মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান দা. বা.
গর্হিত প্রথার অবসান - যয়নবের তালাক
গর্হিত প্রথার অবসান
যায়েদ ইবনে মুহাম্মদ তখন পূর্ণ যুবক। তাই বিশ্ব রাসূল তার বিবাহ সংক্রান্ত ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করেন। যায়েদ তো এখন সাধারণ যুবক নয়, তিনি আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি আনুগত্যের নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত কায়েম করেছেন। যখন তায়েফবাসীরা শ্রেষ্ঠ নবীর মুবারক দেহ প্রস্তরঘাতে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল, যুবক যায়েদ তখন নবীর পাশে দাঁড়িয়ে জীবন-মরণের ঝুঁকি নিয়ে নিজের দেহ দিয়ে প্রতিরোধের প্রাচীর তৈরী করেছেন। তিনি ইবনে মুহাম্মদ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। কিন্তু তখনকার আরবরা ছিল মূর্খ জাতি। বংশীয় গৌরব এবং ভৌগোলিক জাতীয়তায় বিশ্বাসী। তারা একজন কৃতদাসের কাছে স্বীয় কন্যা বিবাহ দিতে প্রস্তুত নয়। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরব জাতীয়তার এই ঘৃণ্য বংশীয় আভিজাত্য দূরীভূত করণে ব্রতী হন এবং স্বীয় ফুফাতো বোন জয়নবকে যায়েদের কাছে বিবাহ দিয়ে এই কুপ্রথার অবসান ঘটান।
যয়নবের তালাক
কিন্তু আল্লাহর হেকমত কে বুঝে? তার কর্মকাণ্ডের পিছনে থাকে গভীর রহস্য। তাই যয়নব ও যায়েদের মাঝে বনিবনা হয় না। একে অপরকে কিছুতেই বরণ করে নিতে পারে না। আল্লাহ পাক স্বীয় ইচ্ছা কার্যকর করতে চান। যায়েদের মনে যয়নবকে তালাক দেয়ার ইচ্ছা তীব্র হয়ে ওঠে। তিনি রাসূলের নিকট স্বীয় ইচ্ছার বিষয় সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন। কিন্তু রাসূলে পাক স্বামী-স্ত্রী উভয়কে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সংযমী হতে নসীহত করেন। আর সেই মুহূর্তে হযরত জিবরীলের (আঃ) আগমন হয়।
রাসূলের প্রতি ওহী - জেহাদে অংশগ্রহণ
রাসূলের প্রতি ওহী
হযরত জিবরীল(আঃ) রাসূলকে(সঃ) জানালেন যে, আপনি যায়েদকে তালাক প্রদানের অনুমতি দিন এবং যয়নবকে নিজের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করুন। সমাজের লোকদের মধ্যে এ সত্য প্রতিষ্ঠা করুন যে-
ক) যায়েদ আপনার প্রকৃত পুত্র নয়। সে আপনার অনুগত একজন বিশ্বাসী উম্মত। তার পিতা হচ্ছে হারিসা। সুতরাং তাকে যায়েদ ইবনে মুহাম্মদের স্থলে যায়েদ ইবনে হারিসাই ডাকতে হবে। পালিত হিসেবে সে আপনার অত্যন্ত আপন বটে, তার ত্যাগ-তিতীক্ষা অনস্বীকার্য, কিন্তু তবুও সে আপনার পুত্র নয়। পিতা-পুত্রের বিধান এতে প্রযোজ্য নয়।
খ) আরবে পালক পুত্র বধুকে ঔরসজাত পুত্র বধুর মতই মনে করা হতো। এই কুপ্রথার অবসানকল্পে আপনি যয়নবকে বিবাহ করুন। এটাই আল্লাহ পাকের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
সে সিদ্ধান্তই আল্লাহর রাসূল কার্যকর করেন। এতে কারো কোন সমালোচনায় তিনি বিব্রত হন নাই।
জেহাদে অংশগ্রহণ
যুবক যায়েদ ছিলেন বীর পুরুষ, অত্যন্ত সাহসী। রাসূলে পাকের সাথে একাধিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। বেশ কিছু যুদ্ধে রাসূলে পাক তাকে সিপাহ সালার দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। হযরত ইবনুল আকওয়া বলেন, রাসূল কর্তৃক নিয়োজিত সিপাহসালার যায়েদ ইবনে হারিসার নেতৃত্বে আমি নয়টি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি। হযরত আয়েশা বলেন, যায়েদকে যুদ্ধে পাঠালে রাসূল তাকেই সিপাহসালার দায়িত্ব দিতেন। যুবক যায়েদ যেমন ছিলেন সাহসী বীর পুরুষ, যুদ্ধ বিষয়ে পারদর্শী, কৌশলী, তেমনি ছিলেন আল্লাহর রাসূলের অত্যন্ত বিশ্বস্ত। তাই রাসূল তাকেই সাধারণত আমীর হিসেবে নিয়োগ করতেন। মুসলিম উম্মাহর প্রতি তার অবদান অপরিসীম। আল্লাহ পাক তাকে উপযুক্ত প্রতিদানে ভূষিত করুন।
মুতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ - যায়েদের শাহাদাত বরণ
মুতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ
যুবক যায়েদের ঈমানী শক্তি, রাসূলের প্রতি তার আকর্ষণ সর্বজন স্বীকৃত বিষয় ছিল। তার বীরত্বের বিষয়ে বিশ্ব রাসূল যথার্থভাবেই অবহিত ছিলেন। কারাদাহ, জামূম, ঈছ, তর, হিসমী, উম্মে ফিরকা ইত্যাদি যুদ্ধে যুবক যায়েদ নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং বিজয় অর্জন করেছেন। কিন্তু আসন্ন যুদ্ধ ছিল একটু ভিন্ন ধরণের। কারণ, হারিসা ইবনে উমাইর রাসূলের দাওয়াতী পত্র নিয়ে বছরার অধিপতির কাছে পৌঁছার পূর্বে জর্ডানের মুতা নামক স্থানে গাসোসিনার অধিনায়ক শুরাহবিলের হাতে শহীদ হন। তাকে জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। এ কারণেই মুতা যুদ্ধের সূচনা হয়। এ যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্ব মুসলিম পক্ষে কাকে দেয়া যায় এটাই ছিল চিন্তার বিষয়। কারণ, পরাশক্তি রোম সম্রাট এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে মুকাবিলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তাদের সহায়তার জন্য আরবের মুশরিকরা আরো এক লক্ষ সৈন্য পাঠিয়েছে। সর্বমোট দুই লক্ষ শত্রুবাহিনীর মুকাবিলার জন্য কাকে আমীর নিযুক্ত করা যায় এ নিয়ে রাসূলে পাক গভীরভাবে ভাবছেন। খানিক বাদে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন হাজার মুসলিম সৈন্যের অভিযানে আমীর হিসেবে যুবক যায়েদের নাম ঘোষণা করেন। হযরত জাফর বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার ধারণা ছিল যে, এই যুদ্ধ আঞ্জাম দেয়ার জন্য আপনি আমাকে নিয়োজিত করবেন, যায়েদকে নয়। রাসূলে পাক উত্তরে বললেন, “চুপ থাক! আল্লাহর দরবারে তার কি মকাম তা তোমার জানা নাই।” যুবক যায়েদের মর্যাদা ও মহত্ত্ব সম্পর্কে রাসূল খুব ভালো করেই অবগত ছিলেন। আর ছিলেন বলেই তিনি হযরত জাফরকে এভাবে সতর্ক করেন। অতঃপর রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৈনিকদের নির্দেশ দিলেন- যায়েদ যদি শহীদ হয়ে যায় তাহলে জাফর ইবনে আবী তালিব ঝাণ্ডা হাতে নিবে। আর জাফর শহীদ হয়ে গেলে আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা ঝাণ্ডা হাতে নিবে। যদি সেও শহীদ হয়ে যায় তাহলে মুসলিম সৈনিকগণ তাদের মধ্যে থেকে একজনকে আমীর নিযুক্ত করে তার হাতে ঝাণ্ডা দিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করবে। রাসূলে পাকের এই নির্দেশমালা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই তাৎপর্যপূর্ণ নির্দেশ শুনে যুবক যায়েদ তার শাহাদাত বরণের বিষয়টি অনুমান করে নিতে সক্ষম হন। কিন্তু তিনি বিচলিত নন। তবে প্রাণাধিক প্রিয় নবীর সান্নিধ্য থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ছিল যায়েদের জন্য অসহনীয় ব্যাপার।
যায়েদের শাহাদাত বরণ
হযরত যায়েদ রাসূলের দোয়া নিয়ে মুতার প্রান্তে মাত্র তিন হাজার সৈন্য সহ উপস্থিত হন। শত্রুদের দু’লক্ষ সৈন্যের সমাবেশ প্রত্যক্ষ করে প্রথম পর্যায়ে মুসলিম সৈনিকদের মধ্যে সামান্য ইতস্ততবোধ কাজ করলেও পরিশেষে যুদ্ধ অভিযান শুরু হয়। যুবক যায়েদ নজীরবিহীন অবদান রাখেন এ যুদ্ধে। শত শত শত্রু সৈন্যকে পরাস্ত করে যায়েদ ঈমানের ঝাণ্ডা উড্ডীন রাখেন। তবে এখানেও আল্লাহ পাকের সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে রাসূলের প্রাণপ্রিয় সাহাবী ও সহচর যায়েদ শাহাদাত বরণ করেন। এমনিভাবে এ যুদ্ধে পর্যায়ক্রমে হযরত জাফর ও আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা শাহাদাত বরণ করেন। অতঃপর মহান বীর হযরত খালিদ ইবনে ওলীদের নেতৃত্বে মুসলমানরা যুদ্ধ চালিয়ে দু’লক্ষ কাফের সৈনিকদের পরাজিত করেন। মুসলমানদের অর্জিত হয় পূর্ণ বিজয়।
শাহাদাতের প্রতিক্রিয়া - স্মরণীয় আদর্শ
শাহাদাতের প্রতিক্রিয়া
জুমাদাল উলা অষ্টম হিজরী, ৫৫ বছর বয়সে মুতার ময়দানে হযরত যায়েদ ইবনে হারিসা শাহাদাত বরণ করেন। যায়েদের শাহাদাত বরণের সংবাদ শোনার সাথে সাথে মদীনা পাকে নেমে আসে শোকের ছায়া। ভরাক্রান্ত হৃদয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে বিশ্ব রাসূল সমবেত সাহাবাদের নির্দেশ দেনঃ
استغفروالاخيكم قددخل الجنة وهو يسعي
“তোমরা তোমাদের ভাইয়ের মাগফিরাতের জন্য দোয়া কর, সে দৌড়ে জান্নাতে প্রবেশ করছে।”
রাসূলে পাক স্বয়ং মুনাজাতে বলেনঃ
اللهم اغفر لزيد اللهم اغفر لزيداللهم اغفر لزيدثلاثا
‘হে আল্লাহ পাক! যায়েদকে ক্ষমা করুন, হে আল্লাহ পাক! যায়েদকে ক্ষমা করুন, হে আল্লাহ পাক! যায়েদকে ক্ষমা করুন।’
