হলে টিভি রুমে ঢোকা যায় না সিরিয়ালের যন্ত্রণায়। বাসায়ও মোটামুটি একই অবস্থা। একই জিনিস বার বার দেখা হচ্ছে, দু মিনিটের ঘটনা দু দিন ধরে দেখাচ্ছে। বিচিত্র ও উদ্ভট সব কাহিনী আর অদ্ভুত সাজপোশাক।
আরও দুর্ভাগ্যজনক যে, আমাদের মেয়েরা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্যই সিরিয়াল দেখে ক্ষান্ত নয়। তারা একে অন্তরে ও মস্তিষ্কে ধারণ করছে। বাস্তব জীবনের যেকোনো ঘটনায় তারা সিরিয়ালকে টেনে নিয়ে আসছে, সিরিয়ালের চরিত্রদের অন্ধের মত অনুকরণ করছে। মেয়েরা আড্ডার আসরে সিরিয়ালের চরিত্রদের নিয়ে এমনভাবে কথা বলে, মনে হয় যেন এরা বাস্তবের জীবন্ত চরিত্র। আমাদের মেয়েরা সাজপোশাকে ত সিরিয়ালের চরিত্রদের অন্ধ অনুকরণ করেই, তাদের চিন্তা-চেতনা পর্যন্ত অক্টোপাসের মত আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে সিরিয়াল।
এসব নিয়ে কথা বললে মেয়েরা রেগে গিয়ে জবাব দেয়, সেকেলে হয়ে বসে থাকা কোন কাজের কথা নয়, আধুনিক হতে হলে কসমোপলিটান হতে হবে, বিশ্বের সাথে তাল মিলাতে হবে। গোঁড়া হয়ে নিজের সংস্কৃতি নিয়ে পড়ে থাকলেই চলবে না, অন্যের সংস্কৃতি থেকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। ভারতীয় মেয়েরা কত স্মার্ট, তাদের অনুকরণে ত সমস্যা হওয়া উচিত নয়।
মেনে নিচ্ছি এসব যুক্তি। আসলেই আমাদের আধুনিক, কসমোপলিটান ও স্মার্ট হওয়া খুব দরকার। কিন্তু আধুনিকতা কি সিরিয়ালের উদ্ভট কাহিনী নিয়ে মাথা ঘামানো? স্মার্টনেস কি কেবল অদ্ভুত সাজপোশাকে? কসমোপলিটান হওয়া মানে কি বাস্তবের ঘটনাগুলোকে সিরিয়ালের মত করে চিন্তা করে জীবনটাকে সমস্যাসঙ্কুল করে তোলা?
অনুকরণ তখনই সুফল বয়ে আনে যখন সেটা ইতিবাচক হয়। নেতিবাচক অনুকরণে কি উপকারিতা থাকতে পারে তা আমার বোধগম্য নয়। ভারতীয় মেয়েদের একান্তই যদি অনুকরণ করতেই হয়, তাহলে সত্যিকারের আধুনিক ও সফল নারীদের কেন আমরা অনুকরণ করছি না? অনুকরণ কেন শুধুমাত্র শোবিজ নারীদের প্রতি? আজকে ভারতীয় মেয়েরা শিক্ষায়, গবেষণায়, সমাজ সেবায়, খেলাধুলায়, লেখনীতে, বিজ্ঞান চর্চায় কত এগিয়ে গেছে, আমরা কেন এসব দেখে শিখছি না?
আজ থেকে আরও নয় বছর আগে যখন কল্পনা চাওলারা মহাকাশ গবেষণায় প্রাণ দিয়েছেন, তখন আজও আমরা আত্মার মরণ দেখছি অজ্ঞানতা ও কুসংস্কার বিশ্বাসে। ভারতীয় মেয়েরা আজ যখন অলিম্পিক থেকে গলায় পদক ঝুলিয়ে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরছেন, আমরা তখন গলায় মানানসই অলঙ্কার খুঁজতেই বেশি ব্যস্ত। ভারতীয় মেয়েরা যখন বিজ্ঞানের জটিল সব সমস্যা সমাধানে মাথা খাটাচ্ছে, পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, আমরা তখন হিংসা, পরচর্চা, পরনিন্দা, সন্দেহ দিয়ে ভরপুর কুটিল সব সমস্যা তৈরিতে মাথা খাটাচ্ছি, নিজেরাই শুধু অশান্তিতে ভুগছি না, অন্যদেরও অস্থিরতায় ফেলে রাখছি। নিজেরা এগোনোর চিন্তা ত করছিই না, উলটো কেউ এগোতে চাইলে তার পথে কাঁটা ছড়াতে চেষ্টা করছি। এর নাম কি আধুনিকতা? অনুকরণ যদি করতেই হয় তবে ভালো গুণগুলোকে নয় কেন? রূপচর্চার পিছনে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় না করে কিছু সময় কি মেধাচর্চায় কাজে লাগানো যায় না?
তাছাড়া আধুনিক হবার জন্য ভারতীয় নারীদেরই অনুকরণ করাটা কি খুবই জরুরী? ইলা মিত্র, বেগম রোকেয়া, জাহানারা ইমাম, সুফিয়া কামালরা কি আমাদের সামনে নেই? লাখ লাখ বীরাঙ্গনারা যখন আমাদের মা, তখন আমাদের আত্মসম্মানবোধ কি আরও একটু বেশি হওয়া উচিত নয়? অন্যের তৈরি বিচিত্র কাহিনীর পিছনে না ছুটে আমরা কি পারি না নিজেরাই এক একটি বিজয় কাহিনীর সূচনা করতে? আমরা ত এমন সব সাহসী মানুষের উত্তরসূরি যারা মাত্র নয় মাসে এক অলৌকিক মহাকাব্যের সৃষ্টি করেছিলেন। তাই ত আমাদের মাঝেই আছে নিশাত কিংবা ওয়াসফিয়াদের মত মেয়েরা যাদের নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। আমরা বিশ্বাস করতেই পারি, একটু চেষ্টা করলে আমরা বাংলাদেশের নারীরা এভারেস্টের চূড়া ছুঁয়ে দিতে পারি যার যার নিজের ক্ষেত্র থেকে।