بسم الله الرحمن الرحيم
হাদীছের আলোকে শবে বরাত - ৯
গত কয়েক পর্বে আমরা শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কিত মোট দশটি হাদীস উল্লেখ করে সেগুলোর কয়েকটিকে সহীহ বা হাসান প্রমাণ করেছিলাম। যদি শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে আর কোন হাদীস না থাকত, তবে এই হাদীসগুলোই এ রাতের ফযীলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এবং এ রাতে মাগফেরাতের উপযোগী নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হত।
এই পর্বে আমরা আরও একটি হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করব এবং সাথে সাথে এই হাদীস সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনদের মতামত পর্যালোচনা করব।
একাদশ হাদীছ( اسناده ضعيف لكن ليس فيه كذاب )
হযরত আলী ইবনু আবি তালিব (রঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রসূলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেনঃ শা’বান মাসের পনের তারিখ রাত আসলে তখন তার রাতের অংশে ইবাদত করো এবং দিনের অংশে রোজা রাখো। কারণ ওই রাতে সূর্যাস্ত যাওয়ার পর মহান আল্লাহ প্রথম আসমানে অবতরণ করে বলতে থাকেন, আছো কি কোন মাগফিরাতের প্রত্যাশী? তাকে আমি মাগফিরাত দান করবো। আছো কি কোন রোগাক্রান্ত ব্যক্তি তাকে আমি সুস্থতা দান করবো। আছো কি অমুক আছো কি অমুক - এভাবে প্রভাতের সূচনা পর্যন্ত ডাকতে থাকেন।
উক্ত হাদীছটি
১। ইবনে মাজাহ তাঁর সুনানে
২। ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে
৩। মুনযিরী তাঁর তারগীব ওয়াত তারহীবে
সংকলন করেছেন।
উক্ত হাদীছের সনদ পর্যালোচনাঃ
হাদীছটির সনদে নিম্নোক্ত রাবীগণ রয়েছেনঃ
১। হাসান ইবনু আলী আল খিলাল (মৃঃ ২৪২ হিঃ)
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) ব্যতীত সিহাহ সিত্তাহর প্রত্যেকেই তাঁর থেকে হাদীছ গ্রহণ করেছেন।
খতীব আল বাগদাদী বলেনঃ ثقة حافظ , তিনি নির্ভরযোগ্য এবং হাফিযুল হাদীছ ছিলেন।
ইয়াকুব ইবনু শাইবাহ বলেনঃ তিনি নির্ভরযোগ্য ও আস্থাযোগ্য রাবী।
ইবনু হিব্বান তাঁকে নির্ভরযোগ্যদের মধ্যে পরিগণিত করেছেন।
হাফিয ইবনু হাজারও তাঁকে নির্ভরযোগ্য এবং হাফিযুল হাদীছ সাব্যস্ত করেছেন।
২। আব্দুর রাজ্জাক ইবনু হুমাম ইবনু নাফি (মৃঃ ২১১ হিঃ)
আসহাবে সিত্তাহর প্রত্যেকেই তাঁর কাছ থেকে হাদীছ গ্রহণ করেছেন।
তিনি ইবনু জুরাই আওযায়ী, মালিক, সুফিয়ান সওরী প্রমূখের ন্যায় বড় বড় ইমামদের শাগরিদ।
আলী ইবনুল মাদীনী থেকে কথিত আছে যে, হিশাম ইবনু ইউসুফ বলেছেন, আব্দুর রাজ্জাক আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আলেম এবং হাফিযে হাদীছ।
আহমদ ইবনু হাম্বল থেকে বর্ণিত যে, তিনি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাদীছ বর্ণনাকারী ছিলেন।
৩। ইবনু আবি সাবুরাহ (মৃঃ ১৬২ হিঃ)
তাঁর সম্পর্কে পরে উল্লেখ করা হচ্ছে।
৪। ইবরাহীম ইবনু মুহাম্মদ।
