بسم الله الرحمن الرحيم
মুফতী মীযানুর রহমান সাঈদ
শবে বরাতে করণীয় ও বর্জনীয়ঃ
যেহেতু রাতটিতে মহান আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের উপর বিশেষ রহমত দান করেন এবং গুনাহগারদের জন্য ক্ষমার ঘোষণা হয় বিধায় মুসলমানদের উচিত এমন রহমত ও বরকতপূর্ণ রাতকে গণীমত মনে করে স্বীয় প্রভূর দরবারে বেশি বেশি তওবা-ইসতিগফার করা। নিত্যনতুন বিদআত ও ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থেকে প্রশান্তিচিত্তে ইবাদত করবে। নফল নামায কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল, দরূদ শরীফ বিভিন্ন দু'আসমূহ সব ধরণের মাসনুন ইবাদতই এ রাতে করা যাবে।
যেমনঃ
আল্লামা হাসান ইবনু আম্মার আশশারাম্বুলালী (রহঃ) বলেনঃ
" রাত্রি জাগরণের তাৎপর্য এই যে, এ রাতের অধিকাংশ সময়ে, কারো কারো মতে কিছু অংশে কোরআন হাদীছ পড়া অথবা শুনানো কিংবা তাসবীহ পড়া বা দুরূদ পাঠ করার মাঝে লিপ্ত থাকবে। "
এ বর্ণনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, এ রাতে জাগ্রত থাকার জন্য বিশেষ কোনো পদ্ধতি এবং বিশেষ কোন ইবাদত কিংবা বিশেষ পদ্ধতির কোন নামায শরীয়তের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করা হয় নি। এবং বারো রাকাআত কিংবা ষোল রাকআত সম্পর্কে যে জনশ্রুতি আছে ইসলামী শরীয়তে তার কোন ভিত্তি নেই। রাতটির সাথে সম্বন্ধযুক্ত এ ধরণের বিশেষ পদ্ধতির নামাযের ফজীলত সংক্রান্ত যে সব বর্ণনার উদ্ধৃতি দেয়া হয় এ সব নিজেদের পক্ষ থেকে বানানো ও মনগড়া এবং ভিত্তিহীনও বটে।
এজন্যই আল্লামা আবুল ফারাজ ইবনুল জাওযী (মৃঃ ৫৯৭ হিঃ) বলেনঃ
" উক্ত রাতে যে সব নামায আদায়ে যথাক্রমে প্রতিদান পাওয়া যাবে এবং যা জনসাধারণের মাঝে ব্যাপকতা লাভ করেছে অথচ তার কোন ভিত্তি নেই। "
তার সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তার সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু রেওয়ায়েত উল্লেখ করতঃ পরিশেষে তিনি রায় প্রদান করেন যেঃ
" এটি এমন হাদীছ যার জাল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তার তিনটি স্তরের প্রসিদ্ধ রাবিগণ অজ্ঞাত। তার মধ্যে দুর্বল রাবীও আছে। তাই হাদীছটি অবশ্যই অকল্পনীয়। "
অতিরিক্তঃ
আল্লামা যাহাবী, ইবনু আরাক, সুয়ুতী, মোল্লা আলী ক্বারী এবং হাদীসের অন্যান্য মুহাদ্দিসীনে কেরামগণ এই রকম নামাযগুলোকে (নির্দিষ্ট রাকাআত সংক্রান্ত) খণ্ডন করেছেন।
( যারা আরও বিস্তারিত জানতে চান তারা মওযু হাদীস নিয়ে লিখিত কিতাবগুলো দেখতে পারেন )
মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) এই বিষয়টি বারাতের রাতে নির্দিষ্ট নামায শীর্ষক আলাদা অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন। এই সব নামাযের কথা উল্লেখ করে, তিনি বলেন যে, এগুলো ভিত্তিহীন এবং চতুর্থ শতাব্দীতে বায়তুল মুকাদ্দাসে এবং পরবর্তীতে এর সমর্থনে কিছু হাদীস জাল করা হয়।
( মওযু আত্তী কাবীরঃ পৃ-৩৩০, বায়রুত সংস্করণ; তাযকিরাতুল মওযুয়াত, ফারবীঃ পৃ-৪৫ )
