মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান দা. বা.
কুরআনের আলোকে আদর্শ যুবক
কুরআনের আলোকে আদর্শ যুবক
আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-
انمايؤمن بايتناالذين اذاذكروبهاخرو سجدا وسبحوابحمد ربهم وهم لايستكبرون-تتجافي جنوبهم عن المضاجع يدعون ربهم خوفاوطمعاوممارزقناهم ينفقون-فلاتعلم نفس ما اخفي لهم من قرة اعين جزاء بما كانوايعملون
অর্থাৎ কেবল তারাই আমার আয়াতসমূহের প্রতি ঈমান আনে, যারা আয়াতসমূহ দ্বারা উপদেশপ্রাপ্ত হয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং অহংকারমুক্ত হয়ে তাদের পালনকর্তার প্রশংসা-পবিত্রতা বর্ণনা করে। তাদের পার্শ্বদেশ শয্যা হতে পৃথক রেখে তারা তাদের পালনকর্তাকে ভয়ে ও আশায় ডাকতে থাকে। আর আমি তাদের যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে। কেউ জানেনা কি কি নয়ন প্রীতিকর প্রতিদান তাদের জন্য লুকায়িত রাখা হয়েছে, তাদের কৃতকর্মের পুরুষ্কার স্বরূপ।
হাদীসের আলোকে আদর্শ যুবক
মুসলিম শরীফের হাদীসে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ পাক বলেনঃ আমি আমার নেক বান্দাদের জন্য যা প্রস্তুত রেখেছি তা কোন চোখ দেখে নাই, কোন কান শুনে নাই এবং কোন অন্তর অনুভব করে নাই। এই হাদীসের সমর্থনে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করেন।
অনুরূপ পুরস্কারের কথা তাওরাতেও উল্লেখ রয়েছে বলে হযরত মুগীরা ইবনে শুবা ও ইবনে মাসউদের হাদীসে উল্লেখ আছে। ইবনে সারীন বলেন, “আল্লাহপাকের দীদার লাভ করাও উপরোক্ত প্রতিদানের অন্তর্ভূক্ত।” হযরত হাসান বসরী বলেন, “তারা রাতের আঁধারে মানুষের অগোচরে আমল করেছে। তাই আল্লাহ পাক অবর্ণনীয় প্রতিদান তাদের জন্য অগোচরে প্রস্তুত করে রেখেছেন।
চার. প্রাসাদ নির্মাণে উদ্যত যুবক
আদর্শ যুবক
জাফর ইবনে সুলাইমান ও মালিক ইবনে দীনার বসরা সফরকালে নির্মাণাধীন একটি বিরাট প্রাসাদ দেখতে পান। তারা দেখেন, প্রাসাদ নির্মাণের তত্ত্বাবধান করছিল এক সুন্দর, সুশ্রী যুবক। জফর বললেন, এমন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী যুবকটিকে দুনিয়ার মরিচিকার পেছনে নিমগ্ন দেখে আমার মনে আগ্রহ সৃষ্টি হলো যে, আমি তার জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করব, যাতে তার মন প্রলুব্ধকর দুনিয়া থেকে ফিরে আখেরাতের দিকে ধাবিত হয় এবং জান্নাতের চিরস্থায়ী সুখ-শান্তি লাভে সে ধন্য হয়। এরূপ চিন্তা-ভাবনা করে উভয়ে যুবকের কাছে গিয়ে সালাম দেন। যুবক সালামের উত্তর দেয় এবং মালিক ইবনে দীনারকে চিনতে পেরে অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে স্বাগত জানায়। তখন তাদের মাঝে কিছু কথপোকথন হয়ঃ
মালিক ইবনে দিনারঃ হে যুবক! এই প্রাসাদ নির্মাণের জন্য তুমি কি পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছ?
যুবকঃ এক লক্ষ দেরহাম।
ইবনে দীনারঃ যদি বরাদ্দকৃত অর্থ তুমি আমাকে দিয়ে দাও তাহলে আমি এর পরিবর্তে তোমার জন্য জান্নাতে এর তুলনায় অধিক উত্তম প্রাসাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। সে প্রাসাদ হবে মণিমুক্তা খচিত, স্বর্ণ-রূপা ও মূল্যবান পাথরে আচ্ছাদিত। সে প্রাসাদের মাটি হবে জাফরান ও মেশকে আম্বরের সুগন্ধিযুক্ত। রকমারী বিলাস সামগ্রীতে পরিপূর্ণ সেই প্রাসাদে তুমি চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করবে। যুবক জানতো যে, মালিক ইবনে দীনার যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস এবং সমকালীন বুযুর্গদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন আল্লাহর ওলী। তাই তার প্রস্তাবটিকে সে অত্যন্ত গুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখে এবং সুযোগ গ্রহণের প্রতি উৎসাহী হয়।
সে বলে, আমাকে একটু চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ দিন। আগামীকাল সকালে আপনি দয়া করে তশরীফ আনলে আমার চূড়ান্ত মতামত আপনার খেদমতে পেশ করব।
মালিক ইবনে দীনার সেদিন চলে যান। রাতব্যাপী তিনি ঐ যুবকের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন এবং শেষ রাত্রে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করে অত্যন্ত কাকুতি-মিনতির সাথে যুবকের হেদায়েতের জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে মুনাজাত করেন। পরদিন সকালে আবার উভয় ব্যক্তি যুবকের বাড়ীতে যান। যুবকও তাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। তাই তাদেরকে দেখে সে অত্যন্ত আনন্দিত হয় এবং সাদর আমন্ত্রণ জানায়।
ইবনে দীনারঃ হে যুবক! গতকাল আমি তোমাকে যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম সে সম্পর্কে আজ তোমার মতামত জানতে চাই।
যুবকঃ গতকাল আপনি আমাকে যে প্রতিশ্রুতির কথা বলেছিলেন, তাকি আপনি পূরণ করবেন?