ইমাম বুখারী আত-তারীখুল কাবীর গ্রন্থে এবং ইমাম যাহাবী মীজানুল ইতিদাল গ্রন্থে তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। উভয়ের কেউই তাঁকে দুর্বল বলেন নি।
হাফিয ইবনু হাজার তাঁর ব্যাপারে বলেনঃ
صدوق من السادسة
“ তিনি ষষ্ঠ স্তরের একজন সৎ রাবী। ”
( তাক্বরীবুত তাহযীবঃ খ-১, পৃ-৬৫; তাহযীবুল কামালঃ খ-২, পৃ-১৯৩ )
ইবনে হিব্বান তাকে কিতাবুছছিক্বাতে উল্লেখ করে নির্ভরযোগ্য বলে সাব্যস্ত করেছেন।
( দেখুনঃ كتاب اثقات পৃ – ১৯, খ – ১ )
৫। মুআবিয়া ইবনু আবদিল্লাহ ইবনু জাফর।
ইমাম নাসাঈ এবং ইবনু মাজাহ তাঁর কাছ থেকে হাদীছ গ্রহণ করেছেন।
হাফিয আজালী তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন।
ইবনু হিব্বানও তাঁকে নির্ভরযোগ্যদের মধ্যে উল্লেখ করেছেন।
হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ তিনি চতু্র্থ স্তরের একজন গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারী।
হাফিয যাহাবী বলেনঃ “ ثقة ” নির্ভরযোগ্য।
( দেখুনঃ আল কাশেফ – ২/২৭৬ )
৬। আব্দুল্লাহ ইবনু জা’ফর।
আল ইসাবা ফী তাময়িযিস সাহাবা গ্রন্থে ( ২য় খন্ড পৃঃ ২৮৯ ) রয়েছে যে, তিনি নবী করীম (সঃ) এর সাহাবা হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। তিনি সাধারণ স্তরের সাহাবাদের মধ্যে পরিগণিত। ইতিহাসের কিতাবসমূহে তাঁর অনেক ফযীলত ও গুণাগুণ উল্লেখ রয়েছে।
৭। আলী ইবনু আবি তালিব (রঃ)।
একজন জলীলুল ক্বদর সাহাবী, খুলাফায়ে রাশেদীনের একজন।
রাবী ইবনু আবি সাবুরাহ (মৃঃ ১৬২ হিঃ) সম্পর্কে অস্পষ্ট সমালোচনাঃ
ইমাম নাসাঈ বলেনঃ তাঁর বর্ণিত হাদীছ মাতরূক তথা পরিত্যাজ্য।
আব্দুল্লাহ এবং সালিহ স্বীয় পিতা ইমাম আহমদ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি হাদীছ জাল করতেন।
তবে একথাগুলো অতিশয়োক্তি থেকে মুক্ত নয়, কারণ হাদীছ শাস্ত্রবিদদের নিকট সর্বজনবিদিত একটি মূলনীতি এও আছে যে, একজন বর্ণনাকারী দোষ-ত্রুটির কারণ ও বিবরণ উল্লেখ ব্যতীত কেবল দোষ ত্রুটি বর্ণনা করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। উপরন্তু উক্ত কারণ ও বিবরণ এর উপর প্রমাণও থাকতে হবে।
( দেখুনঃ الرفع والتكميل পৃ-৪১ )
এখানে জরাহ-তা'দীল' শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি সম্পর্কে সবার অবগত হওয়া দরকার।
জরাহ এবং তা'দীল প্রত্যেকটি মূলত দুই প্রকার। জরহে মুবহাম (অস্পষ্ট সমালোচনা), জরহে মুফাসসার (ব্যাপক বিস্তৃত সমালোচনা), তা'দীলে মুবহাম (অস্পষ্ট স্বীকৃতি), তা'দীলে মুফাসসার (বিশদ সত্যয়ন ও স্বীকৃতি)।
মুবহাম বলতে সেই সব জরাহ-তা'দীলকে বুঝায় যেগুলোতে জরাহ-তা'দীলের কারণসমূহ বিবৃত হয়নি। পক্ষান্তরে যেখানে জরাহ-তা'দীলের কারণসমূহ বিশদভাবে বিবৃত হয়ে থাকে, তাকে মুফাসসার বলা হয়। ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম সহ জরাহ তা'দীলের অধিকাংশ বিদগ্ধ ইমামগণের মতে, তা'দীলে মুবহামও গ্রহণযোগ্য। এতে এর কারণগুলো উল্লেখ করার কোন আবশ্যকতা নেই। পক্ষান্তরে জরাহ যদি মুবহাম হয়, তার কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। এক্ষেত্রে সমালোচনার কারণ সমূহ উল্লেখ থাকা একান্ত আবশ্যক। খতীব বাগদাদী, হাফেজ ইবনুস সালাহ ও ইমাম নববী এই মতকে অন্যান্য মতামত থেকে অত্যধিক সঠিক ও সমধিক প্রসিদ্ধ বলে আখ্যায়িত করেন এবং একে সংখ্যাগরিষ্ঠ ইমামগণের মতামত বলে উল্লেখ করেন।
