ব্লগার েপচাইললা আমার এক পোস্টে শিরোনামে উল্লেখিত বিষয়টিসহ একটি প্রশ্নমালা উত্থাপন করেছেন (পোস্টটি এখানে View this link ), উত্তর লিখতে গিয়ে দেখি, শিরোনামের বিষয়ে একটি পোস্ট দেয়ার দীর্ঘদিনের ইচ্ছাটি জাগ্রত হয়েছে. একটি সুস্থ আলেচনা হোক এই আশায় সবার সুচিন্তিত মতামত কামনা করছি এবং বর্তমান বিষয়ে টু-দা-পয়েন্ট মন্তব্যের অনুরোধ করছি. বর্তমান বিষয়ের বাইরে কোন মন্তব্য থাকলে ‘সেনাবিদ্বেষ:আত্মপক্ষ সমর্থন’ শিরোনামে আমার ধারাবাহিক পোস্টের প্রাসঙ্গিক অংশে মন্তব্য করতে অনুরোধ করছি (View this link ).
েপচাইললা বলেছেন: ... দেশের আভ্যন্তরীণ প্রায় সব বিষয়েই তাদের নাক মোবারক গলিয়ে ফেলেন এবং ব্যাক আপ হিসেবে জনগণের টাকায় কেনা বন্দুক শো করেন।
জনাব েপচাইললার অভিযোগ সরাসরি বাতিল করছি না. কিন্তু আমি এর প্রেক্ষাপট বলতে চাই. প্রেক্ষাপটগুলো দেখুন (এলোমেলো ও অসম্পূর্ণ, ব্লগাররা সাহায্য করুন) -
১. আর্মি না হলে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না (প্রকৃত দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিসের).
২. আর্মি না হলে ওয়াশার পানি বিতরন সম্ভব না (প্রকৃত দায়িত্ব ওয়াসা ও পুলিসের).
৩. আর্মি না হলে ডেসকোর বিদ্যুতবিল আদায় হয় না (প্রকৃত দায়িত্ব ডেসকোর).
৪. আর্মি না হলে বিদ্যুত কেন্দ্রের নিরাপত্তা সম্ভব না (প্রকৃত দায়িত্ব পুলিস, আনসারের).
৫. আর্মি না হলে অনেক জাতীয় ব্যক্তিত্বের সুচিকিৎসা বা সন্তানপ্রসব হয় না (প্রকৃত দায়িত্ব কার???).
৬. আর্মি না হলে ভোটার আইডি কার্ড তৈরি সম্ভব না (প্রকৃত দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন ও বেসামরিক প্রশাসনের).
৭. আর্মি না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না (প্রকৃত দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন, পুলিশ তথা বেসামরিক প্রশাসনের).
৮. আর্মি না হলে পোর্টের স্বাভাবিক কার্যক্রম সম্ভব না (প্রকৃত দায়িত্ব পোর্ট কর্তৃপক্ষের).
৯. আর্মি না হলে পোর্টের কাস্টমসের অটোমেশন সফটঅয়্যার তৈরি ও ব্যবহার সম্ভব না (প্রকৃত দায়িত্ব এনবিআর-এর).
১০. আর্মি না হলে সাফ গেমসের ব্যবস্থাপনা সম্ভব না (প্রকৃত দায়িত্ব ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ও বেসামরিক প্রশাসনের).
১১. আর্মি না হলে সন্ত্রাস, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না (প্রকৃত দায়িত্ব পুলিসের; ফলাফল ৱ্যাব, ক্লিনহার্ট).
১২. আর্মি না হলে সিডর, আইলা, বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না (প্রকৃত দায়িত্ব ত্রাণ মন্ত্রণালয় ও বেসামরিক প্রশাসনের).
১৩. আর্মি না হলে ভিজিএফ-এর চাল বিতরণ সুষ্ঠু হয় না (প্রকৃত দায়িত্ব ত্রাণ মন্ত্রণালয় ও বেসামরিক প্রশাসনের).
১৪. আর্মি না হলে ধ্বসে পড়া ভবনের উদ্ধারকার্য সম্ভব না (প্রকৃত দায়িত্ব সিভিল ডিফেন্স ও বেসামরিক প্রশাসনের).