ইবনে দীনারঃ অবশ্যই!
যুবক এই কথা শোনার সাথে সাথে এক লক্ষ দেরহাম মালিক ইবনে দীনারকে দিয়ে দেয় এবং প্রতিশ্রুত বিষয়ে তাকে একটি ওয়াদাপত্র লিখে দেয়ার আবেদন জানায়। মালিক ইবনে দীনার এইভাবে একটি ওয়াদা পত্র লিখে দেন যে, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আমি মালিক ইবনে দীনার এই যুবকের সাথে ওয়াদাবদ্ধ যে, তার নির্মাণাধীন প্রাসাদের তুলনায় সে উন্নত মানের প্রসাদ প্রাপ্ত হবে, যে প্রাসাদের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী হবে নিম্নাক্ত ধরণের।” এরপর প্রাসাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে একটি লিপি যুবককে প্রদান করতঃ এক লক্ষ দেরহাম নিয়ে মালিক ইবেন দীনার চলে যান। জাফর বলেন যে, ইবনে দীনার গোটা এক লক্ষ দেরহাম ঐ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ফকীর-মিসকীনদের মধ্যে বিতরণ করে দেন। একটি দেরহামও অবশিষ্ট থাকেনি। একটি দেরহাম নিজের কাজেও তিনি ব্যয় করেননি।
যুবকের সৌভাগ্য
এই ঘটনার চল্লিশ দিন অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই ফজরের নামায আদায় করার পর মালিক ইবেন দীনার মসজিদের মেহরাবের উপর যুবককে দেয়া ঐ প্রতিশ্রুতি লিপিটি দেখতে পান, যার অপর পৃষ্ঠায় লেখা ছিল- হে মালিক ইবেন দীনার! যুবকের সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি থেকে তুমি মুক্ত। যুবকের সাথে তুমি যে ধরণের প্রাসাদের প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয়েছিলে, আমি তার চেয়েও অধিক উত্তম প্রসাদে তাকে জান্নাতে রেখেছি।
যুবকের কাফনে লিপি - ওলামাদের কর্তব্য
যুবকের কাফনে লিপি
ইবনে দীনার এই লিপি পাঠ করে অবাক হয়ে যান এবং যুবকের খবর নেয়ার জন্য তার বাড়ীতে যান। বাড়ীর চত্বরে গিয়ে অবগত হন যে, গতকাল ঐ যুবক মৃত্যুবরণ করেছে। মালিক ইবনে দীনার জানতে চান, তাকে কিভাবে গোসল দেয়া হয়েছে এবং কিভাবে কাফন-দাফন করা হয়েছে? লোকেরা জানালো যে, এই যুবক মৃত্যুর পূর্বে আমাদেরকে অছিয়ত করে গিয়েছিল। তার অছিয়ত মুতাবেক তাকে গোসল ও কাফন-দাফন করা হয় এবং একটি লিখিত কাগজ তার কাফনে দিয়ে দেয়া হয়। মালিক ইবনে দীনার লিখিত কাগজটি বের করে তাদেরকে দেখালেন। কাগজ দেখে তারা বলে উঠল, ‘আল্লাহর কসম! এই কাগজটিই যুবকের কাফনে দেয়া হয়েছিল।’ এই দৃশ্য দেখে অন্য এক যুবক বলে উঠলো, হে মালিক ইবনে দীনার! আমি আপনাকে দুই লক্ষ্য দেরহাম দিব, আমাকেও আপনি একটি ওয়াদাপত্র লিখে দিন। মালিক ইবনে দীনার বললেন, “এসব আল্লাহ পাকের ইচ্ছা, আমার কিছু করার নেই।” এরপর প্রায়ই মালিক ইবনে দীনার এই যুবকের কথা স্মরণ করতেন এবং অশ্রুসিক্ত হতেন।
দাওয়াতের গুরুত্ব
এই ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, যেসব যুবক অর্থ-কড়ি ও দুনিয়ার পিছনে মত্ত, তাদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানো জরুরী। বিশেষ করে যাদের প্রতি জনগণ আস্থাশীল, যাদেরকে লোক ভক্তি-শ্রদ্ধা করে তাদের কর্তব্য হলো, তারা যেন মানুষকে আখেরাতের ব্যাপারে নছীহত করেন। অসংখ্য যুবক এমন রয়েছে যারা দ্বীনের দাওয়াত না পাওয়ার দরুন পাপাচার ও অর্থ-সম্পদের মধ্যে আপাদমস্তক নিমজ্জিত হয়ে আখেরাতের জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে। যদি তাদের পিছনে মেহনত করা হয়, তাহলে তারা হেদায়েত লাভ করতে পারে। বর্তমান যুগের তাবলীগী দাওয়াত এর জ্বলন্ত প্রমাণ। তাদের অক্লান্ত মেহনতের বদৌলতে অসংখ্য যুবক সঠিক পথের সন্ধান লাভ করছে এবং শরীয়তের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আমাদের দেশে বর্তমানে অসংখ্য ওলামা-মাশায়েখ, মুহাদ্দিস, ফকীহ ও আল্লাহ ওয়ালা বিদ্যমান রয়েছেন। যুবকদের দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তাদের কি কর্তব্য তা গভীর ভাবে ভেবে দেখা দরকার।
ওলামাদের কর্তব্য
