মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান দা. বা.
অন্তদৃষ্টির গুরুত্ব
চর্মচোখে মানুষ বস্তুকে দেখে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তার দ্বারা উপকৃত হয়। বস্তু জগতের আড়ালে বিশাল এক অদৃশ্য জগত রয়েছে। সেখানে রয়েছে অনেক কিছু বুঝার এবং বিশ্বাস স্থাপনের। কিন্তু চর্মচোখে তার অবলোকন করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন হয় অন্তদৃষ্টির অধিকারী হওয়ার। অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে অদৃশ্য জগতের বিষয়ে দৃঢ় ঈমান ও বিশ্বাস স্থাপনের সুযোগ লাভ হয়। তাই অন্তদৃষ্টির গুরুত্ব অপরিসীম। এই নেয়ামত লাভের উপায় কি? এ সম্পর্কে এক সাহাবী বিশ্ব রাসূলকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন
التجافي عن دار الغرور والانابة الي دارالخلود والاستعداد للموت قبل نزوله
অর্থাৎ, ‘মরীচিকাময় বস্তুর আকর্ষণ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা, আখেরাতের প্রতি ধাবিত ও আকৃষ্ট হওয়া এবং মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করা।’ কিন্তু এটি সহজ কোন পথ নয়। অতি সংকীর্ণ এবং কাঁটাযুক্ত এই পথ অতিক্রম করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তবে যার অন্তদৃষ্টি সক্রিয়, যার সম্মুখে অদৃশ্যও দৃশ্যময়, তার জন্য এই পথ অতিক্রম করা কোন কঠিন ব্যাপার নয়। এই হাজী যুবক ছিল সেই পথেরই পথিক। না জানি আমাদর অজ্ঞাতে কত যুবক এই পথ অতিক্রম করেছে এবং করছে। হাজী যুবকের অন্তর্দৃষ্টি ছিল অত্যন্ত প্রখর এবং উন্মুক্ত। তার সম্মুখে অদৃশ্য বহু কিছুই ছিল দৃশ্যময়। এই দৃষ্টিই তাকে চলার পথে সহায়তা করেছে। একদিন সে মিনার মরুভূমিতে মনের আবেগে স্বীয় মনোভাব এভাবে প্রকাশ করেছিল, “হে পৃথিবীর মানুষ! আমি একজনের প্রেমে মুগ্ধ, যার প্রেমে আমার অন্তর দাউ দাউ করে জ্বলছে। আমার জীবন-মরণ সবকিছুই তার হাতে সোপর্দ করে দিয়েছি। তার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে পারলে আমার জীবন হবে স্বার্থক, আমি হব শান্ত ও পরিতৃপ্ত। এ প্রেমের কারণে তোমরা আমাকে ভর্ৎসনা করো না। আমি যার প্রেমে আবদ্ধ তাকে আমি দেখেছি, তোমরা তাকে দেখনি তাই আমাকে ভর্ৎসনা করছো। যদি তোমরা তাকে অবলোকন করতে তাহলে আমাকে ভর্ৎসনা করতে না, বরং আমার প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠতে। তোমরা তো বায়তুল্লাহ তাওয়াফ ও জানোয়ার কুরবানী করে ক্ষান্ত হয়েছ। যদি তাকে অবলোকন করতে, তাকে তাওয়াফ করার সৌভাগ্য অর্জন করতে তবে জানোয়ার কুরবানী করে ক্ষান্ত হতে পারতে না, বরং নিজের জান কুরবানী করতেও কুন্ঠাবোধ করতে না।”
বস্তুতঃ এই যুবকের দৃঢ় ঈমান, আল্লাহর প্রতি আসক্তি ও অনুরাগের মূলে ছিল তার প্রখর অন্তরর্দৃষ্টি। এই অন্তর্দৃষ্টি লাভের জন্য প্রয়োজনীয় মুজাহাদা-মেহনত, শ্রম-পরিশ্রম শুধু তাকে নয় বরং তার মত অসংখ্য যুবকের ভাগ্যকে করতে পারে উজ্জ্বল। এই যুবক আমাদের নিকট অমর হয়ে আছে এবং থাকবে। তার জীবন আমাদের যুব সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পাথেয়। আল্লাহ পাক তাকে উপযুক্ত প্রতিদানে ভূষিত করুন। আমীন।
ছয়. নও-মুসলিম যুবক
নেক স্বভাব ঈমানের উপায়