কোন কোন বুযুর্গ থেকে বর্ণিত বিশেষ পদ্ধতির আমলের তাৎপর্যঃ
এ সুবাদে একটি কথা স্পষ্ট করা দরকার যে, আল্লাহর কোন কোন নেক বান্দাদের পক্ষ থেকে যেসব বিশেষ বিশেষ পদ্ধতির নফল ও আমলের বিবরণ পাওয়া যায় ঐ সকল আমল তাদের নিজস্ব ধ্যান-ভাবনা বা রায় মাত্র। যেগুলো শরীয়তের কোন মাসআলা নয়। শরীয়তের কোন বিষয় নয় বরং কেবল বুযুর্গদের অভিজ্ঞতালব্ধ আমল মনে করে এ জাতীয় আমল কেউ করতে চাইলে করতে পারে। শরীয়তের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোন বাধ্য-বাধকতা নেই।
যথা হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) বুযুর্গদের এসব নফল ও বিভিন্ন আমলের বিবরণ দিয়ে এগুলোর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের বর্ণনা দেন এভাবেঃ
" একটি বিষয় না বুঝলেই নয় যে, কোন কোন বুযুর্গের বিভিন্ন কিতাবে (শাবানের) পনের তারিখ রাতে বিশেষ নফল নামায আদায় করার কথাও লিপিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে-এটা কোন বাধ্যতামূলক নয়। যে বিষয় শরীয়তের পক্ষ থেকে বাধ্যতামূলক নয় সে বিষয়টিকে এভাবেই নিরঙ্কুশ রাখা উচিত। হাদীছ শরীফে এ রজনীতে নফল নামাযের কোন বাধ্যবাধকতা আসেনি। বরং যে ইবাদত সহজ মনে হবে তাই করবে। তন্মধ্যে নফল নামাযও অন্তর্ভুক্ত। তাও আবার বিশেষ কোন পন্থা অবলম্বন করে নয়।
তবে কথা হলো বুযূর্গদের বক্তব্যে যে বিশেষ তরীকার নফল নামাযের কথা বলা হয়েছে তার কারণ এই যে, কোনো বুযুর্গ তার কোন মুরীদের বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে এর অনুমোদন দিয়ে থাকতে পারে। হয়ত তার ব্যাপারে এটাই ছিল যুক্তিযুক্ত। এখন একে ব্যাপক করে নেয়া বিদআত। তাই বলে বুযুর্গদেরকেও উপেক্ষা করা যাবে না। "
এ রাতে করণীয় আমলসমূহঃ
প্রথম আমল - রাত্রে জাগরণ করে নির্জনে ইবাদত করাঃ (তবে মসজিদে সমবেত হওয়া অনুচিত)
শাবানের পঞ্চদশ রজনীতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করা একটি মুসতাহাব আমল যা পূর্বে সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে। মুসতাহাব আমলকে তার পর্যায়েই রাখা উচিত। তার নির্দিষ্ট পর্যায় থেকে অগ্রসর হয়ে ওয়াজিব তথা আবশ্যকতার স্থানে তাকে নিয়ে যাওয়া জায়েয নেই বরং বিদআত। অপরদিকে এ রাতে একাকী ইবাদত করা উত্তম।
এর জন্য মানুষকে মসজিদে দলবদ্ধ করা, দলবদ্ধতার সাথে এ রাতে ইবাদত করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অন্যকেও অংশগ্রহণের জন্য দাওয়াত দেয়া, শবীনা ইত্যাদির আয়োজন করা ফুকাহায়ে কেরাম পছন্দ করেন নি। বরং বিদআত বলেছেন।
যথাঃ
ইতিপূর্বে ফিক্বহে হাম্বলীর প্রসিদ্ধ ফক্বীহ শায়খ মানসূর ইবনু ইউনুস আল বাহুকী (রহঃ) এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, তিনি বলেছেনঃ
" ... তবে মসজিদে রাত জেগে দলবদ্ধভাবে এ রাতে ইবাদতের উদ্দেশ্যে একত্র হওয়া বিদআত। "
ফিক্বহে হানাফীর অভিজ্ঞ আলিম ইবনু নুজাইম (রহঃ)ও প্রায় এরূপ বলেছেন, তিনি বলেনঃ
