এখান থেকে নিঝুম দ্বীপ আরও ২/৩ ঘণ্টার পথ।দুই ভাবে যাওয়া যায়।বাইকে করে কিছুদুর গিয়ে নদী পাড় হয়ে আবার বাইকে করে নিঝুম দ্বীপ।অন্য পথ টা হল ট্রলার ভাড়া করে সরাসরি নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার।ঘাটে আর একটা বড় গ্রুপের সাথে পরিচয় হল।ডাচ বাংলা ব্যাংক থেকে আসছে ওরা এগার জন।আমার বন্ধুরা ৯ জন আর আমরা ২ জন।২২ জনের একটা বেশ বড় দল হয়ে গেলাম।ভেবে দেখলাম বাইকের চেয়ে ট্রলার এ করে হই হুল্লোড় করে চলে যাই সবাই মিলে।পর্যটনের সবুজ ভাইয়ের সাথে কথা বলে রেখেছিলাম আগেই যদি প্রয়োজন পড়ে যেন একটা ট্রলার এর ব্যাবস্থা করে দেয়।সবুজ ভাই কে ফোন করলাম।ভাই বলল ডাচ বাঙলার ওই গ্রুপের জন্য অলরেডি একটা ট্রলার ঠিক করা আছে ঘাটে।আমি চাইলে ওদের সাথে কথা বলে একসাথে আসতে পারি।সবাই মিলে অবশেষে ট্রলারেই উঠে বসলাম।
তপ্ত দুপুর মাথায় নিয়ে ট্রলারে আমরা
নদীর পাশ দিয়ে ট্রলার এগিয়ে চলল।জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য দেখতে আমরাও আড্ডায় জমে গেলাম।সবাই নিরুদ্বেগ প্রকৃতির ছবি তোলায় মগ্ন।একসময় মধ্য দুপুরের উদোম রোদে পড়ে গেলাম।কোন বাতাস নেই।ভয়াবহ তাপে সিদ্ধ হওয়ার মত অবস্থা আমাদের।মাঝি আমাদের প্রথমে বলেছিল এক দের ঘণ্টার মত লাগবে।এদিকে এক ঘণ্টা পেরিয়ে দুই ঘণ্টাও পাড় হয়ে যায়।আমাদের নিঝুম দ্বীপের এখনও খবর মেলেনা।অনেকেই আফসোস করতে লাগলো কেন বাইকে করে গেলনা অন্তত তীব্র উত্তাপ থেকে তো বাঁচতে পারতো।সময় টাও যেন আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেল।কিছুতেই ফুরোয় না।
দীর্ঘ অপেক্ষার শেষে অবশেষে ১ টার দিকে আমরা নামলাম এসে নিঝুম দ্বীপ।নিঝুম দ্বীপ হচ্ছে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার অন্তর্গত একটা দ্বীপ।মূলত বল্লার চর,কামলার চর,চর ওসমান আর চর মুরি এই চারটা চর নিয়ে গঠিত।দ্বীপ টি আয়তনে ৪০৩৯০ বর্গকিলোমিটার এবং প্রায় ২০ হাজার জনসংখ্যা(স্থানীয়দের ভাস্যমতে)অধ্যুষিত এই দ্বীপ টি পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত।১৯৭৪ সালে বন বিভাগ ২০ বছরের একটা প্রোগ্রামের আওতায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী হাতে নেয়।উত্তরে প্রায় ৯ হাজার একর নিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ যেমন গেওয়া,পশুর,করমজা,বাইন,বাবুল সহ অনেক গাছ রোপণ করে।২০০১ সালের পহেলা এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার দ্বীপ টিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষনা করে।