মূলতঃ এক্ষেত্রে ওলামা-মাশায়েখদের বড় কর্তব্য হচ্ছে, দিশেহারা যুবকদের পিছনে মেহনত করা, তাদেরকে ঘৃণা না করে, দূরে ঠেলে না দিয়ে তাদের মধ্যে দ্বীনী চেতনা সৃষ্টি করা। সেটি করতে হবে আদর-যত্নের মাধ্যমে, স্নেহ-মায়ার মাধ্যমে, রাতের আঁধারে তাহাজ্জুদ পড়ে তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে হেদায়েত ও নাজাতের দোয়া করার মাধ্যমে। এ বিষয়ে কিয়ামতের ময়দানে ওলামাগণই অধিক জিজ্ঞাসিত হবেন। সুতরাং ওলামা-মাশায়েখগণের এ ব্যাপারে সচেতন ও সক্রিয়া হওয়া বাঞ্ছনীয়।
জান্নাতের মালিক আল্লাহ - যুবকদের করণীয়
জান্নাতের মালিক আল্লাহ
জান্নাতের মালিক আল্লাহ পাক। কোন মানুষ অন্য কোন মানুষকে জান্নাত দিতে পারে না। তবে আল্লাহ ওয়ালাগণ আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করতে পারেন এবং তাদের সুপারিশ গৃহীত হতে পারে। এজন্যই কুরআন-হাদীসে সুপারিশ ও দোয়ার বিধান প্রবর্তিত হয়েছে। বুখারী শরীফের হাদীসে আছে যে, অনেক সময় আল্লাহর খাঁটি বান্দাগণ কোন কিছু দাবী করে বসেন, তখন আল্লাহ পাক তাদের খাতিরে তাদের দাবী পূরণ করে থাকেন। মালিক ইবনে দীনার ছিলেন সমকালীন শ্রেষ্ঠ ওলী। যুবকের ক্ষেত্রে তার দোয়া আল্লাহর মহান দরবারে গৃহীত হয়েছে এবং এ কারণে যুবকের এই সৌভাগ্য লাভের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে, কেবল তাদের কাছেই এরূপ ঘটনা অবাস্তব মনে হতে পারে, অন্যদের কাছে নয়।
যুবকের দৃঢ় বিশ্বাস
বুযুর্গানে দ্বীনের নেক দৃষ্টি ও দোয়া নাজাতের বড় উপায়। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন হয় ঈমান, আমল এবং আল্লাহর ওয়ালাদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তির। এই যুবকের প্রতি মালিক ইবনে দীনারের নেক নজরের কারণ ছিল এটাই। মূলতঃ বৈধভাবে দুনিয়ার টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পদ উপার্জনে বাধা নেই। তবে অর্থ-সম্পদ মূল বস্তু নয়, মূল বস্তু হচ্ছে আল্লাহর গোলামী। এ অনুভূতি ও বিশ্বাস নিয়ে যারা অর্থ-সম্পদ উপার্জন করে তাদের জন্য অর্থ-সম্পদ হয় নেয়ামত ও সফলতার প্রতীক। আর যারা অর্থ-সম্পদকেই জীবনের মূল বস্তু মনে করে তারা হয় লোভাতুর, অর্থলিপ্সু। তারা কোনদিন সফলকাম হতে পারে না; না ইহকালে, না পরকালে। এই যুবকও ছিল অর্থশালী ও বিত্তবান। তবে সে যেমন ছিল বাহ্যিক দিক দিয়ে বিত্তবান, তেমনি ছিল আধ্যাত্মিক ও মনের দিক দিয়েও বিত্তবান। হাদীসে বলা হয়েছে, যে মনের ধনী সেই প্রকৃত ধনী। যুবক বয়সে বিপুল অর্থ-কড়ি ব্যয়ে প্রাসাদ নির্মানে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও নির্মাণাধীন প্রাসাদের আকর্ষণ বর্জন করে বরাদ্দকৃত সমুদয় অর্থ আখেরাতের আশায় দান করে দেয়া প্রমাণ করে জান্নাতের প্রতি যুবকের অসাধারণ আকর্ষণ। প্রমাণ করে অর্থ-সম্পদের তুলনায় দান-খয়রাতের শুভ পরিণতির প্রতি তার বিশ্বাস। প্রমাণ করে আল্লাহ ওয়ালাদের প্রতি তার অগাধ আস্থা ও শ্রদ্ধা-ভক্তি। এরূপ যুবকের জীবনই হতে পারে সফল ও সবার জন্য পাথেয়।
হাদিয়া-নজরানা
এমন যুবক এ যুগেও বিরল নয়। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ টাকার নজরানা ও হাদিয়া পেশ করে জীবন ধন্য করার তাগিদ আজও অসংখ্য যুবকের অন্তর আন্দোলিত করে। যুবকদের নজরানা ও হাদিয়ার টাকায় বিরাট বিরাট প্রাসাদ ও মার্কেট তৈরীর ঘটনাও রয়েছে যথেষ্ট। তবে মালিক ইবনে দীনারের মত লোকের সংখ্যা বিরল না হলেও খুবই কম। যুবকরা শ্রদ্ধা-ভক্তি ঠিকই করে, নজরানা ও হাদিয়াও পেশ করে থাকে, কিন্ত উপযুক্ত রাহবার না ধরতে পারার কারণে তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। তাদের মধ্যে শরীয়তের অনুশীলন এবং আল্লাহ ও রাসূলের সুন্নতের প্রতি আকর্ষণ প্রতিফলিত হয় না। আখেরাতের অনুভূতি তো বহু দূরের কথা, মানবতা ও মনুষ্যত্বের চরিত্রও অনেক সময় অনুপস্থিত থাকে।
যুবকদের করণীয়
