'ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস' পদে লোক নিয়োগের ঘুষের টাকার ভাগ দিতে ঢাকায় গিয়েছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা! তিনি ওই পদে ৪০০ জনকে নিয়োগের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন গত সপ্তাহে। এ নিয়োগ-বাণিজ্যে আদায় করা ঘুষের অংশ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে বণ্টন করতেই রবিবার রাতে তূর্ণা নিশীথা ট্রেনে তিনি ঢাকায় যান। ওই দিন তিনি চট্টগ্রামে অফিসও করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের ১৯ এপ্রিল ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস পদে লিখিত পরীক্ষা হয়। চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পাওয়ায় নিয়োগ দীর্ঘায়িত হচ্ছিল এবং প্রথমদিকে প্রতিপদে তিন লাখ করে টাকা নেওয়া হলেও শেষদিকে তা চার থেকে পাঁচ লাখে গিয়ে পৌঁছে। গত সপ্তাহে এ পদে ৪০০ জনের নিয়োগ চূড়ান্ত করেন পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা।
অনুমোদনের পর গত রবিবার থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্থায়ী ঠিকানায় নিয়োগপত্র পাঠানোর কথা স্বীকার করে পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের সিনিয়র ওয়েলফেয়ার অফিসার গোলাম কিবরিয়া জানান, চাকরিপ্রাপ্তদের নিয়োগপত্র পাঠানো শুরু হয়েছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ে শ্রমিক লীগের এক নেতা বলেন, 'অনেক আগে থেকে এ পদে নিয়োগের বিপরীতে ঘুষ নেওয়া হচ্ছিল। সর্বশেষ গত সপ্তাহে শেষবারের মতো টাকা নেওয়া হয়েছে। ওই টাকার ভাগ দিতে রবিবার রাতে জিএম ঢাকায় গিয়েছিলেন।'
অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে রেলওয়ে শ্রমিক লীগের নেতা মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান বলেন, 'ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস পদ ছাড়াও রেলওয়ের অর্ধশতাধিক পদে প্রায় পাঁচ হাজার লোক নিয়োগে ২০০ কোটি টাকার ঘুষ-বাণিজ্য চলছে। ঘুষ ছাড়া কোনো পদে নিয়োগ হচ্ছে না।'
এর সত্যতা জানতে ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস পদে নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক হাফিজুর রহমানকে গতকাল কয়েক দফা ফোন করা হয়; কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। একইভাবে রেলওয়ের জিএমকে ফোন করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ করেননি।
এদিকে রেলওয়ের লোক নিয়োগে অনিয়ম হচ্ছে- এ ধরনের অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চট্টগ্রামের উপপরিচালক মোরশেদ আলম বলেন, 'বেশ কয়েকবার এ ধরনের অনিয়মের কথা আমাকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছিল। কিন্তু কেউ লিখিতভাবে না জানানোয় তদন্ত করা যায়নি। এখন জিএম ঢাকায় টাকাসহ ধরা পড়ায় তদন্ত কার্যক্রম চালানো সহজ হবে।'
রেলওয়েতে সহকারী লোকোমোটিভ মাস্টার পদে ১৮২, অফিস সহকারী পদে ৪১২, খালাসি পদে এক হাজার ৪৪১, সুইপার পদে ২৪৮, ট্রলিম্যান পদে ১৪৩, ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস পদে ৪০০, চৌকিদার পদে ১১২, অ্যাটেডেন্ট পদে ১৪৩ এবং জুনিয়র অডিটর পদে ১২৪ জনের নিয়োগে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
পূর্বাঞ্চলীয় ও পশ্চিমাঞ্চলীয় রেলওয়ের ৬৮ পদে সাত হাজার ২৭৫ জন কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম হচ্ছে বলে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন রেলওয়ে সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ আবদুল খালেক। এ ছাড়া লোক নিয়োগে অনিয়মের কথা উল্লেখ করে গত ২৫ ডিসেম্বর রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে রেজিস্টার্ড ডাকযোগে একটি অভিযোগপত্র পাঠান ভিশন-২০২১ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন নাগরিক ফোরামের মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মাসুদ চৌধুরী। রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব ও রেলওয়ের মহাপরিচালকের ঠিকানায় পাঠানো ওই আট পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় তিনি উল্লেখ করেন, 'ঘুষের বিনিময়ে এই প্রথম মালি ও সুইপার পদে মুসলমান ছেলেমেয়েদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে আবার একই পরিবারের ভাইবোনকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১২ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে। চার লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে ডিগ্রি পাস ছেলেকে অষ্টম শ্রেণী পাস গেটম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।'
উল্লেখ্য, গত সোমবার রাতে ঢাকায় ৭০ লাখ টাকাসহ পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা এবং রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক বিজিবি সদস্যদের হাতে ধরা পড়েন।