মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান দা. বা.
সৎলোকের সংশ্রব
পবিত্র কুরআন ও হাদীসে সৎলোকের সংশ্রব ও সান্নিধ্য লাভের প্রতি গুরুত্ব আরোপ এবং অসৎ লোকের সাথে চলাফেরা ও উঠা-বসা থেকে দূরে থাকার ব্যপারে হুঁশিয়ারী ব্যক্ত করা হয়েছে। কেননা সংশ্রব অত্যন্ত ক্রিয়াশীল। সংশ্রব যেরূপ হয়, মানুষ সাধারণত সেরূপ ভাবেই গড়ে ওঠে। প্রসিদ্ধ মনীষী আফলাতুন তার একান্ত ভক্তকে নসীহত করেছিলেন, “অসৎ লোকের সহচর্যে বসো না। কেননা, তোমার অজ্ঞাতে তার অসৎ চরিত্র তোমার চরিত্রে অনুপ্রবেশ করবে।” এ যুবকটি ছিল একান্ত বেদ্বীন ও ধর্মহীন পরিবেশে লালিত-পালিত। তদুপরি বাদশাহ নিজ তত্ত্বাবধানে তাকে যাদুবিদ্যা শিক্ষা করার জন্য নিয়োজিত করে। কিন্ত এ যাদু শিক্ষার অবসরে যুগশ্রেষ্ঠ ওলী আল্লাহর সোহবত ও সংশ্রব লাভের সুযোগ তার হয়। আল্লাহ তায়ালা বুযুর্গের এ সংশ্রবই যুবকের মাধ্যমে পুরো জাতির ঈমান ও ইসলাম গ্রহণের উপায় হয়ে দাড়ায়। এজন্য আল্লাহওয়ালাদের সোহবত ও সান্নিধ্য অত্যন্ত জরুরী। এক্ষেত্রে মাতা-পিতা ও অভিভাবকদের অবহেলায় অসংখ্য যুবকের জীবন ধ্বংস হচ্ছে। যুবকদের স্বীয় জীবনকে পাপাচার ও ধর্মহীনতায় লিপ্ত করে ধ্বংস করা উচিত নয়। বরং বর্ণিত এ মহান যুবকের জীবনকে পাথেয় করে ওলী-বুযুর্গদের সোহবত ও সান্নিধ্য লাভ করা বাঞ্ছনীয়। এই যুবকের আদর্শ গ্রহণ করতঃ যৌবনের তাড়না-বাসনা পরিহার করে স্রষ্টার পরিচয় লাভ করা এবং বস্তু জগতের কামিয়াবীর সাথে সাথে আখেরাতের অনন্ত জীবনের শান্তি-সফলতার পথ অবলম্বন করাই যুবকদের সাফল্য ও মুক্তির একমাত্র পথ।
যুবকের আধ্যাত্মিক শক্তি - আল্লাহর দরবারে মুনাজাত
যুবকের আধ্যাত্মিক শক্তি
শারীরিক শক্তিই মানুষের মূল শক্তি নয়। প্রকৃত শক্তি হচ্ছে রূহানী বা অধ্যাত্মিক শক্তি। মূলতঃ কামিয়াব সেই, যে শারীরিক শক্তির সাথে সাথে আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হতেও সক্ষম হয়েছে। শারীরিক শক্তি অর্জনের জন্য বিভিন্ন ধরণের খাদ্য-দ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষ সবল ও শক্তিশালী হয়; অন্যথায় নয়। তেমনি রূহানী ও আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জনের জন্য রয়েছে ইবাদত, রিয়াজত ও বিভিন্ন ধরণের হুকুম-আহকাম। মোটকথা শরীয়তের সঠিক সুন্দর অনুশীলনই হচ্ছে আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার একমাত্র উপায়। এ যুবক শুধু নামের ইসলাম গ্রহণ করে নাই, বরং সে ছিল ইসলামের যথার্থ মূল্যায়নকারী মুসলিম যুবক। সে একনিষ্ঠভাবে শরীয়ত অনুশীলনের বদৌলতে বিরাট আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করে এবং আল্লাহর মারিফাত ও নৈকট্য লাভের অধিকারী হয়। এক্ষেত্রে তার সুনাম-সুখ্যাতি তার প্রতি আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা ভক্তি করে। সে যেমন মানুষের রোগ-ব্যধি ও বস্তুগত সমস্যা সমাধানে অবদান রেখে তাদের নানবিধ উপকার করে, তেমনি জনগণের ঈমান ও আখেরাতের মুক্তির জন্যও ভূমিকা রাখে। তার এসব কিছুর মূলে ছিল তার রূহানী শক্তি ও আধ্যাত্মিকতা। তার আধ্যাত্মিক