আল্লাহ পাক মানুষকে অত্যন্ত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন এবং সকল সৃষ্টির মাঝে তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। এই শ্রেষ্ঠত্বের মূল কারণ হচ্ছে ঈমান। একারণেই যাদের ঈমান নেই, সৃষ্টির মাঝে তারা সবচেয়ে মূল্যহীন। মানুষের মধ্যে আল্লাহ পাক সৃষ্টিগতভাবে মেধা ও জ্ঞানের যে উপাদান বিদ্যমান রেখেছেন সেই মেধা ও জ্ঞান তাকে সততাপরায়ণ ও চরিত্রবান করে তোলে। মানুষ যদি সঠিক বিবেচনা, গবেষণা ও নিরোপেক্ষ চিন্তা-ভাবনা অব্যাহত রাখে, তাহলে মেধা, বুদ্ধি ও স্বভাব-চরিত্রের সৌন্দর্য একদিন তাকে পারিপার্শ্বিকতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করে ঈমান-আমলের আলোয় উদ্ভাসিত করে তোলে। এক নও-মুসলিম সাহাবী রাসূলকে প্রশ্ন করেছিলেন “ইয়া রাসূলাল্লাহ! কাফের অবস্থায় অনেক ভালো ও নেক কাজ সম্পাদন করেছি, সেগুলোর কি কোন প্রতিদান আছে?” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বলেন,
اسلمت بما اسلفت من الخير
এই হাদীসের এক অর্থ এই যে, কাফের অবস্থায় তুমি যে নেক কর্ম সম্পাদন করেছিলে তারই বরকতে আজ ঈমানে দৌলত লাভে ধন্য হয়েছ। ইতিহাসে এমন অসংখ্য যুবকের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা মুসলমানের ঘরে লালিত-পালিত হয়ে বিধর্মী ও পাপাচারী হয়েছে। আবার এমন বহু যুবকের সন্ধান পাওয়া যায়, যার জন্ম ও লালন-পালন কুফরী পরিবেশে হয়েছে, কিন্তু এক সময় তার বুদ্ধি বিবেচনা এবং স্বভাবে সৌন্দর্য তাকে কুফরীর অন্ধকার থেকে মুক্ত করে ঈমানের নেয়ামতে গৌরবান্বিত করেছে।
বিধর্মী যুবক
এমন এক যুবকের সন্ধান দিয়েছেন সিলসিয়ারে চিশতিয়ার প্রসিদ্ধ বুযুর্গ আবদুল ওয়াহিদ ইবনে যায়েদ (রহঃ)। তিনি একবার সামুদ্রিক ভ্রমণে নৌকায় আরোহী ছিলেন। ঘটনাক্রমে প্রচন্ড ঘূর্ণিবাতাস ও সমুদ্রের ঢেউ তাদেরকে অজানা-অচেনা স্থানে নিয়ে পৌঁছায়। সেখানে তিনি অতি সুঠাম সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী এক যুবককে মূর্তিপূজারত দেখে তাকে নছীহত শুরু করেন। তিনি তাকে বলেন, “তুমি তো এমন মাবুদের পূজা করছ যাকে তুমি নিজ হাতেই তৈরী করেছ। আর আমরা এমন মাবুদের ইবাদত করি যিনি স্বয়ং স্রষ্টা। নিজ হাতে তৈরী করা মাবুদকে আমরা পূজা করি না।”
উপদেশ ফলপ্রসূ হলো
ইসলামের ঐতিহাসিক জাগরণ ও প্রসারের পিছনে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে মুসলমানদের ধর্ম প্রচারের আগ্রহ ও তাদের অবিরাম প্রচেষ্টা। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এই প্রচেষ্টা একদিকে যেমন নিজের জন্যে পূণ্যের কারণ হয়, অপরদিকে তেমনি তা কাফেরদের জন্য ঈমান লাভের উপায় হয়। আজ সর্বশ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে এক্ষেত্রে উদাসীনতা বিরাজমান। মুসলমানদের অধঃপতনের একটি কারণ এটাও। যারা আজও দাওয়াত ও তাবলীগের মহান দায়িত্ব পালনে রত আছেন, তাদের দ্বারা এই যুগেও অসংখ্য বিধর্মী ও পথহারা যুবক-যুবতী ঈমানের নিয়ামত লাভে ধন্য হচ্ছে। যে কোন কারণেই হোক না কেন সেই যুবক ছিল ভাগ্যবান। ঈমান গ্রহণের সৌভাগ্য লাভের সময় তার ঘনিয়ে এসেছিল। কুদরতের খেলা বুঝা দুষ্কর। বুযুর্গ ইবনে যায়েদ ঝড়ো বাতাসে পথহারা হয়ে সেখানে পৌঁছেন, আল্লাহ পাক তাকে সেখানে পৌঁছান। আর এই বুযুর্গ নীরব ভূমিকা পালন না করে আল্লাহর দেয়া যবানে তাকে তাওহীদের বাণী শোনান। একদিকে বুযুর্গের তাওয়াজ্জুহ, অপরদিকে যুবকের স্বভাবগত পরিশুদ্ধি মেধা ও চিন্তা-উভয়ের সম্মিলন যুবকের মনকে সত্যের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলে। সর্বোপরি আল্লাহর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। তাই যুবক নছীহত শুনে অত্যন্ত অনুরাগের সূরে প্রশ্ন করে “আপনার মাবুদের পরিচয় জানাবেন কি?”