" উল্লেখিত ফজীলতময় রাতসমূহে রাত জেগে ইবাদত করার নিমিত্তে বিভিন্ন মসজিদে দলবদ্ধ হওয়া মাকরূহ। মসজিদ হোক বা অন্যত্র কেননা রসূল (সঃ) করেন নি, সাহাবায়ে কিরামও করেন নি এবং আহলে হিজাযও করেন নি। যাদের মধ্যে ইমাম আতা বিন আবী রাবাহ এবং ইবনে আবী মুলাইকার মত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আলেমও রয়েছেন। তা ছাড়া মদীনার ফকীহগণ এবং ইমাম মালিক (রহঃ) এর শাগরিদগণ দলবদ্ধতার সাথে সমবেত হয়ে যিকির আযকার করাকে বিদআত বলে আখ্যায়িত করেছেন। "
আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলী (রহঃ) দলবদ্ধতার সাথে মসজিদে জমায়েত হয়ে শবেবরাতে ইবাদত করা সম্পর্কে ওলামায়ে আহলে শামের দুইটি দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করেছেন।
১। একত্রিত হয়ে দলবদ্ধতার সাথে ইবাদত করা এ রাতে বৈধ ও জায়েয।
২। এগুলো কিছুই বৈধ নয় বরং মাকরূহ।
এ মতদ্বয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় মত তথা মাকরূহ হওয়াকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাই তিনি বলেনঃ
" দ্বিতীয় হলো শবে বরাতে মসজিদে কোন বিশেষ নামায, ওয়ায, দু'আ এর জন্য একত্রিত হওয়ার ব্যবস্থাপনা (গুরুত্ব সহকারে) মাকরূহ। অবশ্য যদি কেউ একাকী ঐ মসজিদে তার নামায আদায় করে তা মাকরূহ হবে না। এটা ইমাম আওযায়ী (রহঃ) এর উক্তি। যিনি শিরিয়ার ইমাম ফক্বীহ ও বড় আলেম। আর এই মতটি সঠিক হওয়ার বেশি নিকটবর্তী ইনশাআল্লাহ। "
তাই মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) উল্লেখ করেছেন যে, এ রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত, যিকির-আযকার করা অবশ্যই উত্তম কাজ। চাই নির্জনে হোক কিংবা প্রকাশ্যে। জনসমক্ষে হোক কিংবা একাকী। কিন্তু সমবেত হওয়ার প্রতি অতি গুরুত্বালোপ এবং তার আনুষ্ঠানিকতা না করাই চাই।
( দেখুন - যাওয়ালুসসিনাহ আল আ'মালিস সানাহঃ পৃ - ১৭, সূত্রে ফজীলত কী রাতেঁ )
সারকথাঃ
আল্লাহ তাআলা উক্ত মুবারক রাতে নিজ বান্দাদিগকে একান্তে ডাকতে চান, যেন বান্দা তার রবের সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে এবং বান্দা যেন নিজ গুনাহসমূহের স্মৃতিচারণ করে তাওবা ইসতিগফার করে গুনাহর পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে পবিত্র করে নিতে পারে, রহমত ও মাগফিরাতের খাজাঞ্চি থেকে যেন নিজের আঁচল পূর্ণ করে শনৈঃ শনৈঃ নিজেকে গোলাম হিসেবে প্রভূর কাছে পরিপূর্ণভাবে সঁপে দিতে পারে। তাই শবে বরাত আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নিজ বান্দার উপর এক মহান পুরস্কার ও নেয়ামত। অথচ বান্দা উক্ত নেয়ামতের শোকর আদায় করার পরিবর্তে তার অবমূল্যায়ন করে। একান্তে নির্জনভাবে ও একাকী ইবাদত করার পরিবর্তে তার অবমূল্যায়ন করে। একান্তে নির্জনভাবে ও একাকী ইবাদত করার পরিবর্তে প্রকাশ্যে ইলান করে গুরুত্বসহকারে দলবদ্ধভাবে ইবাদত করার মাধ্যমে বান্দা প্রকৃতপক্ষে উক্ত মহান নেয়ামতের ফজীলত ও মর্যাদারই ইতি ঘটায়। সম্ভবত এই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করেই উলামায়ে উম্মত ফজীলতের রাতসমূহে ইবাদতের উদ্দেশ্য জমায়েত হওয়াকে মাকরূহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