যুবকদের তাদের নিজেদের জীবনের মূল্যায়ণ করতে শিখতে হবে। হক্কানী বুযুর্গদের সন্ধান লাভ করে জীবনের সফলতার তাগিদে তাদের নেক নযর ও দোয়া নিতে হবে। তাদের সহচর্য অবলম্বনের মাধ্যমে বস্তু জগতের উন্নতির সাথে সাথে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আখেরাতের সাফল্য লাভের প্রতি আগ্রহী হতে হবে। দুনিয়ার জীবন চিরস্থায়ী নয়, অথ-সম্পদও চিরস্থায়ী নয়। এ সত্যটি যাদের সান্নিধ্যে থাকলে বুঝা যায়, যাদের সান্নিধ্যে মানুষ রাসূলের সুন্নতের প্রতি ধাবিত হয়, শরীয়তের অনুশীলনের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়, কেবল তাদের সহচর্য অবলম্বনই যে সফলতার একমাত্র পথ, একথা যুবকদের অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে। তাহলে তাদের জীবন সফলকাম হবে; ইহকালেও এবং পরকালেও।
পাঁচ. হাজী যুবক
প্রশ্নোত্তর
মালিক ইবনে দীনার হজ্বের সফরে পায়ে হেঁটে একটি যুবককে হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে পথ চলতে দেখেন। তার সাথে কোন প্রকার সামান-পত্র ছিল না। আরোহনের জন্য কোন সাওয়ারীর ব্যবস্থাও ছিল না। ইবনে দীনার তাকে সালাম করলেন। যুবক সালামের উত্তর দিল। অতঃপর দু’জনের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হলো।
ইবনে দীনারঃ হে যুবক! কোথা হতে আসছ?
যুবকঃ আল্লাহর দরবার থেকে।
ইবনে দীনারঃ কোথায় যাবে?
যুবকঃ আল্লাহর দরবারে।
ইবনে দীনারঃ সামানপত্র কোথায়?
যুবকঃ আল্লাহর জিম্মায়।
ইবনে দীনারঃ খালি হাতে তো যাওয়া যাবে না, কোন পথ-সম্বল আছে কি?
যুবকঃ আল্লাহ পাকের ৫টি শব্দ সম্বল আছে।
ইবনে দীনারঃ শব্দ পাঁচটি কি?
যুবকঃ كهيعص
ইবনে দীনারঃ এর অর্থ কি?
যুবকঃ ك অর্থঃ كافي যথেষ্ট, ه অর্থ هادي পথপ্রদর্শনকারী, يا অর্থ আশ্রয়দাতা, ع অর্থঃ عليم সর্বজ্ঞ, ص অর্থ صادق ওয়াদা পূরণকারী। সুতরাং যার জন্য আল্লাহ যথেষ্ট, পথপ্রদর্শনকারী, আশ্রয়দাতা, সর্বজ্ঞ ও ওয়াদা পূরণকারী হবেন, তার ভয় আছে কি? সামানপত্রের বোঝা বহনের প্রয়োজন তার আছে কি?
যুবকের নছীহত - যুবকের কবিতা
যুবকের নছীহত
যুবকের কথাবার্তা শুনে ইবনে দীনার অবাক হন। তিনি বুঝতে পারেন যে, এই যুবক সাধারণ কোন যুবক নয়, বরং বড় ধরণের ওলী আল্লাহ। তাই তিনি তাকে একটি কুর্তা হাদিয়া স্বরূপ পেশ করেন। কিন্তু যুবক হাদিয়া গ্রহণে অসম্মতি প্রকাশ করে বলে যে, হে বৃদ্ধ! জড় জগতে কুর্তা পরিধান না করে খালি শরীরে থাকাই ভালো। কেননা হাশরের ময়দানে হালাল বস্তুর হিসাব দিতে হবে, আর হারাম বস্তুর জন্য কঠোর আযাবে আক্রান্ত হতে হবে।
যুবকের মুনাজাত
ইবনে দীনার যুবকের নছীহত শুনে আশ্চার্যান্বিত হয়ে যান এবং তার আচার-আচরণ গভীরভাবে অবলোকন করতে থাকেন। তিনি দেখেন যে রাতের আধারে যুবকটি অত্যন্ত দীনতা-হীনতার সাথে মুনাজাত শুরু করেছে এবং বলছে, হে মহান আল্লাহ! আপনি বান্দার ইবাদতে খুশী হন। বান্দার গোনাহের দ্বারা আপনার কোন ক্ষতি হয় না, তবে বান্দার বিরাট ক্ষতি হয়। তাই আপনি আমাকে এমন আমলের তওফীক দিন, যে আমলের দ্বারা আপনি খুশী হন। আমাকে নেক আমলের তওফীক দিন। আর যে আমলের দ্বারা আপনার কোন ক্ষতি নাই, অথচ আমার বিরাট ক্ষতি হয়ে যায় অর্থাৎ গোনাহের আমলগুলোকে ক্ষমা করুন এবং তা থেকে আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন।
যুবকের অন্তরে আল্লাহর ভয়
সকালে অন্য হাজীগণ ইহরামের প্রস্তুতি গ্রহণ করতঃ তাবলিয়া পাঠ করে ইহরাম পরিধান করে। কিন্তু যুবকটি নীরবে বসে থাকে। ইবনে দীনার তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, “তুমি দেখি তাবলিয়া পাঠ করছ না, কি ব্যাপার?” যুবক বললঃ আমার ভয় হচ্ছে যে, আমি যদি লাব্বাইকা বলি আর আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তর আসে যে, ‘লা-লাব্বাইকা লা-সাদাইকা’ অর্থাৎ তোমার লাব্বাইকা ও সাদাইক আমার নিকট গ্রহণীয় নয়, আমি তোমার কথা শুনতে সম্মত নই, তোমার প্রতি আমার করুণার দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে না, এই ভয়ে আমি চুপচাপ বসে আছি।
যুবকের কবিতা
এরপর যুবক সেখান থেকে উঠে চলে যায়। রাস্তায় আর কোথাও তাকে দেখা যায় নি। অবশেষে ইবনে দীনার মিনাতে তাকে একটি কবিতা পাঠরত অবস্থায় দেখতে পান। সে কবিতাটির ভাবার্থ এইঃ
