ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকার কারণগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে বইমেলা অন্যতম। বইমেলার জন্য লাইনে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে বসন্ত উত্সব আর ভ্যালেণ্টাইন্স ডে, কি নেই ফেব্রুয়ারিতে। তবে এবারের ফেব্রুয়ারি অন্তত একটি কারণে আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ববহ। প্রায় একবছরের সাধনায় ইংরেজি উইকিপিডিয়ায় ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে লেখা নিবন্ধটি নির্বাচিত নিবন্ধ হওয়ার ফলে এবার একুশে উত্যাপন একটি ভিন্ন অনুভূতি নিয়ে এসেছে। এছাড়া ২১শে তে নিবন্ধটি প্রথম পাতায় আসারও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যদি সত্যিই তাই হয় তবে তো কথাই নেই। যা হোক, আসল কথায় আসা যাক।
ভাষা আন্দোলনের এই আবেগকে আমরা অন্য কোনভাবে কাজে লাগাতে পারি কি? কিংবা বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষার গুরুত্বটুকুই বা কতটুকু? এক্ষেত্রে সম্পুর্ণ অভিজ্ঞতা থেকে দুটো উদাহরণ দিচ্ছি।
১. গত বছরে ইউএনডিপি আয়োজিত এক কর্মশালায় মুক্ত সফটওয়্যার শীর্ষক এক সেমিনারে সারা দেশ থেকে আসা কর্মজীবীদের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময়ে জানতে পারি, তারা মুক্ত সফটওয়্যার সংক্রান্ত ব্যবহারবিধি বা ম্যানুয়ালগুলি বাংলা ভাষায় পেতে আগ্রহী। বাংলা ভাষায় এই সুবিধাটুকু পেলে তারা কত সহজে নিজেদের দক্ষতাটাকে বাড়িয়ে নিতে পারতেন তা বলাই বাহুল্য। তখন খুব সম্ভবত তাদের উবুণ্টু শেখানো হচ্ছিল। তবে আনন্দের ব্যাপার হল, বাংলায় উবুণ্টুর ব্যবহারবিধি তৈরি হয়েছে।
২. গণিত উত্সব বেশ কয়েকবছর ধরেই বাংলাদেশে গণিত তথা বিজ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্র। এই উত্সবকে সামনে রেখে তাই গড়ে তোলা হয়েছে গণিতের বইয়ের এক বিশাল সংগ্রহশালা। আমাদের দেশের ক্ষুদে ও বিজ্ঞানমনষ্ক শিশু কিশোরেরা এই বইগুলো পড়ে সহজেই তাদের ভিতরের সৃজনশীলতা আর মেধাকে বিকশিত করতে পারে। তবে সমস্যা একটিই, গোল বাধায় সেই ইংরেজি। গণিত উত্সবের একজন অন্যতম সক্রিয় কর্মীর সাথে আলাপে জানতে পারি, শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষায় লেখার কারণে অনেক শিশু-কিশোর ও তাদের অভিভাবকেরা আগ্রহ থাকা স্বত্ত্বেও গণিতের এই শ্রেষ্ঠ বইগুলো কিনতে পারেন না। অথচ হুবহু সেই বইটিই যদি বাংলা ভাষায় লেখা হত তবে কত সহজে সেই নির্দিষ্ট জ্ঞানটুকুই তার কাছে পৌছে যেত। কানে শোনা কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে নেই, এবার মেলায় গিয়ে সেই অভিজ্ঞতাটিই নিজের চোখে দেখলাম। আমার নিজের কথাই যদি ধরি, তবে বাংলা ভাষায় লেখা গণিতের বই “নিউরনে অণুরণন” পড়েই গণিত, কম্পিউটার বিজ্ঞান সর্বোপরি লেখাপড়ার উপরই প্রথমবারের মত আগ্রহ পেয়েছিলাম।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশে আসা হার্ডওয়্যারনির্ভর প্রতিষ্ঠান ইণ্টেলের নির্বাহী ক্রেইগ ব্যারেটের কথা দিয়ে। একটি উন্নয়নশীল দেশ কিভাবে নিজেদের উন্নতি করবে এর উত্তরে তিনি স্থানীয় ভাষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মুক্ত লেখা তৈরির দিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
সংগীতশিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবু একবার আমাকে বলেছিলেন, এই ভাষাকে নিয়েই তো সব স্বপ্নের শুরু। সত্যি কথা, আবার ভাষাই সে স্বপ্নপুরণের সবথেকে বড় হাতিয়ার।