সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে যৌন হয়রানিতে অভিযুক্ত হয়েছে অনেক দেশের শান্তিরক্ষী, অভিযুক্তদের মধ্যে আছে বাংলাদেশও। এ ব্যাপারে আমার একটি ব্যক্তিগত বিশ্লেষন রয়েছে। যে থানায় বা অফিসে সবাই দুর্নীতিবাজ, সেখানে যে দুর্নীতি করে না সে সবার ন্যাচারাল শত্রুতে পরিণত হয়। আমি জানি না, কিন্তু আশঙ্কা করি যে কোন ষড়যন্ত্র কি না। যাক, শীঘ্র বাংলাদেশ আর্মি থেকে তদন্ত টিম যাচ্ছে। দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে তা আমি আস্থার সাথে বিশ্বাস করি।
জাতিসংঘে sexual exploitation and abuse (SEA) এর উপর এত বেশি প্রচারণা কার্যক্রম চালানো হয় তা সাধারণের ধারণার বাইরে। একই সাথে সবখানে কন্ডোম দেয়া থাকে, অর্থাদ নিরাপদ যৌনজীবন যাপন কর - এই অনুমোদন দেয়া আছে। কিন্তু বৈধ সঙ্গী ব্যতিত যৌনতাকে স্বীকার করলে সেখানে SEA যে হবেই, অবধারিত, বিশেষ করে যুদ্ধবিধ্বস্থ গরিব দেশে, সেতো বলাই বাহুল্য। কিন্তু সবাই এটা অস্বীকার করে একটা প্রঞ্চনার বাতাবরণ তৈরি করে রাখে, যেখানে SEA চলতে থাকে কিন্তু সেটাকে আমলে না নিয়ে বরং মেনে নেয়ার একটা সর্বসন্মত ওপেন সিক্রেট পরিস্থিতি চলতে থাকে। পেছন দিয়ে SEA এর হাতিঘোড়া সশব্দে হেটে চলে যায়, কিন্তু সামনে দিয়ে মশা উড়ে গেলে SEA এর লোকেরা হৈহৈরৈরৈ করে তাদের কঠোর অবস্থানের জানান দিতে থাকে। এটা একটা ভন্ডামি।
যারা SEA এর কার্যক্রম চালায় আর যারা শোনে তাদের অধিকাংশ SEA এর সাথে জড়িত। বাকিরা SEA বহির্ভূত সেক্সের সাথে জড়িত। তাদের কাছে মিশন একটা সেক্স অবকাশ কেন্দ্র। গড়ে প্রতিটা আফ্রিকান জাতিসংঘ সদস্যের একটা বুশ ওয়াইফ আছে। এই বুশ ওয়াইফ জিনিষটা কি যারা জানেন না, তারা bush wives Africa লিখে গুগল করতে পারেন, ধারণা পেয়ে যাবেন। বুশ ওয়াইফ তার বউয়ের মত সার্বক্ষণিক সঙ্গী, তার ঘরে সে খায়দায়, পরিবারের কর্তার মত আচরণ করতে থাকে, কিন্তু সেখানেই সীমিত না, এর বাইরে সে মর্জিমত রুচি বদলাতে থাকে। আবার জাতিসংঘের সাদা সদস্যরা স্থানীয়দের দিকে না গিয়ে নিজেদের টিম বা বাসায় বা অন্য কোথাও পারস্পরিক সম্মতিতে, সাধারণত অন্য সাদার সাথে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলে। নারী বা পুরুষ হোক, ব্যতিক্রম ব্যতিত যৌনতা-রহিত জীবন তারা ভাবতেই পারে না।
লাইবেরিয়ায় আমার প্রথম টিমে মিশরীয় ও নেপালী এবং বলিভিয়ান মহিলা কর্নেল ছাড়া আর কেউ সেক্স বহির্ভূত জীবন কাটিয়েছে বলে আমার জানা নাই, পাকিস্তানির নারীমোহন বলে বেশ পরিচিতি ছিল। অবশ্য চাইনিজ সহকর্মী তার অধিকাংশ সময় কাটাতো চাইনিজ লেভেল-টু হাসপাতালের দেশীয়দের সাথে, তার ব্যাপারে ঠিক বলতে পারবো না। আর ডেনিশ সহকর্মীর অনেকগুলো দেশে বান্ধবী ছিল, ছুটিছাটার পরিকল্পনা করতো ঐসব বান্ধবীর সাথে যোগাযোগের ভিত্তিতে – আমি ছুটির ব্যাপারটা দেখতাম বলে আমার সাথে নিঃসঙ্কোচে পরামর্শ করত, ফলে আমি জানতাম। লাইবেরিয়ায় তার টার্গেট ছিল এনজিওর সাদা ও বাদামী (ভারতীয়) মেয়েরা। সে হিসাবে অবশ্য SEA এর অপরাধ তার ছিল না। আমাদের বাসার হাউজ ক্লিনার প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে নাইজেরিয়ান সহকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল, দেশে আসার আগে আমাকে স্টেটমেন্ট দিতে হয়েছিল, ফলাফল কি হয়েছিল জানিনা। তবে সে দেশে গিয়ে পদোন্নতি পেয়েছে, আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে আছে। একটা মজার বিষয় লক্ষ্য করেছি, বাঙালি মিশনে গিয়ে কেনে ফোমের কমদামী সিঙ্গেল ম্যাট্রেস আর আফ্রিকানরা কেনে স্প্রিংঅলা ডবল মেট্রেস - কারণ মিশনে তাদের বিছানায় ডাবল থাকার পূর্ব পরিকল্পনা থাকে।