সুখ্যাতির আকর্ষণেই মন্ত্রী তার দরবারে হাজির হয়। যুবক তার আধ্যাত্মিক শক্তির সাহায্যে কেবল মন্ত্রীর জড় চোখেই আলো ফুটায় নাই, বরং তার অন্তর চোখেও দৃষ্টিদানে সক্ষম হয়। তাই যুবকের হাতে মন্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করে চির ধন্য হয়। কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে, যুবক সেজন্য কোন অহংকার করে নাই। বরং আল্লাহ পাকের প্রতি চরম ও পরম আনুগত্যের দৃষ্টান্ত কায়েম করে। সে মন্ত্রীকে বলে এসব কিছু আমার ক্ষমতা নয়, বরং পরম করুণাময় আল্লাহ পাকের ক্ষমতা ও রহমতের ফলাফল। এই যুবকের আধ্যাত্মিক শক্তি যেমন জনগণের ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে, তেমনি সহায়ক হয়েছে তার নিজের জন্যও। সর্বপোরি সে অনুসরণীয় আদর্শ হয়েছে আল্লাহর পাণে আগুয়ান বিশ্ব যুবসমাজের জন্য।
আল্লাহর দরবারে মুনাজাত
আল্লাহ পাকের দারবারে মুনাজাত করে স্বীয় প্রয়োজন মিটানো মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্বল। কিন্তু এক শ্রেণীর মানুষ ও বিষয়ে এতো উদাসীন যে, তারা তো নিজেরা কোন দিন আল্লাহর দরবারে নতশীর হয় না, প্রার্থনাও করে না। অপর দিকে বলে বেড়ায় যে, ‘কই আল্লাহতো মুনাজাত কবুল করে না? কতবার দুআ-মুনাজাত করানো হলো, অথচ ফল হয় না।’ আসলে এ হল বুঝের ভুল। আল্লাহ পাক মুমিনের মুনাজাত অবশ্যই কবুল করেন। তবে মুনাজাতে যে বিষয়টি কামনা করা হয়, সে বিষয়টি যদি মুনাজাতকারীর জন্য অমঙ্গলজনক হয়, তাহলে এর পরিবর্তে তার জন্য মঙ্গলজনক কোন কিছু নির্ধারণ করা হয়। অনেক সময় আখেরাতে জন্য জমা রাখা হয়, আবার কখনো সময়ের ব্যবধানে ফল প্রকাশ করা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, বিপদ মুক্তির জন্য দোয়া করেও কোন ফল পাওয়া যায় না, একথা ঠিক। এর অন্যতম কারণ হলো, যার বিপদমুক্তির জন্য মুনাজাত করা হয়, সে নিজে বিপদের কারণসমূহ পরিহার করে না। যার জন্য মুনাজাত করা হয়, সে যদি সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার, মদ্যপান, গীবত,খিয়ানত, মিথ্যা, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, হত্যা, পাপাচারিতা ও অপরাধে লিপ্ত থাকে, আল্লাহর হুকুম-আহকামের পরোয়া না করে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে, তাহলে তার ক্ষেত্রে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত কবুল হবে কি করে? মূল বিবেচ্য বিষয় এটাই। তা না হলে এই যুবকের বেলায় আল্লাহ পাক মুনাজাত কবুল করলেন কি করে? তাকে পাহাড়ের চূঁড়া থেকে নিক্ষেপ করতে গিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা নিজেরাই ভূমিকম্পে আক্রান্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে গেল। তাকে যারা সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়ার পায়তারা করেছিল, তারা নিজেরাই পানিতে ডুবে জাহান্নামী হলো। এতে কি প্রমাণ হয় না যে, আল্লাহ পাক মজলুমের মুনাজাত কবুল করেন। তবে এর জন্য প্রয়োজন এই যুবকের মত মানষিকতার এবং আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান ও একীনের। পক্ষান্তরে যাদের মধ্যে এসব গুণ নেই, তাদের নিজেদের দোয়া যেমন কবুল হয় না, তেমনি তাদের জন্যে কৃত অন্যের দোয়াও কবুল হয় না। যুবকের এই ঘটনা যেমন বিশ্ব যুব সম্প্রদায়ের জন্য আদর্শ তেমনি শিক্ষণীয় পাপাচারি জালিমদের জন্যও।
