টানাপোড়েনে
১
বিশাল সেমিনার হলের অর্ধচন্দ্রাকৃতি টেবিলের অন্যদিকে বসেছিলেন তিনি। পাশের ব্যক্তির সাথে আলাপে মগ্ন। ঘরে ঢুকেই তনিমার চোখ ঠিক সেদিকেই কেন গেল! মুখটা যেন চেনা চেনা, সামান্য কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করলেন তিনি, কোথায় দেখেছেন, এই মুখ, এই রেখা, এই ভঙ্গি। নাহ মনে পড়ল না। আজকাল কত কিছুই যে মনে পড়ে না; ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ঘরের ভিতরে পা রাখলেন তনিমা। আয়োজক দলের সদস্যরা এগিয়ে এসে তাঁকে স্বাগত জানাল, নিয়ে গেল তাঁর নির্ধারিত আসনে। অন্যতম প্রধান আহবায়ক প্রফেসার তিমির বর্মণ এগিয়ে আসেন, কৃতজ্ঞতা ও স্বস্তি মেশানো সুরে বলেন - ওয়েলকাম টু কলকাতা প্রফেসার সেন। আপনি যে শেষ মুহূর্তেও আমাদের জন্য সময় দিয়েছেন, তার জন্য আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। আমাদের স্টুডেন্টস দের সৌভাগ্য তারা আপনার লেকচার শোনার সুযোগ পাবে। স্তুতিগান কে একটু রুক্ষ ভাবেই সংক্ষিপ্ত করেন তনিমা। আসার তাগিদটা আমারো কম ছিল না প্রফেসার বর্মণ। তবে আজকাল এই রিফিউজি ক্রাইসিসের প্রেক্ষাপটে, কাজের চাপ যে কি সাংঘাতিক সে তো জানেনই। সমব্যথী বর্মণ মাথা নাড়েন।
দেশ বিদেশের নামজাদা সমাজতত্ত্ববিদরা একত্রিত হয়েছেন একদিনের সেমিনারে, সমসাময়িক কিছু সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইস্যুতে সুশীল সমাজের কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করতে। ইস্যুর গাম্ভীর্য অনুপাতে, আগত অতিথিরাও বেশ গণ্যমান্য। তনিমা বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদ, বিদেশের এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান। কাজের সূত্রে কিছুদিন দিল্লীতে এসেছেন, সেই সুযোগই কলকাতার কর্মকর্তারা তাঁকে একবারের জন্য হলেও ঘুরে যেতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে, কলকাতায় প্রফেসার সেন।
২.
কত বছর পরে কলকাতায় পা রাখলেন তনিমা, প্রায় ২০ বছর তো হবেই। শহরটা চেনা যায় না। এয়ারপোর্ট থেকে এই সল্টলেক - কোথাও তার চেনা কলকাতাকে পেলেন না। এক রকম স্বস্তি বোধ করেন তিনি। কেমন জেন এক অপরাধবোধ থেকে মুক্তি। নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ক্লিষ্টতা? কিন্তু যখন সেই দেশটাই পালিয়ে গেছে নিরুদ্দেশে, তখন আর কিসের আক্ষেপ? পুরনো কিছু মুখ মনের পর্দায় ভেসে উঠে মিলিয়ে যায়। হাতের ফোনের কন্ট্যাক্ট লিস্ট আনমনেই কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে, ফোনটা হাত ব্যাগে ঢুকিয়ে দেন। নাহ অকারণে ফোন করার মত আজ আর কেউ নেই এককালের একান্ত আপন এই শহরে। চোখ বুজে সীটে হেলান দেন তনিমা, যতক্ষণ না গেষ্ট হাউসে পৌঁছয় গাড়ি। মনে মনে সেমিনারে কি বলবেন সেগুলি সাজিয়ে নিতে নিতে আবার কাজের জগতে হারিয়ে যান প্রফেসার সেন।
৩