রাতের কোন অংশে জাগ্রত থাকা উত্তমঃ
এ ব্যাপারে হযরত থানভী (রহঃ) হাক্বীকতে ইবাদত (পৃঃ ৪৬৬) গ্রন্থে যা বলেছেন তার সারসংক্ষেপ হলো নিম্নরূপঃ
কুরআনে কারীমের আয়াত
قيلا واقوم وطأ اشد هى الليل ناشئة ان
এর দ্বারা রাতের শেষাংশে অথবা শোয়ার পর গভীর রাতে জাগ্রত হয়ে ইবাদত করা উত্তম বলে বুঝা যায়। আর হাদীছে নববী দ্বারা শেষ রাতে ইবাদত করা উত্তম বলে সাব্যস্ত। এ ব্যাপারে অনেক হাদীছ হাদীছগ্রন্থে বর্ণিত আছে। যাকে নুযূলে রবের হাদীছও বলা হয়। যুক্তি-প্রমাণও এর স্বপক্ষে। কারণ শেষ রাত নিদ্রার সময়। তখন নিদ্রা ত্যাগ করে ইবাদতে মগ্ন হওয়া খুবই কষ্টকর ও কঠিন। তাই এ কষ্ট উপেক্ষা করে ইবাদত করাটাই হবে উত্তম। সুতরাং উপরোক্ত বিবরণ দ্বারা বুঝা যায়, শবেবরাতের ইবাদত শেষ রাতে করাই অতি উত্তম। কিন্তু কারো জন্য যদি শেষ রাতে জাগরণ কঠিন হয়ে পড়ে তাহলে সে রাতের প্রারম্ভেই সাধ্যমত নফল ইবাদত করে নিবে। ( উল্লেখ্য যে, সর্বক্ষেত্রে ইশা ও ফজর নামায অবশ্যই জামাআতের সাথে পড়তে হবে। ) কারণ অন্যান্য রাতগুলিতে আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে রাতের শেষ অংশের দিকে অবতরণ করার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু শবে বরাতে রাতের প্রারম্ভেই প্রথম আসমানে আগমন করেন বলে হাদীছে আছে। এ ব্যাপারে আমরা হাদীছগুলো উল্লেখ করে এসেছি। উপরন্তু কেউ যদি সারারাত জাগ্রত থেকে ইবাদত করতে আগ্রহী বা সক্ষম হন তাহলে তা ভাল কথা। তবে এর জন্য দুটি শর্ত রয়েছে।
১। সময়কে অপচয় না করে ইবাদত, দু'আ, নামায, যিকির, তেলাওয়াত ইত্যাদিতে শরীয়ত সম্মতভাবে মগ্ন থাকা
২। ইশা ও ফজরের নামায অবশ্যই জামাআত সহকারে পড়ার নিশ্চয়তা থাকা।
দ্বিতীয় আমল - শাবানের পনের তারিখ রোযা রাখাঃ
আমরা হযরত আলী (রঃ) এর বর্ণিত হাদীছে পেছনে উল্লেখ করে এসেছিলাম যে,
" শাবানের পনের তারিখ রাতের বেলায় জাগ্রত থেকে ইবাদত কর এবং দিনের বেলায় রোযা রাখ। "
হাদীছটি সম্পর্কে আমরা মুহাদ্দিছীনে কেরামের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলাম যে, হাদীছটি জাল কিংবা অত্যাধিক দুর্বল নয়। হ্যাঁ অবশ্য একজন রাবীর স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কারণে মুহাদ্দিছীনে কেরাম হাদীছটিকে কিছুটা দুর্বল বলেছেন। আর ফাজাইলে আমাল এর ক্ষেত্রে এ ধরণের হাদীছ সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণযোগ্য। এর আগে আমরা মাহে শাবানে অধিক পরিমাণে রোযা রাখা, প্রতি মাসে আয়্যামে বীজ তথা ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রোযা রাখা তদুপরি হযরত আলী (রঃ) থেকে বর্ণিত উপরোক্ত হাদীছের উপর সবিস্তারে আলোচনা করে এসেছি। সুতরাং পেশকৃত হাদীছগুলির আলোকে শবেবরাতের রোজা রাখা মুসতাহাব।