ঐ প্রেমাস্পদ, যার কাছে আমার রক্তের প্রবাহ ভালো লাগে, আমার রক্ত তার জন্য হরম শরীফের ভিতরে-বাইরে উভয় স্থানেই বৈধ।
আল্লাহ পাকের কসম! যদি আমার আত্মা অবহিত হতে পারে যে, কোন পবিত্র সত্ত্বার সাথে সে আবদ্ধ হয়ে আছে, তাহলে পায়ের উপর দাঁড়িয়ে নয় বরং নতশীরে তার দরবারে হাজির হবে।
হে ভর্ৎসনাকারীগণ! তোমরা আমাকে তার প্রেমের কারণে ভর্ৎসনা করো না, আমি যা দেখি যদি তোমরা তা দেখতে তাহলে অবশ্যই ভর্ৎসনা করতে না।
মানুষ স্বশরীরে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করে থাকে। যদি তারা আল্লাহর সত্ত্বার চারপাশে তাওয়াফ করতে সক্ষম হতো তাহলে বায়তুল্লাহর তাওয়াফের প্রয়োজন হতো না।
মানুষ ঈদের দিন ভেড়া-বকরী কুরবানী করেছে, আর আমার প্রেমাস্পদ সেদিন আমার জানের কুরবানী গ্রহণ করেছেন।
লোকেরা হজ্জ্ব করেছে, আর আমার হজ্জ্ব হচ্ছে আমার মনের শান্তির বস্তুকে নিয়ে।
মানুষ সেদিন অনেক কুরবানী করেছে, আর আমি আমার রক্ত ও জানের কুরবানী করছি।
যুবকের মৃত্যু - শিক্ষণীয় বিষয়
যুবকের মৃত্যু
এরপর এই যুবক আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করে বলেঃ ‘হে আল্লাহ পাক! মানুষেরা আপনার দরবারে কুরবানীর মাধ্যমে নৈকট্য লাভে ধন্য হয়েছে। আমার নিকট আমার জান ব্যতীত কুরবানী করার মত কোন কিছু নেই। তাই আমি আমার জানকে কুরবানী হিসেবে আপনার মহান দরবারে পেশ করলাম। আপনি আমার জানের কুরবানীকে কবুল করুন।’ এই বলে সে একটি চিৎকার দেয় এবং মৃত্যু বরণ করে।
গায়েবী সংবাদ
ইবনে দীনার বলেন, যুবকের মৃত্যুর পর আমি গায়েবী আওয়াজে শুনতে পাই “এই যুবক আল্লাহর অতি প্রিয়। সে আল্লাহর নামে মৃত্যুবরণ করেছে।” অতঃপর আমি তার কাফনের ব্যবস্থা করে সুন্নত মুতাবেক দাফনের কাজ সমাধা করে তাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের মধ্যে তাকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞাসা করি যে, আল্লাহপাক তোমার সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন? সে বলল, আল্লাহ পাক বদরের শহীদদের সাথে যেরূপ আচরণ করেছেন আমার সাথে সেরূপ আচরণই করেছেন।
শিক্ষণীয় বিষয়
ঘটনা ও ইতিহাস বর্ণনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষা গ্রহণ; নিছক ঘটনার আবৃত্তি উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-
ان في ذالك لعبرة لاولي الابصار
অর্থাৎ ‘জ্ঞানীদের জন্য ঘটনাবলীতে রয়েছে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়।’
এই মহান যুবকের ঘটনা থেকেও আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।
আল্লাহর প্রতি ঈমান ও ভরসা - যুবকের আকীদা
আল্লাহর প্রতি ঈমান ও ভরসা
আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান ও ভরসা মানব জীবনের কল্যাণের পথে বড় সহায়ক। এরূপ ঈমান ও ভরসা মানুষকে বস্তু-আকর্ষণ থেকে মুক্ত করে এবং আখেরাতের প্রতি ধাবিত করে। ফলে মানুষ বস্তু জড়তামুক্ত হয়ে অপরাধ ও গোনাহের কাজ থেকে সংযত হতে পারে এবং আখেরাতের সৌভাগ্য অর্জনে ধন্য হয়। পবিত্র কুরআনে এ দিকটির প্রতি আলোকপাত করে ইরশাদ হয়েছেঃ
ومن يتق الله يجعل مخرجا ويرزقه من حيث لا يحتسب ومن يتوكل علي الله فهو حسبه ان الله بالغ امره قد جعل الله لكل شيئ قدرا
অর্থাৎ ‘যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার জন্য পথ বের করে দেন এবং তাকে রিযিক দান করেন বে-হিসাব। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট হয়ে যান। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করে থাকেন। আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের জন্য একটি পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন।’
