সেলিম-আল-দীন রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে বাংলা নাটকের সবথেকে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বাংলা নাটকে তিনি যুক্ত করেছেন এক স্বকীয় ধারা। ২০০৮ সালের এই দিনে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন তিনি। তিনি আসলে মারা যাননি। তিনি বেঁচে ছিলেন, আছেন ও থাকবেন তার কাজের মাধ্যমে। বাংলা নাটকে তিনি যোগ করেছেন মহাকাব্যিক বর্ণণাধর্মী রীতি।
বাংলা নাটকের এই জীবন্ত কিংবদন্তীর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ডানপিটে স্বভাবের। একই সাথে পড়াশোনাতেও ছিলেন সবার সেরা। বাবা ছিলেন চাকুরীজীবী। বদলির সূত্র ধরে তিনি কখনও ছিলেন চট্রগ্রাম, কখনও সিলেট, কখনও আখাউড়া আবার কখনও রংপুরে। মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৬৪ সালে। ১৯৬৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ফেনী কলেজ থেকে। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন তিনি। টাঙ্গাইলের সাদত কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে পি.এইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেন ।
কিশোর বয়স থেকেই তিনি বাংলা কবিতার প্রতি আসক্ত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের সকল প্রথিতযশা কবির কবিতা তিনি পড়ে ফেলেন। রবীন্দ্রনাথ, মধুসুদন দত্ত, সুকান্ত সবই ছিল তার নখদর্পনে। কিন্তু কবিতার ভাবটা কিছুতেই আসছিলনা তার মাঝে। পরবর্তীতে বাংলা নাটকের আরেক মহাপুরুষ মুনীর চৌধুরী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি বাংলান নাটকের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এরপর শুধুই এগিয়ে চলা। তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
গতানুগতিক ইউরোপের প্রসেনিয়াম তত্ত্বকে বাদ দিয়ে তিনি চালু করেন বাংলার হাজার বছরের পুরান শিল্পরীতিকে। তার প্রবর্তিত এ ধারা একেবারেই বাংলার নিজস্ব ধারা। লুঙ্গিনুসের অন সাবলাইম আর পিটার ব্রকের দ্যা এম্পটি স্পেসের তত্ত্বগুলোকে তিনি পরিণত করছেন প্রাচ্যের নান্দনিকতায়। শব্দ চয়নের ক্ষেত্রেও তিনি তৈরী করেছিলেন নিজস্ব ধারা। তিনি অনেক গানও লিখেছেন। গানকে তিনি বলতেন কথাসুর। তার লেখা ”কীর্তনখোলা” ও ”চাকা” নিয়ে তৈরী হয়েছে চলচিত্র।
তিনি তার নাটকের মাধ্যেমে গ্রাম বাংলার স্বরূপ উন্মেচন করেছেন। পাশাপাশি গবেষণা করে গেছেন বাংলার লোক তিনি সব সময়ই মনে করতেন ইউরোপের থেকে বাংলা নাটকের ইতিহাস অনেক পুরান ও সমৃদ্ধ।
সেলিম-আল-দীন ১৯৬৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় প্রথম নাটক লেখেন। তার রচিত নাটক বিপরীত তমশায় ১৯৬৯ সালে প্রথম রেডিওতে প্রচারিত হয় এবং পরবর্তী বছর একই নাটকটি টেলিভিশনে প্রচারিত হয়।
নাটকের প্রতি ভালবাসা থেকে একক উদ্যোগে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা অনুষদ চালু করেন। তিনি ঢাকা থিয়েটারের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। ২০০৮ সালের আজকের দিনে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে তিনি ল্যাবএইডে ভর্তি হন এরপর সবাইকে কাঁদিয়ে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে।