আমি যখন সিক্স কি সেভেনে পড়ি তখন আমার বড় ভাইটির কাছে একদিন গেলাম গাণিতিক আরোহ কি জিনিষ সেইটা বুঝতে। আমি সেইদিন হাফপ্যাণ্ট ছেড়ে সবে ফুলপ্যাণ্ট ধরেছি, আমি বাপু এসব আরোহণ-টারোহণ বুঝি কি করে? তো আমি ভাবলাম কি, ওসব এখন অত বুঝে টুঝে কাজ নেই, বরং দু’চারটা আলগা কাগজ ছিড়ে নিয়ে ভাইকে দিয়ে বললাম, এখন পারলে আমাকে এই অঙ্কটা করে দেখাও। কিন্ত আমার গোবেচারা টাইপের সহোদর কি আর এসব বুঝবে, সে অগত্যা আমাকে আরোহ পদ্ধতির কি সব গোজামিল দিতে শুরু করল। সে কি সব একে একে দুই আর দুইয়ে দুইয়ে চার বলছে, আর এইদিকে আমি মহাবিরক্ত। আরে বাবা ( মানে ভাই ) আমি এতসব জেনেশুনে কি করব, তার থেকে বরং ঐ কাগজে ঘচাঘচ দু’চার লাইন লিখে দাও, পরীক্ষায় হুবহু তুলে দিয়ে মুখে ললিপপ গুজে থাকি।
এর বছরখানেক পরে একদিন রাতের বেলা খাবার টেবিলে বসে আছি। খাবার দেখলে আমার আবার বিশেষ হুশ জ্ঞান থাকে না , সেদিনও যা পারছি অন্যান্য দিনের মত গোগ্রাসে গিলছি । অইদিকে আবার বসে আছে আমার গোবেচারা ভাইটি। খাবারের দিকে তাকিয়ে তার ভাবখানা এমন যেন তাকে মুসা ইব্রাহিমের মাউণ্ট এভারেস্টের চড়ার মত কঠিন কিছু করতে দেয়া হয়েছে । মাউণ্ট এভারেস্টে ওঠার চেষ্টা চালাতে চালাতে ভাই হঠাত করে নিচের সমস্যাটি বলে বসল:
তিনজন মিলিটারি গোছের লোককে এক লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে, ঠিক যেভাবে স্কুলের এ্যাসেমব্লিতে আমর দাঁড়াই। সিনিয়র অফিসারের কড়া নির্দেশে তিনজন এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যেন তৃতীয় জন প্রথম দুজনকে দেখতে পায়, দ্বিতীয় জন কেবল প্রথম জনকে দেখতে পায়, আর প্রথম জন কাউকেই দেখতে পায় না। এইবারে পাগলাটে সিনিয়র অফিসারটি তিনটি সাদা আর দুটি কালো টুপির মধ্যে কয়েকটা টুপি নিয়ে মিলিটারি গোছের লোক তিনটিকে পড়িয়ে দিয়েছে। এমনভাবে টুপি পড়ানো হয়েছে যাতে করে কেউ তার নিজের টুপির রং দেখতে না পায়। বাকিসব আগের মতই আছে, তার মানে, তৃতীয় জন এখনো প্রথম দুইজনকে ( এবং সাথে করে তাদের টুপির রং) দেখতে পারছে , দ্বিতীয় জন কেবল প্রথম জনের টুপির রং দেখতে পারছে। আর প্রথম জন কাউকেই দেখতে পায় না। পাগলাটে অফিসারটি এখন বলে উঠল , আচ্ছা এবার বল তো দেখি তোমাদের কার মাথায় কোন রং এর টুপি? মিলিটারি গোছের লোক তিনটা একেবারে যাকে বলে ভীতুর ডিম। এরওর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলে দিক, তা না। এমনকি ওরা চোখ উচিয়ে নিজের টুপিটা দেখার সাহসও করল না। অগত্যা তৃতীয় জন আর দ্বিতীয় জন বোকার মত বলে বসল, তারা তাদের টুপির রং জানে না। এতে প্রথম লোকটি গেল ভড়কে। রগচটা অফিসার, পারি না বললে কি জানি কি করে বসে ঠিক নেই। তাই সে নাক মুখ খিচিয়ে মাথা চুলকে ঠিক ঠিক তার টুপির রং বলে দিল। এখন প্রশ্ন হল, এই লোকের টুপির রং কি এবং কেন?