( বিস্তারিত জানতে দেখুন - আল কিফায়াহ ফী উলূমির রেওয়ায়েহঃ পৃ-১০০, ১০৮, ১০৯; মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহঃ পৃ-১১৭; আত তাকরীবঃ পৃ-২০২ )
অর্থাৎ যখন কোন রাবী বা ব্যক্তি সম্পর্কে সমালোচনা করা হবে, তখন তা বিস্তারিত আকারে প্রমাণ সহকারে কারণ সহ উল্লেখ থাকতে হবে, নতুবা তা মুহাদ্দিসীনে কেরামের কাছে কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
আলী ইবনে আল মাদীনী এবং ইমাম নাসাঈ, যারা দুজনেই ইবনে আবি সবুরাহর কিছু শতক পরে এসেছেন, তারা বলেন যে, ইবনে আবি সবুরাহ "মাতরুকুল হাদীস" ছিলেন (যাঁর হাদীস বর্ণনা করা যাবে না, কারণ তিনি ঐটুকু যোগ্যতা রাখেন না।)
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল এর পুত্র, আব্দুল্লাহ এবং সালিহ স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি হাদীস জাল করতেন।
ইবনে আদীও ইবনে আবি সবুরাহকে হাদীস জালকারী ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য করেছেন।
কিন্তু, এ সমস্ত বক্তব্য তাদের নয় যারা ইবনে আবি সবুরাহ এর সমসাময়িক বড় বড় জ্ঞানী লোক ছিলেন, বরং তাদের মত যারা ইবনে আবি সবুরাহর অনেক যুগ পরে এসেছেন। তাছাড়া এই মতগুলো অতিরঞ্জিত বা অতিশয়োক্তি থেকেও মুক্ত নয়। কারণ এসব মুহাদ্দিসীনের কেউই তার দোষ ত্রুটির কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে যান নি এবং কোন প্রমাণও দিয়ে যান নি।
এমনকি, ইমাম বুখারী, উলূমিল হাদীস শাস্ত্রে তার সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং গভীর অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও, ইবনে আবি সবুরাহ সম্পর্কে কোন ধরণের ব্যাখ্যা ছাড়াই সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছেন। তিনি ইবনে আবি সবুরাহকে শুধুমাত্র যঈফ বলে উল্লেখ করেছেন। এটা তাই আরও ব্যাখ্যার দাবি রাখে। এটা হতে পারে যে, ইবনে আবি সবুরাহ কিছুটা দুর্বল স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন, যার ফলে তিনি ইমাম বুখারীর কাছে রাবীর যোগ্যতার যে মানদণ্ড আছে, সেটা পূর্ণ করতে পারেন নি। তাই, তাঁর এ মতটি রাবীর পদমর্যাদা এবং ন্যায়পরায়ণতা বা পূর্ণতার ক্ষেত্রে নয়; বরং ইমাম বুখারীর নিজের কঠোর মানদণ্ড অনুযায়ী রাবীর যে যোগ্যতা দরকার ছিল, শুধুমাত্র তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
ইমাম যাহাবী এ বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত আকারে আলোচনা করেছেন।
যাই হোক না কেন, এটা সুস্পষ্টভাবে বুঝে রাখা দরকার যে, হাদীস শাস্ত্রের নীতিমালা অনুযায়ী, একজন জাল হাদীস বানানো ব্যক্তি বা রাবী কখনই 'যঈফ' রাবীর তালিকাভুক্ত হতে পারে না।