১৫. আর্মি না হলে বাসের উদ্ধারকার্য সম্ভব না (প্রকৃত দায়িত্ব সিভিল ডিফেন্স ও বেসামরিক প্রশাসনের).
১৬. আর্মি না হলে বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল আদায় হয় না (প্রকৃত দায়িত্ব রাজস্ব বিভাগ/যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের?!).
১৭. আর্মি না হলে লোকসানী মেশিন টুলস ফ্যাক্ট্রির পূনর্বাসন হয় না (প্রকৃত দায়িত্ব শিল্প মন্ত্রণালয়ের).
১৮. আর্মি না হলে রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়ন ও দূর্নীতিদমন সম্ভব না (প্রকৃত দায়িত্ব প্রধানত রাজনৈতিক সরকারের).
আমি এর কোনটার পক্ষে বলছি না, বিশ্বাস করি, জনাব েপচাইললাও অবশ্যই এর কোনটার পক্ষে নন. কিন্তু বাস্তবতা হল, দেশের অধিকাংশ জনগন এভাবে আর্মির দ্বারা উন্নত সেবা পাবে বলে বিশ্বাস করে (স্বরণে রাখুন, ড. কামালও ‘আর্মিই শুধু পারবে দেশকে রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়ন থেকে রক্ষা করতে’ বলে ১/১১-এর প্ররোচণা দিয়েছিলেন). কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমিও করি, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাবনাটা আপাত সত্যও বটে. কিন্তু এগুলো সবই এডহক ব্যবস্থাপনা, সবই শর্টকাট -– বাঙ্গালির লোভী, দূর্নীতিগ্রস্থ মানসিকতা এমন এডহক ও শর্টকাটের পক্ষে বিশেষ সহায়ক. এমন আস্থার কারণ? কারণ সেনাবাহিনীর সুশৃঙ্খল, সুপ্রশিক্ষিত ওয়ার্কফোর্স (বন্দুক নয়). সর্বশেষ কারণটি ব্যতিত আর কোনটিতে সেনাবাহিনী যেচে, স্বউদ্যোগে যায় বলে আমার জানা নাই. কিন্তু ফলাফল কী? ভাল ফলাফল অবশ্যই আছে, পাশাপাশি কুফলগুলো দেখুন (এলোমেলো ও অসম্পূর্ণ, ব্লগাররা সাহায্য করুন) –-
১. প্রকৃত দায়িত্বগুলো যাদের তারা কখনও সাবালক হয় না, তাদের প্রাতিষ্ঠানিকতা পরিগঠিত হয় না, তাদের হীনমন্যতা বৃদ্ধি পায় ও সাবালকত্ব বিলম্বিত হয় (অন্য অনেক কারণের সাথে এটি অন্যতম).
২. প্রকৃত দায়িত্বগুলো যাদের তাদের উপর খবরদারির প্রতিক্রিয়ায় সেনা-বেসামরিক সম্পর্ক ক্ষতিকর নেতিবাচকতায় পর্যবসিত হয় [স্মর্তব্য যে, এমন খবরদারি প্রশাসনের আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোন দূর্নীতিমুক্ত কর্মকর্তাও বরদাস্ত করবেন না, ব্যক্তিগতভাবে ঘুষবঞ্চিত হওয়ায় দূর্নীতিগ্রস্থরাতো নয়ই. এছাড়া মূল কারণ সেনাবাহিনীর কাজের পদ্ধতিগত ভিন্নতা. সেনাবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে কাজ সম্পন্ন করায় বিশ্বাসী, বেসামরিক প্রশাসন তেমন নয়, তার দীর্ঘসূত্রিক প্রচলিত পদ্ধতি আছে -– এই পদ্ধতিগত সংঘর্ষ ক্ষেত্রবিশেষে মারাত্মক পরিণতিও বয়ে আনতে পারে. উদাহরণস্বরূপ, একজন