ভাইয়া বলল, কি যেন নিউরণে অনুরণন নামে একটা বিভাগ চালু হয়েছে প্রথম আলোতে, সেখানে নাকি এমন মজার (!) মজার (!) অনেক সমস্যা দেয়া থাকবে। আরো বড় কথা সেগুলো নাকি মামা-চাচার জোর ছাড়াই নিজেকেই সমাধান করতে হবে! এমন পরিস্থিতে সাধারণত আমি পিছের দরজা দিয়ে বের হয়ে পালানোর তালে থাকি। কিন্তু খাবার ঘরের পাশের দরজা দিয়ে বেরোলেই বাড়ির উঠোন। আর রাত বিরাতে উঠোনের বেলতলায় যে দু-দশটা ন্যাড়া ভুত ঘুরঘুর করে একথা কে না জানে। তাই দরজা পালানোর আইডিয়া আপাতত বাদ দিয়ে আমি খাওয়া দাওয়ায় মন দিলাম। ওসব সমস্যা টমস্যা নিয়ে ভেবে চুল পাকিয়ে আর কি কাজ। ওদিকে আর ভাইটি আমাকে হাত করতে না পেরে আমার অন্য ভাইয়ের সাথে বকবক করে চলল। কায়কোবাদ স্যার ( মুহম্মদ জাফর ইকবালের সাথে ) নাকি এসব করছে কচিকাঁচাদের গাণিতিক দক্ষতা বাড়ানোর জন্য! আমি ভাবলাম, যাক বাবা, ভালই তো কথা! গণিতে আমি বরাবই লবডঙ্কা। রোজ আমি রুটিন করে মেজ ভাইয়ের কাছে অঙ্ক করতে বসি আর তালগোল পাকিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে থাকি। ভাইটিও সুযোগে আমাকে কথা দুটো শুনিয়ে দিতে ছাড়ে না, আর তাতেই আমার নাকের পানি চোখের পানি এক হবার দশা । এ অবস্থায় গাণিতিক দক্ষতা কিছু বাড়লে বৈ মন্দ হত না । তাই ভাবলাম, নিউরনে অনুরণন থেকে কটা সমস্যা পড়েই দেখি না কি হয় !
আমার পরিষ্কার মনে আছে, নিউরণে অনুরণন থেকে প্রথম যে সমস্যাটি সমাধান করেছিলাম সেটি ছিল একটি বীজগাণিতিক সমস্যা। এর আগে জীবনে অনেক বীজগণিতের অঙ্ক দেখেছি, তবে সেগুলো হয় ভাই না হয় স্কুলের রাগি স্যার বা ম্যাডাম করিয়ে দিয়েছে। বলতে গেলে আগে কখনো আমি নিজে কোন সমস্যাই সমাধান করিনি। এখনো মনে পড়ে সেদিন একটা কাগজে যখন সমস্যাটির সমাধান লিখছিলাম, তখন রীতিমত আমার হাত কাঁপছিল, মনের ভিতরে ছিল এক আনন্দমিশ্রিত উতকণ্ঠা। আগে কখনোই এমন হয়নি! তবে সেটা ছিল সবে শুরু।
এরপর থেকে দাঁত মাজার ফাঁকে কিংবা স্কুল পালিয়ে বাড়ি ফেরার পথে যখনি সময় মিলত তখনি সমস্যাগুলো মনে মনে সমাধানের চেষ্টা করতাম। ছেঁড়া একটা পাতায় আঁকিবুকি করে বা হাতের তালুতে কলম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখতাম সমস্যাগুলোর কোন কুলকিনারা হয় কি না । হঠাত একদিন ভাবলাম, আচ্ছা আমি নিজেই কি কম যাই নাকি? শুধু শুধু মেজ ভাইয়ের কাছে অঙ্ক করতে বসে ঝারি না খেয়ে ওগুলো নিজে চেষ্টা করলেই তো হয়। যেই