হরিণ দর্শনে যাওয়ার পথে
প্রায় ১২/১৩ বছর আগে প্রথমবার আসছিলাম।সেই গল্প আর করা হয়ে ওঠেনি।অনেক পরিবর্তন তাই প্রত্যাশিতই ছিল।ওরা এগার জন আর আমরা দুই জন আমাদের গন্তব্য পর্যটনের অবকাশ।আগে থেকেই আমি বুকিং করে আসছি।আমার বন্ধুদের দলটা আর একটা হোটেল এ উঠবে।হোটেল পর্যটনের ম্যানেজার সবুজ ভাই কে ফোন করলাম।ভাই এসে নিয়ে গেল আমাদের।আমাদের রুম বুঝিয়ে দিল।প্রায় ৫০ জনের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন বেশ পুরনো এই হোটেল টা।কিছুদিন আগেও ছিল নিঝুম দ্বীপের একছত্র অধিপতি।এখন বাজারে আর একটা হোটেল হয়েছে। ২৩ ঘণ্টার টানা জার্নির শেষে একটা লম্বা সময়ের গোসল করা খুব জরুরি হয়ে উঠল।আমার কলিগ রাজীব ভাই কে আগে পাঠালাম গোসলে।আমি ততক্ষনে ব্যাকপ্যাক চেক করে নিলাম।সবকিছু ঠিকঠাক আছে।বিকেলের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করে নিলাম।সে আসতেই আমি ঢুকলাম।যতসময় সম্ভব পানির সাথে থাকলাম উত্তাপের তাপ কিছুটা যদি কমে তাতে।এতক্ষনে মনে হল কিছু খাওয়া দাওয়াও করা দরকার।পেটের ভেতর চোঁ চোঁ করছে ক্ষুধায়।বেরুতে যাব অমনি দেখি সবুজ ভাই চলে আসছে ডাকতে আমাদের দুপুরের খাবার খেতে।আরে বাহ!এত দেখি মেঘ না চাইতেই জল।ইলিশের ঝোল,শুঁটকি মাছ সাথে ছোট মাছের ফ্রাই চমৎকার একটা লাঞ্চ হয়ে গেল। এবার একটু ঘুমিয়ে নেই।রাজীব ভাই এতক্ষনে ঘুমের রাজ্যে।কেবল একটু চোখ টা লাগতেই ডাচ বাংলা ব্যাংকের একজন ডেকে তুলল।ওরা দক্ষিনে কবিরাজ চর দেখতে যাবে আমরা যাবো কিনা।ভেবে দেখলাম ওদের সাথে ঘুরাটা খারাপ লাগবেনা।এতক্ষন একসাথে আসায় বেশ ভাল জমেও গেছে ওদের বেশ কয়েক জনের সাথে আর তাছাড়া বিকেলে যখন চৌধুরী খালের দিকে যাবো নৌকা ভাড়া করে তখন কিছুটা সাশ্রয়ীও হবে।কলিগ কে ডেকে ওঠালাম।বেচারা মাত্র কিছুক্ষন ঘুমিয়েছে।কিসসু করার নেই আমরা ঘুরতে আসছি আরাম করতে না।তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে ওদের পিছু নিলাম।দক্ষিনে সমুদ্র খুব কাছে।এদিকে রাতে বারবিকিউ করার তোরজোরও শুরু হয়ে গেছে ওদের মধ্যে।কেউ বলছে ইলিশ মাছের আর কেউ বলছে দেশি মুরগী দিয়ে বারবিকিউ হবে।শেষে ভোটাভুটিতে ইলিশ মাছ ফাইনাল হয়ে গেল।একজন কে মাছ সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়ে আমরা চলে গেলাম চরের দিকে।কিছুক্ষন থাকলাম ওদিকটায়।তারপর দূর থেকে সাগর কে টাটা দিয়ে চলে আসলাম।
ব্যাস্ত রাখাল
শাঁসমূল
হরিণ ধরতে না পারলেও হরিনের শিং ঠিকই পেয়েছি