আমার পরবর্তী বদলিস্থানে আমি বাসা শেয়ার করতাম দুই ইথিওপীয়র সাথে, প্রথমে হয়তো সাহস করেনি, আমার চলে আসার একমাস আগে থেকে তারা বাসায় মেয়ে আনতে শুরু করল। আমি জাতিসংঘের স্থানীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ জানাতে চেয়ে দু’বার ফোন করে না পেয়ে চিন্তা করার সুযোগ পেলাম। ইথিওপীয়রা দোষ স্বীকার করবে না, ঐ মেয়েও না, আমাদের বাসার স্থানীয় সিক্যুরিটি গার্ডরাও না, আমার নাইজেরিয়ান টিম লিডার নিজে এসব কাজে লিপ্ত, সুতরাং সেও আমার পক্ষ নেবে না আর মিশনে ঐ এলাকার সিক্যুরিটি অফিসার ও তার ডেপুটি দুজনই কালো, তারাও ইথিওপীয়দের পক্ষই নেবে, উল্টা আমাকে দোষী সাব্যস্থ করে বিপদে ফেলতে পারে। আমি সবকিছু বিবেচনা করে চুপ মেরে গেলাম। বাসায় মেয়ে আসলে লক্ষণ বুঝতাম, আওয়াজ পেতাম। গাড়ি নিয়ে বাসা ছেড়ে অফিসে গিয়ে ইন্টারনেট, রান্নাবান্নায় সময় কাটিয়ে রাত পোনে বারটায় এসে ঘুমিয়ে পড়তাম। এ সময়টা ছিল আমার জন্য খুবই দুর্বিসহ। SEA প্রসঙ্গে কোন কথা কেউ কখনও টিমে সচারচর উত্থাপন করত না, কিন্তু আমার কঠোর মনোভাবের বিষয়ে সবার ধারণা ছিল। আমি খুব বুঝতাম, তারা নিজেদের SEA কর্মকান্ড বিষয়ে আমার ব্যাপারে অস্বস্থিতে থাকত এবং এ জন্য আমার প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব পোষন করত। এ বাইরে আরেকটা সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না, সেটা হল, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে গৃহযুদ্ধ সাম্প্রদায়িক পর্যায়ে, খ্রিস্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইথনিক ক্লিনজিং চালাচ্ছে, সে সূত্রে মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী কারও কারও চক্ষুশূলের কারণ হয়ে থাকতে পারে।
বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির কারণে এর সদস্যদের SEA এ লিপ্ত হওয়ার সুযোগ অতীব সীমিত। তবে আমার পূর্বের মিশনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মিশনের শুরুকালিন সময়ে স্থানীয়দের সাথে কন্টিনজেন্ট সদস্যদের মেলামেশার বেশ কিছু সুযোগ তৈরি হয় এবং সেই সুযোগে অপকর্ম করার মত সবসময় কেউ না কেউ থাকেই। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে এমন কিছু ঘটে থাকতে পারে। আরেকটা হতে পারে, কোন স্টাফ অফিসার বা মিলিটারি অবজার্ভার করে থাকতে পারে, কেননা তারা যা ইচ্ছা করার মত স্বাধীনতা ভোগ করে। জাতিসংঘে কর্মরত কোন বাংলাদেশি সিভিলিয়ান স্টাফের দ্বারাও SEA হতে পারে (বাংলাদেশ পুলিস থেকে কোন সদস্য সেখানে মোতায়েত হয়নি বলে খবরে এসেছে)। মিশন এলাকায় দেখেছি, বাংলাদেশের দু’একজন যারা এসবে লিপ্ত হয়েছে তাদের ব্যাপারে বাতাসে কথা ঘুরে বেড়াতো। ঐ পর্যন্তই। এসব অভিযোগ প্রমাণ করা সঙ্গত কারণে খুব কঠিন। অন্যদিকে SEA এর অভিযোগ তুলে স্থানীয়দের দ্বারা ব্ল্যাকমেইলিঙেরও অনেক ঘটনা ঘটে। যারা তদন্ত করে তাদের দক্ষতার অভাব অথবা SEA এর প্রতি নিজেদের দুর্বলতা থাকলেও কেস হালকা হয়ে যেতে পারে যাতে অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায় বা লঘু শাস্তি ভোগ করে।
প্রকৃতই কোন ষড়যন্ত্রের বিষয় থাকলে এবং সেটা জানা গেলে অবশ্যই স্বস্থির ব্যাপার হবে সেটা। SEA এ সম্পৃক্ত না হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশীদের সুনাম আছে। কোন টিম সাইটে বদলি হলে দায়িত্ব হল, শুরুতেই সিক্যুরিটি অফিসারের ব্রিফ নিয়ে আসা। আমার ২য় টিমে বদলির সময় আমাকে কোন ব্রিফ করেনি, ব্যাপক প্রসংশা করে বলেছিল, যেসব বিষয়ে সতর্ক করতে চায় বাংলাদেশী সদস্যদের তার প্রয়োজন নাই, কারণ তারা নিজে থেকেই নাইটক্লাব, বার, ওয়াইন ও ওমেন কেস থেকে দূরে থাকে। যা হোক, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের ঘটনায় তদন্তে অপরাধী পাওয়া গেলে দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তি বরাদ্ধ হবে আশা করি, কারণ এত লোকের এত কষ্টার্জিত সুনামে কিছু কালপ্রিটের জন্য কালো দাগ লেগে যায়। আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ ও সঠিক প্রেষণা এবং কনটিনজেন্টের ক্ষেত্রে কমান্ড পর্যায়ের সতর্কতা ও সচেতনতাই পারে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এমন লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে।