ইডেন গার্ডেনে বাংলাদেশের বিপরীতে পাকিস্তানকে কলকাতাবাসীর প্রাণান্ত সমর্থন মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদের দীনতা প্রকাশ করেছে এবং এই মতবাদকে আরো দুর্বল করেছে। আমি খেলার সাথে রাজনীতিকে মিশাচ্ছিনা; মিশাচ্ছি প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাকে। কলকাতার ইডেন গার্ডেন ক্রিকেট স্টেডিয়ামে গত ১৬ মার্চ ২০১৬ তারিখে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচে গ্যালারির প্রায় সব ভারতীয় বাঙালি দর্শক পাকিস্তানকে অকুণ্ঠ সমর্থন করেছে অনাকাঙক্ষিত ভাবে। এই অদ্ভুত ঘটনাটি বাঙালি জাতির জন্য লজ্জাজনক এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের গালে চপেটাঘাত।
বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা প্রচার করে- "ধর্মীয় বা রাজনৈতিক পরিচয় যা-ই হোক, আমরা বাঙালিরা মূলত এক জাতি। ধর্ম বা রাজনীতির চেয়ে ভাষা ও সংস্কৃতিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যা আমাদেরকে অভিন্ন বন্ধনে বাঁধবে। ধর্মীয় বন্ধনের অসারতা প্রমাণ হয়েছে একাত্তরে; কিন্তু বাঙালিয়ানার বন্ধন ছিঁড়বে না। তাই 'বাঙলা' আমার মৌলিক পরিচয়, বাঙালি আমার ভাই।"
অথচ কলকাতার দর্শকরা চোখে আঙুল তোলে বাংলাদেশি বাঙালিদেরকে সোজা বলে দিল- "তোমরা কারা? তোমাদের চিনি না। তোমরা বাঙালি নাকি আফ্রিকান ইথিওপিয়ান, তাতে কিছু যায় আসে না। তোমরা সবাই বিদেশী। ক্ষেত্রবিশেষে (যেমন খেলায়) পাকিস্তানিরা আমাদের কাছে বাংলাদেশিদের চেয়ে বেশি প্রিয়। বাঙালিয়ানা? আরে বাবু, বাঙালিয়ানার বন্ধন তো ১৯৪৭ সালেই ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে; তোমাদের ধর্মীয় বন্ধন ছেঁড়ার চব্বিশ বছর আগেই ছিঁড়েছে সে-বন্ধন। তোমাদের সাথে আমাদের আর হবে না।"
এখন অনেকে প্রশ্ন তোলবে, "ঐসব আমজনতা লোকগুলো কি ভারতীয় বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব করে? ওরা কি ও-দেশের বুদ্ধিজীবি? নাকি তাদের জাতীয় নীতিনির্ধারক? ওদের কথা একটি জাতির বক্তব্য হিসেবে নেওয়া অনুচিত।"
আমি এই প্রশ্নকারী বোকা বাংলাদেশিকে বলব: বুদ্ধিজীবি বা নীতিনির্ধারক কারা? তারা তো আমজনতার মুখপাত্র মাত্র। জনগণ যা চাইবে, নীতিনির্ধারকেরা তা করবে। আর এমন তো নয় যে, পশ্চিম বাংলার সব পাগল, মূর্খ, বেকুবদের ধরে আনা হয়েছিল ইডেন গার্ডেনে। বরং সেখানে এসেছিল গড়পড়তা সাধারণ মানুষজন, যাঁদের বেশিরভাগই শিক্ষিত। এই 'গড়পড়তা' লাখখানেক মানুষের কাজে পুরো পশ্চিম বাংলার মানুষদের মন প্রতিফলিত হয়। হ্যাঁ, অল্পকিছু মানুষ হয়তো তাদের উল্টো, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে ছিল, কিন্তু তাদের সংখ্যা নগণ্য; তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করে না, প্রতিনিধিত্ব করে ইডেনের ঐসব বাংলাদেশবিরোধিরাই।
আমি উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী নই, তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আমার ভাল লাগে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, ততই মনে হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষগুলো কোনোদিনই বাংলাদেশিদের আপন হবে না। তারা সবসময় আমাদেরকে ও আমাদের বাংলাদেশকে ছোট করে দেখতে অভ্যস্ত।