এ ব্যাপারে উলামায়ে উম্মত ও ফুকাহায়ে কেরামের কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হলোঃ
১। আল্লামা যুরকানী মালেকী (রহঃ) ১৫ শাবান রোজা রাখাকে মুসতাহাব বলেছেন। তিনি বলেনঃ
" শা'বানের পনের তারিখ রাত আগমন করলে রাত জেগে থাকো তথা ইবাদতের মাধ্যমে রাতকে সতেজ করো এবং আল্লাহ তাআলার আনুগত্য প্রকাশার্থে প্রশান্তচিত্তে পদক্ষেপ গ্রহণ করো আর দিনের বেলায় রোযা রাখ। কেননা এসব কিছু মুসতাহাব। "
২। শায়খ আলা উদ্দীন আবুল হাসান আল হাম্বলী (মৃঃ ৮৮৫ হিঃ) লিখেনঃ
" শায়খ ইবনুল জাওযী আসবাবুল হিদায়াতে বলেছেন, হারাম মাসসমূহে এবং পূর্ণ শাবান মাসে রোজা রাখা মুসতাহাব। হারাম মাসসমূহের ব্যাপারে মাজদও স্পষ্টভাবে এটাই বলেছেন এবং আরো বলেছেন শাবানের পনের তারিখের রোজা আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ। "
৩। হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) বলেনঃ
" শাবানের পনের তারিখ রোজা রাখা মুসতাহাব। "
৪। হযরত মাওলানা মুফতী শফী সাহেব (রহঃ) শবে বরাতের মাসনূন আমলসমূহের আলোচনা করতে গিয়ে বলেনঃ
" শবে বরাত সকালে তথা পনের তারিখে রোজা রাখ। "
৫। হযরত মাওলানা মুফতী আজীজুর রহমান সাহেব (রহঃ) একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলেনঃ
" শাবান মাসের কোন তারিখে দিনে রোজা রাখা ফরজ কিংবা ওয়াজিব নয়। আর শাবানের তের তারিখের রোজার বিশেষ কোনো ফজীলত হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত নয়। তবে ১৫ শাবানের রোজার কথা হাদীছ শরীফে এসেছে যে, এ তারিখে রোজা রাখো। সুতরাং ১৫ শাবানের রোজা মুসতাহাব। কেউ রাখলে ছওয়াব পাবে, না রাখলে অসুবিধা নেই। "
উল্লেখ্য যে, বিষয়টিকে আমরা ইতিপূর্বে সবিস্তারে উল্লেখ করে এসেছি।
তৃতীয় আমল - শবে বরাতে কবরস্থানে গমনঃ
হযরত আয়েশা (রঃ) এর বর্ণিত হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয়েছে যে, হুযুর (সঃ) উক্ত রাতে মদীনার জান্নাতুল বাকী নামক কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের জন্য মাগফিরাতের দু'আ করেছেন। অতএব, উক্ত রাতে কবরস্থানে গমন করা, মৃতদের রূহে সাওয়াব পৌছানো এবং তাদের জন্য মাগফিরাতের দু'আ করা জায়েয। বরং ফিক্বহী বর্ণনার দৃষ্টিকোণে এই রাতে কবরস্থানে গিয়ে যেয়ারত করা মুস্তাহাব অনুমিত হচ্ছে।
নিম্নে এ সম্পর্কে কিছু বিবরণ তুলে ধরা হলোঃ
১। ফাতওয়া আলমগিরীতে বলা হয়েছেঃ
" কবর যিয়ারতের জন্য উত্তম দিবস চারটি। সোম, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার। তেমনিভাবে পবিত্র রাতগুলোতেও বিশেষ করে বরাত রজনীতে। "
২। হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) উক্ত ফিক্বহী আলোচনা করতঃ এক্ষেত্রে উলামায়ে দেওবন্দের ফয়সালা উল্লেখ করে লিখেনঃ