এবার আমাদের কাঙ্ক্ষিত হরিণ দর্শনের পালা।একটা ইঞ্জিনচালিত নৌকা ঠিক করলাম।আমাদের গন্তব্য উত্তর পূর্ব দিকের হরিণের অভয়ারন্য বলে পরিচিত চৌধুরীখাল।আমাদের ১১ জনের দল যাত্রা করলাম একটা ছোট্ট নৌকায়।হেলেদুলে চলতে থাকলাম নৌকায়।২০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম এক প্রান্তে।একটু আগেই নেমে আসলাম আমরা।তারপর নৌকার মাঝি কে গাইড বানিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম হরিণ দর্শনে।কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি আমরা দুই গ্রুপ হয়ে গেছি।আমার সাথে আরও ৫জন কে দেখলাম যারা অনেকদুর এগিয়ে গেছি বাকিদের পিছনে ফেলে।টানটান উত্তেজনায় চুপুচুপি এগুচ্ছি আমরা।কারন আমাদের সারাশব্দ পেলে হরিণের দল ভুলেও আমাদের সামনে আসবেনা।আমরা অপেক্ষায় কখন এক ঝাঁক হরিণ এসে আমাদের স্বাগতম জানাবে।কিন্তু বেরসিক হরিণের দলের দেখা নেই।এদিকে আমাদের একেক জনের পায়ের অবস্থা যায়যায়।শ্বাসমূল গুলো যেন ঝকঝকে ছুরির ফলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অপেক্ষায়।ওদের কে এড়িয়ে পা ফেলার জায়গা পাওয়া খুব কঠিন।একটু এদিক সেদিক হলেই গুঁতো।কয়েক জনের পা কেটে রক্ত বেরিয়ে আসছে।কিন্তু হরিণ তো দেখতে হবেই তাই সেদিকে খুব একটা ভ্রুক্ষেপ নেই কারোরই।হঠাৎ দূর থেকে মনে দুটি হরিণ আমাদের চুপি চুপি দেখছে।আমরাও এগুচ্ছি।ইতিমধ্যে দূর থেকেই চোখে চোখে কথা হয়ে গেছে আমার ওদের সাথে।আবার তাকিয়ে দেখি নেই ওরা।একদম হাওয়া।কয়েকজন দেখতেই পায়নি।বেচারা রা !আবার এগুতে থাকলাম আমরা।একটা ছোট দলকে এবার খালের উল্টো পাশ দিয়ে দৌড়ে যেতে দেখলাম।পিছনে পিছনে আমরাও ছুটলাম।কিন্তু ওদের কে ধরে কার সাধ্য।
কয়েকটা ছবি আমার বন্ধুর থেকে ধার নেওয়া
ফেরার পথে আমরা
এতক্ষনে সন্ধ্যা হতে চলল।এবার খবরই আছে।প্রথমত অন্ধকারে আর দূর থেকে ভাল করে হরিণ দেখা যাবেনা আর সবচেয়ে বড় কথা হল অন্ধকারে শ্বাসমূলের মধ্যে হাঁটা খুব কষ্ট হয়ে যাবে।দুইজন তো হরিণের দেখাই পায়নি।খুব হতাস তারা।আমারও স্বাধ মেটেনি।আর বেশি করে ঝাঁকে ঝাঁকে আশা করেছিলাম।সেখানে মাত্র দুইবার দেখেছি তাও কিছুটা দূর থেকে।কিছুটা হতাশ হয়েই ফিরতে শুরু করলাম।যে অন্ধকারের ভয় পেয়েছিলাম সেটা আস্তে আস্তে দূর হয়ে গেল যখন দেখলাম চাঁদ মামা তার পূর্ণ আভা নিয়ে হাজির হতে শুরু করেছে।ভুলেই গেছিলাম ভরা জোছনার কথা।ফেরার পথে একজন হরিণের এক বড় শিং পেয়ে গেল।সে তাতেই মহাখুশি।দুধের স্বাধ ঘোলেতো তো মিটল।ফিরতে ফিরতে বাকিদের পেয়ে গেলাম।ওরা আমাদের মত অত ভেতরে যায়নি।ওদের অবস্থাও একই।