পাশাপাশি একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বর্তমানে দুর্বল হলেও উগ্র বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ যেন আমাদের গ্রাস না করে। উগ্র বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীরা শাড়ি, চুড়ি, রবীন্দ্রসংগীত, হিন্দু সাহিত্যিকদের রচনা, পহেলা বৈশাখ, এমনকি অনেক সময় নবান্নের পিঠা উৎসবেরও বিরোধিতা করে। এটি দুঃখজনক। তাঁরা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের কথা বলে ইসলাম ও বাঙালিয়ানাকে (উগ্রতার চরম মাত্রায় ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধকেও) মুখোমুখি দাঁড়া করায়। বাংলাদেশি জাতীয় দর্শনের জন্য এটি ভয়াবহ রকমের ক্ষতিকর। আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি, বাঙালিয়ানার ৮০% বিষয়ের সাথেই ইসলামের কোনো বিরোধ নেই। মূর্তিপূজা, দুর্গাপূজা, যৌতুক ইত্যাদি হিন্দুধর্মীয় বিষয়গুলো বাদ দিলে বাকি সবই একজন মুসলিম পালন/উপভোগ করতে পারে।
বাংলা ভাষা কি হিন্দুদের ভাষা? দূর হও বেকুব! হিন্দুরা কি বাংলা ভাষা বা বাঙালিয়ানার ইজারাদার? ভাষা ও সংস্কৃতি যার কাছে যায়, তার। ফারসি ভাষা ছিল পারস্যের অগ্নিউপাসকদের ভাষা; তাই বলে কি ইসলামের স্বর্ণযুগে এই ভাষাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে? একসময়কার অগ্নিপূজকদের এই ফারসি ভাষা-ই পরবর্তীতে আরবিকে ছাপিয়ে প্রধান ইসলামী ভাষার স্থান দখল করে রেখেছিল শত শত বছর। ইরান থেকে আসাম, বুখারা থেকে ইন্দোনেশিয়া, প্রায় বেশিরভাগ মুসলিম জাহান শাসিত হয়েছি ফারসি ভাষায়। ইসলামের তত্ত্বীয় ভাষা আরবি হলে ব্যবহারিক ও উন্নতির ভাষা ফারসি। ইসলামি সাহিত্যে আরবির চেয়ে ফারসির ব্যবহার বেশি ছিল গত একহাজার বছর যাবত। এই যুগে আরবি আবার ফিরে আসছে বটে, তবে এখনো অনেক বড় বড় মাদ্রাসায় উচ্চশিক্ষার মাধ্যম ফারসি। অথচ হাজারখানেক বছর আগেও ফারসি ভাষা ছিল অগ্নিউপাসকদের ভাষা, যেভাবে উর্দু (ভারতীয় ভাষা) ছিল পৌত্তলিকদের ভাষা, বাংলার মত। এসব ফারসি-উর্দুর সাথে ইসলামের কোনো সমস্যা না থাকলে বাংলার সাথে কেন থাকবে?? ইসলাম কি এতই ক্ষুদ্র যে, তা কিছু (বাংলা) অক্ষরকেও সহ্য করে না? কক্ষনো না! সবই বাজে কথা। আবার ইসলাম এত কঠিনও না যে, আপনার স্ত্রীর অন্তর্বাসের রঙও নির্ধারিত করে দেওয়া হবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে। ইসলাম এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিছু মৌলিক বিশ্বাস ধারন করলে এবং কিছু নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করলেই আপনি মুসলিম; আপনার ভাষা বা জাতীয়তা যা-ই হোক। বৃহত্তর গণ্ডিতে গিয়ে অবশ্য আপনি মুসলিম জাতির অন্তর্ভুক্ত হবেন। এজন্য আপনার 'বাঙালি' পরিচয় মুছে ফেলার কোনো প্রয়োজন নেই; যে-কারণে তুর্কি, মোঘল, পাঠান, উজবেক, ইরানি, ইরাকি, আফগান, মিশরি, ইয়ামেনি, বসরি, বুখারি ইত্যাদি জাতের মুসলিমগণ নিজেদের স্বকীয় জাতীয় পরিচয় মুছে নি। তারা তো এখন উল্টো অভিজাত মুসলিম গোষ্ঠী বলেই বিবেচিত হয়। তাহলে আপনার 'বাঙালি' পরিচয়ে লজ্জা থাকবে কেন? যারা বাঙালি পরিচয় মুছে ফেলতে বলে, তারা হয়তো ইসলাম বুঝে না, নাহয় খোদ বাঙালিয়ানাকেই জানে না। খুঁজ নিয়ে দেখুন- খুব সম্ভবত তাদের পূর্বপুরুষেরা দুয়েক শ' বছর আগে মধ্য এশিয়ার পাহাড় বা তৃণভূমি থেকে বিতাড়িত বা অর্থসংকটাপন্ন হয়ে বাংলায় এসে উঠেছিল; আর এখন তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে বাঙালিয়ানার বিরুদ্ধে লেগেছে, বাঙালি জাতিকে পঙ্গু করে দিতে চাইছে।
