বরাবর,
মুফতী সাহেব
মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা
প্রশ্ন : আমাদের সমাজে মাঝে মাঝে এমন লোকের কথাও শোনা যায়, যারা নিজেদেরকে ধর্মে অবিশ্বাসী বলে ঘোষণা করেন, কিন্তু লোকগুলো যেহেতু মুসলমান পরিবারের তাই এদের মৃত্যুর পর মুসলমানদের মতোই তাদেরও জানাযা-দাফনের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এখন জানার বিষয় হল-
১. ইসলামের দৃষ্টিতে কাফের, মুশরিক তথা বিধর্মীদের জানাযার বিধান কি?
২. ধর্মে অবিশ্বাসী তথা নাস্তিকদের জানাযা পড়া হবে কি না? কিছু লোককে দেখা যায়, তারা জন্ম নিয়েছে মুসলমানের ঘরে কিন্তু তারা নিজেদের কথায় ও লেখায় আল্লাহ, রাসূল ও শরীয়তের বিধিবিধানকে কটাক্ষ করে। তাদের জানাযার ব্যাপারে শরীয়তের নির্দেশ কী?
৩. মুসলিম-এলাকায় বসবাসকারী বিধর্মীদেরকে কাদের কবরস্থানে সমাহিত করা হবে? এক্ষেত্রে ধর্মত্যাগী তথা মুরতাদ-নাস্তিকের ব্যাপারে ভিন্ন কোনো হুকুম আছে কি?
৪. কাফের, মুশরিক, নাস্তিক, মুরতাদদের মৃত্যুর পর আমরা তাদের জন্য দুআ করতে পারব কি না? অথবা আলেম ও ইমাম সাহেবদের দুআ করতে বলতে পারব কি না? কোনো মুসলমান ঐ কাজগুলো করলে তার ব্যাপারে শরীয়তের বিধান কী?
উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর জবাব আপনাদের মুখপত্র মাসিক আলকাউসারের মাধ্যমে জানাতে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।
নিবেদক
মুহাম্মাদ দ্বীন ইসলাম
পো : আমিরগঞ্জ
থানা ও জেলা : কিশোরগঞ্জ
উত্তর :
بسم الله الرحمن الرحيم
الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على خاتم الأنبياء والمرسلين، وعلى آله وصحبه أجمعين، وعلى من تبعهم بإحسان إلى يوم الدين.
মূল জবাবের পূর্বে কয়েকটি বিষয় বলা দরকার।
এক. জানাযা, কাফন ও দাফন হচ্ছে মানুষের মৃত্যু পরবর্তী কার্যক্রম। এগুলো বাস্তবায়ন করতে হয় জীবিত লোকদের, মৃত ব্যক্তির তখন করণীয় কিছুই থাকে না। এ জন্যই শরীয়ত এ সংক্রান্ত নির্দেশগুলো প্রদান করেছে মৃতের আত্মীয়স্বজন ও নিকটবর্তী স্বধর্মীয় লোকদের।
দুই. মানুষের মৃত্যু পরবর্তী তার লাশ কেন্দ্রিক কার্যক্রমগুলো পরিচালিত হয় ঐ ব্যক্তির মৃত্যুপূর্ব ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী। প্রত্যেক ধর্মের রয়েছে এ সংক্রান্ত নিজস্ব বিধিবিধান। কোনো ধর্মই তার অনুসারীর লাশের উপর অন্য ধর্মের বিধিবিধান প্রয়োগের অনুমতি দেয় না। যেমনিভাবে অনুমতি দেয় না তাদের নিজস্ব গোরস্থান ছাড়া অন্য ধর্মের গোরস্থানে দাফন করার।
