আমাদের এবারের গন্তব্য খইয়াছরা।মাত্রই আগের দিন প্রথম আলোতে ফিচার আসছে খইয়াছরা নিয়ে।তাই খুব ভয়ে ছিলাম মানুষের না ঢল নামে।তাই ফেরার পথে আমরা রীতিমতো দৌড়ে এসেছি এবার চেনা রাস্তায়।তখন আর চারপাশে এডভ্যানচার টানছেনা।আমাদের মাথায় তখন অন্য কোন নেশার ঝিলিক।খুব স্বার্থপরের মতো আমরা দিব্যি ভুলে গেছি একটু আগেই আদর করে আসা সুন্দরীদের।অন্য রাস্তায় নতুন আর একটা পাহাড়ি খাঁড়া ট্রেইল ধরে নেমে আসলাম আমরা।ওখান থেকে চলে আসলাম নয়দুয়ারি।ওখান থেকে সিএনজি নিয়ে বরতাকিয়া বাজার।কিছুক্ষন বিশ্রাম দিলাম শরীর ও মন কে।খেয়ে নিলাম দুপুরের খাবার।
আবার সিএনজি নিলাম।চলে আসলাম রেল গেইট পর্যন্ত।এবার কাঁচা রাস্তায় মেঠো পথে নামতে হবে আবার।যেখান থেকে মুলত ট্র্যাকিং শুরু আমাদের।গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে এত সুন্দর রাস্তাও কাদায় ডুবে আছে।কাঁদার রাস্তায় কিছুদুর হাঁটার পর পেয়ে গেলাম ঝিরি পথ।কিছক্ষন চললাম ঝিরি ধরে।কিছুদুর গেলেই পেয়ে গেলাম কিছু বাড়ি।কেউ কেউ এতক্ষন ধরে হাতে করে নিয়ে আসা স্যান্ডেল রেখে দিল ওদের বাড়িতে।এবার আবার নেমে পড়লাম ঝিরিপথে।আগের ট্রেইলগুলো যদিও সহজ ছিলনা তবে শুধু ঝিরি ধরে হাঁটার কারনে খুব একটা কষ্টও হয়নি।কিন্তু এখানে বেপারটা মোটেও আনন্দদায়ক ছিলনা।কোথাও কোথাও হাঁটু পরিমান কাঁদা মাড়িয়ে আমাদের চলতে হয়েছে,পাহাড় বেয়ে নামতে হয়েছে আবার উঠতে হয়েছে বারবার।এতক্ষনে টের পেতে শুরু করলাম প্রথম আলোর রিপোর্টের প্রভাব।কি পরিমান মানুষের পায়ের ধুলি পেলে তা হাঁটু পরিমান কাঁদায় রুপান্তরিত হতে পারে ভেবেই শংকিত হচ্ছি।
বেশ কিছু ট্রেকারের দেখাও পেয়ে গেলাম ইতমধ্যে।পেয়ে গেলাম কিছু সৌখিন অভিযাত্রীর দেখাও।যারা ফিরছে চোখে আনন্দের ঝিলিক নিয়ে সাথে শরীরে ব্যাথার ধকলটাও স্পষ্ট।ঘণ্টা খানেক এভাবে চলতে চলতে অবশেষে পেয়ে গেলাম মাইটি খইয়াছরার দেখা।যার প্রথম ধাপের নিচে রীতিমতো ওয়াটার কিংডম বানিয়ে সাঁতার প্রতিজুগিতা চলছে যেন।এত মানুষের ঢল সত্যি অবাক করার মতো।সবার দেখাদেখি আমরাও ঝাপ দিলাম জলকন্যার বুকে।অনেক উপর থেকে বয়ে আসা স্রোতস্বিনী ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে গেলাম।অবগাহন করলাম এক আনন্দ সংগীতের।নিজাম ভাইয়ের ডাকে সম্বিত ফিরল।জিজ্ঞেস করল আমরা উপরের বাকি যে স্টেপ গুলো আছে তাতে উঠতে চাই কিনা।খইয়াছরা ৯ ধাপের এক শক্তিমান সুবিশাল ঝর্ণা।আয়তন আর উচ্চতার দিক দিয়ে যেটা নিঃস্বন্দেহে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঝরনাগুলোর একটা।যার নিচ থেকে উপরের দিকে তাকালে বোঝা যায়না উপরে আরও ভয়ঙ্কর আকাশ ছোঁয়া ৮টা ধাপ আছে সাথে ছোট ছোট আরও পার্শ্ব চরিত্র হিসেবে ছোট ভাই বোন তো আছেই।