বাঙালি বনাম মুসলিম- এই দু'টানায় আমাদের জাতীয়তা কী হবে? উত্তর হলো: আমরা বাঙালি মুসলিম, আমরা বাংলাদেশি। 'বাংলাদেশি' শব্দটি কারো ধর্মীয় পরিচয় বহন করে না। সাতচল্লিশ ও একাত্তরের ঔরসে বাংলাদেশের জন্ম। এদেশে আছে বাংলাদেশি মুসলিম, বাংলাদেশি হিন্দু, বাংলাদেশি বৌদ্ধ, বাংলাদেশি আদিবাসী/পাহাড়ী সবাই। 'বাংলাদেশি' শব্দটি কিছু মানুষের ভূ-রাজনৈতিক পরিচয় বহন করে, এর বেশি কিছু না। সংস্কৃতি ও ভাষার দিক দিয়ে আমরা সবাই বাঙালি। বাঙালি ও বাংলাদেশি, এ পরিচয় দু'টিকে এক করার দরকার নেই; এরা আলাদাভাবেই সুন্দর। অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করছে ক্ষুদ্রমনা লোকেরা। "ইসলাম আগে নাকি বাঙালিয়ানা আগে?" এটা ঠিক এমন শোনায় "হাত আগে নাকি পা আগে?"। হাত ও পা, কোনোটা একটার চেয়ে আরেকটা কম না। হাত দিয়ে যেমন মানুষ কাজ করে, ধর্ম তেমনিভাবে মানুষের কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, কাজের দিকনির্দেশনা দেয়। পা দিয়ে যেমন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে, সংস্কৃতি তেমনিভাবে একটি জাতিকে সভ্য পৃথিবীর দরবারে বুক ফুলিয়ে দাঁড়া করায়, সম্মানের আসন দেয়।
আর, বাংলাদেশকে ভিত্তি করে যদি কোনো পূর্ণাঙ্গ সংস্কৃতির কথা ভাবা হয়, তাহলে সে সংস্কৃতি সৃষ্টি হতে দু'-চার-পাঁচ শত বছর সময় লাগবে। মানুষেরা পরিকল্পিতভাবে কোনো ভাষা বা সংস্কৃতি জন্ম দিতে পারে না, সামান্য প্রভাবিত করতে পারে মাত্র। এগুলো নিজ থেকেই জন্ম নেয়, নিজের মতো চলে। তাই নতুন কোনো উদ্ভট সংস্কৃতি সৃষ্টির কথা না ভেবে বাংলা সংস্কৃতি নিয়েই থাকতে হবে।
যাহোক, আবার পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কথা বলি একদম শেষে। তাদের ও আমাদের মাঝে এখন আকাশ-পাতাল পার্থক্য। বাঙালিয়ানা এখন দু'টি ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত; একটি বাংলাদেশি বাঙালিয়ানা এবং আরেকটি ভারতীয় বাঙালিয়ানা। আর এই বিভাজনের জন্য তাঁরাই দায়ি। তাদের উগ্রতা ও কর্তৃত্ববাদিতার জন্য ভারত ভাগ হয়েছিল। তাঁরা এখনও আগের মতো আছে। বাংলাদেশিরা যতই 'বাঙালি ভাই' বলে চিৎকার করুক, তাঁরা বাংলাদেশিদেরকে আপন ভাবে না, নিচু চোখে দেখে, পর ভাবে, আর দশটি বিজাতির মতো করে গণ্য করে। ১৬ মার্চের ইডেন গার্ডেন তার ভালো সাক্ষি।
তবে এই অবস্থায় তাদেরকে প্রতিহিংসা করা অন্যায়। তারা ভালো করছে না, তাই বলে আমরা মন্দ করব কেন? সৌন্দর্য হলো বাঙালি মাত্রই অন্য বাঙালির মঙ্গল চাইবে, তাকে সম্মান করবে, ভালবাসবে; ধর্ম বা রাষ্ট্র যা-ই হোক। বাঙালি জাতির মহান সন্তানদের উচিত, সকল ধর্মের সকল রাষ্ট্রের সকল স্থানের বাঙালিদের মধ্যে মজবুত বন্ধন তৈরি করার চেষ্টা করা। আমজনতা বুঝছে না, তবুও তো সবাই এক মায়ের সন্তান। আমজনতাকে সুপথে নিয়ে আসার দায়িত্ব সকল বড় মানুষের উপর বর্তায়।
বিশ্বের দরবারে যে-দল 'বাংলা' শব্দের প্রতিনিধিত্ব করে, যে-দলের সকল সদস্যই বাঙালি, যে-দল রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে খেলতে নামে, যে-দলের হাসি-কান্না-প্রেম-গালি-গান-কবিতা সবই বাংলা, বাঙালি মাত্রই সে-দলকে আন্তরিক সমর্থন করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি সমর্থনের বদলে উল্টো বিরোধিতা করে, তাও আবার ত্রিশ লাখ বাঙালি হত্যার দায়ে অভিশপ্ত পাকিস্তানের বিপরীতে, তাহলে বাঙালি জাতির জন্য এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে? কলকাতা দুঃখজনকভাবে তা-ই করে দেখাল।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৬