এক দিনের ভিতরে এক্সট্রিম ট্রেকিং ট্যুর দিতে চান ? এলিমেন্ট হিসাবে যদি এইগুলো পান তাহলে আর কি কি লাগে বলেন,
১। টোটাল ৯ ঘণ্টার ট্রেকিং
২। চা বাগান
৩। সরু গিরিপথ
৪। তিন ঘণ্টার ঝিরিপথ (চিংড়ি মাছে ভরপুর)
৫। অন্যরকম ঝর্না (যা পাহারা দেয় একটি বিষাক্ত সাপ)
৬। ঝর্নার পাশ দিয়ে ৮৫ ডিগ্রী খাড়া এসেডিং এবং ডিসেন্ডিং (বর্ষার সময়ে এই প্রচেষ্টা না করাই ভালো)
৭। সারি সারি ১০০০ ফুট উচ্চতার কাছাকাছি পাহাড় (সব থেকে উঁচু পাহাড় থেকে সমুদ্র দেখা যায়)
৮। সব শেষে বিশাল বড় একটা ঝর্না
৯। ঝর্নার সাথেই একটি বিশাল পুকুর (বাধের কারনে সৃষ্টি)
নাগরিক এই ব্যাস্ততার ভিড়ে যারা Travelers of Bangladesh এ পোস্ট হওয়া বান্দারবনের অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি দেখে শুধু হতাশা ব্যাক্ত করেন, তাদের জন্য ঠিক করেছি একদিনের ভিতরে এক্সট্রিম ট্রেকিং ট্যুর নিয়ে বিস্তারিত লিখয়ে যাবো।
বান্দারবনের ওইসব জায়গা গুলো দেখতে নিম্নে তিন থেকে চার দিন হাতে নিয়ে হারিয়ে যেতে হয় যা আমাদের মত অনেকেরই সম্ভব না। এর আগে একদিনের এক্সট্রিম ট্রেকিং ট্যুর "কালাপাহাড়" নিয়ে লিখেছিলাম। এবার যেটা নিয়ে লিখবো সেটা আগের থেকে আরো অনেক গুন বেশি এক্সট্রিম বলে আমি মনে করি।
আগে থেকেই ঠিক করেছিলাম আমাদের এবারের ট্যুর হবে "হাজারিখিল গেম লাইফ স্যাংচুয়ারি" এটি চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে অবস্থিত। আমদের গ্রুপ থেকে সব ধরনের ট্যুর দিয়ে থাকি, ছ্যাঁচড়া ট্যুর (ব্যাকপ্যাক ট্যুর) থেকে রিলাক্স ট্যুর। আর এবারের ট্যুর ছিল আমাদের গ্রুপের নবম ট্যুর। এই ট্যুরে আমাদের রেগুলার দুই জন সদস্য যেতে পারে নাই। তাদের জন্য এক বস্তা সমবেদনা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারলাম না। ট্যুর মেম্বার মোট ছয় জন এর ভিতরে একজন আবার ফিমেল।
কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা => ফটিকছড়ি => সিএনজিতে করে হাজারিখিল গেম লাইফ স্যাংচুয়ারি।
খরচঃ জন প্রতি ১৫০০ টাকা
সকালে বাস স্ট্যান্ডে নেমেই প্রথমে নাস্তা করলাম, আগের রাতে পেটের অবস্থা খুব খারাপ ছিল বিধায় আমাদের ট্যুর মেম্বাররা আমাকে কিছুই খেতে দেয় নাই, চেয়ে চেয়ে সকলের নাস্তা করা দেখলাম আর শুকনো রুটি এককাপ চা কোন মতে শেষ করলাম। এই ট্যুরে আমি জাভেদ ভাইয়ের প্রতি বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ। উনি না থাকলে এবারের ট্যুর শেষ করতে পারতাম কিনা জানি না। যখনই দুর্বলতা অনুভব করেছি তখনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিছে।