যায়েদের শাহাদাত বরণের কারণে রাসূলে পাকের দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হলে সাহাবী সাআদ ইবনে উবাদা প্রশ্ন করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার কান্নার হেতু কি? রাসূল বললেনঃ বন্ধুর সাথে বন্ধুর মিলনের আশায়।”
স্মরণীয় আদর্শ
রাসূলের প্রতি আনুগত্য, ভালোবাসা হযরত যায়েদকে যে উর্ধ্ব মকামে সমাসীন করেছিল তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। হ্যাঁ, এ কারণেই রাসূলও তাকে স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। তাকে নিজের পুত্রতুল্য মনে করতেন। তিনি বলতেন, “যায়েদ আমার প্রাণাধিক প্রিয়।” রাসূল এবং যায়েদের মধ্যে কে মহব্বতকারী আর কে যে প্রেমাস্পদ- এ পার্থক্য করা সত্যিই দুষ্কর! ভালোবাসা এবং ভালোবাসার মূল্যায়নের ইতিহাসে যার কোন নজীর নেই।
যায়েদের স্মরণে হযরত আবু বকর (রাযিঃ) - হযরত যায়েদের গুণাবলী
যায়েদের স্মরণে হযরত আবু বকর (রাযিঃ)
যায়েদের প্রতি রাসূলের আকর্ষণ ও ভালোবাসার এ নিদর্শন রাসূলের খলিফা ও সাহাবগণও সমুন্নত রাখেন। সাহাবগণ ছিলেন বিশ্বনবীর আদর্শের প্রতিক। তারা কেবল রাসূলের প্রতিই নয়, বরং যার প্রতি রাসূলের ভালোবাসার দৃষ্টি পড়তো, তার প্রতিও তারা ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। হযরত আবু বকর তার খেলাফল আমলে যায়েদের পুত্র উসামাকে সিপাহসালার মনোনীত করে শামের অভিযান পরিচালনা করেন। উসামা বয়সে ছোট এবং যুবক ছিলেন। এ কারণে খলীফার এই সিদ্ধান্তই ছিল অনেকের বোধগম্যের বাইরে। কিন্তু সে মুহূর্তে হযরত আবু বকরের জোরালো উক্তিতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, এই সিদ্ধান্তের পেছনে যায়েদের প্রতি রাসূলের আকর্ষণ ও স্নেহ বড় ভূমিকা রেখেছে। হযরত রাসূলে পাক যায়েদের পুত্র উসামার প্রতি স্নেহময় দৃষ্টি রাখতেন। আর উসামা তো হযরত যায়েদের পুত্র। যে যায়েদ ব্যক্তি স্বার্থ এবং পার্থিব সম্পর্ককে বর্জন করে বিশ্ব রাসূলের প্রতি আনুগত্যেল বিরল নজীর স্থাপন করেছিলেন, যাকে রাসূল তার জীবদ্দশায় বিভিন্ন যুদ্ধে আমীর নিযুক্ত করেছেন, যাকে রাসূলের সাথে বদর, উহুদ ,খন্দক, খায়বার ও হুদায়বিয়াতে দেখা গেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মরীসিয়ার যুদ্ধে যাওয়ার সময় যায়েদকেই মদীনা পাকে স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন। হযরত আবু বকর এসব কিছু বিবেচনা করেই যায়েদের পুত্র উসামাকে শামের অভিযানে আমীর নিযুক্ত করেন। হযরত উসামার প্রতি হযরত আবু বকরের আকর্ষণ, মায়া ও স্নেহের কথা আজও ইতিহাসে বিদ্যমান। এর মূলেও ছিল যায়েদের প্রতি রাসূলে পাকের মহাব্বত ও ভালোবাসা।
হযরত যায়েদের গুণাবলী
আল্লাহর প্রতি ঈমান, রাসূলের প্রতি আনুগত্য, আখেরাতের আকর্ষণ, দুনিয়অ বিমুখতা, হিম্মত-সাহসিকতা, ইবাদত-রিয়াজত এবং ঈমানী শক্তি যুবক যায়েদের সফলতার পথ সুগম করেছে। হযরত যায়েদ হিজরতের গৌরব অর্জন করেন। রাসূল বলতেন, যায়েদ আমার, আমি তাকে সার্বাধিক ভালোবাসি। পবিত্র কুরআনে সাহাবীদের মধ্যে কেবল যায়েদের নামই উল্লেখ হয়েছে। ইবনে উমর বলেন, “আমার পিতা হযরত উমর (রাযিঃ) উসামা ইবনে যায়েদের জন্য অধিক বেতন বরাদ্দ করলে আমি আপত্তি জানাই। এর উত্তরে হযরত উমর (রাযিঃ) বলেন, “হে ইবনে উমর! চুপ হও, উসামা তোমার তুলনায় রাসূলের অধিক প্রিয় ছিল।” হযরত উমরের এই বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বক্তব্যটি হযরত যায়েদের মর্যাদা ও অবস্থান নির্ণয়ে বিশেষ বিবেচনার দাবী রাখে। মুসনাদে আহমাদে রয়েছে, ইবনে উমরের সূত্রে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন “আমি শুনেছি, তোমরা উসামার নেতৃত্বের সমালোচনা করছ। এর পূর্বে অনেকেই তার পিতা যায়েদের নেতৃত্বের সমালোচনা করতো। তোমরা ভালো করে জেনে নাও, যায়েদ তোমাদের মধ্যে নেতৃত্বে সার্বাধিক উপযুক্ত ছিল। সে ছিল আমার সার্বাধিক প্রিয় ও আস্থাভাজন। তারপর তার পুত্র উসামা আমার সার্বাধিক প্রিয়।” হযরত বুরাইদার সূত্রে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি জান্নাতে প্রবেশ করলে এক যুবতী আমাকে স্বাগত জানায়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি যে, তুমি কার? সে উত্তর দেয় যে, আমি যায়েদ ইবনে হারিসার! হযরত যায়েদের জীবন একটি ঐতিহাসিক জীবন, আদর্শ জীবন, ত্যাগÑতিতীক্ষার জীবন। তার জীবন এ উম্মাহর চলার পথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাথেয়। তিনি মৃত্যুবরণ করেও মুসলিম উম্মাহর নিকট অমর হয়ে আছেন। আল্লাহপাক তাকে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদার অধিকারী করুন। তার জীবন হোক যুব সম্প্রাদায়ের জন্য আদর্শ ও পাথেয়।