আল্লাহর পরিচয়
ইবনে যায়েদ বলেন, “আল্লাহ বিশাল আসমানের উপর বিদ্যমান আরশে আজীমের মালিক। তিনি জগতের স্রষ্টা। সমগ্র সৃষ্টি তারই সৃজিত এবং তারই কীর্তি। তার সাথে কেউ শরীক নেই। সবকিছুই তার ক্ষমতাধীন ও নিয়ন্ত্রণে। তিনি আসমান সৃষ্টি করেছেন, যমীনও সৃষ্টি করেছেন। মানুষ সৃষ্টি করে তাকে অসংখ্য নেয়ামত দিয়ে লালন-পালন করেছেন। সমস্ত মানুষকে একদিন তারই দরবারে ফিরে যেতে হবে এবং নিজ নিজ কর্মকাণ্ডের হিসাব দিতে হবে। অতঃপর শাস্তি অথবা শান্তির চিরস্থায়ী জীবনের অধিকারী হতে হবে।
রাসূল পরিচয়
বুযুর্গের বর্ণনা শুনে যুবকের হৃদয় আন্দোলিত হয়। সে তার অতীত জীবনের ভূলের কথা স্মরণ করে ভবিষ্যত জীবনের দিক নির্দেশনা লাভের তাগিদে বুযুর্গকে প্রশ্ন করে, “আপনি আল্লাহর বিষয়ে অবগত হলেন কি করে? তার সাথে দেখা-সাক্ষাত ও আলাপ-আলোচনা করা যাবে কি?” বুযুর্গ বললেন, “তাকে দেখা, তার সাথে সাক্ষাত ও সরাসরি কথাবার্তা বলার ক্ষমতা মানুষের নেই। তবে মৃত্যুর পর পরকালের জীবনে জান্নাতী শক্তিতে যারা বলীয়ান হবে, তারা অবশ্যই তার সান্নিধ্য লাভে ধন্য হবে। বাদশার সাথে সবসময় সকলের দেখা সাক্ষাৎ ও কথা বলা কি সম্ভব হয়? তবে তিনি তার বিষয়ে অবহিতকরণের জন্য আমাদের কাছে তাঁর মনোনীত রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁর প্রেরিত রাসূল ছিলেন শিষ্টাচার সম্পন্ন ও উদার। তিনি আমাদেরকে সকল বিষয়ে অবহিত করেছেন, আমাদেরকে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন।” যুবক প্রশ্ন করে, “রাসূল কোথায় আছেন?” বুযুর্গ বললেন, “তিনি তার দায়িত্ব পালন করে চলে গিয়েছেন। আল্লাহ পাক তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথ পালনের পুরস্কারে ভূষিত করার জন্য তাঁকে নিজের কাছে ডেকে নিয়েছেন।”
পবিত্র কুরআনের প্রভাব
যুবকটি প্রশ্ন করে, “রাসূল কি আপনাদের কাছে তার কোন পরিচয় রেখে গিয়েছেন?” বুযুর্গ বললেন, “হ্যা তিনি আমাদের কাছে আল্লাহর বাণী পবিত্র কুরআন রেখে গিয়েছেন। তাতে সবকিছুই বিদ্যমান রয়েছে।” যুবক বলল, ‘আমাকে সেই পবিত্র কালাম দেখাতে পারেন কি?’ বুযুর্গ বললেন, “অবশ্যই!” এই বলে তিনি পবিত্র কুরআন যুবকের সম্মুখে হাজির করেন। পবিত্র কুরআনের তেলাওয়াত শুনে অসংখ্য কাফের ইসলাম গ্রহণ করেছে। এই কুরআনের তেলাওয়াতের প্রভাবেই হযরত উমর ফারুকের অন্তর আলোকিত হয়েছিল এবং ঈমানের দৌলত লাভে তিনি ধন্য হয়েছিলেন। আজ এই যুবকের সম্মুখে সেই পবিত্র কুরআন। কুরআন আজও তার প্রভাব নিয়েই অক্ষত আছে এবং থাকবে।
যুবকের ইসলাম গ্রহণ - শিক্ষার সুফল
যুবকের ইসলাম গ্রহণ
যুবক বলল, ‘আমি মূর্খ, পড়ালেখা জানি না। তাই আপনি আমাকে পবিত্র কুরআন পড়ে শোনান এবং বুঝিয়ে দিন।’ বুযুর্গ বলেন, ‘এরপর আমি পবিত্র কুরআনের একটি সূরার তেলাওয়াত শুরু করি। যুবকটি আমার তেলাওয়াত অত্যন্ত আগ্রহ ও মনোযোগের সাথে শ্রবণ করে। রাসূলের বাণী অনুসারে তেলাওয়াতের প্রভাব-জ্যোতি তার অন্তরের কালিমা ও অন্ধকার দূরীভূত করে। সে অনুতাপদগ্ধ হয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়।’
এভাবে বুযুর্গের তেলাওয়াত শেষ হলো, কিন্তু যুবকের মন এখনও পরিতৃপ্ত হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত সে হকের সন্ধান পেয়ে ধন্য হয়ে বলল, “সত্যিই এই কালাম যার তার নফরমানী করা যায় না।” এই বলে কালিমা পাঠ করে মুসলমান হয়ে যায়।
দ্বীনি শিক্ষার গুরুত্ব