তিন. ইসলামে জানাযা, কাফন, দাফন ইত্যাদি জীবিত মুসলমানদের উপর মৃতদের হক এবং অবশ্য পালনীয় ফরয নির্দেশ। তবে এটি ফরযে কিফায়া। অর্থাৎ কিছু সংখ্যক মুসলমান এ দায়িত্ব পালন করলে অন্যরা দায়িত্বমুক্ত হবেন। যদিও এলাকার সকল লোক ও আত্মীয়স্বজনের দায়িত্ব (সুন্নত) হচ্ছে মৃতের জানাযা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করা এবং তার স্বজনদেরকে সান্ত্বনা দেওয়া।
এবার মূল প্রশ্নগুলোর জবাব :
প্রথম প্রশ্নের জবাব : জানাযা পড়া হবে একমাত্র মুসলমানের। কাফের, মুশরিক তথা বিধর্মীর জানাযা পড়া হারাম।
দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব : শুধু ঐ মৃতের জানাযা পড়তে হবে, যিনি মুসলমান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। মুসলমান পরিবারের কোনো সদস্য যদি নাস্তিক হয়, যদি সে আল্লাহ-রাসূলকে অস্বীকার করে অথবা আল্লাহ রাববুল আলামীন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, কুরআন মজীদ বা শরীয়তের অকাট্য অন্য কোনো বিধিবিধান নিয়ে কটূক্তি, কটাক্ষ করে তবে সে কাফের; বরং মুসলিম-পরিবারে জন্মগ্রহণকারী বা জীবনের একটি অংশে মুসলমান থেকে পরবর্তীতে অবিশ্বাসী হওয়ায় সে নিকৃষ্টতম কাফের। শরীয়তের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘মুরতাদ।’ এদের শাস্তি কাফেরদের চেয়েও বেশি। এ সকল অবিশ্বাসী ও মুরতাদের জানাযায় অংশ গ্রহণ করা, তাদের জানাযায় ইমামতি করা সুস্পষ্ট হারাম। এমনকি তাদের নিকটতম মুসলমান আত্মীয়দের জন্যও এদের জানাযা পড়া জায়েয নেই। এমনিভাবে যারা প্রকাশ্যে নিজেদেরকে মুসলমান বলে, কিন্তু বাস্তবে সে কাফের ও অবিশ্বাসী, এরা হল মুনাফিক। আর মুনাফিকের অবিশবাসের বিষয়টি যদি প্রকাশ পেয়ে যায় তবে তার জানাযা পড়ারও সুযোগ নেই।
কাফের, মুশরিক, অবিশ্বাসী নাস্তিক, মুরতাদ তথা অমুসলিমের জানাযার নামায হারাম হওয়ার বিষয়টি শরীয়তের সুস্পষ্ট দলিল দ্বারা প্রমাণিত।
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلَا تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِنْهُمْ مَاتَ أَبَدًا وَلَا تَقُمْ عَلَى قَبْرِهِ إِنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَمَاتُوا وَهُمْ فَاسِقُونَ.
(তরজমা) কখনো তাদের কেউ মারা গেলে তুমি তার জানাযা পড়ো না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়িও না (দুআ-ইস্তিগফারের জন্য বা দাফন-কাফনের জন্য)। তারা তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং না-ফরমান অবস্থায় মারা গেছে।-সূরা তাওবা (৯) : ৮৪), তরজমা : তাফসীরে উসমানী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