নাস্তা শেষ করে সিএনজিতে চলে গেলাম সোজা হাজারিখিল গেম লাইফ স্যাংচুয়ারি। সেখানে নেমেই জসীম ভাইয়ের (০১৮২২৮৬৮৪৮৬) সাথে কথা বার্তা শেষ করে চলে গেলাম ফরেস্ট অফিসের অনুমতি আনতে। সেখানকার ফরেস্ট অফিসার শাহাদাত ভাই (০১৮১৬৪৬৬৪৯২) খুব আন্তরিক একটি মানুষ। তার অনুমতি সাপেক্ষে ওই এলাকার স্থানিও একজন গাইড পেলাম যার নাম মান্নান ভাই (০১৮১৫৩৮২৪৩১)
এই বন মুলুত বন-ছাগলের জন্য সরকারি ভাবে ঘোষিত অভয় আরণ্য। চিতা বাঘ, অনেক প্রজাতির পাখি, অজগর সহ ছোট বড় অনেক প্রজাতির সাপ, খরগোশ, শিয়াল সহ অনেক কিছুই এখানে আছে। তার থেকে বড় কথা এখানে অবৈধ ভাবে গাছ কাটার উৎপাত একেবারেই নেই যার ফলে আপনাকে সিকিউরিটি নিয়ে ভাবতে হবে না। সুতরাং যত দিন না এইভাবে চলতে থাকবে ততদিন পর্যন্ত সিকিউরিটির কোন সমস্যা হবে বলে মনে করি না।
থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা নাই তবে আপনি যদি টেন্ট নিয়ে যেতে চান তাহলে ফরেস্ট অফিসের পারমিশন নিয়ে থাকতে পারবেন ও তাদের নির্ধারিত জায়গায় রান্না বান্নার ব্যাবস্থা করতে পারবেন।
রবির নেটওয়ার্ক সব থেকে ভালো। পাহাড়ের উপরে উঠলে গ্রামীনের নেট ভালো আর এয়ারটেলের নেট মোটামুটি পাওয়া যায়।
এখানে রেঞ্জ মোট দুটিঃ হাজারিখিল রেঞ্জ এবং বারোইঢালা রেঞ্জ
বিট তিনটিঃ হাজারিখিল বিট, ফটিকছড়ি বিট এবং বারোমাসি বিট
চা বাগান মোট একটিঃ রাংগাবানি চা বাগান
আসল আলোচনায় ফিরে আসি, সকাল সাড়ে আটটার দিকে গাইড ভাইকে নিয়া হাটা শুরু করলাম। প্রথমে স্থানিও আদিবাসীদের গ্রামের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলে গেলাম একটি সরু গিরিপথে। অস্থির এই গিরি পথ। সেখান থেকে বের হয়ে গেলাম রাঙ্গাবানি চা বাগানে। চা বাগানের ভিতর দিয়ে সোজা নেমে গেলাম ঝিরিপথে। অস্থির এই ঝিরিপথ চিংড়ি মাছ আর নানা প্রজাতির ছোট বড় মাছে ভর্তি। বুঝলাম স্থানিও মানুষের মাছের জোগান এই ঝিরি পথ। ঝিরি পথে অনেক গুলি লিলিপুট কিছু ক্যাসকেড আছে, পানি বেশিরভাগ সময়ে হাঁটু পানি ছিল। কোন কোন জায়গা দিয়ে কোমর সমান তবে তা খুব কম। টানা দেড় ঘণ্টা হাটার পর অবশেষে পেলাম কালাপানি ঝর্না। এই ঝর্নায় যেখানে পানি পরে সেখানে বড় জোর একজন মানুষ দাড়াতে পারবে। ঝর্নায় যাবার আগে দুই জায়গায় সাঁতরাতে হবে। ঝর্নায় গিয়ে ছবি তুলছি, লাফ দিচ্ছি এমন সময়ে হটাত আমার চোখে পড়লো একটা পাথরের নিচে কি জানি একটা প্যাচ মেরে বসে আছে। কাছে গিয়ে দেখি তিন চার ফুট লম্বা আর বেশ মোটা একটা সাপ। সেই পাথরের উপড়েই বসে ছিল মেহেদি আর রুমানা। কাউকে চমকে না দিয়ে মেহেদিকে আর রুমানাকে বললাম