সেমিনার হলে রিজার্ভ করা আসনে বিশিষ্ট অতিথিদের ভিড়ে আনমনে একাকী তনিমা। এক অস্বাচ্ছন্দ্য তাকে ঘিরে ধরেছে, ঐ মুখ, জেন কোন অতীতের পারে তাকে দেখেছেন, কি জেন নাম? চিনতে না পারা কি বয়েসের কাছে পরাজয়ের সূচনা? পরাজয়কে বড় অপছন্দ তনিমার। এদিকে মঞ্চে অতিথি আহবান করা শুরু হয়েছে। ঘোষিকার গলা - মে আই রিকোয়েস্ট প্রফেসার রায় টু জয়েন আস অন স্টেজ। 'রায়, প্রফেসার রায়', মুহূর্তে স্মৃতির উপর পরা ধুলো উড়ে যায়। নড়ে বসেন তনিমা। টেবিলের অপর প্রান্তে বসা সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক স্মিত হেসে স্টেজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, লম্বা শরীর, সামনে একটু ঝুঁকে হাঁটছেন। হল কখন ভর্তি হয়ে উঠেছিল, তনিমা খেয়াল করেননি, সারা হল ততক্ষণে করতালিতে প্রফেসার রায়কে স্বাগত জানাচ্ছে।
৪
ঘরের দরজায় ছোট্ট নক করে ভিতরে এল দেবরাজ, দেব। হা ক্লান্ত বিষন্ন তনিমাকে সরাসরি প্রশ্ন - তুমি ঠিক কি চাও তনু? পরিষ্কার করে বল। চারপাশে ছড়ানো প্যাকিং বাক্সে, নিজের অফিস প্যাক করছিলেন তনিমা। ঘুরে দাঁড়িয়ে সোজা দেবের চোখে চোখ রাখলেন তিনি।
- তুমি এখনো বোঝনি কি চাই? তিন বছর হয়ে গেল, এবার যাই। গুড ডে দেব। আমার অনেক কাজ বাকি। অনেক কিছু গোছাতে হবে, জীবনটাকেও।
ক্ষুব্ধ গলায় দেব বলেন, তুমি আমায় চলে যেতে বলছ? এড়িয়ে যাচ্ছ আমায়?
-সামান্য হেসে কোমর সোজা করে, স্ট্রেচ করলেন তনিমা
- না তো, আমি তো বুঝেছি আমার বন্দরের কাল শেষ, তাই নোঙর তুলছি। তুমি ভালো থেকো। আমিও ভালো থাকবো, কথা দিলাম।
দেবের চলে যাওয়ার পথের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়েছিলেন তনিমা। জানালা দিয়ে দেখেছিলেন ইউনিভার্সিটির বিশাল লন পেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন দেব, লম্বা চেহারা, সামনের দিকে সামান্য ঝোঁকা।
৫
আজ আবার দীর্ঘ ১৪ বছর পরে, আরেকটা দরজা খুলে যেন আবার দেবের প্রবেশ। সেদিনের মতই আকষ্মিক আবার খানিকটা যেন প্রতীক্ষিত। কলকাতায় আসার পিছনে কি দেবের স্মৃতি কাজ করেনি? যে প্রফেসার সেনকে এক বছর আগে না ডাকলে পাওয়া যায় না, এত সহজেই তিনি এলেন এ শহরে! শহরের মাটি আর বাতাসে পুরনো কলকাতাকে খুঁজতে খুঁজতে, তিনি কি খোঁজেননি দেবের সান্নিধ্যের গন্ধ? ঝাঁঝালো, নেশা ধরানো সেই গন্ধ যা তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এক অচেনা ভালোবাসার জগতে, যেখানে তাঁর ভালোবাসার প্রতিদানে দেব শুধুই বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রথম প্রথম সেটাকেই মস্ত পাওয়া বলে মনে হয়েছিল তনিমার, তরুণী তনিমার বন্ধু বিখ্যাত প্রফেসার দেবরাজ রায়। সূর্যর আলোয় আলোকিত চাঁদের মতই গরবিনী। কিন্তু প্রেম যে কম্প্রোমাইজ করতে চায় না! ভালোবাসার মানুষটিকে একান্তভাবে নিজের করে না পেলে যে তার শান্তি নেই। সেই শান্তির খোঁজেই অশান্তির সূচনা। দেব সম্পর্কটাকে বন্ধুত্বের বেড়াজালেই ঘিরে রাখলো, প্রেমিক দেব অধরাই রয়ে গেল। হতাশ তনিমা একদিন সব কিছুতে ইতি টানার সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজেই। টানাপোড়েনে তিনি ততদিনে জেরবার, নিজের সাথে কাঁহাতক যুদ্ধ করা যায়? বদলে ফেললেন কর্মস্থল, দেশ। কিন্তু ভালো থাকব বলে যে কথা তিনি দিয়েছিলেন সেটা কি রাখতে পেরেছেন? মনে মনে উত্তর খোঁজেন তিনি, প্রত্তুতরে আরেকটি প্রশ্ন মাথা চাড়া দেয়, ভালো থাকা ঠিক কাকে বলে? দেব ভালো আছে? মানে প্রফেসার দেবরাজ রায়!