দুই একজন দেখেছে তাও দূর থেকে।কি আর করা ভাগ্য হয়তো খুব ভাল ছিলনা আমাদের।নৌকায় ফিরে আসলাম আবার।কাদায় মাখামাখি করে ফিরে চললাম খাল ধরে।কিছুদূর আসার পর নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল।কিছুতেই ছোট নৌকা আমাদের ১২ জনকে টেনে নিয়ে যেতে পারছেনা স্রোতের বিপরীতে।দুর্ভাগ্যের শেষটুকও মেনে নিয়ে নেমে গেলাম আমরা খালের পাড়ে।হাঁটা শুরু করলাম খালের পাড় ধরে।কয়েক জন কে দেখলাম খুব বিরক্ত। যারা সবসময় রিলাক্স ট্যুর দিয়ে অভ্যস্ত ওদের জন্য আসলেই কষ্টকর হয়ে গেল।একেতো সেভাবে হরিণের দেখা পায়নি তারপর আবার ওই কর্দমাক্ত পিচ্ছিল রাস্তায় হাঁটা ওদের জন্য খুব কঠিন হয়ে গেল।আমি খুব এঞ্জয় করছিলাম ওদের কাণ্ডকারখানা দেখে।এভাবে ২০/৩০ মিনিট হাঁটার পর অবশেষে এসে পৌঁছলাম হোটেলে।
স্বাধ তো মিটলনা।কি করি! হোটেলে ফিরেও তাই সস্তি পাচ্ছিনা।আমার কলিগেরও মন কিছুটা ভার।সবুজ ভাই কে গিয়ে ধরলাম।রাতে কোন ব্যাবস্থা আছে কিনা।সবুজ ভাই কয়েক জন কে ফোন করে একজন কে রাজি করিয়ে ফেলেছে।এবার জমবে খুব।এই রাতে তার সাথে আমরা যাবো অধরা হরিণের সান্নিধ্য পেতে।রাত তখন ৯ টা।এক বাইকে আমরা ৩ জন চললাম শীতের ঠাণ্ডা ঝাপটা গাঁয়ে মেখে।আমাদের এবারের গন্তব্য দক্ষিণ পূর্ব দিকের চোয়াখালি।অন্য আর একটা হরিণের অভয়ারন্য।এবার আর হতাস হতে চাইনা।মাথায় সাদা ধবধবে চাঁদ কে নিয়ে আমরা এসে নামলাম চোয়াখালি খালের পাড়ে।ভরা পূর্ণিমার আলোয় চারদিকে চকচক করছিল।সামনের খাল টা পাড় হতে হবে।এখন ভাটা চলসে।তাই খালে খুব বেশি পানি নেই।কিন্তু এই শীতে গলা পরিমান পানিতে নামার সাহস পাচ্ছিলামনা।পাশেই একটা নৌকা বাঁধা আছে মাঝ খালে।কিন্তু নৌকা টাও বেশ দুরত্তে বাঁধা আছে।ওটাকে দড়ি বেঁধে কিছুটা টেনে আনলাম পাড়ের দিকে।তারপর সাহস করে দিলাম লাফ।পড়লাম গিয়ে নৌকার মাঝে।পড়েই বেসামাল আমি আবিষ্কার করলাম পুরো নৌকা টা কাঁকড়ায় ভরা।পা ফেলার জায়গাটাও নেই।আমার গাঁ শিরশির করতে লাগলো।তাড়াতাড়ি ওপারে যাওয়ার জন্য আবার লাফ দিলাম।গিয়ে পড়লাম পাড়ের কাঁদায়।গাঁয়ে কাদা মেখে ওঠে পড়লাম।রাজীব ভাই ও গাইডের সাহায্য নিয়ে নৌকা পার হয়ে আসলো।
রাতে হোটেলে ফিরে দেখি ইলিশের বারবিকিউ আমাদের জন্য
এবার দেশি মুরগির বারবিকিউ (আমার বন্ধুদের টা দিয়ে দিলাম)