" ... এ সমস্ত লোক কবরস্থানে গুনাহের কাজ করে কবীরা গুনাহর অধিকারী হয়ে গেছে। কারণ কবর তো ভয়-ভীতির স্থান এবং নেক আমলের প্রতি অনুপ্রেরণাদায়ক। অথচ তারা উলটো কাণ্ড ঘটিয়ে বসলো। তারা কবরকে বিনোদন ও অপরাধ সংঘটিত করার আখড়া বানিয়ে নিল। যেসব লোক চাঁদনী রাতে মিম্বর এবং চেয়ারে বসে ওয়াজ-গল্পগুজব, নারী-পুরুষের সম্মিলন ইত্যাদির মতো বিদ'আত প্রচলন ঘটিয়েছে তাদের এসব কিছু নিষিদ্ধ তথা হারাম। কবর যিয়ারতকারী পুরুষ বা নারী যেই হোক না কেন, উল্লেখিত অন্যায়ের কারণে এসব কিছুই হারাম। "
শবে বরাত উপলক্ষে কবরস্থানে যাওয়া একটি মুসতাহাব আমল। তবে তার জন্য দলবদ্ধ হওয়া, একে অন্যকে যাওয়ার জন্য দাওয়াত দেয়া বিদআত। স্বয়ং হুজুর (সঃ) উক্ত রাতে জান্নাতুল বাকীতে তাশরীফ নিয়েছিলেন, কিন্তু ব্যাপারটি হযরত আয়শা (রঃ)ও জানতে পারেন নি। তাই মুসলমানদেরও উচিত শরীয়ত পরিপন্থী কাজ থেকে দূরে থেকে একাকী যিয়ারত করতে কবরস্থানে যাওয়া এবং মৃতদের জন্য ঈসালে ছাওয়াব করা। কিন্তু বিষয়টিকে শবে বরাতের আবশ্যকীয় আমল মনে করা যাবে না।। মোটকথা শরীয়তের যে আমল যে পর্যায়ের প্রমাণিত তাকে সে পর্যায়েই রাখা উচিত। তার থেকে আগে চলে যাওয়া শরীয়তের বিধান লংঘণ ছাড়া কিছু নয়।
শবেবরাতে সংঘটিত কিছু বিদআত ও কুসংস্কারঃ
আল্লাহ তা'আলা অভিশপ্ত শয়তানকে যখন তার গোস্তাখী ও সীমালংঘণের কারণে প্রশান্তির নির্ঝরিণী জান্নাতের নির্মল পরিবেশ থেকে তাকে বের করে দিলেন, তখন সে আদম জাতির সাথে স্পষ্ট শত্রুতার ঘোষণা করে এ মর্মে বদ্ধপরিকর হয় যে, সে আদম জাতিকে সীরাতে মুসতাক্বীম তথা সহজ সরল পথ থেকে বিভ্রান্ত করে অন্ধকারের অতলান্ত গহবরে নিক্ষেপ করার পূর্ণ প্রয়াস চালিয়ে যাবে।
কুরআন মাজীদের ভাষায়ঃ
" সে (ইবলীস) বললো, আপনি আমাকে যেমন উদভ্রান্ত করেছেন, আমিও অবশ্যই তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকবো। এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে। "
( আলা আরাফঃ ১৬, ১৭ )
বাস্তবেই শয়তানের গতিবিধি খুবই সুক্ষ্ম ও রহস্যময়। বড় সুক্ষ্ম পন্থায় সে যুগে যুগে বনী আদমের বিরুদ্ধে সব রকমের ষড়যন্ত্র করে আসছে। বনী আদমের কোন একটি দলকে শিরকের আবর্তে জট পাকিয়ে দিলে আরকটি দলকে বিদআত ও কুসংস্কারের মাঝে ঘুরপাক খাওয়ায়। মোটকথা, সব ধরণের গুনাহের উপর তার সমান দখল। অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী পন্থায় সে বনী আদমকে গুনাহের দিকে উৎসাহিত করে।
শবে বরাতের সময় যেহেতু মহান আল্লাহর রহমতের বারিধারা নেমে আসে, যেহেতু তিনি স্বীয় বান্দাগণকে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা করেন, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই শয়তান এই চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠে যে, বনী আদমকে রহমত ও মাগফিরাতের এই নির্ঝরণী থেকে কিভাবে বঞ্চিত করা যায় ? কিভাবে তাদেরকে ইবাদত থেকে দূরে রাখা যায় ? এসব জটিল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আতশবাজি, সিন্নি, আলোকসজ্জা, ইজতেমা প্রভৃতি অবশ্যই পালনীয় - এ চেতনা সে মানুষের মাঝে প্রবেশ করিয়ে দেয়। যেন মানুষ কুসংস্কারের জালে আটকা পড়ে এ ফজীলতময় রাতটির ফজীলত থেকে মাহরুম থেকে যায়। অবশেষে কুসংস্কারের জালে বন্দী মানুষটি তওবা করার নসীবও হারিয়ে ফেলে।
