ধরুন আপনার কাছে ১০০টি ফুল আছে। যদি বলা হয় এই ফুল দিয়ে একটি ঘর সাজাতে। আপনি ঘরটির একটি দৃষ্টিনন্দন রূপ দিতে পারবেন। যদি এই একশটি ফুল দিয়ে পঁচিশটি ঘর সাঁজাতে বলা হয়? তখন কি হবে?
আমাদের দেশের গণমাধ্যমের এখন সেই ফুল সংকট চলছে। সেখান থেকে এখন আর সুবাস ছড়ায় না। সে ফুল কারো চোখে পড়ে না। আমাদের গণমাধ্যম এখন আর তাই দর্শকের দৃষ্টি কাড়ে না। মন ভরায় না। দর্শক তাই ভিনদেশী অনুষ্ঠানের প্রতি ঝুঁকে পরছে। মানুষের বিনোদনের যে ক্ষুধা তা নিবারণ করতে হবে। সেটা যে চ্যানেল তা করতে সক্ষম হবে মানুষ সে চ্যানেলই দেখবে এটাই স্বাভাবিক। সে চ্যানেলটি দেশী না বিদেশী এটা তো দর্শকের ভাবার কথা নয়।
আমাদের দেশে মেধা সম্পন্ন নির্মাতা নেই, রুচিসম্মত অনুষ্ঠান নির্মিত হয় না এটাই সত্য। তবে এই কথাটি বলা বাড়ন। এটা যখনই বলা হবে তখন তারা খড়গহস্ত হবেন সেটাও কিন্তু তাদের মননের বিকলাঙ্গতা বৈ আর কিছু নয়।
গতকাল একটি খবরে পড়লাম, “সাকিব খান বিভিন্ন জায়গায় বলে বেড়াচ্ছেন, বাংলাদেশে কোনও ভালো টেকনিশিয়ান নেই”। আর তাতে নাকি এ দেশের পুরা ইন্ডাস্ট্রিকে অপমান করা হয়েছে। সেই অপরাধে পরিচালক বদিউল আলম খোকন তার ‘রংবাজ ২’ শিরোনামের নতুন ছবিতে সাকিবকে পারিশ্রমিক দেওয়ার পরও বাদ দিচ্ছেন।
অর্থাৎ নির্মাতাদের দুর্বলতা প্রকাশ করাও যাবে না। আমাদের নির্মাতাদের মানসিক গড়নটা এর থেকে খুব সহজেই অনুমিত হয়।
সাকিব খান টালি উডের ছবিতে অভিনয় করে নিজেকে যেভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন সেভাবে কি ঢালি উডের ছবিতে অভিনয় করে পেরেছেন? পারেননি, তার একটি মাত্র কারণ পেছনের কারিগরদের ভূমিকা বা নির্মাণ শৈলী।
আজ যদি বদিউল আলমের পথ অনুসরণ করে অন্য পরিচালক গনও একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাহলে সাকিব খান কিন্তু থেমে থাকবেন না। টালি উড তার জন্য বরমাল্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ফেরদৌসকে দেখেছি, জয়াকে দেখেছি। টালি উডে তাদের সাফল্য দেখেছি। আবার এ দেশে তাদের মুখ থুবড়ে পরাও দেখেছি। দায় এ সব শিল্পীদের নয়, দায় নির্মাতাদের। সে দায় তাদের নিতে হবে। তাদের শিখতে হবে। তাদের আধুনিক হতে হবে। এখানে অর্থ খুব বড় কোন প্রতিবন্ধকতা যে নয় তা টালি উডের অনেক ছবিতেই প্রমাণিত হয়। গল্প নির্ভর এমন অনেক ছবি তারা উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন যেখানে টাকা নয় নির্মাণ শৈলী, অভিনয় আর গল্পের শক্ত গাঁথুনিই ছবিকে পাইয়ে দিয়েছে ঈর্ষনীয় সাফল্য।
আবু হেনা রনী জি বাংলার মিরাক্কেল খ্যাত কৌতুক অভিনেতা। যিনি ষ্টেজে এসে দাঁড়ালেই দারুণ একটা কিছুর অপেক্ষায় থাকত দুই বাংলার দর্শক এবং কখনোই তারা আশাহত হননি। সেই আবু হেনা রনি যখন বাংলাদেশের একটি চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থাপকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তখন দর্শক যার পর নাই হতাশ হল। কারণ একটাই, পেছনের কারিগরদের ব্যর্থতা।