ইমাম বাযযার এই হাদীসকে "লীন হাদীস" বলে যে মন্তব্য প্রদান করেছেন, তাও সম্পূর্ণ সঠিক নয়।
হাদীস তালিকাভুক্ত (কোন হাদীস কোন তালিকায় পড়বে) করার ক্ষেত্রে, হাদীস শাস্ত্রে "লীন হাদীস" এবং "ইয়াদা উল হাদীস" এই ২ টি গ্রুপের মাঝে বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান।
( দেখুনঃ কাশফুল আসতার আন জাওয়াইদিল বাযযার )
কোন ভাবেই এই দাবী করা সঠিক হবে না যে, ইবনে আবি সবুরাহ জাল হাদীস রচনাকারী ছিলেন। যদি তাই হত, তাহলে ইমাম মালিক এবং অন্যান্য অসংখ্য প্রসিদ্ধ ফকীহর উপস্থিতিতে ইবনে আবি সবুরাহকে কখনোই মদীনা মুনাওয়ারাতে ইফতা তথা কাযীর পদের দায়িত্ব ও সুবিধা দেয়া হত না, এক কথায় সম্ভবও নয়।
ঠিক একই ভাবে, ইমাম মালিকের পক্ষে এটাও কখনও সম্ভব হত না যে, ঐ সময়ের পবিত্র নগরীর ৩ জন বুজুর্গ এবং প্রসিদ্ধ স্বীকৃত ব্যক্তির একজন হিসেবে তিনি ইবনে আবি সবুরাহর নাম উল্লেখ এবং প্রস্তাব করেছিলেন। খলিফা মনসুর যখন মদীনা মুনাওয়ারাতে কাযী পদের জন্য লোক খুঁজছিলেন, তখন ইমাম মালিক এই প্রস্তাব করেছিলেন অন্য ২ জনের সাথে ইবনু আবি সবুরাহকে কাযী পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য।
( দেখুনঃ সিয়ারু আলামিন নুবালা এবং তাহযীবুত তাহযীব; আরও দেখতে পারেনঃ মুফতী মুহাম্মদ তকী উসমানীর কিতাব লাইলাতুল বারাআত )
তাছাড়াও, আহমদ ইবনে হাম্বল এবং ইবনে আদী বাদে, অন্য কোন মুহাদ্দিসীন তাদের আগে ইবনে আবি সবুরাহর সত্যবাদীতা বা মর্যাদার ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেন নি। শুধুমাত্র ইমাম বুখারীর মন্তব্য পাওয়া যায় এবং তাঁর কঠোর মূলনীতি ও মানদণ্ডের আলোকে তিনি শুধুমাত্র এই মন্তব্যটিই করেছেন যে, ইবনে আবি সবুরাহ যঈফ। (হাদীসের মতন সম্পর্কেও কিছু বলা হয় নি)।
ইমাম আবু দাউদ বলেন, সে (ইবনে আবি সবুরাহ) আহলুল মদীনার (মদীনার মানূষ) কাছে গ্রহণযোগ্য মুফতি ছিলেন।
হযরত মা'আন উল্লেখ করেন যে, আমিরুল মুমিনীন আবু জাফর আল মনসুর ইমাম মালিকের কাছে জানতে চান, " বড় বড় প্রসিদ্ধ মাশায়েখদের মধ্যে এখন কারা কারা বেঁচে আছেন? " তিনি (সাহিবুল মুতহুব) তাদের নাম পরপর উল্লেখ করে উত্তর দেন, বলেনঃ " ইবনে আবি তাঈব, ইবনে আবি সবুরাহ এবং ইবনে আবি সুলামাহ আল মাজিশুন বেঁচে আছেন এখন। "
এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, মদীনা মুনাওয়ারাহ ইসলাম এবং খাইরুল কুরুনের জমানার মুসলিমদের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। ইবনে আবি সবুরাহ প্রথমে ইরাকের একজন মুফতী এবং কাযী ছিলেন। এটা ছিল ইমাম আবু ইউসুফের নিয়োগের আগের কথা। অতঃপর, তাঁকে মদীনা মুনাওয়ারাহর মুফতী এবং কাযী পদের সুবিধা (নিয়োগ) দেওয়া হয়।
এরকম একজন প্রসিদ্ধ, নামকরা, গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি কি কখনো সাদিক এবং আদিল ( সত্যবাদী এবং নির্ভরযোগ্য ) না হয়ে পারে ??
