১০. * শূন্য আরণ্যকের তালিকা: ‘'২০০৯ বিডিআর বিদ্রোহ (বন্চনার অভিযোগ)’'.
বিদ্রোহটি যে রাজনীতিকদের আস্কারায় বিডিআর জওয়ানদের ষড়যন্ত্রের ফসল, তা তো বিভিন্ন তদন্তেই বেড়িয়ে এসেছে. ষড়যন্ত্রীদের কাছে আবেদন সৃষ্টিকারী বঞ্চনার গল্পের প্রয়োজন ছিল, যা তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃনা ছড়াবে - আর তা কিছু সত্য, কিছু অতিরঞ্জিত ও অনেকটুকু মিথ্যার বেসাতি দিয়ে তৈরি - এই বিষয়টি এখন স্পষ্ট. অভিযোগ আর সত্যতা এক নয়. বাস্তবতা হল, ২০০০ সালের পর থেকে বিডিআর ব্যাটালিয়নগুলোতে দুইজনের স্থলে চারজন সেনা-অফিসার করা হয় এবং তৎকালিন প্রচলন ভেঙ্গে অনেক উঁচু পেশাগত মানসম্পন্ন অফিসার বদলি করা হয়. এতে আভ্যন্তরীণ নজরদারির কারণে সীমান্তে চোরাচালানের সহযোগীতার মাধ্যমে অবৈধ অর্থোপার্জনের সুযোগ কমে যায় –- এটি ক্ষোভের প্রধানতম কারণ. তবে, ষড়যন্ত্র করার মত কিছু অনিয়ম ছিল, এটাও সত্য.
তারা সেনা-অফিসার না চেয়ে নিজেদের অফিসার চেয়েছে – কিন্তু, প্রতিরক্ষার প্রথম ব্যূহ হিসাবে বিডিআর-এর অন্যতম দায়িত্বের জন্যই এ বিধান যাতে যুদ্ধকালীন সেনাবাহিনীর সাথে ইন্টিগ্রেশন সহজ হয়. বিডিআর-এর নিজস্ব অফিসাররা ভিনদেশ থেকেও আসবে না. বস্তুত, কোন অফিস বা প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তাদের প্রতি কর্মচারিদের কিছু ন্যায্য ও কিছু অন্যায্য ক্ষোভ থাকে না? বিডিআর-এও হাবিলদারের উপর সিপাহি থেকে নায়েকদের কিংবা, জেসিওদের উপর হাবিলদার থেকে সিপাহির ক্ষোভের অনেক ঘটনা/কারণ পাওয়া যাবে. বিডিআর-এ, মনে করি, যুদ্ধকালীন বিবেচনা বাদ দিয়ে বিসিএস অফিসার নিয়োগ দেয়া হল, তাদের উপর ক্ষোভ থাকবেনা, সে নিশ্চয়তা কই পাওয়া যাবে? আনসারে বিসিএস অফিসার আছেন, তাদের উপর সাধারণ আনসারদের ক্ষোভ নাই? প্রকৃতপক্ষে, কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের চাওয়া কর্মচারিদের চাওয়া-পাওয়ার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন হয়. কারণ, কর্মকর্তাদের চাওয়া হয় প্রতিষ্ঠানের লক্ষ অর্জনের দিকে ধাবিত, অন্যদিকে কর্মচারিদের চাওয়া হয় ব্যক্তিগত সুযোগসুবিধার দিকে –- এই সাংঘর্ষিক অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় উভয়ের মাঝে ঘনিষ্ট সংস্রব ও সকলের বৃহত্তর কল্যাণের বিষয়ে নিয়মিত মোটিভেশন. বস্তুত, একজন সেনা-অফিসার তার কমিশন-উত্তর চাকুরির প্রথম দিন থেকে যে সবক পান তা হল –- সৈনিকদের ছুটি, রুটি (খাওয়াদাওয়া অর্থে) ও ওয়েলফেয়ার নিশ্চিত করা. বিরল ব্যতিক্রম ব্যতিত তাদের পক্ষে বিডিআর সদস্যদের সাথে কথিত দূর্ব্যবহারের অভিযোগ সাধারণভাবে সত্য হতে পারে না. কিন্তু তার পক্ষে একজন রাজনৈতিক নেতা, একজন ফোরম্যান বা একজন ম্যানাজারের মত আচরণ করা সম্ভব নয়, এটাই সামরিক শিক্ষা, এটাই মিলিটারি লিডারশিপ. শান্তিকালীন সেনাবাহিনীর প্রধানতম কাজ প্রশিক্ষণ বা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া. যুদ্ধ এক ভয়াবহ বাস্তবতা - সেই জীবনমৃত্যুর লড়াইয়ে নিরন্কুশ আনুগত্যের অপরিহর্যতা এবং সেই সাথে শান্তিকালীন সময়ে তার চর্চার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য (Small Unit Leadership –- A Commonsense Approach, লেখক Col Dandridge M Malone, USA (Ret), প্রকাশক Presidio Press). একজন সেনা-অফিসার কর্তৃক অধীনস্থের প্রতি তার আচরণের মর্মার্থ না জেনে তা অভিযোগ হিসাবে আমলে নেয়া উচিত কিনা তা ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি.
জাতিসংঘ মিশনে বিডিআর কেন নেয়া হয় না, এ জন্যও দোষ সেনা-অফিসারদের! শান্তিরক্ষার জন্য জাতিসংঘ সামরিক বাহিনী চায়, আধা-সামরিক বাহিনী নয়. একইভাবে, জাতিসংঘের চাহিদা অনুযায়ীই পুলিসিং কর্মকান্ডের জন্য পুলিস শান্তিরক্ষায় যায়, সেনা-অফিসারদের সেখানে নাক গলানোর সুযোগ নাই.
বিদ্রোহীদের অন্যতম অভিয়োগ অপারেশন ডালভাত নিয়ে. এ বিষয়ে সেনা তদন্ত কমিটি সত্যতা পেয়েছে বলে পত্রিকান্তরে জানা গেছে, অবশ্য বিস্তারিত আসেনি (সেই জেনারেল শাকিল আর কর্নেল মুজিবুল হক আর নাই, তাদের আত্মপক্ষ নেয়ারও সুযোগ নাই).
প্রথমত, এই অপারেশন বিডিআর স্বউদ্যোগে করেনি, মূল্যবৃদ্ধিতে ব্যর্থ সরকার কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া হয়েছে –- এটা সরকারের ভুল.
দ্বিতীয়ত, এই কাজটি কিছুতেই বিডিআর-এর দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না, এই বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণও নাই, তারপরেও এমন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে –- এটাও সরকারের ভুল.
তৃতীয়ত, বিডিআর অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে ন্যূনতম লাভের মার্জিন রেখে পণ্য বিক্রয় করেছে, কোন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নয়. এমতাবস্থায়, অপারেশন ডালভাতের কোটিকোটি টাকা লুটপাটের অভিয়োগ সত্য হতে পারে না.
চতুর্থত, পণ্য ক্রয়ে অনিয়ম ও সদস্যদের ভাতা পরিশোধে বিলম্বের কথা জানা গেছে. এ ব্যপারে দোষীদের বক্তব্য না শুনেও সাধারণভাবে বলা যায়, এই অপারেশনে গুটিকয়েক অফিসার জড়িত ছিলেন এবং জড়িতের সবাই অনিয়মে জড়িত ছিলেন না. কতিপয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের জন্য সকল অফিসার দায়ী হতে পারেন না, হলেও এমন করুণ মৃত্যু কাম্য হতে পারে না.
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০০৯ সকাল ৮:০৭