মুমিনের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ। নবীর ওয়ারিস-আলেমদের গুরু দায়িত্ব হচ্ছে মুসলমানদেরকে কুরআন-সুন্নাহ তথা শরীয়তের সঠিক শিক্ষা দান করে তাদের মধ্যে দ্বীনি চেতনা জাগিয়ে তোলা। কেননা ঈমানের পর ঈমানের সজীবতা, ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি ও স্থায়িত্ব নির্ভর করে আমলের উপর। পক্ষান্তরে মূর্খতা ও আমলে উদাসীনতা মুসলিম সমাজকে কুলষিত করে, আকীদার বিকৃতি সাধন করে। বেদআত-মুনকারাত ও অপসংস্কৃতির বিস্তৃতি ঘটায়। উপরন্তু মুসলিম সমাজে প্রসারিত হয় ধর্মনিরোপেক্ষতার নামে ধর্মদ্রোহীতার কালো থাবা। আজ মুসলিম যুবক-যুবতীসহ সর্বশ্রেণীর জনসাধারণের মাঝে বিজাতীয় তাহজীব-তামাদ্দুন ও তাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচার-প্রসার লাভের অন্যতম কারণ হচ্ছে দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে মুসলমানদের অজ্ঞতা। অজ্ঞতার এ অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে, সমাজের সর্বশ্রেণীর মুসলমানদের দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ ও সে শিক্ষা বিস্তারে এগিয়ে আসা এবং এক্ষেত্রে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। শিক্ষা অভিযানের মাধ্যমেই কেবল মুসলিম জাতির ঐতিহ্য রক্ষা পেতে পারে, দূরীভূত হতে পারে জাতীয় অধঃপতনের বিষাক্ত সাপ। এর কোন বিকল্প নেই।
ওলামা-মাশায়েখদের দায়িত্ব
শিক্ষা-দীক্ষা বিস্তারের প্রধান দায়িত্ব আলেম-ওলামাদের। কেননা রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলেমদেরকেই স্বীয় উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করেছেন। আর তা করেছেন দ্বীনি ইলমের কারণেই, অন্য কোন কারণে নয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী অথবা অর্থশালী ধনাঢ্যদেরকে তিনি স্বীয় ওয়ারিস বলে ঘোষণা করেন নি। কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য যে, আজ এক শ্রেণীর আলেম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও অর্থ-কড়িকে ইসলামের প্রচার প্রসার ও শরীয়ত বাস্তবায়নের উপায় ভেবে দ্বীনি শিক্ষার চেয়েও সেগুলোর প্রতি অধিক গুরুত্ব দানে প্রয়াসী। তাদের মতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ব্যতীত ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথ খোলা নেই। একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, ইসলামী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য এর প্রয়োজন অপরিসীম এবং এর জন্য নিয়মতান্ত্রিক ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখাও জরুরী, কিন্তু দ্বীনি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এর চেয়েও অধিক। কেননা রাষ্ট্র ও প্রশাসন যতই গুরুত্বের দাবীদার হোক না কেন, তার অবস্থান সহায়ক উপায় বা সহায়ক শক্তির অধিক নয়। আর দ্বীনি শিক্ষা হচ্ছে মূল ভিত্তি। ভিত্তির জন্যইতো উপায় অবলম্বন। আত্মা ব্যতীত দেহে যেমন শক্তি সঞ্চার হয় না, দেহ ক্রিয়াশীল হয় না, তেমনি ইলম ব্যতীত দ্বীনি চেতনা টিকে না, শরীয়তের আমল ক্রিয়াশীল হয় না। বস্তুতঃ দ্বীনি শিক্ষাকে বাদ দিয়ে বা খাটো করে দেখে রাষ্ট্র প্রতিষ্টার অভিযান হচ্ছে ভিত্তি স্থাপন না করেই এমারত নির্মাণের নামান্তর। এই ধ্রুব সত্যটি সবার অনুধাবন করতে হবে। বুঝতে হবে যে, অন্য সব কার্য সমাধানের লোক রয়েছে এবং অধিক সংখ্যায় রয়েছে। কিন্তু নবীর ওয়ারীসি শিক্ষার লোকের খুবই অভাব এবং এর ব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত অত্যন্ত সীমিত। উপরন্তু এই সামান্য ব্যাবস্থাপনাটুকুও শত্রুদের জন্য অসহনীয়। তাই তারা দ্বীনি শিক্ষাকে সমূলে উৎপাটনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, পদমর্যাদা ও অর্থের লোভনীয় জাল বিস্তার করে তারা জ্ঞাত-অজ্ঞাত পথে শিকার তালাশে ব্যস্ত। তাদের শিকারে যাতে পরিণত না হতে হয় এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মুসলিম যুবকদের মধ্যে দ্বীনি শিক্ষার বিস্তার এবং ধর্মীয় জীবনাচারের অনুশীলন নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল নয়।