ধবধবে জোছনা মেখে এগিয়ে চললাম আমরা হরিণের খোঁজে।এইবার তাকে না দেখে ফিরছিনা কিছুতেই।সে যদি সারারাত ধরে অপেক্ষা করতে হয় তাও রাজি।এখানেও শাঁসমুলের আক্রমন আছে তবে একটু কম।তাছাড়া পূর্ণিমার আলোয় চারদিক এতোই ঝকঝক করছে যে বহুদুরের গাছগুলোও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।আমরা আস্তে আস্তে এগুতে লাগলাম।চোখ কান খোলা।রাতের আলোয় হাঁটছিলাম গাঁ ছমছমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে।চারদিকে অনেকবেশি চুপচাপ।ভেতরে ভেতরে যে ভয়টা পাচ্ছিলাম তা কেউ কাউকে বুজতে দিচ্ছিনা।এতো নির্জন যে পা ফেলার আওয়াজ টাও খুব শব্দ হচ্ছে।এই বুজি কিছু একটা ঝাঁপিয়ে পরছে আমাদের উপর।যদিও আমরা জানি যে ওখানে হরিণ ছাড়া আর কোন হিংস্র প্রাণী নেই।তবে আছে হিংস্র কিছু মানুষ।সেই গল্প একটু পর বলছি।আমার ভাগ্যটা এবার মনে হয় খুব ভাল।একদম আমার সামনে এসে পড়েছে এক ঝাঁক হরিণের পাল।চোখ গুলো জ্বলজ্বল করছে যেন।ভয় পাওয়ার মত অবস্থা।এতগুলো হরিণ একসাথে ভাবাই যায়না।আমি যতটা না আশ্চর্য হয়েছি এর চেয়ে বেশি হয়েছে ওরা আমাদের দেখে।এতো রাতে বনের এতো ভেতরে মানুষ দেখবে তা মনে হয় ওরা স্বপ্নেও ভাবেনি!কিন্তু বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে নিতে ওদের বেশি সময় লাগেনি।আমার বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে সামনে তাকিয়ে দেখি ওরা আর নেই।হারিয়ে গেছে।পেছনে তাকিয়ে দেখি আমার কলিগ আশে পাশে খুঁজছে।জিজ্ঞেস করলাম তাকে দেখছে কিনা।সে বলে কোথায়,কি?বেচারা এবারও মিস করে গেল!
আমরা দুজনায়
রাত ১০ টা।আমরা বনের অনেক গভীরে চলে আসছি।এর মধ্যে আরও বেশ কয়েকবার কয়েক ঝাঁক হরিণের দেখা পেয়েছি তবে বেশ দূর থেকে।শুধু কয়েকশত জ্বলজ্বলে চোখ দেখেছি যা বেশ ভয় পাওয়ার মত!গভীর বনে ঘন গাছের সারির ভেতর থেকে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে জোড়ায় জোড়ায় চোখ।কয়েক পাল হরিণের পিছু পিছু ছুটলাম কয়েকবার।কিন্তু ওদের সাথে দৌড়ে পাড়ে কার সাধ্য।মুহূর্তেই হারিয়ে যায় গভীর বনে।হঠাৎ দূর থেকে কেউ একজন লাইট মারল আমাদের দিকে।আমরাতো ভয় পেয়ে গেলাম!এই নির্জন গভীর বনের ভেতর মানুষ আসলো কোথা থেকে!আরও কিছুদূর আগানোর পর লোকটা চিৎকার করে জানতে চাইলো কে আমরা।আর বারবার লাইট মারতে লাগলো আমাদের চোখে মুখে।মনে হল বেশ খেপে গেছে সে আমাদের দেখে।আমরাও বুঝতে পারছিলাম না কতজন আছে সেখানে।একজনকেই কথা বলতে শুনছি আর লাইটও মারছে একজন।তবে তার সাথে আরও লোকজন থাকা অস্বাভাবিক না।আমাদের গাইড তার নাম বলল কিন্তু মনে হল সে চিনতে পারেনি।আমরা আরও কাছাকাছি চলে গেলাম তার ভয়ে ভয়ে!গিয়ে দেখি একজন লোক খালের পাশে জুমঘর বানিয়ে সেখানে মাছ ধরছে।এবার আমাদের গাইড তার পরিচয় দেওয়ার পর মনে হল চিনতে পারছে।