তিনি কি হাদীস জাল কারী হতে পারেন এবং রসূলুল্লাহ (সঃ) এর উপর মিথ্যা আরোপ করতে পারেন ??
যদি তাই হয়, তাহলে কাযীর মত গুরুত্বপূর্ণ পদে ইমাম মালিকের মত বুজুর্গ ও মুজতাহিদের উপস্থিতিতে এরকম ব্যক্তি কি কখনো নিয়োগ পেতে পারে ??
স্বয়ং ইমাম মালিক কি এই রকম ব্যক্তিকে শ্রেষ্ঠ ৩ জন বুজুর্গের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন ??
স্বয়ং ইমাম মালিক কি কাযী পদে নিয়োগ দানের জন্য এই রকম ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে পারেন ??
তাছাড়াও সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, এই রকম পদে কি একজন মিথ্যুক বা হাদীস জালকারী থাকতে পারেন, অথচ যেখানে প্রধান নীতি হচ্ছে একজন মুফতিকে আবশ্যকীয়ভাবে আদিল (নির্ভরযোগ্য), সাদিক (সত্যবাদী) হতে হবে ??
এরকম মুফতিকে তো অভিজ্ঞ হতে হবে এবং কোরআন ও হাদীসের গভীর জ্ঞানও থাকতে হবে। সাথে সাথে, দ্বীনের মাসয়ালা মাসায়েল সঠিক ও পর্যাপ্তভাবেও তাকে বুঝতে হবে, পরিবেশের ভিন্নতার প্রেক্ষিতেও দ্বীন ও মাসায়েলের পরিপূর্ণ ও সঠিক বুঝ থাকতে হবে। এগুলো হল ইফতা বা বিচারকার্যের প্রাথমিক মূলনীতি এবং আবশ্যকতা।
আহলুল মদীনা এত অশিক্ষিত, অবুঝ, বিবেকহীন, বোকা, অবিবেচক, অপরিণামদর্শী ছিলেন না যে, ইমামুল মাতহুব এবং বড় বড় যুগবিখ্যাত ধার্মিক বুজুর্গানে দ্বীন যেমন মুজতাহিদ ইমাম মালিকের উপস্থিতিতে, তারা এমন এক ব্যক্তিকে কাযী এবং মুফতি হিসেবে পছন্দ করবেন বা নিয়োগ দিবেন যে কিনা হাদীস জাল করত বা মিথ্যুক ছিল !!
তারা কি দ্বীনের মাসয়ালা মাসায়েলগত বিষয়াদির ক্ষেত্রে এবং ধর্মীয় বিধি বিধানের ক্ষেত্রে এমন একজনকে পছন্দ করতে পারেন যে হাদীস জালকারী ছিল ??