শিক্ষার সুফল
আমরা এই যুবকের জীবন থেকে দৃষ্টান্ত গ্রহণ করতে পারি। মুসাফির বুযুর্গ কেবল যুবকটিকে মুসলমান করেই ক্ষান্ত হননি, বরং তাকে শিক্ষা-দীক্ষা দান করে স্বল্প সময়ে তার তরবিয়তের প্রতি তিনি মনোনিবেশ করেন। তাকে তিনি পবিত্র কুরআন শিক্ষা দেন, দ্বীনি মাসলা-মাসায়েল সম্পর্কে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা দানে ব্রতী হন। তার আধ্যাত্মিক পরিশোধনেও সচেষ্ট হন। ফলে সে আমলের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং বুযুর্গের সহচর্যেই মুজাহাদা মেহনত করে মারিফাতের সুধা পানে ধন্য হয়, তার জীবন হয় সফলকাম।
যুবকের আধ্যাত্মিক সাফল্য - শিক্ষার প্রতি অনুরাগ
যুবকের আধ্যাত্মিক সাফল্য
ইবনে যায়েদ বললেন, “যুবকটি মুসলমান হয়ে আমাদের সাথেই থেকে যায়। তার আমল পরিশ্রম ও আধ্যাত্মিক সাধনা আমাকে অবাক করে তুলে।” একটি যুবক, তারপর নও-মুসলিম, রাতভর সে আল্লাহ পাকের ইবাদত করে, আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চায়, মুনাজাতে রত থাকে। অল্প সময়ে তার এই সাফল্যে সত্যিই অবাক হওয়ার কথাই! একদিন এশার নামাযান্তে ঘুমানোর সময় যুবকটি বুযুর্গকে সম্বোধন করে প্রশ্ন করে, “মহান আল্লাহ পাক কি রাত্রে ঘুমান?” বুযুর্গ বললেন, “না না তিনি ঘুমান না। তিনি চিরন্তন, তার সত্ত্বায় তন্দ্রা-নিদ্রার অবকাশ নেই।” তিনি তাকে আয়াতুল কুরসী তেলাওয়াত করে শোনান এবং আয়াতের অর্থ সম্পর্কে অবহিত করেন। যুবক তার মুখে আয়াতুল কুরসীর বর্ণনা শ্রবণ করে ভর্ৎসনার সুরে বলে, “আপনারা কেমন উদাসীন! মালিক সামনে জাগ্রত দণ্ডায়মান, আর আপনারা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন?”
মিরাজের রাত্রে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক শ্রেণীর লোকদেরকে কঠোর শাস্তিতে আক্রান্ত দেখে জিবরীল আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এরা কারা, প্রস্তরঘাতে কেন তাদের বারবার চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হচ্ছে? জিবরীল বললেন, “তারা এমন সব ক্বারী, হাফেজ, আলেম-ওলামা, যারা দিনের বেলায় উদাসীন হয়ে ঘুরাফেরা করে আর রাতের বেলায় বেহুশ হয়ে ঘুমায়, আমলের ধার ধারে না। অন্য হাদীসে আছে, “অনেকে কুরআনে পাকের তেলাওয়াত করে এবং কথাবার্তঅয় মিষ্টভাষী, কিন্তু তাদের জীবনে দ্বীনের কোন চিহ্নও নেই।” আল্লাহ পাক আমাদেরকে হেফাযত করুন। যারা আজ পবিত্র কুরআনের তেলাওয়াত, শিক্ষা ও তালিমকে উপার্জনের উপায় বানিয়ে নিয়ে অহংকারে গর্বিত, যারা ইসলামী শিক্ষার নিদর্শন দাঁড়ী কর্তন করে, বে-সুন্নতী চুল মাথায় রেখে বেপর্দা হয়ে নির্লজ্জভাবে মহিলাদের সাথে আনাগোনা ও অনুষ্ঠান করে থাকে, তাদের না আছে সুন্নতের আমল, না আছে শরীয়তের আমল। পরিণাম সম্পর্কে তাদের সতর্ক হওয়া উচিত। এই যুবকের জীবনাদর্শ থেকে তাদের শিক্ষা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।
শিক্ষার প্রতি অনুরাগ