ভাবনা সেই কাজ, গণিতের বই খুলে দু একটা সমস্যা নিয়ে ভাবতে বসে গেলাম । আমি বোকাসোকা মানুষ , এতে বিশেষ সুবিধা করতে পারলাম না। তাই ভাবলাম, বইটা আরেকটু ঘেঁটেঘুঁটে দেখি । দেখলাম , বইয়ের প্রতিটা অনুশীলনীর আগে বেশ কিছু কথাবার্তা লেখা আছে সেই বিষয়ে। অদ্ভুত ব্যাপার হল, এগুলো কখনোই আমাদের স্কুলে কিংবা অন্য কোথাও শেখানো হয় না। এমনকি এগুলো যে আসলেই পড়তে হয় সেই জিনিষটাই আমাদের অজানা ! আমি তো আগে ভাবতাম, এগুলো শুধু শুধু লেখার জন্য লিখেছে্। এখন দেখি, এগুলো বুঝে বুঝে পড়লে, না বুঝলে ভাইদের কাছে বুঝে নিলে নিজে নিজেই বইয়ের সমস্যাগুলো সমাধান করা যায় ! মোদ্দা কথা , মৌলিক জিনিষগুলো ঠিকভাবে বুঝে নিলেই সেগুলো দিয়ে বানানো যে কোন সমস্যা সমাধান করা যায় , এমন কি আমার মত বোকার হদ্দও সেগুলো করতে পারে!
এ কথা যখন বুঝতে পেরেছি তখন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমাদের স্কুল কলেজের অধিকাংশ শিক্ষকেরাই এই ব্যাপারটা করেন না । তারা মৌলিক ব্যাপারগুলোকে সহজভাবে না বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঘচাঘচ কিছু সমস্যার সমাধান লিখে দেন এবং সেগুলো শিক্ষার্থীদের গলধ:করণ করতে হয় । এই পুরো প্রক্রিয়াটির ভিতরে আনন্দ , আবিষ্কার বা বুদ্ধি খাটানোর কোন ইসু নেই । আমার স্পষ্ট মনে আছে , গণিত যে “বোরিং” বা “ভয়ংকর” কিছু নয় , বরং ঠিকভাবে শিখলে ভীষণ এ্যাডভেঞ্চারময় আর মজার একটা ব্যাপার হয় এ কথা বন্ধুদের বলতে গিয়ে আমার কয়েকবার গণধোলাই খবার দশা হয়েছিল ! তখন থেকেই মনে মনে ভাবতাম, এমন কোন শিক্ষক কি কখনো পাব না, যে গণিতের একটু বিদঘুটে রুপ না এঁকে তার সুন্দর দিকটা ফুটিয়ে তুলবে, গণিতের মূল বিষয়গুলো হাত পা নেড়ে বলেকয়ে দিয়ে সেগুলোর সুন্দর সুন্দর সমস্যা আমাদের সামনে তুলে ধরবে। গণিতকে তখন আমরা আর সাক্ষাত যমদূত না মনে করে বন্ধু ভেবে আমাদের বেঞ্চে বসতে দেব । কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় , আমার স্কুল বা কলেজ জীবনে এমন কোন শিক্ষকের দেখা পাইনি । গুণে গুণে অনেক বছর পার করে যখন হাল ছেড়ে দিতে বসেছি, তখনি “তিনি এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন
“ ।
তিনি আর কেউ নন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষক জুবায়ের রশীদ!
জুবায়ের কথন ( ক্লাসের কথা )
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ২:১৬