তাফসীরবিদ ইমাম কুরতুবী রাহ. আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলেন-
هٰذَا نَصٌّ فِيْ الامْتِنَاعِ مِنَ الصَّلاٰةِ عَلىٰ الْكُفَّار
অর্থাৎ এটি সকল কাফেরের জানাযা নিষিদ্ধ হওয়ার সুস্পষ্ট দলিল।-আলজামি’ লিআহকামিল কুরআনিল কারীম ৮/১৪০
এ জন্যই এ ব্যাপারে উম্মতের সকল ফকীহ একমত। কোনো মাযহাবেই এ বিষয়ে ভিন্নমত নেই।
(দ্রষ্টব্য : হানাফী ফিকহের জন্য : কিতাবুল আছল ১/৪১১; আলমাবসূত, সারাখসী ২/৫৪;
মালেকী মাযহাবের জন্য : আলমুদাওয়ানাহ ১/১৬৩; মাওয়াহিবুল জলীল ৩/৭০; আলবয়ান ওয়াত তাহসীল ২/২৭৭
শাফেয়ী মাযহাবের জন্য : আলমাজমূ’ ৫/১২০, ২১৮; আলবায়ান ৩/৭৯
হাম্বলী মাযহাবের জন্য : আলমুগনী, ইবনে কুদামা ৩/৪৬৬; আররওযুল মুরবি ১/৩২৯; আলফুরূ ১/৫৩৯ )
তৃতীয় প্রশ্নের জবাব : মৃত ব্যক্তির লাশ তার স্বধর্মীয় লোকদের কবরস্থানে দাফন করতে হবে। ইহুদীকে ইহুদীদের গোরস্থানে, খৃষ্টানকে তাদের গোরস্থানে এবং অন্য ধর্মের লোকদেরকে তাদের নিজ নিজ গোরস্থানে সমাহিত করতে হবে। এক ধর্মের লোককে অন্য ধর্মের গোরস্তানে সমাহিত করা যাবে না। আর মুসলমানদের কবরস্তানে একমাত্র মুসলমানদেরকেই দাফন করতে হবে। কোনো অমুসলিমকে সেখানে দাফন করা যাবে না।
আর মুসলিম পরিবারে বড় হওয়া ধর্মত্যাগী নাস্তিক লোকদের বিধান আলাদা। তাদেরকে কোনো ধর্মের কবরস্থানেই জায়গা দেওয়া যাবে না। বরং আলাদা কোনো জায়গায় গর্ত করে মাটিচাপা দিবে।
অমুসলিমের জানাযা নিষিদ্ধের বিধানের মতো এ বিধানেও উম্মতের ঐকমত্য রয়েছে।
ফকীহ ইবনে নুজাইম মিসরী বলেন-
وإذا مات أو قتل على ردته لم يدفن في مقابر المسلمين، ولا أهل ملته، وإنما يلقى في حفرة كالكلب.
অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তি মুরতাদ অবস্থায় মারা যায় বা নিহত হয় তবে তাকে মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করা যাবে না এবং ইসলাম ত্যাগ করে যে ধর্ম সে গ্রহণ করেছিল ঐ ধর্মের কবরস্থানেও না; বরং ... কোনো গর্তে নিক্ষেপ করে মাটিচাপা দেওয়া হবে।-আশআশবাহ ওয়ান নাযাইর ২/১৯৫
আদ্দুররুল মুখতার ও তার ভাষ্য ফতোয়ায়ে শামীসহ প্রায় সকল ফিকহের কিতাবে এ মাসআলা রয়েছে।
মালেকী মাযহাবের বিখ্যাত ফকীহ ও মুফাসসির কাজী আবু বকর ইবনুল আরাবী একই কথা বলেছেন। (দ্রষ্টব্য : আহকামুল কুরআন, আবু বকর ইবনুল আরাবী ২/৮০২
শাফেয়ী মাযহাবের ফকীহ ও প্রখ্যাত হাদীসভাষ্যকার ইমাম নববী বলেন-
اتفق أصحابنا رحمهم الله على أنه لا يدفن مسلم في مقبرة كفار ولا كافر في مقبرة مسلمين.