তিন. যুবক ইবনে হারুন
ফকীর শাহযাদা
মুসলিম খলীফাদের মাঝে খলীফা হারুনের নাম প্রায় সবারই জানা। আলেম-উলামাদের প্রতি তিনি মোটামুটি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। হযরত ইমাম আবু ইউসুফকে তিনিই চীফ জাস্টিস নিয়োগ করেছিলেন। হযরত ইমাম মালিকের সাথেও তিনি মাঝে মাঝে মুলাকাত করতেন এবং তার নসীহত গ্রহণ করতেন। খলীফা হারুনের এক পুত্র ছিল অত্যন্ত আল্লাহ ভীরু। মাত্র ষোল বৎসর বয়সেই এই যুবক আল্লাহওয়ালা বুযুর্গানে দ্বীনের সাথে সময় কাটাতো। ফলে অল্প বয়সেই সে আল্লাহর মারিফাত এবং বেলায়েত লাভে ধন্য হয়। আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান, রাসূলের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি ও ভালোবাসা তাকে অতি উচ্চ মকামে সমাসীন করেছিল। পিতা হারুন ছিলেন প্রভাবশালী বাদশাহ। রাজ প্রাসাদ এবং একচ্ছত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী। ভোগ-বিলাস এবং সুখ-শান্তির কোন অভাব ছিল না তার। তদুপরি পিতার পর বাদশাহ হওয়ার বিষয়টিও ছিল সুনিশ্চিত। কিন্তু এসব কিছুর দিকে ইবনে হারুনের আগ্রহ ছিল না, বস্তুর প্রতি আকর্ষণ ছিল না মোটেই। অত্যন্ত সরল-সোজা এবং সাধারণ লোকের মত ছিল তার চলাফেরা। যুব রাজের মত নয়, বরং ফকীর-মিসকীনদের মত হয়ে থাকতো সে। ছেড়া-ফাটা কম মূল্যের লুঙ্গি পরে মাথায় কাপড় পেঁচানো অবস্থায় এই যুবক প্রায়ই কবরস্থান যিয়ারতে যেত। সে কবর যিয়ারতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত ও ভরাক্রান্ত হয়ে পড়তো। অনেক সময় কবরবাসীদেরকে সম্বোধন করে বলতোঃ হে কবরস্থ লোকজন! আপনারা আমাদের পূর্বে পৃথিবীতে ছিলেন এবং অনেক সহায়-সম্পদ এবং বাড়ী-ঘরের মালিক ছিলেন। অনেকে রাজা-বাদশাহ ও মন্ত্রী-মিনিষ্টার ছিলেন। কিন্তু এসব বস্তু আপনাদেরকে মৃত্যুর ছোবল থেকে রক্ষা করতে পারে নাই। আপনারা এখন নির্জনে একাকী কবরে বসবাস করছেন। মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন কারো সাথে আপনাদের কোন সম্পর্কই আজ নেই। আহ! যদি জানতে পারতাম আপনাদের কি অবস্থা? কিভাবে আপনারা জীবন-যাপন করছেন? যদি জানতে পারতাম, আপনারা কবরে কি কি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন! অতঃপর ইবনে হারুন এই কবিতা পাঠ করতঃ “জানাযার নামায প্রতিদিন আমাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে। যারা মৃত ব্যক্তিদের জন্য কাঁদে, তাদের কান্না আমাকে অধীর চিত্ত করে তোলে।” এরূপ কবিতা পাঠ করতে করতে সে অস্থির হয়ে কবরস্থানে পড়ে থাকতো।
মন্ত্রীবর্গের পরামর্শ
যুবক ইবনে হারুন একদিন পিতা বাদশাহ হারুনের রাজকীয় সভাকক্ষে হাজির হলে তার জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থা, মাথায় পেঁচানো কাপড়, পড়নে ছেঁড়া-ফাটা লুঙ্গি পরিদর্শন করে মন্ত্রী ও সভাসদবর্গ পরস্পর বলাবলি করতে থাকে যে, এই পাগল ছেলেটির কারণে অন্যান্য রাজা-বাদশাহদের সম্মুখে খলীফা হরুনের ইজ্জত-সম্মান ও প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্ষুন্ন হতে চলেছে। সুতরাং এ ব্যাপারে ত্বড়িৎ কোন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যকীয়। এই ব্যাপারে কোন বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তারা বাদশাহ হারুনকে পর্যন্ত পরামর্শ দিল।
বাদশাহ হারুনের নসীহত
বাদশাহ হারুন মন্ত্রীবর্গের পরামর্শে স্বীয় পুত্রকে বললো, ‘হে পুত্র! তুমি মন্ত্রীবর্গের কথাবার্তা শুনেছো। তুমি কি আমাকে এভাবেই অপদস্থ করতে থাকবে? তোমার অবস্থার কি কোন পরিবর্তন করবে না? হে আমার প্রাণপ্রিয় সন্তান! আমার কি কোন জিনিসের অভাব আছে, যে কারণে তুমি এরূপ জীর্ণ-শীর্ণ, মলিন বেশ ধারণ করে ফকির-মিসকীনের মত হয়ে চলেছ? তুমি আর আমাকে লজ্জা না দিয়ে সঠিক-সুন্দর অবয়বে যুবরাজ হিসেবে চলাফেরা করার প্রতি মনোযোগী হও। তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যত তুমি নষ্ট করো না।’