ইবনে আবি সবুরাহ হযরত আলী (রঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছের নিছক একজন রাবী মাত্র। তাছাড়া, এই মন্তব্যগুলো আলী (রঃ) এর হাদীসের মতন (বক্তব্য) এর উপর করা হয় নি। "যঈফ" শুধুমাত্র ইবনে আবি সবুরাহকেই বলা হয়েছে।
ইবনে আবি সবুরাহ প্রসিদ্ধ, বুজুর্গ, ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি যেমনঃ হযরত আতা ইবনে আবি রুবাহ, ইমাম আরুজ এবং হিশাম ইবনে আবি ওরওয়াহ প্রভৃতি বুজুর্গদের ছাত্র ছিলেন এবং তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন।
তাছাড়াও, ইবনে আবি সবুরাহ, বিখ্যাত মুহাদ্দিস এবং হাদীসের উস্তাদ ইমাম আব্দুর রাজ্জাক ইবনুল হুইমাম এর উস্তাদ ছিলেন। আবার ইমাম আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন ইমাম বুখারীর উস্তাদ। পাশাপাশি ইমাম ইবনে জুওরাযী, ইমাম আবু আসিয়াম আন নাবিলেরও উস্তাদ ছিলেন।
( আরও দেখুনঃ তাহযীবুল কামাল )
যাই হোক না কেন, যারা ইবনু আবি সবুরাহকে "জাল হাদীস রচনাকারী বা যঈফ" বলেছেন, তাদের মধ্যে কেউই এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে যাননি, কিংবা কোন স্পষ্ট দলীল বা প্রমাণও দিয়ে যান নি। এমনকি আমাদের জ্ঞানের আওতায় ঐসব মুহাদ্দিসীনগণ ইবনে আবি সবুরাহ কর্তৃক সম্পৃক্ত এমন কোন হাদীসকেও মওযু (জাল) বলেন নি।
অথচ ইবনে আদী, ইবনে আবি সবুরাহর অনেক হাদীস নিয়েই আলোচনা করেছেন, কিন্তু তার একটি হাদিসও তিনি মওযু বলে চিহ্নিত করেন নি, কিংবা তার ঐসব কিতাব যেখানে তিনি মওযু হাদীসগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন, সেখানেও স্থান পায়নি। বাস্তব সত্য হল, ইবনে আদী যেসব হাদীস নিয়ে আলোচনা করেছেন, তার প্রত্যেকটি হাদীসই অন্যান্য নির্ভরযোগ্য রাবীদের কাছ থেকেও বর্ণিত। যার ফলে, সেসব হাদীসগুলোও প্রসিদ্ধ এবং নির্ভরযোগ্য রাবীদের কাছ থেকেই বর্ণিত। আর ইবনে আদী নিজেই ইবনে আবি সবুরাহর অনেক হাদীস নিয়ে আলোচনা করেছেন।
মুফতী তকী উসমানী লিখেছেনঃ হযরত আলী (রঃ) এর হাদীসটি সিহাহ সিত্তার একটি বিখ্যাত কিতাব সুনানে ইবনে মাজাহতে উল্লেখ আছে এবং ইমাম বায়হাকীর বিখ্যাত কিতাব শুয়াবুল ঈমানেও উল্লেখ আছে। তাদের উভয়েই এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, কিন্তু এর বিশুদ্ধতা নিয়ে কোন মন্তব্য করেন নি।
ইবনে আবি সবুরাহ নামক একজন রাবী থাকায় হাদিসের স্কলাররা তথা মুহাদ্দিসীনগণ এই হাদীসকে দুর্বল বা যঈফ বলেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তিনি হাদীস জাল করতেন, তা সঠিক নয়। বাস্তব সত্য কথা হচ্ছে, তিনি মদীনার মুফতী ছিলেন; মনসুরের আমলে ইরাকের কাযী (বিচারক) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তিনি ইমাম আবু ইউসুফের সাথে অত্যন্ত সফলও ছিলেন। তিনি ইমাম মালিকের সহযোগী ছিলেন।