অর্থাৎ এ ব্যাপারে ফকীহগণ একমত যে, কোনো মুসলমানকে কাফেরদের গোরস্থানে এবং কোনো কাফেরকে মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করা যাবে না।-শরহুল মুহাযযাব ৫/২৪৮
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. মুসলমানদের কবরস্থানে অমুসলিম, অবিশ্বাসী ও মুরতাদকে সমাহিত না করার তাৎপর্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন- فيتأذؤا بعذابهاঅর্থাৎ মুসলমান মাইয়্যেতগণের আত্মাসমূহ যেন কাফের, মুরতাদদের শাস্তির কারণে কষ্ট অনুভব না করে।-আলমুগনী, ইবনে কুদামা ৩/৫১৩
কুয়েত থেকে প্রকাশিত ফিকহী বিশ্বকোষ ‘আলমাওসূআতুল ফিকহিয়্যা’য় (খন্ড : ২১, পৃষ্ঠা : ১৯) কাফের ও মুরতাদের দাফন সংক্রান্ত মাসআলাটির ক্ষেত্রে সকল ফকীহর ঐকমত্য সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
চতুর্থ প্রশ্নের জবাব : যে ব্যক্তি ঈমান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে একমাত্র তার জন্যই দুআ করা যাবে। এছাড়া অন্য কোনো ধর্মের লোক বা অবিশ্বাসী-মুরতাদদের জন্য কোনোক্রমেই দুআ করা যাবে না, অন্য কাউকে দুআ করতে অনুরোধও করা যাবে না। এটা সুস্পষ্ট হারাম।
আল্লাহ রাববুল আলামীন কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে তার নবীদেরকে কাফের-মুশরিকদের জন্য দুআ-ইস্তিগফার করতে সুস্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন। এমনকি যদি ঐ মৃত কাফের নবীর পিতা বা পুত্রও হয়।
(দ্রষ্টব্য : সূরা তাওবা (বারাআহ) (৯): ৮০, ১১৩, ও ১১৪; সূরা হুদ (১১) : ৪৫, ৪৬, ৪৭
মুসলিম উম্মাহর কোনো ফকীহ বা আলেমের এ বিষয়ে ভিন্ন মত নেই।-আলমাজমূ ৫/১২০
সুতরাং কোনোক্রমেই কাফের, মুশরিক বা বে-দ্বীন মুরতাদের জন্য দুআ করা বা দুআর জন্য অনুরোধ করা যাবে না। এমন দুআ কবুলের কোনো সম্ভাবনা তো নেই-ই; বরং দুআকারী এবং তাকে অনুরোধকারী উল্টো হারাম কাজ করার গুনাহয় লিপ্ত হবে। কেউ যদি না জেনে বা না বুঝে এমনটি করে ফেলে তবে অবিলম্বে আল্লাহর দরবারে তওবা-ইস্তিগফার করে নিবে।
যুক্তির নিরীখে : শরীয়তের হুকুম-আহকাম নির্ধারিত হয় কুরআন-সুন্নাহ এবং এ দুটির ভাষ্য ফিকহের দ্বারা। তাই এখানে যুক্তির প্রয়োজন হয় না। তবে আলোচ্য বিষয়গুলো যদি সাধারণ যুক্তিতে দেখা হয় তবুও বিধর্মী ও অবিশ্বাসী নাস্তিক, মুরতাদদেরকে মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করা, তাদের জানাযা পড়া এবং তাদের জন্য দুআ করার অন্যায় ও অযৌক্তিক হওয়াই পরিষ্কার হয়ে উঠে। কারণ জীবদ্দশায় তারা যা ঘৃণা করত, অবিশ্বাস করত বা যা নিয়ে কটাক্ষ করত সে বিষয়গুলো মরণের পর তাদের উপর আরোপ করা দুনিয়াবী দৃষ্টিতেও অন্যায়ই বটে। সাধারণ যুক্তিতে এটি তো তার ‘বিশ্বাসে’র অবমাননা বৈ কিছু নয়।
মোটকথা, মুসলমানদের জন্য কোনো বিধর্মী বা অবিশ্বাসী নাস্তিক, মুরতাদের জানাযা পড়া, তাদেরকে মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করা এবং তাদের জন্য দুআ করা বা দুআ করতে বলা সম্পূর্ণ হারাম।
মহান আল্লাহ সকলকে সঠিক কথা বলার ও সঠিক পথে চলার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ
মুফতী, ফতওয়া বিভাগ
মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা
(গবেষণামূলক উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা ও দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান)
৩০/১২ পল্লবী, ঢাকা-১২১৬
তারিখ : ১৪/০৪/১৪৩৪ হি.
২৫/০২/২০১৩ ঈ.
লিখাটি যেখান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছেঃ
http://www.alkawsar.com/article/844