আমার ছোট বোন তখন আড়াই বছর। বাসার হাজীগঞ্জের গৃহ কর্ম সহকারীর বদোউলতে সে তখন আধো আধো বোলে কিন্ত নির্ভুল হাজীগঞ্জী ঊচ্চারণে গান গায়ঃ
"আঁই চলি জারগেই
আঁই চলি জারগেই
আঁর লাগুল হাইত্তেন নঁ।"
চিটাগাং এ আমাদের আনা ফ্রাংকীয় জীবনে ওর এই গান অতি অপ্রতুল ভাল লাগার একটি।
রাতে আমরা আগে আগে খেয়ে নিয়ে বাড়ির সব লাইট অফ করে দিয়ে, দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান শুনতে বসতাম গোল হয়ে। কখনো আসতো কামালপুর যুদ্ধের বর্ণনা আবার কখনো ঢাকার ক্র্যাক প্লেটুনের অসম সাহসিক কান্ড কারখানার খবর। মা আমার প্রতিদিন এই সময়ে অঝোরে কাঁদতেন, আর দোয়া দরুদ পড়ে অনবরত অদৃশ্য এই বীরদের ফুঁ দিয়ে যেতেন যাতে করে সর্ব শক্তিমান সমতটের হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিরাপদে
রাখেন।
বিবিসির খবরের শেষে ছোট বোনকে ঘুম পাড়ানো একটা বিশাল যন্ত্রণার কাজ ছিল। সে ঘুমুবেনা এবং "পূর্ব দিগন্তে" গানটি শুনবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার সেই ফরমায়েস পৌঁছুনোর কোন বন্দোবস্ত ছিলনা। তাই ওই গানও বাজতো না এবং সে ধনুক ভাংগা পণ করে বসে থাকতো ওই গান না শুনে ঘুমুতে যাবে না।
এক সময় তার ঘুমোনোর ব্যবস্থা করা গেল।
আল বদর তখন একটা ত্রাসের নাম। আজ যেমন জয়নাল হাজারী, এরশাদ সিকদার বা শামীম ওসমানের নাম শুনলে বা মনে আসলে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার সাধারন লোকজনেরা আতংকে দিশাহারা হয়ে যায় বা যেত সে সময়ে চিটাগাং এর মানুষদের মনে "মীর কাসেম আলী" ও ছিল একটি ভয়াবহ আতংকের নাম।
দেওয়ান হাট হোটেলকে যে কুখ্যাতি দিয়েছিল জবাইখানা ও নির্যানত কেন্দ্রের, যার খুব কাছেই ছিল তখনকার বিখ্যাত গরুর মাংসের দোকান, নন্দন কাননকে যে নরকের ভাগাড়ে রূপান্তরিত করেছিল, চাকতাইকে লোকে যার জন্যে তখন মনে করতো মানুষের চামড়ার গুদাম নাম সেই লোকটিই মীর কাসেম আলী।
আড়াই বছরের ওইটুকুন মেয়েও বুঝতো মীর কাসেম রাতের অন্ধকারের ভুতের মতনই ভয়াবহ একটা কিছু। তাকে ঘুম পাড়ানো হ'ত "ঘুমাও তা না হ'লে মীর কাশেম আসবে"
_____________________________
মানুষের পরিচিতি কিভাবে বদলে যায়। কিছু রূপান্তরিত হয় নিজ কর্ম ফলে বাকী গুলো দল, গোষ্টি, ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষার্থে।
আজ তাই একাত্তরের অসম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, যিনি ভারতীয় সাহায্য ছাড়াই বিপুল বিক্রমে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যিনি বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র জীবিত বীর উত্তম, কিংবদন্তির জাহাজ মারা হাবীবের যিনি পরিচালক ছিলেন, তিনি, হ্যাঁ তিনিই নব্বুইয়ের দশকের চাঁন্দাবাবা, অসংখ্য সেতু আর কাল্ভার্টের কাজ না করে ফেলে রেখে বিল তুলে নেওয়া ঠিকাদার, আজকের রাজাকার শিরোমনিদের দোসর। "
একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন চট্টগ্রামের মেয়র হয়ে বাংলাদেশের একাত্তরের বৃহত্তম বধ্যভূমি গুলোর অন্যতম, ফয়েজ লেইককে প্রমোদ বিতানে রূপান্তরিত করাকে বন্ধ না করে সেই ঘৃন্য প্রকল্পের অন্যতম পৃষ্টপোষক, চিটাগাং এর অগ্নি কন্যা যার জন্যে সমগ্র চিটাগাং এর মানুষ গর্ব করতে পারে, সেই প্রীতিলতার স্মৃতি বিজড়িত অপর্নাচরন স্কুল গ্রাসের প্রচেষ্টার অন্যতম খল নায়ক।
সিপাই জনতা ভাই ভাই সুবেদারের /হাবিলদারের ওপরে অফিসার নাই" স্লোগানের জনক,নির্বিচারে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মেরে ফেলার আদেশ দাতা আজ ক্রাচের কর্নেল, জাতীয় বীর।
চট্টগ্রামের কসাই এখন "সহজ-সরল ও সাদা-সিদে জীবনের অধিকারী মীর কাশেম আলী ভাই"।মানুষ