আমরা যদি জি বাংলার রিয়্যালিটি শো গুলির দিকে লক্ষ করি। তাহলে দেখব, সেখানে খুব একটি অর্থ লগ্নি করা হয় না। কিন্তু অনুষ্ঠান গুলি ভীষণ জনপ্রিয়। তার প্রধান কারণটি হচ্ছে অনুষ্ঠানগুলি দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করে। যেমন হ্যাপি প্যারেন্টস ডে, হোম মিনিস্টার বৌমা কিংবা মিরাক্কেল। এই অনুষ্ঠানগুলিতে একদিকে যেমন থাকে সমাজ বিনির্মাণের বার্তা অন্যদিকে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরাও সমাজের সাধারণ অংশ যা সাধারণ মানুষকে অনুষ্ঠানগুলোর প্রতি আগ্রহী করে তুলতে বাধ্য। অনুষ্ঠানগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল প্রাণবন্ত করে তোলা। আবার একটি অনুষ্ঠান শেষ করে আপনি যে উঠে যাবেন তারা সে সুযোগও আপনাকে দিচ্ছেন না। কোন বিজ্ঞাপন বিরতি ছাড়াই তারা পরবর্তী অনুষ্ঠানে চলে যাচ্ছেন।
জি বাংলার সারেগামা পা অনুষ্ঠানে শিল্পীদের সাথে যারা সঙ্গত করছিল সেই মেয়েগুলোর পোশাক দেখা গেল সবুজ কামিজের উপরে লাল রঙের কোটি যেন বাংলাদেশের পতাকা এবং বার বারই তাদের পোশাক টিভি স্কিনে ভেসে উঠছিল। এটাকে বলে মার্কেটিং। বাংলাদেশের দর্শকদের ধরে রাখতে হবে না? বাংলাদেশের চ্যানেলগুলির কর্তা ব্যক্তিরা কি সেটা বোঝেন?
আসুন আমাদের দেশের চ্যানেলগুলো কি দেখাচ্ছে তার দিকে দৃষ্টি ফেরাই। বিজ্ঞাপন যন্ত্রণার কথা নতুন করে কিছু বলার নেই। সেটা না হয় নাই বললাম। বাংলাদেশের সংবাদ চ্যানেল ছাড়া বিশেষায়িত চ্যানেল কোনটি কেউ কি বলতে পারেন?
এত এত চ্যানেল থাকা সত্যেও আমাদের বাচ্চাদের তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে কার্টুন নেটওয়ার্ক, নিক এমন সব বিদেশী চ্যানেলগুলির উপর। কারণ আমরা শিশুদের জন্য উপযোগী অনুষ্ঠান বানাতে পারি না। আমাদের অনেকগুলি বিনোদনমূলক চ্যানেল আছে যেখানে হাসির নামে হয় সুড়সুড়ি। আর বিনোদনের নামে হয় সাদামাটা গল্পের নিন্ম মানের চিত্রায়ন। গল্পের শক্ত গাঁথুনি নেই। নেই কোন প্রত্যাশা, নেই সাসপেন্স।
বাংলাদেশে মোশাররফ করিমের মত অভিনেতা না থাকলে কমেডি নাটক হত কিনা সন্দেহ। মোশাররফ করিমের এক্সপ্রেশন আর দুর্দান্ত অভিনয়ই সাধারণ গল্পকে অসাধারণ করে তোলে। এই ভদ্রলোকের বিকল্প কোন অভিনেতাই এ দেশে নেই। কিন্তু একই মুখ দর্শন কাহাতক ভাল লাগে? আর এখানেই নির্মাতাদের ব্যর্থতা বেশী করে চোখে পড়ে। যেখানে তারা দর্শকদের নতুন কোন মুখ বা নতুন স্বাদ উপহার দিতে পারছেন না।
আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা যদি ভুতের মত উল্টো পথে চলি আর বিদেশী চ্যানেলের বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ আরোপ করতে থাকি সেটা শিশুসুলভ আচরণ বৈ আর কি?
ভারতের চ্যানেলগুলি যদি পারিবারিক জীবন ঘনিষ্ঠ ড্রামা দিয়ে দর্শক মাতাতে পারে তাহলে আমরা কেন পারি না। তাদের নেতিবাচক বিষয়গুলি বাদ দিয়ে ইতিবাচক জীবন ঘনিষ্ঠ ড্রামা তৈরি করতে পারলে এ দেশের দর্শক কেন স্টার জলসা বা জি বাংলার উপর নির্ভর করে থাকবেন?
ভারতের চ্যানেল যখন গোয়েন্দা গিন্নী দিয়ে এ দেশের দর্শকের মন ভরাতে পারছে তখন আমাদের যদি তেমন লেখক নাই থাকে তাহলে কেন আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস কিংবা নীহার রঞ্জন গুপ্তের কিরীটী রায়, আমাদের হুমায়ুন আহমদের মিসির আলীর আশ্রয় নিচ্ছি না? এ সব চরিত্রে অভিনয় করার মত শক্তিমান অভিনেতা কিন্তু আমাদের রয়েছে। নেই কেবল নির্মাতা আর পৃষ্ঠপোষক।
আমি এটা বলব না যে এ দেশে দর্শক নন্দিত নাটক তৈরি হচ্ছে না। হচ্ছে, কিছু খণ্ড নাটক হচ্ছে যা খুবই ভাল মানের। কিন্তু সমস্যা হল এই সব হঠাত পাওয়া দর্শক ধরবেন কিভাবে? এত চ্যানেলের ভিড়ে আর বিজ্ঞাপন জটের মাঝে কবে কখন কোথায় একটি মনি মাণিক্য নিমেষের তরে উকি দেবে সে খবর কে রাখে? আর তাছাড়া বিজ্ঞাপনের ভিড়ে সেই রত্নটিকেও কি আর রত্ন মনে হবে?
২৩ আগস্ট ২০১৬ “কিরণ মালা সমস্যা নয়, সমস্যা আমাদের নির্মাতাদের ব্যর্থতা” শীর্ষক একটি লেখার একটি জায়গায় লিখেছিলাম “যারা এই টক শো গুলোর আয়োজন করেন তারা কি তাদের টেবিলটাকে নিয়ে হাটে মাঠে ঘাটে বসাতে পারেন না? অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে সাধারণ মানুষকে নিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারেন না? এটা তো যে কোন বিষয়ে জনমত গঠনেও অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। যেমনটি করছে বিবিসি বাংলা”।
অদ্ভুত বিষয় হল ইদানীং দেখছি কিছু চ্যানেল সেই কাজটি করছেন ঠিকই তবে ঘাটে মাঠে নয়, বিরান মাঠে। যেন তারা বিশুদ্ধ অক্সিজেনের খোজেই সেখানে গিয়েছেন, জন সম্পৃক্ত হতে নয়।
জি বাংলার দাদাগীরি, দিদি নং ওয়ান বা হ্যাপি প্যারেন্টস ডে। এ সব অনুষ্ঠান আয়োজনে প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা। আমাদের কোন চ্যানেলের কি এমন কোন গবেষণা সেল আছে? নেই, খুব বেশী অর্থের প্রয়োজন কিন্তু নেই। প্রয়োজন নতুন কিছু করার তাগিদ।
ধরুন একটি চ্যানেল একটি অনুষ্ঠান নির্মাণ করল, অনুষ্ঠানটির নাম “আমার জনক”। যেখানে একদিন অতিথি হয়ে এলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। অতিথি হয়ে এলেন বিরোধী দলের নেত্রী। সেখানে অতিথি হয়ে এলেন নায়ক রাজ। এভাবেই প্রতিটি পর্বে নতুন নতুন চমক নিয়ে উপস্থিত করা হবে সমাজের সর্বোচ্চ শেখরে অবস্থান করা আদর্শ মানুষগুলোকে। আর এই মানুষগুলোও আগ্রহ ভড়েই এ সব অনুষ্ঠানে অংশ নিবেন। কারণ সেখানে তার জনকের কথা বলা হবে। সেখানে তার জনককে পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে। আর জনকের কথা কে না বলতে চান? ঠিক একই ভাবে সেখানে উপস্থিত থাকার সুযোগ করে দেয়া হল সমাজের সকল স্তরের মানুষকে। একটি সপ্তাহ জুড়ে আমন্ত্রিত অতিথির কথা বলে যখন এই অনুষ্ঠানটির বিজ্ঞাপন প্রচার করা হবে দেশের সকল চ্যানেলে। তখন ঐ অনুষ্ঠানটি দেখার প্রতি দর্শকের আগ্রহের কোন কমতি থাকবে না। ভাবুন তো এমন একটি অনুষ্ঠান কি কখনোই বিরক্তিকর হয়ে উঠতে পারে? এমন অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষকের কি কোন অভাব হবে? এমন সব অনুষ্ঠানে শিশুরা শিখবে জনকের প্রতি সন্তানের কর্তব্য। তারা বুঝবে জনক তার সন্তানের জন্য কতটা ছাড় দেন। এতে করে কি আমাদের পারিবারিক বন্ধনও আরও মজবুত হবে না?
