের সীটে বসে ভাবুক হয়ে যায় সে।
ঢাকা শহরে হুটহাট বৃষ্টি দেখে আজ তার মন খারাপ। কত গুলো জল অযথাই নষ্ট হল। আহারে! এই জল রাস্তা গড়িয়ে ড্রেনে যাবে, তারপর সেখানে পলিথিন, ময়লায় মিশবে, কোথাও উথলে উঠে জলবদ্ধতা হবে, গাড়ীর চাক্কার বিয়ারিং এ জং ধরাবে, অপচয়ের পানি বয়ে যাবে বুড়িগঙ্গার খালে, সেখান থেকে সমুদ্রে। কোথাও একটা ঘাসও জন্মাবে না। কেন যে ঢাকায় বৃষ্টি হয়। আজব আল্লাহর বিচার। গায়ে বৃষ্টি হলে সে আজ শহরে আসত না। বাপের দুই কানি জমিতে জমসে হাল চালাত। ঘরের পোয়াতি বউরে আর কষ্ট করে দুধের গরুটার যত্ন নেওয়া লাগত না। বউটার ভাবতেই চোখ ভিজে জল আসে তার। তিনমাস হল গ্রামে যায় না। সবাই কে কেমন আছে খোজ নেওয়া হয় না।
অ্যাই সি এন জি, অ্যাই। মধ্যবয়েসি দুইটা মানুষ ডাকছে। কোর্টটাই পরা, চোখে সানগ্লাস, সুন্দর চেহেরা। দেখেই বুঝল কোথাও ঘুরতে ফিরতে যাবে। হাক শুনে সিএনজি থেকে মেরাজ বলে,
কই যাইবেন?
উত্তরা যাইবা?
কত নাম্বার সেক্টর?
১৪ নাম্বার। যাইবা!
হ যামু।
ভাড়া কত?
মিটারে যা আসে তাই দিয়েন!
ধুর ব্যাটা। কিয়ের মিটার। শর্টকাট দিয়া জলদি চল ভাড়া বাড়ায় দিমু।
উঠেন বলেই মেরাজ সিএনজির গেট খুলে দেয়। বাটকু মানুষটি সিএনজিতে উঠেই সিগ্রেট জ্বালায়।
লম্বা ছেলেটা পাশের বাটকু ছেলেটাকে বলছে
"দোস্ত ব্যবসা কইরা মজা নাই পাব্লিক অনেক চালাক হয়ে গেছে।ভাল মন্দ বুঝে।"
বাটকু সিগ্রেটে বড় করে টান মারে বলে হ তাই না। আরে ব্যাটা পাব্লিক চালাক হয় নাই, পাব্লিক আজীবন গাধা ছিল আছে থাকবে। এদের চালাকি হইল ছাগলের মত। ভাদ্রমাসে ঘাস খায় বাছে বাছে পরের বর্ষাকালে নিমপাতা খায়।
লম্বুঃ হ হাচা কইছস দোস্ত। সেদিন আমার অফিসে দুইটা কাস্টমার আসল। ভাল ভাল কিছু ডিজাইন দেখাইলাম। নিল না। পরে কি মনে কইরা গত বছরের কিছু ফেব্রিক্স সেম্পল দেখাইলাম। শালারা নিয়া নিল। দাম ও নিলাম ডবল। চোখ থাকতেও অন্ধ। হা হা হা। বেচারা পাব্লিক গুলা কাপড় পরবে মাগার জিন্দেগীতেও বুঝবে না কাপড় আসল না, নকল।
বাটকুঃ কস কি? কাপড়ে কি দিছিল।
লম্বুঃ কিছুই না ওয়াশ দিয়া ছাইড়া দিছি। হা হা হা।
প্রতি পিসে লাভ করছি দেড়শ পার্সেন্ট।
বাটকুঃ দোস্ত তাইলে তোর গার্মেন্টস ব্যবসা লালে লাল।
লম্বুঃ হ, সামনে দেখি ইলেকশানে যামু। সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড মেম্বার হইতে মন চায়। ক দোস্ত হমু না, ক।
বাটকুঃ আরে ব্যাটা হবি হবি। মঞ্জু ভাইয়ের লগেই তো আছিস। তোর কাজ না হয়ে যাবে কই।