কিন্তু আমাদের এই প্রায় মধ্য রাতে গভীর বনে আগমনের কারন শুনে খুশি হতে পারেনি।একটু বেশি নাকি দুঃসাহস দেখিয়ে ফেলেছি।আর কিছুদূর এগুলেই আর একটা ছোট খাল পেয়ে গেলাম আমি তার ওপর একটা গাছ দিয়ে তৈরি সেতু করা আছে।ওদিকে গাইড ওই লোকটার সাথে কথা বলে চলেছে আর আমি একাই কিছুদূর এগিয়ে আসছি।হঠাৎ গাইড জোরে আমাকে ডাকল আমি যেন আর সামনে না এগোই।আমি ফিরে আসলাম কিছুটা ভয় পেয়ে।এবার লোকটা জানাল খালের ওই পার একসময় বনদস্যুদের খুব উৎপাত ছিল।ইদানীং যদিও দেখা যায়না তবে থাকাটাও অস্বাভাবিক না।এবার মনে হল আসলেই কিছুটা দুঃসাহসিকের কাজ করে ফেলেছি আমরা।ভেতরের ভয় পাওয়াটা এখনও কেউ কাউকে বুজতে দিচ্ছিনা কিন্তু এবার ফেরার জন্য আমি প্রস্তুত।অনেক হরিণ দেখেছি আমি এই পূর্ণিমার রাতে।আর নয়।এবার ফেরা যাক।
ফেরার পথে নলছিরা ঘাটে এই দৃশ্য,মাছের বদলে সাপ
মোবাইল খুলে দেখি অনেকগুলো ফোন আসছে।ওরা আমাদের অপেক্ষায় থেকে থেকে ডিনার করে ফেলেছে আর এখন বারবিকিউ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।ফিরতে গিয়ে পড়লাম আর এক বিপদে।ভাটার সময় যে ছোট খাল পেরিয়ে আসলাম সেই খাল এসে দেখি পানিতে ভরে বড় হয়ে গেছে।নৌকাটা মাঝ নদীতে বাঁধা আছে এখনও।ওটা আনতে বেশ বেগ পেতে হল।কোনরকমে কাঁদায় মাখামাখি করে আবার পার হলাম।এসে ডিনার করে নিলাম আলতাফ ভাইয়ের হোটেলে।নিঝুম দ্বীপের এখনও পর্যন্ত মানসম্পন্ন একটা হোটেলের কথা যদি বলি তবে আলতাফ ভাইয়ের কথা বলতেই হবে।আমাদের দুপুরের খাবার এখান থেকেই নেওয়া হয়েছিল।দেশি মুরগীর ঝালফ্রাই আর ইলিশের ঝোল সাথে ছোট মাছের চর্চরী।বেশ জমজমাট ডিনার হয়ে গেল।ডিনার করে এসে দেখি বারবিকিউ রেডি হচ্ছে পুরো দমে।বেশ বড় সাইজের কয়েক টা ইলিশের ব্যাবস্থা করা হয়েছিল আগেই।সবুজ ভাই নিজেই দায়িত্ব নিয়েছে পুরো আয়োজনের।আমরা এসে দেখি প্রায় শেষ হয়ে আসছে জম্পেশ পার্টির।এবার খাওয়া দাওয়ার পালা।মাত্রই ডিনার করে এসে আবার কি করে পোড়া ইলিশ খাই।রাজীব ভাই তো কিছুতেই আর খাবেনা।আমি কিছুটা খেয়ে ওদের সাথে জয়েন করলাম পার্টিতে।
দেখুন ট্রলারের অবস্থা
পরদিন ঘুম ভাঙল বৃষ্টির ঝাপটায়।এটাই শুধু পাওয়ার বাকি ছিল এখানে।এবার পূর্ণতার খাতা ষোলআনায় পূর্ণ হল।আমার প্রিয়তমে নিজেও এসে দেখা দিয়ে ছুঁয়ে দিয়ে গেল।তবে যা হলনা তা হল খুব সকালে আবার চোয়াখালি যাওয়ার প্ল্যান ছিল।এবার এটা বাদ দিতে হল।তাতে অবশ্য খুব বেশি আফসোস হবার কথাওনা আমাদের।ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম।এবার ফিরতে হবে ঘরের ছেলে ঘরে।তবে ফিরব এবার ভিন্ন পথে।আসলাম লঞ্চে এবার ফিরব চেয়ারম্যান ঘাট,সোনাপুর হয়ে ঢাকা।দুটো ভিন্ন ভিন্ন পথের স্বাদ নেওয়া হবে এতে।ঘণ্টা দুয়েক পর বৃষ্টি ছাড়লে বেরিয়ে পরলাম আমরা।আবারও আলতাফ ভাইয়ের ওখানে নাস্তা করে বিদায় নিলাম সবার থেকে।ওখান থেকে বাইকে করে নিঝুম ঘাট।নদী পার হয়ে আবার বাইক নিতে হবে।এবার প্রায় ৬০/৭০ কিলোমিটারের পথ নলছিরা।দরদাম করে ৩২০ টাকায় ঠিক করে ফেললাম রুবেল নামের একজনকে।যখন নলছিরা পৌঁছলাম ততক্ষনে এসে দেখি সি ট্রাক ছেড়ে গেছে একটু আগে।এখন দেড়টা বাজে।শেষ পর্যন্ত ট্রলারের অপেক্ষাতেই বসতে হল।ঘণ্টা খানেক অপেক্ষার পর অবশেষে একটা ট্রলারের সিরিয়াল পেলাম।হুরমুর আমাদের মত প্রায় শ’খানেক যাত্রী উঠে পড়ল।কোথাও পা ফেলার পর্যন্ত জায়গা নেই।ঢাকার ১৩/৭/৮ নাম্বার বাসের মতো ঠেসে ঠেসে লোক ভরা হল।আসল চমক তখনও বাকি।ট্রলার ছাড়ছেনা দেখেও দেখলাম লোকজনের কোন বিকার নেই।মনে হয় ওরা এতেই অভ্যস্ত।বেশ কিছুক্ষন পর বুজলাম না ছাড়ার রহস্য।সারি সারি ভ্যান এসে ভীরতে লাগলো ট্রলারের পাশে।সব ভ্যান মাছ ভর্তি।শুনলাম সব নাকি ইলিশ মাছ।ইশ! এত মাছ কোথায় যাচ্ছে।যেখানে পা ফেলার জায়গাটুকো পর্যন্ত নেই ছোট্ট এই ট্রলারে সেখানে প্রায় একশো বস্তা ইলিশ ওঠাল ওরা।আমরা যেখানে বসেছি তার নিচ দিয়ে সব স্তুপ করে নিল।ট্রলার নদীর পারেই দুলতে শুরু করে দিল।এইটা কি করে সুবিশাল নদী পার হয়ে চেয়ারম্যান ঘাট পৌঁছবে ভাবতেই গাঁ শিউরে উঠলো।ট্রলার ছাড়ার পর অবশ্য খুব একটা দোলেনাই।মাঝ নদীতে যাওয়ার পর একবার প্রচণ্ড ভাবে দুলে উঠলো।এপার ওপার তাকিয়ে দেখি ধু ধু সাদা ছাড়া কিছু চোখে পড়ছেনা।এখানে কিছু হয়ে গেলে কয়েক মাস লাগবে হয়ত আমাদের খুঁজে পেতে আবার নাও পেতে পারে যদি সাগরে ভেসে যাই।ভয়ে আত্মারাম বের হয়ে যাওয়ার জোগাড়।আশেপাশে তাকিয়ে দেখি কারও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে।অন্তত ৩০ থেকে চল্লিশ জন মহিলা আছেন ট্রলারে,সাথে বাচ্চাও আছে।কিন্তু কেউ ভয় পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছেনা।কেউ যখন ভয় পাচ্ছেনা তখন আমারও ভয় পাওয়া চলেনা।আমি যেহেতু আবার সাঁতারও জানি তাই ভয় পাওয়া একদমই মানায়না আমাকে।যদিও বাস্তবতা হচ্ছে এখান থেকে সাঁতরে পার হতে বললে হয়ত মাইকেল ফেলেপস ও ভয় পেতেন!পিছনে বসা রাজিব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি সে জোর করে মুখে হাসি আনার অপচেষ্টা করছে।