রাসূলে পাক ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি নিজেকে আখেরাতের চিন্তায় নিমগ্ন রাখে তার জন্য আল্লাহ পাকই যথেষ্ট। আর যে ব্যক্তি জড় বস্তুর চিন্তায় আবদ্ধ হয় তার ধ্বংস অনিবার্য। পৃথিবীর বুকে মানুষ ব্যতীত আরও অসংখ্য সৃষ্টি রয়েছে। তাদের জীবন যাপনের অন্ন-বস্ত্রের কোন স্থায়ী ব্যবস্থা নেই, তাদের নেই থাকার নির্ধারিত স্থান। তারা কেবল স্রষ্টার উপরই ভরসা করে। আর আল্লাহ পাক সত্যিই তাদের সব ব্যবস্থা করে থাকেন। কিন্তু মানুষ মেধা-বুদ্ধির অধিকারী হয়েও এই সত্য অনুধাবনে উদাসীন। এ কারণেই তাদের লাঞ্ছনা-বঞ্চনার জীবন যাপন করতে হয়। পক্ষান্তরে এই যুবক তার জীবনে ঈমান ও আল্লাহর উপর ভরসাকে পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করেছিল। হজ্জ্বের বিরাট সফরে সে কেবল আল্লাহর সত্ত্বার উপরই নির্ভরশীল ছিল। পবিত্র কুরআনের পাঁচটি শব্দই ছিল তার একমাত্র সহায়-সম্বল। এর উপর ভরসা করে সে তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্রতী হয়, প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। আল্লাহ পাক তার প্রচেষ্টাকে বিফল করেন নাই। তাকে করেছেন চিরকালের জন্য সৌভাগ্যবান।
যুবকের আকীদা
যুবকের আকীদা ছিল এই যে, আমাকে আল্লাহ পাক সৃষ্টি করেছেন, সুতরাং তিনিই আমার জন্য যথেষ্ট। মানুষের সৎপথে চলা উচিত। সৎ পথের পথ প্রদর্শক হচ্ছেন আল্লাহ পাক। মানুষ যা চিন্তা করে তা ভুলও হতে পারে, বরং ভুল হওয়াই অনিবার্য। কিন্তু আল্লাহ পাক নির্ভূল, তিনি সুবহান। তাই তার দিকনির্দেশনা নির্ভুল এবং মানুষের জন্য স্থায়ী কল্যাণের উপায়। আশ্রয়দাতা কেবল আল্লাহ পাক, অন্য কেউ নয়। কেননা সৃষ্টি মাত্রই আশ্রয়ের মুখাপেক্ষী, তাই স্রষ্টার বদলে কোন সৃষ্টি কাউকে আশ্রয় দিতে সক্ষম নয়। আল্লাহ মহাজ্ঞানী। যা মানুষ জানে না এবং কল্পনাও করতে পারে না তাও আল্লাহ পাকের জানা আছে। তাই মুমিনের অবস্থা সম্পর্কে তিনি অভিজ্ঞ। মুমিনের কষ্ট-দুর্ভোগের পিছনেও থাকে বিরাট উপকারিতা এবং সুখ-শান্তির পিছনেও থাকে গভীর রহস্য। তাই সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল থাকা বাঞ্ছনীয়। কষ্ট সহ্য ও বিপদে ধৈর্য ধারণ করাই মুমিনের শান। কেননা ধৈর্যের পরিণাম অতীব কল্যাণকর। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এ সমূহ বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে। আল্লাহর বর্ণনা অসত্য নয়, হতেই পারে না। এই আকীদা-বিশ্বাসই যুবকের জীবনে সফলতা বয়ে এনেছে।
দুনিয়ার প্রতি বৈরাগ্য - অহমিকা অন্তরের ব্যধি
দুনিয়ার প্রতি বৈরাগ্য
জড় বস্তুর আকর্ষণ মানুষকে আখেরাতের প্রতি উদাসীন করে তোলে, যার ফলে মানুষ পাপাচারিতায় লিপ্ত হয়ে জাহান্নামী হয়। এজন্য হাদীসে পাকে মৃত্যুর কথা অধিক স্মরণ করতে বলা হয়েছে। কবর যিয়ারতের নির্দেশ একই উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছে, যাতে মানুষ কবর হাশরের হিসাব-নিকাশ, পুলছিরাত ও জাহান্নামের কথা চিন্তা করে অপরাধমুক্ত থাকতে পারে। অপরপক্ষে আখিরাতের শান্তি চিরস্থায়ী জান্নাত। জান্নাতের অবর্ণনীয় সুখ-শান্তির প্রত্যাশায় মানুষ যাতে নেক আমলের প্রতি ব্রতী হয় পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এদিকেও যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। মানুষ উভয় বিষয়ে গভীরভাবে মনোনিবেশ করলে বস্তুর প্রতি তার আকর্ষণ কমে যায় এবং আখেরাতের প্রস্তুতির প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। এই মন-মানসিকতাই এই যুবককে দুনিয়া বিরাগী করে তুলেছিল। তাই সে ইবনে দীনারের দেয়া একটি কুর্তার হাদিয়া গ্রহণ করে অধিক হিসাবের ভার কাঁধে নিতে সম্মত হয়নি। হারাম উপার্জনের পরিণতি ও আযাবের ভয়ে সে ছিল অত্যন্ত সতর্ক। তাই পোষাক-পরিচ্ছদ ও জীবন-উপকরণের অভাব-অনটন তাকে কোন দিন কাতর করতে পারে নি। অর্থের অভাবে সে হয়ত হজ্জ্বের কুরবানীর জন্য জানোয়ার পেশ করতে পারে নি, কিন্তু কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য যা, তা পেশ করতে সক্ষম হয়েছে। সে তার নিজের জীবনকে কুরবানীর জন্য পেশ করে মুনিবের প্রতি গোলামের আনুগত্যের অপূর্ব নিদর্শন স্থাপন করেছে। এর চেয়ে অধিক সফলতা আর কি হতে পারে?