ভাই রে খালি মাঝে মাঝে দুই চাইরটা বান্ডিল দিলেই তো তোর কাজ হয়ে যাবে।
খ্যাক খ্যাক খ্যাঁক।
লম্বুর মোবাইলে ফোন আসে।
লম্বু মোবাইল বের করে ফোন দেয়। জানু কি কর। তুমি পার্লারে যাবানা। শোন চুলটা কিন্তু ঘোড়ার লেজের মত কাটিও না। একটু স্টাইল কইরা কাটাবা। ওই যে দিপিকা পাদুকোন স্টাইল আরকি। আইচ্ছা আমার বাসায় ফিরেতে কিন্তু রাত হবে। ক্লাইন্টদের অফিসিয়াল মিটিং আছে। তুমি খায় নিও।রাখি তাইলে। উম্মা উম্মা। লাভ ইউ জানু। হ্যা হ্যা হ্যা। বাই বাই টা টা।
লম্বুঃ দোস্ত তোর ভাবি কল দিছে। চুল কাটাতে পার্লার যায় আরকি। আমাকে খুব মিস করে তো তাই ফোন দিছে।
বাটকুঃ হ দোস্ত তোমারে কিন্তু প্রিন্সেস মিথিলাও বহুত মিস করতেছে। মিটিং জমাইতে হইব আইজক্যা। খ্যাঁক খ্যাঁক।
হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায় দুজনে। মেরাজের চান্দি গরম হয়ে যায় এই দুই লাল্টুবাজের চাটুলতায়। জীবনেও ভাবেনি ইন্টার পাশ করে এমন দুই ফালতু টাইপের সমবয়সী মানুষকে নিয়ে গাড়ি চালাতে হবে। বাবা বেচে থাকলে তার পড়াটা মাঝপথে থেমে যেত না। এখন আর পড়ার বয়স নেই। আফসোস আর আফসোস! জীবনের প্রতি তার অনেক অভিযোগ। ট্রাফিক পেড়িয়ে সে এগিয়ে যায় আর ভাবে জীবনে আর যাই হোক সে মন্দ নয়। ছয় মাস হয়ে গেল ঢাকায় এসে সে কোন নারীর দিকে তাকায় না। আর এরা ঘরের বউ বাসায় রেখে চলে আরেক নারীর ভোগে। হায়রে মানুষ। রাগে তার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে করাৎ করাৎ। আজকের দিনের বিজলীর মত। এক্সিলারেটর বাড়িয়ে গন্তব্য সড়কে এসে যায়। লম্বু আর বাটকু নেমে ভাড়া দিতে গিয়ে পঞ্চাশ টাকা মিটার থেকে কম দেয়। কিছুই প্রতিবাদ করে না সে। লম্বু বাটু রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগ্রেট ধরায়। হুট করে তার মন আনন্দে ভরে উঠে। মাথায় একটা দারুন বুদ্ধি খেলে যায়। ভাড়া নিয়েই সিএনজি দ্রুত ঘুরিয়ে নেয়।
শীরদাড়া সোজা করে রাস্তার মাথায় দ্রুত সে সিএনজি ঘুরিয়ে নেয়। এরপর দ্রুত গতিতে লম্বু আর বাটুর দিকে এগিয়ে যায় সে। বৃষ্টির জল জমে আছে রাস্তার ধারের গর্ত ভরে। গাড়ি ঘুরাতে গিয়ে মেপে এসেছে তার কার্যকরী প্রয়োগ। কিভাবে সেটা প্রয়োগ হবে সেটা ভেবেই চকচক করে উঠে তার চঞ্চল দুটি চোখ।ঢাকা শহরে এটাই হবে তার নির্মল বিনোদন খেলা।মেরাজ মনে মনে বলে, ঢাকার রাস্তায় আরো বৃষ্টি চাই, আরো বৃষ্টি। তখনি মেঘে মেঘে শুরু হয় করাৎ করাৎ!
ষোড়শী যেন সজোরে সায় দিচ্ছে।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৪