ভাবছি এই শীতে প্রায় ঠাণ্ডা নদীতেই যেখানে এমন কাঁপন ওঠে সেখানে ঘন বর্ষায় নদীর চেহারা কেমন হতে পারে ভাবতেই থামিয়ে দিলাম ভাবনাটা।আর ভাবতেও চাইনা।প্রায় দের ঘণ্টা পর অবশেষে আসলাম চেয়ারম্যান ঘাটে।এখান থেকে ৪৩ কিলোমিটারের পথ সোনাপুর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য।সিএনজি তে করে একঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে পৌঁছে গেলাম সেখানে।৪ টা বেজে গেছে ইতিমধ্যে।আমাদের দুপুরের খাওয়াও হয়নি।ভাত খাওয়ার চেয়ে ভাবলাম পরোটা সবজি মেরে দেই আপাতত।রাতে ঢাকায় ফিরে ভাত তো খাচ্ছিই।সোনাপুর টা একটু ঘুরে দেখে নিলাম।আবার কবে আসি! শেষে ৫ টার বাসে উঠে বসলাম আমাদের প্রিয়!ঢাকার উদ্দেশ্যে।
কীভাবে যাবেন,কি করবেন :
গল্পের ছলে উপরে যদিও সব তথ্য দেওয়া হয়ে গেছে তারপরেও আবার বলছি।নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যাবে দু’ভাবে।সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে অথবা বাসে নোয়াখালী হয়ে।বাসে করে গেলে প্রথমে যেতে হবে নোয়াখালির সোনাপুরে, সেখান থেকে লোকাল বাস বা সিএনজিতে করে যেতে হবে চেয়ারম্যান ঘাটে।ওখান থেকে ট্রলার অথবা সি ট্রাকে করে হাতিয়ার নলছিরা।ওখান থেকে বাইকে অথবা টেম্পো তে করে জাহাজমারা বাজার হয়ে মুক্তারিয়া ঘাট।নদী পার হয়ে বাইকে করে নিঝুম দ্বীপ।আর লঞ্চে গেলে ঢাকার সদরঘাট থেকে যেতে হবে।ঢাকা থেকে হাতিয়ায় যাওয়ার জন্য মোট ২ টা লঞ্চ বরাদ্দ রয়েছে।এর একটার নাম "টিপু ৫/ফারহান ৪" অন্যটা "পানামা"।আমরা গেছি ফারহান ৪ এ,যা ৫:৩০ এ ছেড়ে যায় সদরঘাট থেকে।তবে তজুমদ্দিন দর্শন করতে হলে ৫ টার লঞ্চ ধরতে হবে।এর মধ্যে একমাত্র ফারহান ৪ ই নিঝুম দ্বীপ পর্যন্ত যায়।বাকিগুলো তে গেলে তজুমদ্দিন ঘাটে নেমে যেতে হবে।ওখান থেকে ট্রলারে করে নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার।সময় লাগবে ২-২:৩০ ঘণ্টা।বোনাস হিসেবে তজুমদ্দিন দর্শন(যদি পর্যাপ্ত সময় হাতে থাকে)।টিপু আর ফারহান লঞ্চের মালিক একই ব্যাক্তি।লঞ্চে গেলে ভাড়া পড়বে- ডেকে ৩৫০টাকা (আনুমানিক) কেবিন (৬০০/সিঙ্গেল, ১২০০/ডাবল।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ নাম্বার :
এম.ভি টিপু৫ এর টিকেট বুকিং নম্বর - ০১৭১১৩৪৮৮১৩। এম.ভি ফারহান ৩- ০১৭৮৫৬৩০৩৬৬।
এম.ভি ফারহান ৪- ০১৭৮৫৬৩০৩৬৯, ০১৭৮৫৬৩০৩৭০
হোটেল অবকাশ(নিঝুম রিসোর্ট, নামার বাজার) ম্যানেজার সবুজ ভাইয়ের নাম্বার : ০১৭৩৮ ২৩০৬৫৫/০১৮৪৫ ৫৫৮৮৯৯
হোটেল শাহিন : ০১৮৬৩ ১৫০৮৮১
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:০৩