ইবনে যায়েদ বলেন, যুবকের মুখের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারলাম না। তার সামনে নিজেকে অত্যন্ত লজ্জিত মনে হল। এদিকে আমাদের সামনে দীর্ঘ সফর, তাই আমরা সফরের তৈরী করতে থাকি। এমতাবস্থায় যুবকটি আমাদেরকে বলল, “আপনারা আমাকে সাথে নিয়ে চলুন। আমি দ্বীনি শিক্ষা লাভ করতে চাই। আপনাদের সহচর্য ব্যতীত এর কোন বিহিত ব্যবস্থা আমার সম্মুখে নেই। তাই দয়া করে আপনাদের সাথে আমাকে থাকার অনুমতি দিলে আমার প্রতি ইহসান হবে। আমার দ্বীনি শিক্ষা লাভের সুযোগ হবে।” নও-মুসলিম যুবকের আগ্রহ অনুভব করে বুযুর্গ তাকে সাথে রাখতে সম্মত হন। ফলে যুবকের মনে উৎফুল্লতা জেগে উঠে এবং সে দ্বীনি শিক্ষা লাভের সুযোগ পেয়ে যায়।
যুবকদের প্রতি উদাসীনতা - যুবকদের করণীয়
যুবকদের প্রতি উদাসীনতা
আজ যুবকদের দ্বীনি শিক্ষার প্রতি উদাসীনতা প্রত্যক্ষ করে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না। বস্তুতান্ত্রিক শিক্ষার প্রতি আকর্ষণ আর ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অবজ্ঞা ও অনীহার কারণে যুব সমাজ আজ অধঃপতনের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে, আর প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবীরা কেবল সভ্যতার নানা ধ্বনি উচ্চকিত করছে। কিন্তু এতে তাদের মুক্তির কোন পথ সুগম হচ্ছে না। যুবকদের যারা অভিভাবক, তারা কেউ নীরব দর্শকের ভূমিকায় আছে আর কেউ পরিবেশের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব শেষ করছে। এক শ্রেণীর মাতা-পিতা স্বীয় সন্তানদেরকে বস্তু শিক্ষায় শিক্ষিত করে সন্তানের কাছে স্বীয় অধিকারের দাবী জানাচ্ছে, আর এক শ্রেণীর মুরুব্বী ইয়াহুদী-খৃষ্টান ও বিধর্মীদের প্রতিষ্ঠানে সন্তানের শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা লাভের গৌরবে আত্মহারা হয়ে পড়েছে। অথচ আদরের সন্তান আল্লাহর দেয়া নেয়ামত, তার আখেরাতের জীবন যে ধ্বংসের পথে, বরং ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এতে অভিভাবকদের কোন পরিতাপ নেই, মাথা ব্যাথা নেই। আত্মভোলা মাতা-পিতা ও অদূরদর্শী অভিভাবকদের এহেন উদাসীনতার কারণে আজ মুসলিম যুব সমাজ খোদাভীরুতার পরিবর্তে খোদাদ্রোহীতার হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে। নাস্তিকতার প্রসারে তারা আজ ষড়যন্ত্রের শিকার। দেখা যাচ্ছে, তাদের কাছে সকলেই প্রিয় ধর্ম-কর্ম নির্বিশেষে সকলেই তাদের বন্ধু; শত্র“ হচ্ছে কেবল আল্লাহ, আল্লাহর-রাসূল আর আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত ও রাসূল প্রদর্শিত দ্বীন ও ইসলাম। মাতা-পিতাগণ এর মাশুল আদায় করা থেকে রেহাই পাবেন না।
যুবকদের করণীয়
অভিভাবকদেরকে এ ভুল সংশোধন করতে হবে। তাদের বুঝতে হবে যে, সন্তান-সান্ততি আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত। পিতা-মাতার উপর তাদের বস্তুগত অধিকার অবশ্যই রয়েছে এবং তা আদায়ও করতে হবে। কিন্তু এর চেয়েও অধিক হচ্ছে দ্বীনি অধিকার, যা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আদায়ের দাবী রাখে। সেই সাথে যুবকদেরও সচেতন হতে হবে। তাদের বুঝতে হবে যে, এই যৌবনকাল তাদের কে দিয়েছেন? কতকাল বিদ্যমান থাকবে এই যৌবন? অবশেষে তাদেরকে কোথায় পাড়ি জমাতে হবে? তাদেরকে বুঝতে হবে যে, তারা একদিন ছিল না, কোথা হতে তাদের আগমন হয়েছে? তারা ছিল শিশু, আজ তারা যুবক, কাল হবে বৃদ্ধ, দেহের শক্তি হ্রাস পাবে। তাদের জীবন হচ্ছে একটি পথ। তারা সেই পথের পথিক। পথিককে সামনের পথে গমন অব্যাহত রাখতে হবে। মৃত্যু, কবর, হাশর ও পুলছিরাতের কঠিন ঘাঁটি রয়েছে। সেসব ঘাঁটির পারাপারের ব্যবস্থা এখান থেকেই করে নিতে হবে। সেখানে কোন ব্যবস্থা নেই, সাহায্যকারী নেই। তাদেরকে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং বিশ্ব যুব সমাজের সামনে আদর্শ স্থাপনের দায়িত্বও পালন করতে হবে। এজন্য অতীতের স্মরণীয় মুসলিম যুবকদের আদর্শকে সমুন্নত রাখতে হবে। এই নও-মুসলিম যুবকের জীবনকে করতে হবে পাথেয়।