তাকালাম উপরের দিকে যে পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে আমাদের।এতো এতো মানুষের মধ্যে থেকেও কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা সাহস করে উপরের দিকে উঠতে।গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর হয়ে আছে পাহাড়িও রাস্তা।কি করে উঠবো এই পিচ্ছিল পাহাড় বেয়ে।নিজাম ভাই আমাদের সাহস দিচ্ছে।বলছে কেউ না উঠলেও আমরা পারবো।গত দুই দিন আমাদের ট্র্যাকিং দেখে নাকি তার তাই মনে হচ্ছে।ভাইয়ের কথা শুনে সাহস পেলাম।আমাদের মধ্যে একজনের আগেই উপরের ধাপ গুলো জয় করা আছে তাই সে যাবেনা।আমরা দুজন ভয়ে ভয়ে নিজাম ভাইয়ের পিছু নিলাম।নিজাম ভাই আগে আগে উঠছে পাহাড় বেয়ে তারপর আমাদের জন্য দড়ি ফেলছে নিচে।সেই দড়ি সাথে গাছ থেকে নেমে আসা দড়ির মতো লতা গুল্মের সাপোর্ট নিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলাম।এতো পিচ্ছিল ট্রেইল যে আমাদের বিড়ালের মতো খামচি কেটে কেটে মাটিতে শরীর কে ধরে রাখতে হচ্ছে। ভয়ানক খাঁড়া এই পাহাড়ের নিচে তাকালেই বিপদ।কোনভাবে একবার পড়লে শরীরের হাড়গোড় একটাও আস্ত থাকবেনা।
কিছুক্ষন ওঠে আমরা একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলাম।তারপর আবার উঠতে থাকলাম যতটা সম্ভব শরীর কে মাটির সাথে লেপটে নিয়ে।যে নয়টা ধাপ আছে খইয়াছরা ঝর্নায় তার মধ্যে প্রথম এবং ষষ্ঠ ধাপ বেশি বড় উচ্চতার দিক দিয়ে।একটা ধাপ ২ তলা বিল্ডিং এর সমান।হামাগুড়ি দিতে দিতে অবশেষে আমরা পৌঁছলাম দ্বিতীয় ধাপে।ওখানে পৌঁছেই আমার সাথের ভাই খুব ভয়ানক ভাবে পরে গেল শরীরের ভারসাম্য রাখতে না পেরে।মনে হয় অতিরিক্ত নারভাসনেস থেকে এমনটি হয়েছে।ভাগ্যিস একদম শেষমুহুর্তে গাছের একটা ডাল ধরতে পেরেছিল।নইলে ওখান থেকে ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে নেমে আসা পানির স্রোতের সাথে নিচে পরে গেলে কারও বেঁচে থাকার সম্ভবনা নাই বললেই চলে।দেখলাম সে কাঁপছে।আমি আর নিজাম ভাই মিলে তাকে সাহস দিলাম।ভেতরে ভেতরে খুব ভয় পেয়ে গেলেও কিছুতেই সে তা বুজতে দিবেনা আমাদের।তাকে বললাম চলেন নিচে নেমে যাই আর উপরে উঠতে হবেনা।কিন্তু সে বলল এতো কষ্ট করে এইটুকু উঠলাম যেহেতু বাকি ৮টা ধাপ ও ঠিকই উঠতে পারব।খুব খুশি হলাম শুনে।কারন আমিও চাচ্ছিলাম না ফিরে যেতে।যারা মধ্য জুলাই থেকে মধ্য অগাস্ট পর্যন্ত সময় খইয়াছরা গেছেন তারা জানেন কতটা উগ্র ছিল সে তখন।কাউকেই টলারেট করার মতো অবস্থায় ছিলনা সে।যারা ঝর্ণা ভালবাসেন যাদের খুব কাছ থেকে তার সব সময়ের সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তারা জানেন ঘোর বর্ষায় এই সুন্দরীতমা কতটা ভয়ঙ্কর চেহারায় থাকেন।সুন্দরের এই বৈপরীত্য ভালো না বেসে উপায় কি।আমি দেখেছি শিলং এর ঝর্ণা,দেখেছি সিকিমের অনিন্দ্য সুন্দরী সেভেন সিস্টারস ঝর্ণা,দক্ষিণ ভারতের কিছু মন ভোলানো ঝর্ণা।কিছুদিন আগেই দেখে আসলাম শিমলা মানালির চমৎকার কিছু ঝর্ণা কিন্তু আমাদের সীতাকুণ্ড,মিরসরাই বান্দরবানের গুলো কোন অংশে কি কম!