নিম্নে শবে বরাতে সংঘটিত যাবতীয় বিদআত ও কুসংস্কারের কিছু দৃষ্টান্ত এবং তার সম্পর্কে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হলো।
আতশবাজীঃ
ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ এমন কিছু লোক শবে বরাতকে উপলক্ষ করে লাখো টাকা ব্যয় করে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আতশবাজীর ব্যবস্থা করে থাকে। অথচ ইসলামী শরীয়তে তার কোন ভিত্তি নেই। এটি নিতান্তই কুসংস্কার। সমূহ সমস্যা যার মধ্যে বিদ্যমান। যথাঃ
১। আতশবাজী প্রথায় বহু অর্থ সম্পদের অপচয় হয়। আর অপচয় সম্পর্কে কুরআন-হাদীছে কঠোরভাবে ঘোষণা হয়েছে যে, অপচয়কারী শয়তানের ভাই।
২। এই প্রথার কারণে সময়ও নষ্ট হয়। যে সময়টুকু আতশবাজীর পেছনে ব্যয় হয় সে সময়টুকু ইবাদতে কাটালে আল্লাহ তাআলা হয়ত খুশি হয়ে যেতেন। আর সময়ের অপব্যয় করা গুনাহর শামিল।
৩। উক্ত প্রথাটির কারণে অনেক সময় অপর মুসলমান ভাই কষ্টও পান। বিশেষ করে পাড়া-প্রতিবেশীরা আতশবাজীর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে শান্তিতে থাকতে পারে না। অথচ এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে কষ্ট দেয়া হারাম। যে সম্পর্কে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে।
৪। সর্বোপরি এ রাতে কিছু লোক নিরিবিলি পরিবেশে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করতে চান। আতশবাজীর কারণে তাঁদের ইবাদতে মারাত্নক বিঘ্ন ঘটে।
অতএব একজন আতশবাজ একাধারে এ জাতীয় কয়েকটি গুনাহর শিকার হয়। নিজের সময় ও অর্থ খরচ করে আল্লাহ ও রসূল (সঃ) এর অসন্তুষ্টি কিনে নেয়, অপর মুসলমানকে কষ্ট দেয়। ইবাদতকারীর ইবাদতের মাঝে বিঘ্ন ঘটায়, উপরন্ত শয়তানকে খুশি করে।
আলোকসজ্জাঃ
শবে বরাতের আগমণ উপলক্ষে মসজিদ, কবরস্থান ও বাসা-বাড়ীতে সীমাতিরিক্ত আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়। এর দ্বারা নিজের অর্থ অপচয় তো হয়ই উপরন্ত কাফেরদের সঙ্গে সাদৃশ্য। বিশেষতঃ হিন্দুরাই এ জাতীয় আলোকসজ্জা ও মণ্ডপসজ্জা করে থাকে। যা শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নাজায়েয বা হারাম। যদি কাজটি সাধারণ মুসলমান থেকে চাঁদা নিয়ে করা হয় তাহলে খেয়ানতের গুনাহও অতিরিক্ত যোগ হবে।
এ বিষয়ে নিম্নে বিজ্ঞ আলেমদের কিছু বক্তব্য তুলে ধরছিঃ
১। আল্লামা ইবনু নুজাইম হানাফী বলেনঃ
" শবে বরাতে বিভিন্ন গলি ও বাজারে রঙ বেরঙ এর আলোকসজ্জা করা বিদআত, তেমনিভাবে মসজিদেও। "
২। ইতিহাস মন্থন করলে প্রতীয়মান হয় যে যে, এ কুপ্রথাটির সর্বপ্রথম প্রচলন বারামিকা জাতি থেকে আরম্ভ হয়েছে। যারা মূলতঃ একটি অগ্নিপূজক জাতি ছিল। মুসলমান হওয়ার পরও তারা কুসংস্কারটি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে পারে নি। তাদের পুরনো অভ্যাস থেকে মুসলমানদের মাঝেও প্রথাটির প্রচলন ঘটিয়ে দিয়েছে।