আল্লাহর উপর ভরসা
ইবনে যায়েদ বলেন, “নও-মুসলিম যুবকটিকে সাথে নিয়ে আমরা পুণরায় সফর শুরু করি এবং আবাদান শহরে পৌঁছে সাথীদেরকে বলি যে, নও-মুসলিম যুবকটি অসহায় সুতরাং তার জীবনোপকরণের জন্য আমাদের যা কর্তব্য তা করা উচিত। অতঃপর আমরা চাঁদা করে সামান্য পরিমাণ দেরহাম তাকে পেশ করি এবং তা প্রয়োজনে খরচ করার জন্য বলি। কিন্তু নও-মুসলিম যুবক তা গ্রহণে অসম্মতি প্রকাশ করে বলে, “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ! আপনারা আমাকে এমন পথে পরিচালিত করতে চান যে পথে আপনারা চলতে সম্মত নন। আমি যখন জাযীরাতে (দ্বীপে) ছিলাম এবং আল্লাহর পরিবর্তে মূর্তি পূজায় রত ছিলাম তখনও আল্লাহ পাক আমাকে ধ্বংস করেন নি, আর এখন আমি আল্লাহর পরিচয় লাভ করেছি, তারই ইবাদত-উপাসনা করে চলেছি। এমতাবস্থায় তিনি কি করে আমাকে ধ্বংস করতে পারেন? আমি ফকীর নই, আমার আল্লাহ ফকীর নন। তাই আপনাদের এই দেরহামের প্রয়োজন আমার নেই।”
ভিক্ষুকের পরিচয়
এক সময় রাসূলে পাক সাহাবীদের সমাবেশে প্রশ্ন করেন, “তোমরা কি জান ভিক্ষুক কে?” একজন উত্তর করলেন, যার অর্থ-কড়ি নেই, সহায়-সম্বলহীন, আমরা তাকেই ভিক্ষুক মনে করে থাকি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, সে প্রকৃত ভিক্ষুক নয়। আমার উম্মতের মধ্যে প্রকৃত ভিক্ষুক সে, যে যথেষ্ট নেক আমল নিয়ে হাশরের ময়দানে আল্লাহর আদালতে হাজির হবে, আর হক্কুল ইবাদের দায়ে আবদ্ধ হয়ে স্বীয় আমলসমূহ হারাবে। অবশেষে হকদারদের গোনাহ ঘাড়ে নিয়ে জাহান্নামে দাখেল হবে। এই হচ্ছে প্রকৃত ভিক্ষুক। এই যুবক কারো কাছে ঋণী ছিল না, তাই সে ভিক্ষুক নয়। তার কাছে ছিল ইবাদত-রিয়াজত ও মারিফাতের ধন-সম্পদ। তাই সে ছিল মহা বিত্তবান। যে সম্পদ মালিককে চিনে না, যার হাত লাগে তার হয়ে যায় সেই সম্পদের অধিপতিকে লোকেরা ধনী বলতে পারে, কিন্তু প্রকৃত ধনী সে নয়। ঈমান, আমল যার কাছে আছে, সেটা সর্বদা তারই হয়ে থাকে। কবরে, হাশরে, পুলছিরাতে সর্বস্থানে তা উপকারে আসে, কাজে লাগে। যুবকের এই পুঁজি ছিল প্রচুর, তাই সে ভিক্ষুক ছিল না, সে ছিল বড় ধনী। সে কেন চাঁদা করা দেরহাম গ্রহণ করবে?
মৃত্যুর স্বপ্ন
ইবনে যায়েদ বলেন, এর তিনদিন পরে আমি বুঝলাম যুবকটির মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলামÑ “তোমার কোন কিছুর প্রয়োজন আছে কি?” যুবকটি উত্তর দিল, “যে মহান আল্লাহ আপনাদেরকে আমার হেদায়েতের জন্য দ্বীপে পাঠিয়েছিলেন তিনি আমার সমস্ত প্রয়োজন পূরণে করে দিয়েছেন। আর কোন কিছুর প্রয়োজন নেই।” আমি যুবকের কথা শুনে তার নিকটেই অবস্থান করি এবং ঘুমিয়ে পড়ি। এমতাবস্থায় স্বপ্নে দেখি, অতি মনোরম, অতি সুন্দর, সুসজ্জিত একটি বিরাট বাগিচা। বাগিচার এক মনোরম স্থানে এক বিরাট রাজপ্রাসাদ। সুসজ্জিত সেই প্রাসাদের মধ্যভাগে অবস্থিত সুসজ্জিত পালঙ্কে উপবিষ্ট আছে অপূর্ব সুন্দরী এক মহিলা। সে মহিলা আমাকে ডেকে বলছে যে, “যুবকটিকে অনতিবিলম্বে পাঠিয়ে দিন, আমি অধীর চিত্তে তার অপেক্ষায় আছি।” পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই যারা মুত্তাকী তাদের জন্য রয়েছে, উদ্যান, আঙ্গুর, সমবয়স্কা পূর্ণ যৌবনা তরুণী, অব্যবহৃতা, আনতনয়না, প্রবাল ও পদ্যরাগ সদৃশ রমণীগণ।’
