আমাদের গণিত শিক্ষক জুবায়ের রশীদ একজন অসাধারণ শিক্ষক। রোজই তিনি এমন কিছু করে বসেন যেন তাকে সবার আরো বেশি ভাল লাগে। তাকে নিয়েই এই ধারাবাহিক লেখা:
জুবায়ের কথন ( পূর্বকথা )
ক্লাসে ঢোকার আগে নাবিলা স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে হাত পা নেড়েচেড়ে বলতে লাগল যে সে গতকাল ভেবেছিল বেশ মজা রে স্যারের লেকচার শুনবে, কিন্তু শীতে নাকি তার অবস্থা আইসক্রিম! এই হল আমাদের এক মহা সমস্যা। কড়া গ্রীষ্মের মাঝেও টাইটানিক আকৃতির এসিগুলোর কল্যাণে ক্লাসের ভিতরে ঠকঠকিয়ে কাঁপি। আর তালগাছ আকারের দু'একজন না থাকলে ঐ বজ্জাত এসিগুলোর নাগাল পেতেও ভারি বিপদে পড়তে হয়। যাক সে কাঁপাকাঁপি প্রসঙ্গ! ক্লাস আগেই শুরু হয়ে যাওয়ায় ভীরু পায়ে পিছনের দিকের একটা খালি চেয়ারে বসে পড়ি চটপট। প্রথম দিন তো ক্লাসে আসিইনি ( দিনাজপুরে গিয়েছিলাম ), দ্বিতীয় দিনও আবার দেরি! ভয়ে ভয়ে স্যারের মুখের দিকে তাকাতেই দেখি , পাতলা কাঁচের চশমার ভিতর দিয়ে দুষ্টুমিমাখা একটা হাসি। যেন বলছেন, “দেরি করে এসেছ তো বেশ করেছ। আজকাল এমন কটা ছেলেপিলে পাওয়া যায় বল তো দেখি!”
এই ভদ্রলোকই জেডআরডি । আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদেরকে পুরো নামে না ডেকে তাদের নামের ফাঁকতাল দিয়ে তিনটি অক্ষর নিয়ে সে নামে ডাকা হয়। অনেকটা ভাঁজাপোড়া মুরগী বিক্রি হবার দোকানের নামগুলোর মত! জেড়আরডির প্রথম যেই জিনিষটা আমার নজর কাড়ল তা হল তার বাড়ির কাজ! অন্য সবার মত অনুশীলনীর কিছু সমস্যার নম্বরই শুধু তিনি লিখে দেননি , বরং সেগুলির সাথে বইয়ের অমুক পৃষ্ঠা থেকে তমুক পৃষ্ঠাও পড়ে আসতে বলেছেন। আমি তো আবার অঙ্কে লবডঙ্কা, বলে না দিলেও অনুশীলনী করতে গিয়ে আগের অংশ বেশ কবার করে পড়তে হয়, আর সেসব পড়তে গিয়ে বাড়ির কাজ জমা দেবার সময় প্রায়ই পার হয়ে যায় :'( । মনে মনে ভাবলাম, যাক বাবা, এবার “অর্ধেক” বাড়ির কাজ অন্তত আমি ঠিকই করে নিয়ে আসতে পারব!
আমাদের শিক্ষকদের আবার ক্লাসে ইংরেজিতে কথা বলতে হয় বলে জেডআরডি ক্লাসে কথা বলেন শুদ্ধ আমেরিকান ভাষায়, মানে বারাক ওবামার মত ! হালকা রঙের কোন শার্ট আর জিন্সের প্যাণ্ট পরেই ক্লাসে এসে পড়েন তিনি। কথা বলতে বলতে মাঝেমধ্যে আলবার্ট আইনস্টাইনের ছবিওয়ালা একটা খাতায় উঁকিঝুকি মেরে নেন একটু আধটু। আরেকটা হাসির ব্যাপার হল, বোর্ডে লেখা আর কথার ফাঁকে স্যার বোর্ডের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত সজোরে হাঁটতে থাকেন! ছোটবেলায় পরীক্ষার খাতায় মাইল আর কিলোমিটারের হিসাবে তালগোল পাঁকিয়ে বেদম প্যাদানি না খেলে আমি ঠিকই বলে দিতে পারতাম এক ক্লাসেই তিনি কত মাইল হাঁটেন!
জেডআরডির ক্লাস নেওয়ার ধরণও মজার বলতে হবে। জটিল ব্যাপারগুলো ব্যাখ্যা করার সময় অন্য অনেকেই যেমন সহজ বিষয়গুলো খোলাসা করে বলে জল ঘোলা করতে চান না, জেডআরডি তার পুরো বিপরীত। তিনি সহজ জিনিষগুলোকেই একটার গায়ে একটা জোড়া দিয়ে কঠিন বিষয়টাকেও টিউবওয়েলের পানির মত সহজ করে তোলেন। একবারের ঘটনা বলি। আমাদের ইমপ্লিকেশন বলে কি যেন একটা জিনিষ শিখতে হয় , ব্যাপারটা বিচ্ছিন্ন গণিত নামে একটি কোর্সের শুরুর দিকেই থাকে। মানে বিষয়টা হল , সব মুরগী পাখি হলেও সব পাখিই মুরগী নয়। দুই মিনিটের একটা গল্প দিয়ে আর বোর্ডে কি সব আঁকিবুকি করে জেডআরডি এই কঠিন কথাটা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, অথচ আগে পুরো তিনমাসের কোর্সে আমরা এর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিনি!