একদা মনসুর, আব্বাসী খলিফা, ইমাম মালিকের কাছে ৩ জনের নাম জিজ্জেস করেন, ইমাম মালিক তার মধ্যে একজনের নাম বলেন ইবনে আবি সবুরাহ। তিনি যদি সত্যিকার অর্থেই হাদীস জালকারী হতেন, তাহলে ইমাম মালিক কখনোই তার নাম বলতেন না। তবে তার উচ্চ পদমর্যাদা থাকা সত্ত্বেও তার স্মৃতিশক্তি কিছুটা কম থাকায়, অনেক ইমামগণ যেমন ইমাম বুখারী তার কিছুটা সমালোচনা করেছেন এবং তাকে যঈফ বলেছেন; কিন্তু তাকে জাল হাদীস রচনাকারি কিংবা মিথ্যুক ঘোষণা করেন নি।
ইমাম আহমদ তাকে মিথ্যুক ও হাদীস জালকারী বলেছেন। কিন্তু তার এই মন্তব্য একজনকে হাদীস জালকারী সাব্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণঃ
প্রথমত, ইমাম আহমদ ইবনে আবি সবুরাহর অনেক পরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ইবনে আবি সবুরাহর সমসাময়িক কোন বুজুর্গ বা মুহাদ্দিস তার সম্পর্কে এ মত পোষণ করেন নি।
আর দ্বিতীয়ত, যে আরবী শব্দটি ইমাম আহমদ ব্যবহার করেছেন, তা মাঝে মাঝে এক রেওয়ায়েতের সাথে আরেক রেওয়ায়েতের মাঝে অসমাঞ্জস্যতা বা বিশৃংখলা (confusion) ইত্যাদি বুঝাতে ব্যবহৃত হয়, কাউকে মিথ্যাবাদী বা হাদীস জালকারী সাব্যস্ত করার জন্য নয়।
এই কারণে অধিকাংশ মুহাদ্দিসীনগণ আবু বকর ইবনে আবি সবুরাহকে দুর্বল রাবী হিসেবে সনাক্ত করেছেন, হাদীস জালকারী হিসেবে নয়।
পূর্ব যুগের মুহাদ্দিসীনদের মওযু হাদীস নিয়ে বিশাল বিশাল অনেক কিতাবই রয়েছে, কিন্তু এই হাদীসটি সেসব কিতাবের কোনটিতেই স্থান পায়নি।
এমনকি এটা সবার জানা কথা যে, ইবনে মাজাহ নিজেই প্রায় ২০ টি হাদীসকে মওযু বা জাল হিসেবে সনাক্ত করেছেন। এই হাদীসের তালিকাগুলো এখনও বিদ্যমান, কিন্তু সেখানেও ইবনে মাজাহ তার সুনানে উল্লেখিত এই হাদীসটিকে স্থান দেন নি। অতএব, এই হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যা এই যে, হাদীসটি মওযু বা জাল নয়, শুধুমাত্র দুর্বল।
মোদ্দা কথা হল, যারা ইবনু আবি সবুরাহকে জাল হাদীস রচনাকারী বলেছেন তারা কোন প্রমাণ দেখাতে পারেন নি। الرفع والتكميل পৃ-৪১ কিতাবে কথাটি এভাবে বলা হয়েছেঃ
“ ইবনু আবি সবুরাহ মাতরূকুল হাদীছ কিংবা জাল হাদীছ রচনাকারী হওয়ার ব্যাপারে মুহাদ্দিছীনে কেরামের কেউই বিস্তারিত কারণসহ বিবরণ দেন নি। ”
তাছাড়া হাফিয যাহাবী তাঁর জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে এভাবে শুরু করেনঃ মহান ফক্বীহ, ইরাকের কাজী, আবু বকর ইবনু আবদিল্লাহ ইবনু মুহাম্মদ ইবনু আবি সাবুরাহ।
ইমাম আবু দাউদ বলেনঃ তিনি মদীনাবাসীর মুফতী ছিলেন।(المدينة مفتى)
ইমাম বুখারী (রহঃ) তাকে যঈফ ছাড়া অধিক কিছু বলেন নি।
হাফিয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী বলেন, তাঁর স্মৃতিশক্তি দুর্বল বিধায় তিনি হাদীছশাস্ত্রে দুর্বল। মূলত এটাই বিশুদ্ধ এবং চূড়ান্ত রায়।
হাদীছটির অবস্থানঃ