কৃষি কর্মকর্তাকে সেনাকর্মকর্তা রাতে নির্দেশ দিলেন, ঐ জেলায় কী পরিমাণ ভুট্টা চাষ হয় এবং ১৫ শতাংশ ফলন বৃদ্ধি করতে মোট কী পরিমাণ ভুট্টাবীজ ও সার লাগবে তার উপজেলাওয়ারি টেবুলার তথ্য পরেরদিনের মধ্যে দিতে (তত্ত্বাবধায়ক আমলে বিশ্বব্যপী খাদ্যশষ্যের উৎপাদন কমে যাওয়ায় সেনাবাহিনী ফুড-সিক্যুরিটির দায়িত্ব নিজের মনে করে খাদ্যশষ্যের উৎপাদনবৃদ্ধির জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিল –- বিযয়টি মিডিয়ায় তেমন আসেনি, কিন্তু প্রশাসনে যারা ছিলেন তারা জানেন. আমার ব্যক্তিগত মত, এটিও উচিত হয়নি). কৃষি কর্মকর্তা জানালেন, রেডিমেড তথ্য হাতে নাই, এতে সময় লাগবে, পরেরদিন বৃহস্পতিবারে তিনি ছুটি যাবেন, পরের সপ্তাহে প্রকৃত তথ্য জানাতে পারবেন. কিন্তু সেনা কর্মকর্তা নাছাড়, জানালেন, পরের সপ্তাহ পর্যন্ত সময় দেয়া সম্ভব না, তথ্য যোগার করে কম্পাইল করে তবেই ছুটিতে যান. কৃষি কর্মকর্তার কাছে এটি অযাচিত হস্তক্ষেপ মনে হওয়া অস্বাভাবিক না. কিন্তু বিশ্বব্যাপী যে কোন সেনা কর্মকর্তার কাছে এভাবে কাজ আদায় অতি স্বভাবিক বিষয়, বরং সরকারি দায়িত্ব পাওয়ার পরও কারও অফিসটাইমের বা ব্যক্তিগত সুযোগসুবিধার প্রসঙ্গ সামনে আনা একটি ধৃষ্টতা. এখানে সেনা কর্মকর্তা যা করেছেন তা দেশের মঙ্গলের জন্যই, কোন ব্যক্তিগত লাভালাভের জন্য নয়. এবার ভাবুন, ঐ কৃষি কর্মকর্তাটি দুর্নীতিপরায়ন হলে কতটা উদ্যোগী হয়ে কতটা রং মাখিয়ে বিষয়টির বিরূপ ব্যখ্যা করে কী পরিমাণ কুৎসা রটাবেন!].
৩. সেনাবাহিনীর শান্তিকালীন মূলকাজ অর্থাৎ নিজস্ব প্রশিক্ষণ কর্মকান্ড দারুণ ব্যহত হয় (তত্ত্বাবধায়ককালে সেনাবাহিনীর অসংখ্য কোর্স-ক্যাডার ও প্রশিক্ষণ কর্মকান্ড বাতিল করতে হয়েছিল বা স্বল্প ব্যাপ্তিতে পরিচালিত হয়েছিল).
৪. সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ব্যক্তিবিশেষ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাভোগ ও দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়.
৫. বেয়ামরিক পরিমন্ডলে জড়িয়ে পড়ায় ও প্রশিক্ষণবিহীন থাকায় সেনাবাহিনীর সার্বিক শৃঙ্খলামান ও পেশাদারিত্বের অবনতি ঘটে.
৬. সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ব্রান্ডিং তৈরি হয় এবং সেনাবাহিনীতে রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ ও বিভেদ বৃদ্ধি পায়.
৭. সেনাবাহিনীর সামগ্রীক/ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে নিজেদের সামর্থ ও ক্ষমতার ব্যাপারে আত্মশ্লাঘার জন্ম নেয় (এর ফলেই ড. কামালরা প্ররোচিত করার সুযোগ পান) এবং স্বার্থসিদ্ধির চিন্তা ও অঘটনের সুযোগ সৃষ্টি হয়.