অহমিকা অন্তরের ব্যধি
অহংকার ও অহমিকা সমস্ত আত্মিক ব্যধির মূল সূত্র। শয়তান অহমিকার কারণেই শয়তান হয়েছে; সে নিজেও জাহান্নামী হয়েছে এবং অসংখ্য মানুষের জন্যও জাহান্নামের কারণ হয়েছে। যারা ইবাদতগোযার ও শরীয়তের কঠোর অনুশীলনে অভ্যস্ত, শয়তান তাদেরকে অত্যন্ত সুকৌশলে এই ব্যধিতে জড়িয়ে থাকে। ইবাদত-রিয়াজত ও নেক আমলের কারণে নিজেকে অপরের চেয়ে বড় মনে হওয়া অহংকারের ফলশ্রুতি। অথচ ইবাদত-রিয়াজতের ক্ষেত্রে আসল বিষয় হচ্ছে আল্লাহ পাকের দরবারে কবুল হওয়া, আর এটা নিশ্চিত ভাবে জানার কোন উপায় নেই। পক্ষান্তরে যাকে ছোট মনে করা হচ্ছে, হতে পারে গোপনে সে আল্লাহর প্রিয় হয়ে আছে। তাই নিজেকে বড় মনে করার কোন উপায় নেই। সর্বোপরি আল্লাহর বড়ত্ব ও আযমতের সামনে মানুষ সে যত বড়ই হোক না কেন, তার কি মূল্য আছে? বিশ্ব রাসূলের চেয়ে বড় কে হতে পারে? অথচ তিনি আল্লাহর সম্মুখে ক্রীতদাসের মত হয়ে থাকতেন। তাহলে আর কোন সৃষ্টির বড়ত্বের কী অধিকার আছে? যারা এই সত্য অনুধাবনে সক্ষম হয় তারা হয় নম্র-ভদ্র, দীন-হীন। তারা নিজেকে ছোট মনে করে ও ছোট হয়ে থাকে। ফলে তারা আল্লাহ পাকের নিকট হয় অতি মহান, অত্যন্ত বড়; দুনিয়াতেও ও আখেরাতের জীবনেও। এই যুবক নিজেকে অহমিকা মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। তার চোখে অন্যের গুরুত্ব ও আল্লাহ পাকের বড়ত্ব স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছিল। তাই সে ঈদের দিন অন্যের মত কুরবানী করতে পারে নি বিধায় নিজেকে অন্যদের তুলনায় ছোট মনে করে নিজের প্রাণকে কুরবানী হিসেবে পেশ করেছে। অতঃপর আল্লাহর সম্মুখে জানোয়ারের কুরবানীর পরিবর্তে স্বীয় জানের কুরবানী গ্রহণের জন্য কাতর সুরে মুনাজাত করেছে। এই থেকে যুবকের অহমিকা বিবর্জিত মন এবং দীনতা হীনতা অবলম্বনের স্বভাব প্রমাণিত হয়।
আখেরাতের বিশ্বাস - ভয় এবং আশা
আখেরাতের বিশ্বাস
মানুষ স্বেচ্ছায় দুনিয়াতে আসেনি এবং স্বেচ্ছায় দুনিয়া থেকে যেতেও পারে না। এর জন্য রয়েছে অলংঘনীয় খোদায়ী বিধান। তবে একদিন মানুষকে এই দুনিয়ার স্বপ্নপুরী ত্যাগ করতে হবে এবং যার হুকুমে এসেছে তার হুকুমেই তাকে ফিরে যেতে হবে। দুনিয়ার এ জীবন নেহায়েত ক্ষণস্থায়ী। এই ধ্র“ব সত্য অনুধাবনে যারা সমর্থ হয় তারা বস্তু জড়তার প্রতারণা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়। সক্ষম হয় আখেরাতকে প্রাধান্য দিতে এবং আখেরাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে। সে মৃত্যুকে ভয় করে না, বরং মৃত্যুকে শান্তি ও মুক্তি লাভের উপায় মনে করে। সে মনে করে মৃত্যু হলেই সে জড়বস্তুর পরিবেশ মুক্ত হয়ে নতুন পরিবেশ লাভে ধন্য হবে। ধন্য হবে জান্নাত লাভে, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে। যার নির্দেশে এবং যার নিকট থেকে সে এসেছে, সে তার নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে পুণরায় তার নিকট ফিরে যাওয়ার জন্য। এর বাস্তুব নিদর্শন ছিল হাজী যুবকের জীবন। ইবনে দীনার যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, “তুমি কোথা হতে এসেছ এবং কোথায় যাচ্ছ?” উত্তরে যুবক বলেছিলঃ “আল্লাহর দরবার থেকে এসেছি এবং আল্লাহর দরবারে ফিরে যাওয়ার পথে রওনা হয়েছি।” আহ! কতইনা হৃদয়গ্রাহী কথা! কী অপূর্ব বিশ্বাস, কি প্রেমের অভিব্যক্তি! তার এই উক্তি বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে উজ্জ্বল আদর্শ হয়ে আছে এবং থাকবে। পবিত্র স্থান মিনাতে মৃত্যুবরণ করে সে যার কাছ থেকে এসেছিল তার কাছেই ফিরে গেল। তার এই উজ্জ্বল জীবনাদর্শ হয়ে রইল বিশ্ব যুব সমাজের জন্য স্মরণীয় পাথেয়।
ভয় এবং আশা
মানুষ দুটি কারণে অপরাধমুক্ত থেকে সৎ পরায়ণ হয়।
ক) ক্ষতিকর ও বিপদজনক কাজের প্রতি মানুষের অন্তরে ভয়-ভীতি সঞ্চার হয়ে থাকে। আর এই ভয় থেকে মুক্তির পথ বেছে নেয়ার তাগিদেই সে সততা অবলম্বন করে।