ইবনে হারুনের কারামত - বিদায়ের করুণ চিত্র
ইবনে হারুনের কারামত
যুবক ইবনে হারুন পিতার নসীহত শ্রবণ করতঃ সাথে সাথে কোন উক্তি করল না। বরং সভা কক্ষে একটি পাখি উপবিষ্ট দেখে পাখিটিকে সম্বোধন করে বললঃ ‘হে পাখি! তোমাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, তার বরাত দিয়ে আমি বলছি, তুমি আমার হাতে এসে বসে যাও।’ বলার সাথে সাথে পাখিটি এসে হাতে বসে যায়। অতঃপর সে আবার বলল, ‘তোমার পূর্বের স্থানে ফিরে যাও।’ বলার সাথে সাথে পাখিটি যথাস্থানে ফিরে গেল।
পিতাকে নসীহত
এই কারামত সংঘটিত হওয়ার পর যুবক ইবনে হারুন পিতাকে বললঃ হে আমার শ্রদ্ধেয় পিতা! আমি আপনার জন্য কোন লজ্জার কারণ নই, বরং বলতে গেলে আপনার রাজ্যশক্তি এবং বস্তুর প্রতি আপনার আকর্ষন আমার জন্য লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমি আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। এই বলে সভাকক্ষ থেকে যুবক ইবনে হারুন বের হয়ে যায়।
বিদায়ের করুণ চিত্র
বাদশার সভাকক্ষ থেকে বের হয়ে এসে মা-জননীর নিকট থেকে সে চির বিদায় গ্রহণ করে। পথের সম্বল হিসেবে একটি কুরআন শরীফ বুকে ধারণ করে নেয়। সন্তানের এই অবস্থা দেখে মা-জননী ভরাক্রান্ত হয়ে পড়েন। বাড়ী-ঘর, রাজপ্রাসাদ, আত্মীয়-স্বজন সবকিছু পরিত্যাগ করে আপনার সন্তানের নিরুদ্দেশ যাত্রার বেদনায় ব্যাকুল হয়ে উঠে মায়ের মন। তবে যাওয়ার পথে মূল্যবান একটি আংটি সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে মা বলেন, তোমার যে কোন প্রয়োজনে আংটিটি বিক্রি করে খরচ করো। অশ্রুসিক্ত মা-জননীর দেয়া আংটিটি ফেরত না দিয়ে শ্রদ্ধা ভরে গ্রহণ করতঃ ইবনে হারুন রাজপ্রাসাদ থেকে চির বিদায় গ্রহণ করে।
যুবকের অছীয়ত - বাদশাহ হারুনের পথযাত্রা - পুত্রের মৃত্যু সংবাদ
যুবকের অছীয়ত
(আবু আমেরের বর্ণনা)
আমাকে অছীয়ত করে সে বলে,
ক) হে আমার বন্ধু! দুনিয়ার আকর্ষণে ধোকাগ্রস্ত হয়ো না। মানুষের জীবন যেমন খতম হয়ে যায়, তেমনি অর্থ-সম্পদও খতম হয়ে যায়। তুমি যখন কোন মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে কবরস্থানে যাও তখন তুমি এই চিন্তাও কর যে, একদিন তোমাকেও এভাবে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে।
খ) হে আবু আমের! আমার মৃত্যু সন্নিকটে, আমার আত্মা বের হয়ে যাওয়ার পর তুমি আমাকে গোসল দিয়ে আমার পুরোনো কাপড়েই আমাকে কাফন পরাবে। আমি বললাম, হে আমার প্রিয় বন্ধু! আমি যদি তোমাকে নতুন কাপড় দিয়ে কাফন পরাই তাহলে দোষের কি আছে?
যুবকটি জবাব দিল, নতুন কাপড় পরার অধিক উপযুক্ত হচ্ছে জীবিত মানুষ। হযরত আবু বকর সিদ্দীকও এরূপই জবাব দিয়েছিলেন। কাফন তো নতুন পুরাতন সবই সমান। কেননা দু’একদিন পরই তা ছিড়ে-ফেটে বিনষ্ট হয়ে যাবে। সাথে থাকবে কেবল তার আমলসমূহ।
গ) যে আমার কবর খনন করবে তাকে আমার লোটা এবং লুঙ্গি হাদিয়া দিয়ে দিও।
ঘ) আর এই আংটি এবং কুরআন শরীফ খানা তোমার নিকট আমানত রাখলাম। তুমি এই আমানতগুলো বাদশাহ হারুনের কাছে পৌঁছিয়ে দিও।
ঙ) মনে রাখবে, অন্য কারো কাছে দিও না, বাদশাহর হাতে দিয়ে তাকে বলবে যে, “এক প্রবাসী এই আমানত আপনার নিকট পৌঁছানোর অছীয়ত করে মৃত্যুবরণ করেছে এবং আপনার উদ্দেশ্যে বলে গিয়েছে, এমন যেন না হয় যে, উদাসীন এবং ধোকাগ্রস্তাবস্থায় আপনার মৃত্যু এসে যায়।”
যুবকের মৃত্যু
আমাকে এরূপ অছীয়ত করে যুবকটি মৃত্যুবরণ করে। তার মৃত্যুতে আমি অত্যন্ত মর্মাহত ও দুঃখিত হই এবং বুঝতে পারি যে, যুবকটি বাদশাহ হারুনেরই পুত্র। মৃত্যুর পর অছীয়ত মুতাবেক তার কাফন-দাফন সমাধা করি। লুঙ্গি ও লোটা কবর খননকারীকে দিয়ে দেই। আর পবিত্র কুরআন ও আংটি নিয়ে বাদশাহ হারুনের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বাগদাদে রওয়ানা হই।
বাদশাহ হারুনের পথযাত্রা
আমি যখন রাজপ্রাসাদের কাছাকাছি পৌঁছি তখন দেখতে পাই যে, বাদশাহ হারুনের পথযাত্রা শুরু হয়েছে এবং অসংখ্য অশ্বারোহী দলে দলে এগিয়ে আসছে। প্রতি দলে রয়েছে এক হাজার করে অশ্বারোহী। এ অবস্থা দেখে আমি উঁচু একটি স্থানে দাড়িয়ে বাদশাহ হারুনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। এভাবে দু’শ নম্বর সারিতে দাড়িয়ে বাদশাহকে একটি অবস্থানে উপবিষ্ট দেখে আল্লাহর রাসূলের আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে একটু কথা বলার জন্য বাদশাহর নিকট আবেদন জানাই। আমার আবেদনের ধ্বনি শুনে বাদশাহ আমার দিকে তাকালে আমি দ্রুত তার দিকে অগ্রসর হই এবং নিকটে পৌঁছি।
পুত্রের মৃত্যু সংবাদ
বাদশার নিকট পৌঁছে আমি বলি, “প্রবাসী এক যুবক পবিত্র কুরআন এবং এই আংটি আমার কাছে আমানত রেখে আপনার কাছে পৌঁছানোর অছীয়ত করতঃ মৃত্যুবরণ করেছে। তাই আমি এই আমানত আপনার নিকট পৌঁছানোর জন্য বসরা থেকে বাগদাদে হাজির হয়েছি। যুবকটি এখন আর পৃথিবীতে নেই। সে মৃত্যুবরণ করেছে এবং বসরার যমীনেই তাকে দাফন করা হয়েছে।
বাদশার মনে প্রতিক্রিয়া
বাদশাহ হারুন পবিত্র কুরআন ও আংটি দেখে বিষয়টি বুঝতে সক্ষম হন এবং অশ্রুসিক্ত নয়নে শীর নীচু করে নীরবতা অবলম্বন করেন। অতঃপর ভরাক্রান্ত মনে একজনকে বললেন, “এই লোকটিকে তোমার সাথে রাখ। আমি পথযাত্রা শেষে ফিরে এসে যখন ডাকি তখন আমার কাছে তাকে পৌঁছাবে।” এরপর বাদশাহ হারুন পথযাত্রা সমাপ্ত করে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করতঃ স্বীয় কামরার পর্দা টেনে লোকটিকে বলল, “বসরার লোকটির বক্তব্য যদিও আমার অন্তরের দুঃখ-বেদনা বৃদ্ধির কারণ হবে তবুও তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।”
বাদশার দরবারে আবু আমের - পুত্রের কবর যিয়ারত
বাদশার দরবারে আবু আমের
রাজ দরবারের লোকটি দ্রুত এসে বলল, “বাদশাহ আপনাকে স্মরণ করেছেন। তবে শুনুন পুত্রের মৃত্যু সংবাদে বাদশাহ অত্যন্ত মর্মাহত ও দুঃখিত অবস্থায় আছেন। তাই অল্প কথায় সংক্ষিপ্তভাবে কাজ সেরে নিবেন, দশ কথার স্থলে পাঁচটির দ্বারা কাজ সেরে নিবেন।” এই বলে আমাকে বাদশার দরবারে সে হাজির করে। আমি গিয়ে দেখি যে, অত্যন্ত মর্মাহত ও কাতর অবস্থায় বাদশাহ একাকী বসে আছেন। তিনি আমাকে তার খুব নিকটে বসিয়ে প্রশ্ন করেন এবং আমি সেই প্রশ্নের উত্তর দান করি।
বাদশাহ হরুনঃ তুমি আমার এই ছেলে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত আছ কি?
আবু আমেরঃ হ্যাঁ বাদশাহ! আমি তার সম্পর্কে অবগত আছি।
বাদশাহঃ সে কি কাজ করত?
আবু আমেরঃ সে দিন মজুরীর কাজ করত।
বাদশাহঃ তুমি কি কখনো তার দ্বারা কাজ নিয়েছ?
আবু আমেরঃ হ্যাঁ, আমিও তার দ্বারা কাজ নিয়েছি।
বাদশাহঃ সে তো রাসূলের আত্মীয় এবং তাঁর চাচা হযরত আব্বাসের বংশধর। সুতরাং তুমি তাকে দিয়ে কি করে মজদুরীর কাজ নিলে?
আবু আমেরঃ হে আমীরুল মুমিনীন! সর্বপ্রথম আমি আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করছি, অতঃপর আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আসলে আমি তখন তার বিষয়ে জানতে পারি নাই। আমি কেবল তার মৃত্যুর সময় অবগত হই যে, সে আপনার পুত্র।
বাদশাহঃ তুমি কি স্বয়ং তার দাফন-কাফন করেছ?
আবু আমেরঃ জী হ্যাঁ, আমি স্বয়ং কাফন-দাফনের কাজ সমাধা করেছি।
এই কথা শুনে বাদশাহ আমার হাত টেনে নিয়ে স্বীয় বক্ষে ধারণ করতঃ কবিতা পাঠ করেন। যে কবিতার সারমর্ম হচ্ছে এই-
হে মুসাফির! তোমার বিচ্ছেদ-বেদনায় আমার হৃদয় জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তোমার জন্য আমি অধীর এবং অশ্রুসিক্ত। হে মুসাফির! তোমার বাসস্থান (কবর) এখন কত দূরে? তবে হ্যাঁ, তোমার জন্য দুঃখ-বেদনা আমার অন্তরের অতি নিকটে। সত্যিই মৃত্যু মানুষের স্বাদ এবং সমস্ত প্রশান্তিকে মিটিয়ে দেয়। আহ! ঐ মুসাফিরের মুখমণ্ডল যেন চাঁদের টুকরা, যা রূপার থালার ন্যায় কোমল শরীরে বিদ্যমান। কিন্তু অবশেষে চাঁদের ঐ টুকরা (মুখমণ্ডল) এবং রূপার থালা (শরীর) কবরে সমাহিত হলো।”
বাস্তবিকই মৃত্যু কাউকে পরোয়া করে না, তার ছোবলে সকলকে আক্রান্ত হতে হয়।
পুত্রের কবর যিয়ারত
অতঃপর বাদশাহ হারুন আমাকে নিয়ে প্রিয় পুত্রের কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বসরায় গমন করেন এবং কবরের পার্শ্বে দাড়িয়ে নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করেনঃ
