আমাদের গণিত শিক্ষক জুবায়ের রশীদ একজন অসাধারণ শিক্ষক। রোজই তিনি এমন কিছু করে বসেন যেন তাকে সবার আরো বেশি ভাল লাগে। তাকে নিয়েই এই ধারাবাহিক লেখা:
জুবায়ের কথন ( পূর্বকথা )
জুবায়ের কথন ( ক্লাসের কথা )
পরীক্ষার কথা শুনলেই আবার আমার সর্দিকাশি পেয়ে বসে। একে তো আমি “বোকার হদ্দ” গোছের ছাত্র, খুব যে লেখাপড়া করে “ফাঁটিয়ে দেব” তার কোনই সম্ভাবনা নেই। তার উপরে আমাদের সনাতনী গলধ:করণ পদ্ধতি আমার একদম না-পছন্দ। তাই পরীক্ষা এলে সাধারণত আমার অবস্থা ল্যাজে গোবরে হয়ে যায় :'( “চোখে সর্ষে ফুল দেখা” বলে যে একটা কথা আছে আর সেটা শুধু কথার কথা নয় এই কথা আমার চেয়ে ভাল আর কে জানে! তবে , সব নিয়মেরই ব্যতিক্রম আছে , আর পরীক্ষার ব্যতিক্রম হল জেডআরডির পরীক্ষা!
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইটি মিডটার্ম পরীক্ষা হয় , আর শেষে একটা ফাইনাল। দুইটা মিডের ২০ + ২০ শতাংশ , ফাইনালের ৩০ শতাংশ আর বাকিটা ক্যুইজ আর ক্লাসের উপস্থিতি এসব মিলে দেয়া হয়। তো যখন প্রথম মিডের সময় ঘনিয়ে আসল, তখন ক্লাসের সুবোধ বালক “অনন্য” স্যারকে সেই ঐতিহাসিক প্রশ্নটা করে বসল, “স্যার, কোশ্চেন কিরকম হবে?” আমার মাথায় প্রশ্ন কিরকম হবে এমন চিন্তা ঘুরপাক করে না, উত্তর কি রকম হবে তা ভাবতে গিয়েই গলা শুকিয়ে যায়। আর তাছাড়া এই একই প্রশ্ন আর কত শুনব শুনি? কিন্তু জেডআরডির উত্তরটা শুনতে হল, কেননা একই প্রশ্নের এমন উত্তর আগে কখনো শুনিনি! নতুনত্বগুলো নিম্নরুপ:
১) পরীক্ষা হবে ২৫০ নম্বরের! নতুন জিনিষ, পরীক্ষা সাধারণত হয় ২০ কি ২৫ নম্বরের। তার ভিতরে আবার আমি পাই ৫ কি ১০ । নম্বর দিতেই শিক্ষকদের যত কিপ্টেমি । যাক বাবা , জেডআরডির পরীক্ষায় অন্তত শখানেক নম্বর কামিয়ে নেয়া যাবে!
২) পরীক্ষায় বহুনির্বাচনী ( মাল্টিপল চয়েস ), সত্য-মিথ্যা ইত্যাদি থাকবে! শোন কথা! গণিতে এমন জিনিষপত্র থাকবে তা কেউ কখনো শুনেছে! আমার জন্য ভালই হল, ভুলভাল কিছু টিকচিহ্ন আর সত্য-মিথ্যা গোঁজামিল দিয়ে আমিও টু-পাইস কামিয়ে নিতে পারব
৩) পরীক্ষায় বড় বড় কোন অঙ্ক থাকবে না, যদি থাকেও তবে সেগুলোকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে দেয়া হবে, যাতে করে, এক অংশ সমাধান করে সেটার সাহায্য নিয়ে পরের অংশ সমাধান করা যায়।
৪) পরীক্ষার হলে এক পাতার “চিট শিট” সোজা বাংলায় যাকে বলে নকল , নিয়ে যাওয়া যাবে। শুধু তাই নয়, নকলের পাতাটি আলাদা করে জমা দিতে হবে এবং যার নকল যত বেশি সুন্দর হবে সে নকলের জন্য তত বেশি নম্বর পাবে!
একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেই দেখা যাবে জেডআরডির পরীক্ষা পদ্ধতিটি অসাধারণ! বহুনির্বাচনী ও সত্য মিথ্যা থাকায় শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র হিসাব নিকাশে মাথা না কুটে গণিতের মৌলিক বিষয়গুলো বুঝে নিতে আরো বেশি সময় দেবে। স্যার নিজেই বলেন, “Mathematics is not about mere calculations, it's about theorem and algorithms”। তার পরীক্ষা পদ্ধতিও তার দর্শনকে সুন্দর করে ফুঁটিয়ে তোলে। বড় সমস্যা ছোট ছোট ভাগ করে দেয়ায় শিক্ষার্থীরা গাণিতিক ( বা অন্য যে কেন ) সমস্যা সমাধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখতে পারবে। আর তা হল , কোন বড় ও জটিল সমস্যাকে সহজ ও ছোট সমস্যায় ভাগ করে ফেলা। চিটশিটের কারণে প্রয়োজনীয় সূত্রগুলো মনে রাখার চাপ নেওয়া লাগবে না, ফলে ছাত্ররা জটিল ও বুদ্ধিদীপ্ত সমস্যাগুলোর সমাধানে মন দিতে পারবে। আর বেশি নম্বর থাকায় আমিও অনায়াসে শখানেক নম্বর কামিয়ে নিতে পারব।
এ তো গেল কি হতে পারে তার একটা নীলনকশা। তবে যা হয়েছিল তা আমার কাছে এক কথায় অভূতপূর্ব। জীবনে কত পরীক্ষা দিয়েছি গুণে শেষ করতে পারব না। কিন্তু এত মজা আগে কখনোই পাইনি, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই। পরীক্ষাতে যে সময় ছিল তাতে পুরোটা সময়ই নিরন্তর লেখাজোকা করতে হয়েছে, তবে তাতে আনন্দ বিন্দুমাত্র কমেনি। সব থেকে যে ব্যাপারটি আমার কাছে ভাল লেগেছে তা হল, যেই থিওরেমগুলো দিয়ে আমরা সমস্যা সমাধান করি পরীক্ষার সময় সেগুলো আমাদের নিজেদেরই একটু একটু করে বের করে নিতে হয়েছে। তারপরে সেই থিওরেম দিয়ে সমস্যা সমাধান করতে হয়েছে। ফলে একটা থিওরেম কিভাবে এল বা সেটা কিভাবেই বা প্রয়োগ করতে হবে সেই ব্যাপারগুলোও আমাদের কাছে আরো পরিষ্কার হয়েছে। সারাজীবন পরীক্ষা দেবার সময় ভেবেছি, ইশশ, আগে কেন আরো বেশি করে শিখলাম না। কিন্তু পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিতে দিতে শেখার এমন অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না! আর আনন্দের কথা তো বললামই।
মজার কথা হল পরীক্ষা পদ্ধতি যে কেবল আমার একার পছন্দ হয়েছে তা নয়। কম-বেশি সবাই এর প্রশংসা করেছে! কেউ বলেছে কনসেপ্ট ভাল থাকার কারণে তার পরীক্ষা ভাল হয়েছে, আবার কেউ বলেছে , স্যারের পদ্ধতি ঠিকই আছে, পরেরবার সে তাই আরো বেশি বেশি করে পড়বে! সত্যি কথা বলছি , এমনটাও আগে শুনিনি। ছাত্রের মুখে পড়ার কথা, আর ভূতের মুখে রাম নাম নেয়া সমার্থক! পরীক্ষার পরের দিন ক্লাসে পরীক্ষার ধরণ বদলাতে হবে কি না এর উত্তরে সব ছাত্র-ছাত্রী সজোরে নাআআ বলেছিল! এ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ থাকলে বলত, “না জয়যুক্ত হয়েছে, না জয়যুক্ত হয়েছে, না জয়যুক্ত হয়েছে!”