জেডআরডি ক্লাসের ভিতরেও ভীষণ বন্ধুভাবাপন্ন। ক্লাস চলার সময় দু এক কথা বলতে গেলে অন্যরা যেখানে ঘাড় ধরেই বের করে দেবার যোগাড় যন্তর করেন, জেডআরডি সেখানে নিজেই শিক্ষার্থীদের কথা বলিয়ে নিতে চান। সহজ জিনিষগুলো বোর্ডে না লিখে আমতা আমতা করতে থাকেন, যাতে করে সবাই চিত্কার করে উত্তর বলে দেয়! ক্লাসে যে কোন সময় যে কোন কিছু জানতে চাইলে বিরক্ত না হয়ে মাথা চুলকে সেগুলোর উত্তর দিতে থাকেন। আর ক্লাসের ভিতরে গুরুগম্ভীর গণিতের পাশে হাসি-তামাশা তো চলছেই! একবার হল কি এক ছাত্র ভেক্টরের বৈশিষ্ট্য নিয়ে তুমুল তর্ক শুরু করে দিল, অবশ্য তর্ক না বলে সেটাকে যুক্তিহীন হাউকাউ বলা যেতে পারে। কিন্তু জেডআরডি হাল না ছেড়ে ঠাণ্ডা মাথায় ছেলেটিকে সব ঠিকঠাক বুঝিয়ে সুঝিয়ে দিলেন।
জেডআরডির ক্লাসের আসল মজা বোঝা যাবে একটা উদাহরণ দিলে। তখন তুমুল হট্টগোলে চলছে বিশ্বকাপ এবং ব্রাজিল আর আর্জেণ্টিনা তখনো বাদ পড়েনি। জেডআরডি একদিন ক্লাসে এসে ঘোষণা দিলেন আজ ক্লাস শেষে একটা খেলা খেলবেন। আমরা চুপচাপ ঘাপটি মেরে ক্লাস করলাম। ক্লাস শেষে তিনি আর্জেণ্টিনা সমর্থকদের উঠে দাঁড়াতে বললেন। বেকুবের মত লাফ দিয়ে আমি সবার আগে উঠে দাঁড়ালাম, অবাক হয়ে খেয়াল করলাম আমিই কেবল একা দাঁড়িয়ে আছি! আমি হালে পানি পাচ্ছি না দেখে আমার কয়েক “সতীর্থ” আর্জেণ্টিনা সমর্থকও উঠে দাঁড়ালো। এই ক'জন মিলে হয়ে গেল যাকে বলে “আর্জেণ্টিনা দল”! একইভাবে ব্রাজিল আর “অবশিষ্ট বিশ্ব” দল তৈরি হয়ে গেল। এবার শুরু হল খেলা! খেলার নিয়ম হচ্ছে প্রত্যেক দলের খেলোয়াড়েরা অপর দলের জন্য একটি করে গণিত প্রশ্ন ঠিক করবে, তারপর সেটা বাকি দুটি দলের একটিকে সমাধান করতে হবে। বাকিদলগুলো যদি সমস্যা সমাধান করতে না পারে তবে আমরা মানে প্রশ্নকর্তা দলটি পুরো পয়েণ্ট পাব যদি না আমাদের দেয়া সমস্যাটিই আমাদের যে কোন খেলোয়াড় বোর্ডে গিয়ে সমাধান করতে পারে। শুধু তাই নয়, আমরা নিজেরাই বলে দিতে পারব যে, আমাদের তৈরি সমস্যাটি “ব্রাজিল” বা “অবশিষ্ট বিশ্ব” দলের কোন খেলোয়াড় সমাধান করবে। স্বভাবতই আমরা চাইব আমাদের তৈরি সমস্যাটি অন্য দলের বোকাসোকা গোছের কোন ছেলে বা মেয়ে সমাধান করতে গিয়ে খাবি খাক! এইটাই হল খেলা। বাকি দলগুলোর জন্যও একই নিয়ম। এই নিয়ে কিছুক্ষণ চলল হইচই, তুমুল রেষারেষি আর কথা কাটাকাটি। শেষ পর্যন্ত সবাই সবার কাছ থেকে সব শিখেটিখে নিল আর পুরো খেলাটার মজার একটা সমাপ্তি হল।
তবে আমার কাছে যে জিনিষটি সব থেকে ভাল লেগেছে তা হল জেডআরডির পরীক্ষা। অন্যান্য ব্যাপারের মত জেডআরডি এখানেও ব্যতিক্রম! ( চলবে
জুবায়ের কথন ( পরীক্ষার কথা )
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ২:২০