৬
আরেকবার হল কাঁপানো করতালিতে আবার চিন্তায় ছেদ পড়লো। মঞ্চে দীপ জ্বেলে দেব অনুষ্ঠানের সূচনা করছেন। একদৃষ্টে দেখেন তনিমা। দেবকে তিনি প্রথমদর্শনেই চিনতে পারেন নি, এও কি সম্ভব?
আয়োজকরা তনিমার যোগদান নিয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলেন না। তাই উদ্বোধনী সেশনে তাঁর বক্তৃতা নেই। তাছাড়া এই সেশনটাতে মন্ত্রীরাই সম্মানিত অতিথি - তা তাঁরা বিষয় নিয়ে যত অজ্ঞই হোন না কেন। এক্ষেত্রেও কোন ব্যতিক্রম হয় নি।
প্রথম সেশন শেষ। চা পানের বিরতি ঘোষিত হল। অনিচ্ছুক পায়ে চা/কফি পরিবেশনের হলের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। মন চাইছে এই মুহূর্তে চলে যেতে, বাস্তবে এর পরের সেশনের মূল বক্তব্য তাকেই রাখতে হবে। খুব ক্লান্ত লাগে হঠাৎ। যেন কত রাত ঘুম নামেনি চোখে। - ম্যাডাম কফি না চা? পরিবেশনকারী প্রশ্ন করে। কালো কফির কাপে চুমুক দিয়ে আলোকিত ঘরে এক অন্ধকার কালো কোণ খোঁজেন তিনি, তার দেহ, মন পালাতে চাইছে, চাইছে একাকীত্বে। কিন্তু সেটাই সম্ভব নয়। প্রফেসার বর্মণ আসছেন তার দিকেই সাথে প্রফেসার রায়। আপনাদের তো নিশ্চই পরিচয় আছে? দেবকে দেখিয়ে তনিমার দিকে প্রশ্ন ছোঁড়েন বর্মণ। দেবই বলে ওঠেন, প্রফেসার সেনকে কে না চেনে?
- আপনার শেষ বইটির দ্বিতীয় আর্টকালে, রিফিউজি ক্রাইসিসের পলিটিকাল ইকোনমিক বিশ্লেষণ খুবই সময়োপযোগী, অগ্রিম কনগ্রাচুলেশান, সেরা সমাজতাত্ত্বিক সম্মানের তালিকায় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য। আপনি সত্যি একজন এচিভার। তনিমা বিশেষ কিছু বলার আগেই অন্যদিক থেকে কারা যেন দেবকে ডাক দেয়। এক্সকিউজ মি - বলে সেদিকে এগিয়ে যান তিনি, তনিমাকে, মানে তনুকে চিনতে পারার কোন চিনহই তার ব্যবহারে প্রকাশ পায় না।
৭
মন থেকে যেন এক বোঝা নেমে যায় তনিমার। যেন বিশাল এক কৈফিয়তের দায় থেকে তাকে মুক্ত করে গেল দেব, অনেকদিন যে কৈফিয়ত তিনি মনে মনে আউড়েছেন, আজ তাতে পূর্নছেদ পড়ল।
সেমিনার আবার শুরু হয়েছে, হলে পিন পড়লেও শব্দ শোনা যায়। তনিমা সেন তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছেন। সবার অলখ্যে সেমিনার থেকে বেড়িয়ে আসেন দেবরাজ, চায়ের ফাঁকে বর্মণ কে বলাই আছে, তাঁকে আরেকটা মিটিংএ যেতে হবে। করিডোর পার করে গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তনিমার গলা, কানের পর্দায় আছড়ে পরে - তনু সেই একইরকম আছে, প্রতিভাময়ী, জেদি আর অবুঝ। আজো তার দুচোখে অভিমান দেখেছেন দেব, আর দেখেছেন অপেক্ষা। সেবার তনু চলে গেছিল দূরে, এবার তার পালিয়ে যাওয়ার পালা। সেদিন যা উপেক্ষা করেছেন হেলায়, আজ তা দাবী করার সাহস তাঁর নেই। গাড়ি রাজপথে গড়ায়। অতীতের উপর পর্দা ফেলে, সব রকম টানাপোড়েন থেকে নিজেকে মুক্তি দেন দেব। তনু তাকে মুক্তি দিয়ে গেল আরেকবার, নিজের অজান্তেই।
চোখ বুজে সীটে হেলান দেন প্রফেসার রায়।