খ) লাভ ও সফলতার কামনায় মানুষ সৎ কাজের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং অপরাধমুক্ত থাকার প্রতি ব্রতী হয়। এই বিধান কেবল পার্থিব ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, ধর্মীয় এবং আখেরাতের ব্যাপারেও সমানভাবে ক্রিয়াশীল। বস্তুতঃ যার মনে আল্লাহর ও তার আযাবের ভয় নেই, যার মনে আল্লাহর নেয়ামতের আশা-ভরসা নেই সে হয়ে ওঠে উদাসীন-অপরাধপ্রবণ। সে পাপাচারিতায় লিপ্ত হতে কুন্ঠাবোধ করে না। অপরপক্ষে যার অন্তরে আল্লাহ ও তার আযাবের ভয় বিদ্যমান, যার অন্তরে আল্লাহ ও তার নেয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আশা-ভরসা আছে, সে হয় সজাগ দৃষ্টির অধিকারী-দূরদর্শী, সৎ ও দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারী। সে তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে হয় অত্যন্ত উদ্যোগী। হাজী যুবক এরই নজীর স্থাপনে সক্ষম হয়েছিল। আখেরাতের হিসাবের ভয়ে সে একটি কুর্তা পর্যন্ত হাদিয়া গ্রহণে অসম্মত হয়। হালাল ও বৈধ জিনিসের হিসাব দেয়ার ভয়ে তার অন্তর প্রকম্পিত থাকে, আখেরাতের পোষাক-পরিচ্ছদ লাভে ধন্য হওয়ার আশায় যে খালি গায়ে হাজ্বের সফরে বের হয়, তার অন্তরের অবস্থা কত উন্নত! কিসের ভয়ে এবং কিসের আশা-ভরসায় সে নিজেকে মোহমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল, আজকের যুবক সমাজ কি তা তলিয়ে দেখবে? সমুন্নত রাখতে উদ্যোগী হবে কি এই অবিস্মরণীয় মুসলিম যুবকের সোনালী ইতিহাস?
নেক আমলের তাওফীক - অন্তদৃষ্টির গুরুত্ব
নেক আমলের তাওফীক
সবকিছুর মালিক আল্লাহ পাক। নেক আমলের তাওফীকের মালিকও আল্লাহ পাকই। তিনি যাকে তাওফীক দেন, সে কেবলই নেক আমল করতে সক্ষম হয়। আর যাকে তিনি তাওফীক না দেন সে কোন ক্রমেই নেক আমল করতে পারে না। তবে তিনি জালিম নন। ন্যায়-নিষ্ঠা তারই নির্ধারিত বিধান। অত্যন্ত কঠোরভাবে তিনি তা কর্যকর করে থাকেন। তবে এর জন্য রয়েছে স্বতন্ত্র নীতি ও নিয়ম-শৃঙ্খলা। মানুষকে সেই নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিপালনে বাধ্য করা হয়েছে এবং তা করা হয়েছে মানুষের মঙ্গলের জন্যই। মানুষ যখন আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-নিষেধ মেনে চলার প্রতি ব্রতী হয় এবং অবিরাম প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে তখন তার ইহকাল-পরকাল উভয় জীবনেই মঙ্গল সাধিত হয়, ধন্য হয় তার জীবন। নেক আমলের তাওফীক লাভের ব্যাপারেও আল্লাহপাকের এই নিয়মই কার্যকর রয়েছে। নেকের জন্য যারা প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে, আল্লাহ পাক তাদের প্রচেষ্টার মূল্যায়ণ করে থাকেন, তারা নেক আমলের তাওফীক লাভ করে থাকে। হাজী যুবকের জীবনে এর প্রতিফলন ঘটেছিল এবং আজকের যুবকদের জীবনেও এর প্রতিফলনের সুনিশ্চিত অবকাশ রয়েছে। রাতের আঁধারে মানুষ যখন নিদ্রার তৃপ্তি ভোগে ব্যস্ত, ধীরচিত্তে আরামে বিছানায় ঘুমন্ত, হাজী যুবক তখন জাগ্রত হয়ে অধীর চিত্তে প্রেমাস্পদের সাক্ষাতের অপেক্ষায় অপেক্ষমান। গভীর রাতের আঁধারে প্রেমাস্পদের সাক্ষাতের প্রতিশ্রুতির প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখে সে নফল ইবাদতের হাদিয়া পেশ করে প্রার্থনা জানায়“ হে আমার মালিক! আপনি ইবাদতে খুশী হন, তাই আমাকে ইবাদতের তাওফীক দিন, আপনিই তাওফীকদাতা। আমি অবশ্যই গোনাহ করেছি এবং অপরাধী। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা করেন তবে আপনার কোন ক্ষতি নাই, তবে আমার বিরাট উপকার হবে।”
আল্লাহর রাসূল বলেছেন, “যুবক বয়সে যারা ইবাদত রিয়াজত করে থাকে আল্লাহ পাক তাদেরকে কিয়ামতের ভীষণ সংকটময় মুহূর্তে স্বীয় আরশের নীচে স্থান দিয়ে আশংকামুক্ত করবেন। এই যুবক যে তাদেরই একজন ছিল তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
চলবে ইনশাল্লাহ।
৩য় পর্বঃ
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ১১:৩৯