উঠ। ভালো করে তাকিয়ে বলি দেখ একটা সাপ। সব সময় ইতরামি করি বিধায় কেউ পাত্তা দিলো না। জাভেদ ভাইকে ডাকলাম। সে বলল আসলেই তো। অদিকে মিরু ভাই আবার ঝর্নার নিচে। তাকে বললাম ভাই নড়াচড়া যা করছেন আর কইরেন না। সে ভয়ে পুরা জমে গেছে। অদিকে মিরু ভাই আবার সাতার জানে না। ঝর্নায় যেতে হলে সাতরে যেতে হয়। জাভেদ ভাই লাফ দিয়ে সাটার দিলো। গিয়ে মিরু ভাইকে সঙ্গ দিলো যাতে একা আবার ভয় না পায়। জাভেদ ভাইকে লম্বা একটা বাশ দিলাম আর অপরএক প্রান্ত দিলাম সজীব ভাইকে ধরে রাখতে। দুই প্রান্ত দুই জন ধরে থাকবে আর মিরু ভাই তা ধরে ধরে চলে আসবে। কিন্তু মিরু ভাই একটা আসতে পারবে না। অদিকে আমারো ভয় লাগতেছে আবার পানিতে যেতে। সাত পাছ না ভেবে এইবার আমি সাতার দিয়ে তার কাছে গিয়ে তারে নিয়ে এসে দ্রুত ওই ঝর্না ত্যাগ করলাম।
আরেক বিপদ হাজির এবার ঝর্নার পাশের গা বেয়ে প্রায় ৪০ ফুট উপড়ে উঠতে হবে যা প্রায় ৮০ ডিগ্রী খাড়া। এই জায়গায় আমি বেশ দুর্বল। কেননা ভীষণ হাইট ফবিয়া আছে আমার। কিন্তু কিছু করার নাই, কেননা ব্যাক করে যাবো। প্রথমে বেশ ভালোই উঠলাম। টানা দুই দিন পেট খারাপ থাকায় শরীর বেশ দুর্বল। এরপরে পা কাঁপা শুরু হল। ওই সময়ে জাভেদ ভাই যদি হেল্প না করতো তাইলে আমি কিছুই করতে পারতাম কিনা জানি না। যাই হোক তার হেল্প নিয়া উঠলাম এর পরে আবার খাড়া বেয়ে নামতে হবে প্রায় ৬০ ফুটের মত। এবারো সেই জাভেদ ভাইয়ের হেল্প।
আবার ঝিরি ধরে হাটা শুরু করে দিয়ে বারইধালা পাহাড়ের রেঞ্জ ধরে হাঁটা শুরু করলাম। এবারের পাহাড় গুলো অনেক উঁচু। সব থেকে উঁচু পাহাড় প্রায় ১০০০ ফুটের কাছাকাছি। মনেই হচ্ছে না ফটিকছড়ি আছি। ওখান থেকে সমুদ্র আর চন্দ্রনাথ মন্দির দেখা যায়। এবার রুট চেঞ্জ করে হাঁটা শুরু করলাম ছোট দারোগার হাটের দিকে থাকা সহস্রধারা ঝর্নার দিকে। উদ্দেশ্য ওখানে গিয়ে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে ঢাকার দিকে যাত্রা করা। গিয়ে হতাশ হলাম ঝর্নায় কোন পানি নাই। কিন্তু গত বছর আগস্ট মাসে এসে এই ঝর্নার যে রূপ দেখেছি তাতে বিমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। যাই হোক ওখানে একটি দীঘি আছে যেটা খুব সম্প্রতি তৈরি হয়েছে। দীঘিটি উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা। সূর্য অষ্ট পর্যন্ত সেখানে কাটিয়ে দিলাম। আর তার আগেই গোসল করে সবাই ফ্রেশ হয়ে হাঁটা শুরু করে দিলাম। দিগন্তে সূর্য ডুব দিচ্ছে। পেছনে আমাদের লম্বা ছায়া আস্তে আস্তে মিলিয়ে এলো। আমার গল্প ফুরালো।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ১০:০৮