৮. সেনাবাহিনীর উপর অর্পিত দায়িত্ব অনেক সময় সুষ্ঠু নীতিমালা মোতাবেক হয় না. কারণ প্রথমত, সেনাবাহিনী ঐ কাজের জন্য সংগঠিত ও প্রশিক্ষিত নয়. দ্বিতীয়ত, এডহকভিত্তিতে স্বল্প সময়সীমায় কাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে সঙ্গত কারণেই দীর্ঘসূত্রিক নীতিমালা লংঘন করে শর্টকাটের আশ্রয় নিতে হয় – এতে কাজে গতি সঞ্চার হলেও সুবিধাভোগী শ্রেণীর বাধার মুখোমুখী হতে হয়, নীতিমালা লংঘনই তখন অভিযোগের প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠে. এডভোকেট রফিকুলেরা তখন কালোগাউন পড়ে টিভিতে নীতিমালার লংঘনের পইপই বিবরণ দেন (দুর্নীতিগ্রস্থ আসামির পক্ষে কথা বলা ছাড়া তার বিবেকবোধ কখনও জাগ্রত হয় না). সুবিধাভোগী ঘুসখোর বেসামরিক কর্মকর্তা, পুলিস, কাস্টম অফিসার, চাঁদা ও টেন্ডারবাজ ছাত্র, সাংবাদিক, টাকা মেরে খাওয়া শিক্ষক, ভেজাল দেয়া দোকানী, আধা কাজ করে বিল তুলে নেয়া ঠিকাদার, ভূমিদস্যু রিয়েলএস্টেট ব্যবসায়ী –- সবার তখন গাত্রদাহ. কাজটা অসম্পূর্ণ থাকলেও আর্মির দোষ, শর্টকাটে কম ঝামেলায় কাজ আদায় করলেও দোষ, বোঝুন!
৯. কাজ করতে যেয়ে, বিশেষ করে একটি নতুন কর্মক্ষেত্রে, মানবিক ভুলভাল হওয়া অস্বাভাবিক না. এই ভুলকে পূর্বের অরাজক পরিস্থিতির সুবিধাভোগীরা বিকৃত অতিরঞ্জনে ও বিষোদ্গারে কাজে লাগান. আরও আছে সেনাসদস্য কারও নিজেরই দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাওয়া (শর্টকাটের সুযোগ নিয়ে দুর্নীতি করা সহজ ও নিরাপদ!) – এমন হলেতো কথাই নাই.
১০. সেনাবাহিনীর সুশৃঙ্খল ওয়ার্কফোর্সে কাজ না হলে (যে কোন কারণেই, যার দোষেই হোক) বন্দুকের ব্যবহারের ভীতি প্রদান ও চূড়ান্ত পর্যায়ে বন্দুকের ব্যবহার (লক্ষ্য করুন, শুরুতেই বন্দুকের নলের মুখটা দেখা যায় না!).
১১. সর্বোপরি, সেনাবাহিনীর ইমেজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়. আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন কার্যকরী পন্থা না থাকায় ভেস্টেড ইন্টারেস্ট গ্রুপের লাগাতার কুৎসাপিডিয়া রচনা প্রতিষ্ঠা লাভ করে. বাঙ্গালির সহজাত হুজুগেপনা ও পরশ্রীকাতরতার কারণে এসব কুৎসা, বিশেষ করে শিক্ষিত মহলে বিশেষ উপাদেয় হয়ে দেখা দেয়. সুযোগে অনেকে উদোর পিন্ডি আর্মির ঘাড়ে চাপিয়ে অনেকেই পাড় পান, পেতে চান.
ব্লগবাসীগণ, এবার আপনারাই বলুন, এই কুফলগুলো, যা শুধু সেনাবাহিনী না, দেশের জন্যও ক্ষতিকর, তা থেকে কীভাবে বাঁচবেন? আপনার মতামত আপনারা বলবেন, আমারটা আমি বলে নেই -– একমাত্র উপায়, সেনাবাহিনীকে প্রাকৃতিক দূর্যোগ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া আর কোন দায়ীত্বে নিয়োজিত না করা, এমন কি, স্বল্পমাত্রার হলে প্রাকৃতিক দূর্যোগেও না ডাকা. আমার সীমিত বোঝবুদ্ধি মতে, ইন এইড-টু-সিভিল পাওয়ারের নামে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়ে দিয়ে দিয়ে ব্যর্থ প্রশাসনের দ্রুত কার্যোদ্ধার অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব, কিন্তু কুফলগুলো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে অবধারিত – দুটা একসাথে অর্জন অসম্ভব.
এবং উপরের কুফলগুলোই সকল বিতর্ক ও সেনাবিদ্বেষের মূল অনুঘটক.