দ্বিতীয় মিডটার্ম পরীক্ষাতেও একই রকমের পদ্ধতি ছিল। তবে এইবার স্যার ধাপে ধাপে সমস্যাগুলো তুলে না দিয়ে সমস্যাগুলোকে সরাসরি তুলে দিয়েছিলেন। অনেকটা গণিত অলিম্পিয়াড বা প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার মত। এতে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই জটিল সমস্যাকে সহজ অংশে ভেঙ্গে তার থেকে সমাধান বের করে আনার চেষ্টা শিখে নিতে থাকে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, পরীক্ষার খাতা পাবার পর অনেক সমস্যারই সমাধান করতে পারছিলাম না। কিন্তু যতই সময় যায় ততই সমাধানগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। আর পরীক্ষার শেষের দিকে হঠাত করেই একটা একটা করে সমাধান পরিষ্কার হয়ে যেতে থাকে। শুধু আমার না, আমার বন্ধু মাসুদসহ আরো অনেকেরই এই একই দশা হয়েছিল
ফাইনাল পরীক্ষা হয়েছিল প্রথম দুটো পরীক্ষার ধরণের মিশেল। অর্থাৎ কিছু সমস্যা ছোট ছোট ধাপ করে ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল আর কিছু কিছু সমস্যার ধাপ নিজেদেরই বের করে নিতে হয়েছিল। আর ফাইনালে চিটশিটের বদলে সুযোগ ছিল পুরো বইটাই নিয়ে যাওয়ার। বলাই বাহুল্য, সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম “খোলা বই” বা ওপেন বুক পরীক্ষা! আমাদের সিলেবাস ছিল প্রথম মিডে ইনফিনিট সিরিজ , দ্বিতীয় মিডে থ্রি-ডি ম্যাথস ও ভেক্টর এবং ফাইনালে ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস ।
ফাইনালের দিন জেডআরডি ব্যাগে ভর্তি করে সবার জন্য একটা করে চকোলেটের বক্স নিয়ে এসেছিলেন। অদ্ভূত ব্যাপার, সেটাই ছিল আমাদের অনেকের জীবনে শিক্ষকের কাছ থেকে পাওয়া প্রথম কোন উপহার! এর আগে শিক্ষকেরা যে কখনো আমাদের জন্য কিছু কিনে নিয়ে আসেননি তা নয়। বাজারের সব থেকে দামি মোটা বেত কিংবা ব্যাথার মাত্রা বাড়ানোর জন্য তাতে মোটা করে পেঁচানোর টেপ তারা ঠিকই কিনেছেন। ছোট একটা চকলেট কিনলে বোধহয় মন্দ হত না । ফেইসবুকে জেডআরডির একটা ছবি আছে, ছাত্রদেরকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ফুটবল খেলছেন। জেডআরডি এমনই, দূর্দান্ত গণিত শিক্ষক, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজন অসাধারণ ভাল বন্ধু!
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভবনের নিচতলায় আলবার্ট আইনস্টাইনের একটা কথা লেখা আছে, “Do not worry about your difficulties in Mathematics, I can assure you mine are still greater”। একই কথা লেখা আছে গণিত নিয়ে ফেইসবুকে খোলা জেডআরডির গ্রুপেও। আমার কাছে মনে হয় গণিত বুঝি প্রচণ্ড আনন্দের কোন একটা জিনিষ , তবে সেই ভাবনাটাকে সত্যি করতে জেডআরডির মত কয়েকজন শিক্ষক ঠিকই দরকার হয়। আমরা অনেকদিনের অপেক্ষায় তাঁর মত একজন শিক্ষক পেয়েছি, জুবায়ের রশীদের জন্য এতটুকু অপেক্ষা করাই যায়! ( সমাপ্ত )
পুনশ্চ: সঠিক সময়ে গ্রেড ( শিক্ষার্থীদের নম্বর) জমা না দেওয়ার কারণে জেডআরডি স্যারকে নাকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেবার চিন্তা ভাবনা চলছে। আমার প্রার্থনা তিনি যেন অনেকদিন আমাদের সাথে থেকে যান আর আমার মত গাধা পিটিয়ে ( নাকি চকোলেট খাইয়ে ) মানুষ করেন!