উল্লেখিত বিবরণ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত হাদীছটিতে “ ابن أبى سبره ” ইবনু আবি সবুরাহ নামে জনৈক রাবী ব্যতীত অন্যান্য সকল রাবী নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত। সুতরাং হাদীছটিকে বড় জোর যঈফ বলা যেতে পারে। কোন কোন মুহাদ্দিছ ইবনু আবি সবুরাহকে জাল হাদীছ রচনাকারী বলেছেন বিধায় হাদীছটিকে জাল বলা যাবে না। কারণ তিনি জাল হাদীছ রচনাকারী – কথাটি সঠিক নয়। তাঁর সম্পর্কে বিশুদ্ধ ও চূড়ান্ত রায় সেটাই যা হাফিয যাহাবী সূত্রে আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, স্মৃতি শক্তির দুর্বলতার কারণে তিনি যঈফ রাবী ছিলেন।
এই কারণেই ইমাম যুরকানী হাদীছটি সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, যদিও তার সনদ দুর্বল কিন্তু তার রাবীগণ মিথ্যুক নন, কিংবা জাল রচনাকারী নন। সর্বোপরি তার সমর্থনে আরো হাদিছ পাওয়া যায় বিধায় হাদীছটির ভিত্তি রয়েছে।
যেমন শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুনিয়া (৭/৩১২) তে এসেছেঃ
সুনানে ইবনু মাজাতে আলী (রঃ) থেকে মারুফ হিসেবে যঈফ সনদ দ্বারা হাদীছটি উল্লেখ হয়েছে। তেমনিভাবে আল মুনযিরী ও হাফিয আল ইরাকী তাঁর দুর্বলতার কারণ উল্লেখ করতঃ নিশ্চয়তার সাথে বলেছেন। কিন্তু হাদীছটির মধ্যে কোন মিথ্যুক ও জাল হাদীছ রচনাকারী নেই এবং তার সমর্থনে আরো হাদীছ আছে যা তার ভিত্তি আছে বলে প্রমাণ করে।
অনুরূপ ভাবে আল্লামা ইরাকীও হাদীছটিকে দুর্বল বলেছেন ঠিক কিন্তু জাল বলেন নি। তাঁর ভাষায়ঃ
“ শবে বরাতের ফজীলত ও আমল সম্পর্কীয় যে হাদীছ আলী (রঃ) সূত্রে ইবনু মাজাহতে রয়েছে তার সনদ দুর্বল। ”
মোট কথা, হাদীছটি একজন রাবীর কারণে দুর্বল তবে তার ভিত্তি রয়েছে অন্যান্য হাদীছের সমর্থন পাওয়া যাওয়ায় তার উপর আমল করা যাবে।
সার কথাঃ
ইবনু আবি সবারাহ নামক একজন রাবী থাকায় আহলে হাদীস/সালাফীদের কিছু আলেম হযরত আলী (রঃ) এর এই হাদীসটিকে জাল বলার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু কথাটি সঠিক নয়। হাদীসটি শুধুমাত্র দুর্বল। এ কারণেই আল্লামা ইরাকী, ইমাম আল মুনযিরী, ইমাম যুরকানীর মত বিজ্ঞ মুহাদ্দিসরা এই হাদীসটি জাল বলেন নি, শুধুমাত্র দুর্বল বলেছেন। অনেক বড় বড় বুজুর্গরা এই হাদীসটি তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন এবং এর উপর আমল করা যাবে বলে মত প্রকাশ করেছেন। যেহেতু হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি অনুযায়ী কোন রাবীর সমালোচনা গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য শুধুমাত্র দুর্বল বা মিথ্যক, এতটুকু উল্লেখ থাকলেই হয় না, বরং এর স্বপক্ষে কারণসহ পর্যাপ্ত পরিমাণ দলীল-প্রামাণাদি থাকা আবশ্যক, সেহেতু যারা এই রাবীকে মিথ্যুক বা জাল হাদীস রচনাকারী বলে থাকেন, তারা দয়া করে প্রমাণ দেখিয়ে যাবেন কেন তিনি মিথ্যুক বা জাল হাদীস রচনাকারী।
( চলবে ইনশাল্লাহ )
( পররর্তী পর্বঃ হাদীছের আলোকে শবে বরাত - ১০ )
১৬ তম পর্ব