অল্প বয়সে মৃত্যু তোমাকে কোলে তুলে নিয়েছে। হে মুসাফির! আমি জানি তুমি আর কোনদিন ফিরে আসবে না। হে আমার কলিজার টুকরা, নয়নমণি! অন্তরের প্রশান্তি! কেবল তুমিই ছিলে আমার আশার আলো, দীর্ঘ রাতে এবং অদীর্ঘ রাতেও। যুবক বয়সে তুমি মৃত্যুর যে শুরা পান করেছ তা তোমার বৃদ্ধ পিতা বৃদ্ধ বয়সে পান করবে। মৃত্যুর শুরা সবাইকে অবশ্যই পান করতে হবে। চাই সে মরুভূমিতে বসবাসকারী হোক অথবা রাজপ্রাসাদে বসবাসকারী হোক। বস্তুতঃ সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লাহপাকের জন্য, যার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তাঁর সিদ্ধান্তের কোন বিকল্প নেই।
আবু আমেরের স্বপ্ন - স্বপ্নের হাকীকত
আবু আমেরের স্বপ্ন
যিয়ারতের পরবর্তী রাত্রে আমি স্বপ্নে নূরের একটি বিরাট গম্বুজ দেখতে পাই। গম্বুজের উপর কেবল নূর আর নূর। সেই নূরে উপবিষ্ট বাদশাহ হারুনের সেই যুবক পুত্র আমাকে সম্বোধন করে বলছেঃ হে আবু আমের! তুমি আমাকে অতি উত্তমরূপে দাফন-কাফন করেছ। আমার অছীয়ত সমূহ যথাযথভাবে পূরণ করেছ এবং আমার আমানত যথাস্থলে পৌঁছিয়েছ। আল্লাহপাক তোমাকে উত্তম প্রতিদান দান করে সৌভাগ্যবান করুন। আমি যুবককে জিজ্ঞাসা করলাম, হে আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু! আল্লাহপাক তোমার সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন? সে বললঃ “হে আবু আমের! আমি যে মাওলার চরণে এসেছি তিনি তো পরম দয়ালু ও করুণাময়। তিনি আমার প্রতি অতি সন্তুষ্ট। তিনি আমাকে যা দান করেছেন, তা চোখ কখনো দেখেনি, কান কখনো শুনেনি এবং অন্তরও অনুভব করেনি। আমি তোমাকে আল্লাহর কসম করে বলছি, যে কেউ দুনিয়া থেকে আমার মত এখানে চলে আসবে, তার জন্যও রয়েছে ঐ সম্মান ও মর্যাদা- যা আমি লাভ করেছি।”
আদর্শ সন্তান
বাদশাহ হারুনকে তাঁর পুত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “আমি বাদশাহ হওয়ার পূর্বে তার জন্ম হয়। অতি উত্তমরূপে তার লালন-পালন করা হয়। পবিত্র কুরআন ও দ্বীনী শিক্ষায় সে শিক্ষিত হয়। ফলে বস্তু জগতের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল না মোটেই। পরবর্তী সময়ে আমার উপর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ন্যাস্ত হয়, কিন্তু সেদিকে তার মোটেই ভ্রুক্ষেপ ছিল না। সে কোন দিন আনন্দ-উল্লাসের প্রতি আকৃষ্ট হয় নাই। আমার থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার সময় আমি তার মা-জননীকে মূল্যবান আংটিটি তাকে দিতে বলি। সে তাও খরচ করে নাই, বরং ফেরত দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। সে তার মা-জননীর প্রতি ছিল অত্যন্ত আনুগত্যশীল।
স্বপ্নের হাকীকত
আবু আমের যুবকটিকে নূরের গম্বুজে উপবিষ্ট দেখেছে। যুবক তার প্রতি আল্লাহ পাকের করুণা ও দয়ার কথা তাকে অবহিত করেছে। যারা তার মত জীবন যাপন করবে, পরকালে রয়েছে তাদের জন্য সম্মান-মর্যাদা ও মহান আল্লাহপাকের নৈকট্য- যুবক তার বক্তব্যে এই সুসংবাদও প্রদান করেছেন। রাসূলের স্বপ্ন ব্যাতীত আর কারও স্বপ্ন অকাট্য প্রমাণ নয়, একথা সত্য। কিন্তু মুসলমানের স্বপ্ন যে মিথ্যা নয়, একথাও পবিত্র হাদীসে বর্ণিত রয়েছে। মুসলিম শরীফের হাদীসে রাসূলে পাক (সাঃ) ইরশাদ করেনঃ মুমিনের স্বপ্ন অধিকাংশই সত্য হয়। অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে যে, নবুওয়াতের দ্বার রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই আর নবীও আসবে না, ওহীও আসবে না। তবে সুসংবাদ হিসেবে মুমিন-মুসলিমগণ স্বপ্ন দেখবে। স্বপ্নের মাধ্যমে যা কিছু প্রাপ্ত হবে, যদি সেসব শরীয়তের মূলধারা, অকাট্য প্রমাণাদি ও হুকুম-আহকামের প্রতিকূলে না হয়, তাহলে সেগুলোকে সুসংবাদ এবং সতর্ক সংকেত হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। এ কারণেই মুসলিম মনীষীগণ স্বপ্নের গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণাদি বিদ্যমান রয়েছে।
বাদশাহ হারুনের পুত্র এই যুবকের জীবনাদর্শ ও তার অবস্থা পর্যালোচনা করলে যে সমস্ত গুণাবলী প্রকাশ পায়, পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে এই সমস্ত গুণাবলীর প্রতিদানের সাথে আবু আমেরের স্বপ্নের যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়।
