একটা সময় ছিল যখন পণ্ডিত মশাইয়ের নাম শুনলেও ছাত্ররা দিক্বিদিক পালাতে চাইত। তার মানে এই নয় যে তারা পড়ালেখা করত না। বরং অনেক বেশিই পড়ালেখা করত। সেই পণ্ডিত মশাইদের ছাত্ররা আজ জীবন সায়াহ্নে। তাদের জ্ঞান গরিমা সেই পণ্ডিত মশাইদের বাঁশের কঞ্চি বা মার্বেল থেরাপির কথা মনে করিয়ে দেয় না। উলটো তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা তৈরি করে। কারন তখন ছাত্ররা শিখতে স্কুলে গমন করত ভাল ফল লাভ করাই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। আর তারা সত্যিই শিখত।
তারপরে এলো সেই পণ্ডিত মশাইদের উত্তরসূরিরা। শাস্তি দিতে তারাও কখনো কুণ্ঠিত হতেন না। ফলাফল, শিক্ষার্থীদের শেখার তাড়া। তখনও হোম ওয়ার্ক না করে বা শিক্ষকের নির্দেশিত পড়া মুখস্থ না করে স্কুলে যাওয়াটা ছিল একজন ছাত্রের জন্য অসম্ভব। হয় সে পড়া মুখস্থ করে এবং হোম ওয়ার্ক করে ক্লাসে উপস্থিত হত নয়ত ক্লাস ফাকি দিত। আজকের এ সময় এসে সেই সব ছাত্ররা গভীর শ্রদ্ধায় সেই সব কঠিন হৃদয়(!) শিক্ষকদের কথা স্মরণ করেন। একটি বারও তাদের বেত্রাঘাতের কথা মনে করে ব্যথিত হন না। জীবনের সকল কৃতিত্বের সাথে ছাত্রাবস্থায় কঠিন হৃদয় ভাবা সেই সব শিক্ষকদের অবদানই যে সব থেকে বেশি তা স্বীকার করে নেন অকুণ্ঠ চিত্তে।
এরপরে এলো সেই সময়। যখন স্কুল থেকে বেত উঠিয়ে দেয়া হল। শিক্ষকগন কোচিং নির্ভর হয়ে পরলেন। ছাত্ররা পরীক্ষা পাশকেই একমাত্র কর্ম বলে ধরে নিলো। ফলাফল; শেখা নয়, জানা নয়। যে কোন উপায়েই হোক ভাল ফলাফল করা। সেটা নকল করে হোক, প্রশ্নপত্র ফাঁস করে হোক কিংবা লেখাপড়া করে হোক। মোট কথা ভাল ফলাফল করতে হবে।
অদ্ভুত বিষয় হল এই ভাল ফলাফল লাভ করার বিষয়ে পূর্বে মা-বাবারা যেমন শুধুমাত্র লেখাপড়াকেই একমাত্র উপায় বলে ভাবতেন এখন আর তা ভাবেন না। এখন মা-বাবাও লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্যান্য পন্থা অবলম্বনে সন্তানদের সহায়তা করেন।
ফলে কি হচ্ছে? ভাল ফলাফল আমরা ঠিকইপাচ্ছি, ভাল শিক্ষার্থী পাচ্ছি না। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চাই, সৃজন শীল শিক্ষার্থী তৈরি করতে। কি অদ্ভুত কথা! সত্যিকার অর্থে যদি কাউকে শিক্ষিত করতেই পারেন, তাহলে সে তো নিজে থেকেই সৃজনশীলতার পরিচয় দিতে পারবে। আর এখন তো দেখছি সৃজনশীলতারও সহায়িকা বেশুমার।
স্কুলে শিক্ষার্থীরা নকল করবে শিক্ষকগণ তাতে বাধা দিতে পারবেন না। শিক্ষার্থীদের ভৎসনা করতে পারবেন না। এ কেমন কথা? আমরা কেবল আবেগে ভেসে যাই। আবেগ যেন দিনকে দিন আমাদের বিচার বুদ্ধিকেও লোপ পাইয়ে দিচ্ছে। শিশু কেবল আদরে বাঁদর হয়। তাকে ভালবাসার পাশাপাশি শাসনের প্রয়োজন হয় বৈকি।
আমরা যেন আবেগে ভেসে গিয়ে শিক্ষকদের মহান পেশাটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না ফেলি। শিক্ষকদের মধ্যেও ভাল মন্দের মিশেল আছে। তাদের যে কোন অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে অবশ্যই সোচ্চার হতে হবে, কিন্তু সেটা যেন যৌক্তিক হয়। শিক্ষকের শাসন যদি হয় নৈতিক। যদি হয় আদর্শিক তখন যেন আমরা সেই শিক্ষকের পাশেই দাড়াই। আর যদি বিচার বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে কেবল আবেগে ভেসে যাই তাহলে আমাদের নতুন প্রজন্ম উচ্ছন্নে যাবে এ হলফ করে বলতে পারি।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:২৭