যথা মোল্লা আলী ক্বারী এ সুবাদে আলোচনা করতে গিয়ে বলেনঃ
" আলোকসজ্জার বিষয়টি সর্বপ্রথম বারামিকা জাতি থেকে উদ্ভাবিত। ইসলাম গ্রহণ করার পরও তারা বিষয়টি ধর্মের ভেতর অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। ধর্মীয় রীতি-নীতির সাথে নিজস্ব কামনাকেও জগাখিচুড়ী করে ফেলেছে। "
৩। শায়খ আলী আল মাহফুযও এরূপ মন্তব্য করেন। তিনি বলেনঃ
" আল্লামা আবু শামা বলেনঃ বিদআতীরা যা থেকে বিষয়টিকে উদ্ভাবন করেছে এবং যদ্বারা তারা দ্বীনের সীমা অংকন থেকে বেরিয়ে গিয়েছে, দ্বীনের মাঝে তারা অগ্নিপূজার রীতিনীতির আদলে যেটিকে চালু করেছে এবং নিজেদের দ্বীনকে ক্রীড়া ও আনন্দের বিষয়ে পরিণত করেছে তা হচ্ছে-শবে বরাত উপলক্ষে আলোকসজ্জা। যার সর্বপ্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে বারামিকা জাতির মাঝে। অতঃপর তারা একে মুসলমানদের মাঝেও প্রবেশ করিয়ে দেয়, মূলতঃ অগ্নিপূজাই তাদের উদ্দেশ্য। "
৪। হযরত শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিছে দেহলভী (রহঃ) বলেনঃ
" যেসব জঘণ্যতম বিদআত ভারতবর্ষের অধিকাংশ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে তন্মধ্য থেকে রয়েছে (শবেবরাত প্রভৃতি উপলক্ষে) আলোকসজ্জা তথা বাসা-বাড়ী, দেয়াল অট্টালিকা বৈচিত্র্যময় লাইট দ্বারা সজ্জিত করা, এর মাধ্যমে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া, আগুন নিয়ে আনন্দ খেলার লক্ষ্যে দলবদ্ধ হওয়া। যে গুলোর কোন ভিত্তি বিশুদ্ধ কিতাবাদীতে নেই। এ ব্যাপারে কোন দুর্বল হাদীছ কিংবা কমপক্ষে একটি জাল হাদীছও পাওয়া যায় না। ভারতবর্ষ ছাড়া অপরাপর (মুসলিম) এলাকাতেও এর প্রচলন নেই। হতে পারে যা প্রবল ধারণাও বটে যে, এসব কিছু ব্রাক্ষন্যবাদী প্রথা থেকে ধারকৃত। "
হালুয়া-রুটি ও মিষ্টি ইত্যাদিঃ
শবে বরাতের অন্যান্য রূসূমের মতো এটিকেও খুব গুরুত্ব দেয়া হয়। কিছু কিছু মুসলমানের নিকট প্রথাটি এতই জরুরী যে, তাদের ধারণা হালুয়া-মিষ্টির আয়োজন ছাড়া শবে বরাতই হয় না। এটাও শয়তানের এক প্রকার সুক্ষ্ম কারসাজি। হালুয়া-মিষ্টি রুটির চক্করে ফেলে দিয়ে মুসলমানদেরকে ইবাদত করা থেকে দূরে রাখাই তার উদ্দেশ্য। অন্যথায় শরীয়তের দৃষ্টিকোণে এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। হালুয়া-মিষ্টি বা অন্যান্য ভোজ আয়োজনের জন্যে শবে বরাত নয়। শবে বরাত তো জেগে ইবাদত করা এবং গুনাহগার বান্দা আল্লাহ তাআলার রহমতের শামিয়ানাতে আশ্রয় নিয়ে মাগফিরাত লাভ করে নিজেকে সৌভাগ্যমন্ডিত করে নেয়ার উদ্দেশ্যেই অনুমোদিত হয়েছে। যে শবে বরাতে এ বিষয়গুলো অনুপস্থিত থাকবে সে শবে বরাতকে ইসলামী শরীয়ত অনুমোদন দান করে না।
( চলবে ইনশাল্লাহ )
( পরবর্তী পর্বঃ উপসংহার ও সংক্ষিপ্ত কিছু সওয়াল জবাব )
২০ তম পর্ব