ইবাদত-রিয়াজত - দুনিয়ার প্রতি বৈরাগ্য
ইবাদত-রিয়াজত
মানুষকে আল্লাহপাক অগণিত নেয়াতম দান করেছেন। তাই নেয়ামত যাতে দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং আরো বৃদ্ধি পায় সেজন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রতি দিক-নির্দেশনা করেছেন। পক্ষান্তরে অকৃতজ্ঞদের প্রতি মাহরূমী-বঞ্চনা ও শাস্তির সতর্কবাণী প্রচার করেছেন। কৃতজ্ঞতার মূলসূত্রই হচ্ছে, আল্লাহর প্রতি ঈমান। ঈমান হচ্ছে সর্বোপরি বৃহত্তম নেয়ামত। এ নেয়ামতের হেফাজত এবং তা বৃদ্ধি ও শক্তিশালী করার জন্য আল্লাহপাক দেহকে সহায়ক করেছেন। দেহকে শক্তিশালী করার জন্য পানাহার সামগ্রী এবং রকমারী খাদ্যদ্রব্যের ব্যবস্থা করেছেন। মানুষ তা ভক্ষণ করে দেহকে শক্তিশালী করে থাকে। কিন্তু মানুষের জীবনে দেহই যে মূলবস্তু নয়, তা বুঝা যায় মৃত্যুর ঘটনায়। আত্মার সহচর্যে দেহ সক্রিয় থাকে, আর আত্মা বের হয়ে গেলে মৃত্যুর ঘোষণা দেয়া হয়। অথচ দেহ তখনও বিদ্যমান। এখান থেকেই বুঝা যায় যে, মূল বস্তু দেহ নয়, বরং আত্মা। আত্মার কারণেই দেহ ক্রিয়াশীল হয়। এই আত্মাকে পরিপুষ্ট ও শক্তিশালী করার জন্যও আল্লাহপাক ব্যবস্থা করেছেন। ঐ ব্যবস্থার নামই হচ্ছে ইবাদত-রিয়াজত। আত্মার মধ্যে রকমারী পুষ্টিকর ভিটামিন পরিবেশনের প্রয়োজনে নফল, সুন্নাত, ওয়াজিব ও ফরজসহ বিভিন্ন ধরণের ইবাদত-রিয়াজতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যারা এই তত্ত্ব ও রহস্য অনুধাবনে অক্ষম, তারা দেহকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। আত্মার ব্যাপারে তারা থাকে উদাসীন। আর যারা এ সত্য অনুধাবনে সক্ষম হয় তারা দেহের তুলনায় আত্মার প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। আত্মার পরিশুদ্ধির তাগিদে যারা অধিক হারে ইবাদত-রিয়াজত করে, তারা এ কারণেই করে থাকে। কনকনে শীতের ভিতরে অজু-গোসল ও রাতের আঁধারে তাজাজ্জুদ আদায়ে এ অনুভূতি তাদের সহায়ক হয়। এই অনুভূতিই বাদশাহ হারুনের পূত্রকে ইবাদত-রিয়াজতে অনুপ্রাণিত করত। দিনমজুরী করে তাকে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে, কিন্তু সে মুহূর্তেও স্থায়ী জীবনের স্থায়ী উপকরণ সংগ্রহের জন্য মালিকের কাছে নামায আদায়ের শর্ত আরোপ করত। শুধুমাত্র সপ্তাহে একদিন বস্তুগত জীবনের উপকরণের জন্য পরিশ্রমে অভ্যস্ত ছিল, আর অবশিষ্ট্ দিন-রাত আল্লাহ পাকের ইবাদত-রিয়াজত, তেলাওয়াত ও আল্লাহর তাসবীহ-তাহলীল ও জিকিরে নিমগ্ন থাকতো। কারণ সে জানত, প্রকৃতপক্ষে স্থায়ী জীবন হচ্ছে পরকালের জীবন। সুতরাং অনন্ত জীবনের জন্য কিছু করা প্রয়োজন। বরং আখেরাতের জন্য অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রস্তুতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর বস্তু জগতের জন্য কেবল পথিকের প্রয়োজনীয় সম্বলই যথেষ্ট।
দুনিয়ার প্রতি বৈরাগ্য
আখেরাতের প্রতি অনুরাগ, মৃত্যুর প্রস্তুতি গ্রহণ এবং দুনিয়ার প্রাতি বৈরাগ্য সাফল্যের পূর্ব লক্ষণ। হযরত ইবনে মাসউদের হাদীসে রাসূলে পাক (সাঃ) স্বয়ং এরূপ উক্তি করেছেন। বাদশাহ হারুনের পুত্র যুবকের জীবনে এর পুরোপুরি বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। আখেরাতের প্রতি অনুরাগ তার শাহী তখত-তাজ পরিত্যাগ করতে সাহায্যকারী হয়। রাজকীয় বিলাসিতার পরিবর্তে দিনমজুরী করে জীবন যাপনে সহায়ক হয়। দুনিয়া বিরাগের মন-মানসিকতা ও হিম্মতের ফলে সে নিজেকে একজন পথিক মনে করতো। একটি থলী, এক জিলদ কুরআন শরীফ ছিল তার সহায়-সম্পদ। জঙ্গল আর মরুভূমি ছিল তার বাসস্থান, জমাট মাটি ছিল তার বিছানা, আর ইট ছিল তার তাকিয়া-বালিশ, পড়নের ছিড়া-ফাটা কাপড় ছিল তার পোষাক-পরিচ্ছদ। মা জননীর মূল্যবান আংটি অতি সতর্কতার সাথে সংরক্ষণ করে সে ফেরত দেয়ার অছিয়ত করে যায়। পুরোনো কাপড়ে কাফন পরিয়ে দাফন করার জন্য পথিক বন্ধুকে নছীহত করে। আর তার ব্যবহৃত একটি লোটা ও লুঙ্গি কবর খননকারীকে উপহার দেয়ার শেষ অছিয়ত করে চিরকালের আবাসস্থলে সে চলে যায়। আছে কি এমন কোন যুবক, যে এই যুবকের আদর্শ সমুন্নত রেখে যুব সমাজে ইতিহাসকে আলোকিত ও চমৎকৃত করবে !!!
চলবে ইনশাল্লাহ।
২য় পর্বঃ
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১২ দুপুর ২:১৮