আবার শুরু করলাম পাহাড় বাওয়া নতুন করে নব উদ্যমে।কয়েকটা স্টেপ অত বড় না বলে খুব কষ্টও হয়নি উঠতে।২টা ধাপ উঠতে গিয়ে আমাদের গাছে চরতে হয়েছে তারপর আবার নামতে হয়েছে ডাল বেয়ে।কিছু কিছু জায়গায় প্রবহমান তীব্র জলের স্রোত পেরোতে হয়েছে যা খুব রিস্কি।একটু পা ফস্কালেই কোন পর্যন্ত পানির সাথে নেমে যেতে হবে বলা মুশকিল।এমন কিছু জায়গা পাড় হয়েছি যেখানে কেবল একটা পা’ই পরে নিচে শত ফিট গভীর পানির খাদ।আবার কোন কোন জায়গা পাড় হয়েছি নিজাম ভাইয়ের বাড়িয়ে দেয়া লাঠির সাহায্যে।আমাদের সব লাঠি গুলো নিচে রেখে গেছিলাম।খালি শরীর নিয়েই যেখানে ওঠা কষ্টকর সেখানে লাঠি টা একটা বাড়তি বোঝা মনে হয়েছিল।কিন্তু পরে বোঝলাম কেন নিজাম ভাই লাঠিটা সাথে নিয়ে ওঠেছিল।এক জায়গায় ওটার সাহায্য ছাড়া এগুতেই পারতাম না।তবে ক্যামেরা টা কিন্তু নিতে ভুল করিনি।তাই ছবি ওঠানোও থেমে থাকেনি।
এমনি করে অষ্টম ধাপ পর্যন্ত উঠে এলাম।বাকি দুই জন দেখলাম বসে পড়েছে।আর যাবেনা বলছে।কিন্তু আমাকে থামায় কে।আমি যাবোই শেষ পর্যন্ত।তখনও জানিনা কি বিপদ অপেক্ষা করছে আমার জন্য।তাদের দু’জন কে নিচে রেখে একা আমিই পা বাড়ালাম শেষ দুই ধাপ কে জয় করতে।একা,একাকি।নয় নাম্বার ধাপের দিকে এগুতে গিয়ে বোঝলাম গত কয়েকদিন এদিকে কারও পা পড়েনি।একটু ঘাবড়ে গেলাম।কি ভয়ানক পিচ্ছিল পাথুরে পথ।গাছের ডাল ধরে বেয়ে উঠে গেলাম নয় নাম্বার ধাপে।সাবধানে খালি পা ফেলছি।কিন্তু অতি সাবধানতাও আমাকে বাঁচাতে পারেনি।ঠিকই পড়লাম উপুর হয়ে।বেশ কিছুদুর পিছলে যাওয়ার পর নিজেকে থামাতে পারলাম কোনরকম।সাথে সাথে উঠে বসলাম।নিচে তাকিয়ে দেখলাম কেউ দেখল কি না।দেখি যে না,ওরা নিজেদের মধ্যে গল্প করছে।এতক্ষনে নিজাম ভাই দেখল আমাকে।জোরে চিৎকার করে জানতে চাইল বসে আছি কেন।আমি বললাম এমনি ভাই একটু রেস্ট নিচ্ছি।উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখি আমার হাঁটু কাঁপছে।কতটা ঘাবড়ে গেছি এতক্ষনে বুজতে পারছি।ভেতরের ভয়টাকে কিছুতেই লুকোতে পারছিনা।থামাতে পারছিনা হাঁটুর কম্পন।আবার বসে পড়লাম।অনেক বছর আগের শেখা মেডিটেশন এ বসে গেলাম।বেশ কিছুক্ষন লাগলো নিজের উপর নিয়ন্ত্রন আনতে।ভাবছিলাম আরও একহাত পিছলে গেলে কি হতো।ভাবতেই গাঁ কাটা দিয়ে উঠলো।ঝর্ণা জয়ের আনন্দ তখন বেঁচে যাওয়ার আনন্দের কাছে ম্লান।