তথ্য মন্ত্রণালয় একটু নির্দেশনা জারী করুক শিশু পণ্যের বিজ্ঞাপন শিশুতোষ অনুষ্ঠান ছাড়া দেয়া যাবে না। দেখুন শিশুতোষ অনুষ্ঠান তৈরি শুধু নয় শিশুদের জন্য আলাদা চ্যানেল হয়ে যাবে।
আবার ধরুন একটি অনুষ্ঠান নির্মাণ করা হল যেখানে সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রতিভা গুলোকে জনসম্মুখে তুলে ধরা হল। সেটা হতে পারে বিজ্ঞান, হতে পারে গানের, হতে পারে যে কোন বিষয়ে সফলদের গল্প গাঁথা। সেখানে একই সাথে দেখানো হবে নির্দিষ্ট জেলার তথ্য চিত্র। এসব অনুষ্ঠান যদি একটু গুছিয়ে করা যায়। তাহলে তা শুধু জনপ্রিয়তাই পাবে না একই সাথে সামাজিক দায় শোধ করাও হবে।
মান সম্পন্ন পারিবারিক উপজীব্য গল্প নির্বাচন করে দর্শক ধরে রাখার মত সিরিয়াল তৈরি করুন। আমাদের যা সামর্থ্য আমরা তাই দিয়ে করব কিন্তু তাকে হতে হবে উপজীব্য, হতে হবে চিত্তাকর্ষক। যদি সেটা করা যায় তবেই আমাদের চ্যানেলের দিকে আমাদের দর্শকরা ফিরে আসবেন। আমরা সেটা করছি না বা করতে পারছি না। তার কারণ একটাই। চ্যানেল আছে, শ’য়ে শ’য়ে অনুষ্ঠানও নির্মাণ করা হচ্ছে কিন্তু কোন চ্যানেলের নেই গবেষণা সেল। আমাদের বিনোদনমুলক চ্যানেলগুলি চাইলে সংবাদ অংশটি বাদ দিয়ে সেই অর্থেই এই সেল গঠন করতে পারে। তাতে তারা যেমন উন্নত অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে পারবেন তেমনি দর্শকের কাছাকাছিও পৌঁছুতে পারবেন।
বলতে পারেন আপনি সব শেষ কবে বিটিভি দেখেছেন?
বলতে পারেন সব শেষ কবে বাংলাদেশের চ্যানেলে দেখানো কোন নাটক বা সিনেমা অথবা কোন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আগ্রহ ভরে দেখেছেন?
দেখুন তো মনে করতে পারেন কিনা? আসলে বস্তাপচা মানহীন নকল করা অনুষ্ঠান জোর করেও দেখানো যায় না। বিনোদনের ক্ষুধা তো এমন নয় যে না খেলে মরে যেতে হবে। দর্শক তার পছন্দ মত অনুষ্ঠান খুঁজবেন। পছন্দমত পেলেই কেবল তা দেখবেন কাজেই এ সব অখাদ্য কুখাদ্য খাইয়ে বিদেশী চ্যানেল থেকে মানুষকে সরিয়ে রাখার ভাবনাই বাতুলতা।
মান সম্পন্ন জন সম্পৃক্ত অনুষ্ঠান নির্মাণ করুন সেটাই সমাধানের একমাত্র উপায়।
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:২০