আর এসব কিছু হবে সৎ কাজের প্রতিদান স্বরূপ। সুতরাং আল্লাহর আশেক ও তার মারিফাতে ধন্য নও-মুসলিম যুবকের জন্য এরূপ প্রতিদানই যথার্থ প্রতিদান।
যুবকের মৃত্যু - যুবকদের জন্য পাথেয়
যুবকের মৃত্যু
ইবনে যায়েদ বলেন, “ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে আমি দেখি, যুবকের মৃত্যু ঘটেছে। তার মৃত্যুতে আমি অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়ি। আল্লাহর ইচ্ছাকে চূড়ান্ত মনে করে যুবকের কাফন-দাফনের কাজ সমাধা করতঃ তার জন্য আল্লাহ পাকের মহান দরবারে মুনাজাত করি। মনে মনে চিন্তা করি, কতইনা ভাগ্যবান এই যুবক, সে আল্লাহর কতই না প্রিয়! ঈমান আমলের জন্য মহান রাব্বুল আলামীন যাকে ইচ্ছা করেন এভাবেই তার হেদায়েত ও নাযাতের ব্যবস্থা করে থাকেন।
স্বপ্ন সংবাদ
নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা শেষ হয়েছে, কিন্তু স্বপ্নযোগে সুসংবাদ দানের ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে। এরই নমুনা স্বরূপ ইবনে যায়েদ নও-মুসলিম যুবক সম্পর্কে অবহিত হতে সক্ষম হন। কাফন-দাফন সমাধা করে তিনি স্বপ্নে ঐ যুবককে সেই উদ্যানের মনোরম প্রসাদে অপূর্ব সেই রূপসীর সাথে সিংহাসনে বসে পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটি তেলাওয়াতরত দেখতে পান:
الذين يوفون بعهد الله ولاينقضون الميثاق
অর্থঃ বুদ্ধিমান তারা, যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করে এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না।
জান্নাতীদের প্রতি সালাম
যারা স্থাপিত সম্পর্ক বজায় রাখে, স্বীয় প্রভূকে ভয় করে, কঠোর হিসাবের আশংকা করে, স্বীয় প্রভূর সন্তুষ্টি কামনায় ধৈর্য্য ধারণ করে, নামায কায়েম করে, আল্লাহর দেয়া সম্পদ থেকে কিছু অংশ গোপনে এবং প্রকাশ্যে দান করে, মন্দের বিপরীতে শুভ আচরণ করে, তাদের জন্য রয়েছে পরকালের শান্তিদায়ক বাসস্থান, বসবাসের জন্য জান্নাত। তাতে তারা মাতা-পিতা, দাদা-দাদী, স্বামী-স্ত্রী, পরিবার-পরিজন সহ প্রবেশ করবে। তাদেরকে প্রত্যেক দরজা দিয়ে ফেরেশতাগণ অভ্যর্থনা জানিয়ে বলবে “আপনাদের প্রতি আমাদের ধর্ম পালনের প্রতিদান স্বরূপ শান্তি বর্ষিত হোক। আপনাদের বাসস্থান কতইনা সুন্দর! আপনাদের প্রতি সালাম।”
যুবকদের জন্য পাথেয়
হে যুব সমাজ! মহান দয়াময় ক্ষমাশীল রাব্বুল আলামীনের করুণা ও তার কুদরতের খেলা অবলোকন কর। একটি যুবকের পুরো জীবন মূর্তিপূজা করে কেটেছে। তার হেদায়েত ও নাযাতের জন্য দয়াময় প্রভু তুফানের মাধ্যমে যুগের বিশিষ্ট বুযুর্গ ইবনে যায়েদকে কিভাবে সেখানে পৌঁছালেন, আর কিরূপে যুবকের প্রতি স্বীয় রহমত নাযিল করে ঈমান-আমলের দ্বারা সৌভাগ্যশীল করে স্বীয় দরবারে ডেকে নিলেন। আল্লাহ পাক যাকে ইচ্ছা করেন এভাবেই হেদায়েত দিয়ে তার অন্তরের চক্ষু খুলে দেন। তিনি যাকে স্বীয় মারিফাত দিতে চান, সেখানে বাধা দেয়ার কেউ থাকে না। আর যাকে দিতে চান না, তাকে দেয়ার কেউ নেই। সুতরাং নও-মুসলিম যুবকের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর, ধোঁকার আবরণ ছিড়ে ফেলে দাও। দয়াময় প্রভুর কুদরতী চরণে নতশীর হও। তওবা কর, ক্ষমাপ্রার্থী হও। এতে ধন্য হবে তোমার জীবন ইহকালেও এবং পরকালেও। তোমাদের জীবন হবে মুসলিম যুবকদের জন্য পাথেয়। আল্লাহ পাক তোমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।
(চলবে ইনশাল্লাহ)
৪র্থ পর্বঃ
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:০৭