নিচে নেমে আসলাম।নিজাম ভাই দেখাল বসে থাকা অবস্থায় আমার একটি ছবি উঠিয়ে নিয়েছেন তিনি।তিনি তো জানেন না এই ছবির ইতিহাস।ধন্যবাদ দিলাম ভাই কে ভয়ঙ্কর স্মৃতি টা কে ক্যামেরা বন্দি করার জন্য।এবার নিচে নামার পালা।১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট লাগলো উঠতে।এবার নামার কথা মনে পড়তেই আবার ওঠার পথের স্মৃতি ভেসে উঠলো।কি কষ্টকর,বীভৎস রোমাঞ্চকর সে পথ।ওদের কে জিজ্ঞেস করলাম নামতে প্রস্তুত কি না।দেখলাম ওরা মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে।আমার কথা আর বললাম না।শুরু করলাম ফিরতি পথে নামা।কিছুদুর নামতেই দেখি ছয় নাম্বার ধাপের দিকে একটা ছেলে এগুচ্ছে আর তাকে সাহস দিচ্ছে তিন নাম্বার ধাপ থেকে ৪/৫ জন চিৎকার করে।ওরা সাহস পায়নি বলে তিন পর্যন্ত উঠেই বসে পড়েছে।ছবি তুলে যাচ্ছে সমানে আর সাহস দিচ্ছে আমার মতো লাগামহীন এক রাখাল বালক কে।ওদেরকে দেখেই সাহস ফিরে পেলাম।বুঝতে পারলাম নামার রাস্তা টা এখন বেশ সহজ হয়ে আসছে।নইলে এতগুলা মানুষ উঠে আসতো না।আর অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টিও হচ্ছেনা যেকারনে এই মানুগুলোর পায়ের স্পর্শে পিচ্ছিল রাস্তাগুলো অনেকটাই শুকিয়ে এসছে।আর একটু নিচে নামতেই দেখলাম এক ঝাক স্কুলের ছেলেপেলে উঠে আসছে দ্বিতীয় ধাপের দিকে।ওদের জিজ্ঞেস করে জানলাম লাস্ট এক ঘণ্টায় অনেকেই নাকি উপরে উঠেছে কিন্তু আমরা ওই একটা ছেলেকে ছাড়া কাউকে পাইনি উপরের দিকে উঠতে।তার মানে দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় ধাপের বেশি ওঠার সাহস কারও হয়নি।যেজন্য ওখান থেকেই নিচে নেমে গেছে।
মনে মনে নিজেদের সাহসের তারিফ করলাম,বাহবা দিলাম নিজেকেই।তবে ওদেরকেও ধন্যবাদ দিতে ভুললাম না যারা নিচের কয়েকটা ধাপ আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছিল।ওঠলাম যেখানে সোয়া ঘণ্টায় সেখানে নেমে আসলাম মাত্র ৩৫ মিনিটে।নিচে নেমে দেখি সেতু ভাই আমাদের জন্য ভয়ার্ত চোখে অপেক্ষা করছে।হয়ত ভয় পেয়ে গেছিল আমরা নিচে নামছিনা দেখে।ওখানে নেমে জনসমুদ্রের মাঝে ফটোসেশন করেই আবার ফিরতি পথ ধরলাম।ততক্ষনে বিকেল গড়িয়ে এল।আমাদের ছুট তে হবে ঘোড়ার গতিতে।আরও যে একটা ঝর্ণা দেখে আসতে হবে যত রাতই হোক না কেন।
প্রথম পর্বঃ
Click This Link
দ্বিতীয় পর্বঃ
Click This Link
তৃতীয় পর্বঃ
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:২৮