হকের দাওয়াত - যুবকের দৃঢ়তা
হকের দাওয়াত
যুবকটিকে বাদশাহ নসীহত করে বলেছিল, তুমি আমার খুবই প্রিয় এবং স্নেহের পাত্র। আমার অনুকম্পা ও সাহায্য সহযোগিতায় তুমি লালিত-পালিত। সুতরাং, একত্ববাদের আকীদা বর্জন করে আমার প্রতি আনুগত্য কর এবং আমার ইহসানের জন্য কৃতজ্ঞ হও। যুবক উত্তরে বলেছিল যে, বাদশাহ! আপনার ইহসানের কথা আমি স্বীকার করি, কিন্তু এসব কিছুর পরও আমি আপনার আহ্বানের সাড়া দিতে অক্ষম। কেন সে অক্ষম? এজন্য যে, বাদশাহর আহ্বান ছিল আল্লাহর বিরুদ্ধে বাতিল গ্রহণের দিকে, এরূপ আহ্বানের কেউ সাড়া দিতে পারে না। সে যত অধিক ইহসানই করুক না কেন, আল্লাহ পাকের তুলনায় অধিক ইহসান মানুষের উপর আর কারও নেই। মানুষকে আল্লাহ পাক সৃষ্টি করেছেন এবং অতি সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন। আবার তার কাছেই মানুষকে ফিরে যেতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই। তাই বাদশাহর গলদ আহ্বানে যুবক সাড়া দিতে পারে নাই। তবে তার ইহসানের বদলা হিসেবে যুবক তাকে বাতিল পরিহার করে হকের প্রতি আহ্বান করে, যাতে হক গ্রহণ করে পার্থিব জগতেও নিরাপদ হতে পারে এবং আখেরাতের অনন্তকালের জীবনেও শান্তি ভোগ করতে পারে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সম্মুখে যুবকের এই সাহসী পদক্ষেপ একদিকে তার ইহসানের বদলা দেয়ার মন-মানসিকতা ও হিম্মতের পরিচয় বহন করে, অপরদিকে সত্যের আহ্বান প্রচারে তার আত্মিক ব্যাকুলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পেশ করে। সত্যি, কতইনা সফলকাম এরূপ যুবকের জীবন।
যুবকের দৃঢ়তা
হকের উপর দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারী হয়ে হকের উপর বিদ্যমান থাকা কেবল শরীয়তের চাহিদাই নয়, বরং মানবতার চাহিদাও বটে। কিন্তু এই পথে রয়েছে বহু ধরণের জটিলতা, ঘাত-প্রতিঘাত। এ ঘাত-প্রতিঘাতের মুকাবিলা করেও যারা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তাদেরও অনেক মায়া-মমতা ও পদমর্যাদার লোভে বাতিলের স্রোতে ভেসে যায়। বর্তমান পরিবেশেও এর নজির বিরল নয়। কিন্তু মহান এই যুবক এক ভিন্ন ধরণের যুবক। তাকে মন্ত্রীত্বের পদমর্যাদা দানের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, অন্যথায় হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে, পাহাড়ের চূঁড়া থেকে নিক্ষেপের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং সব শেষে তাকে শহীদ করা হয়েছে কিন্তু এই যুবক ভীত-সন্ত্রস্ত হয় নাই। পদমর্যাদার লোভ তাকে কাতর করতে পারে নাই। এক্ষেত্রে প্রভুর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস তাকে সহায়তা করেছে। জুলুম-নির্যাতনে সে ধৈর্য ধারণ করেছে। এভাবে সে একদিকে খাঁটি বান্দার পরিচয় পেশ করেছে, অপরদিকে বিশ্ব মানব ও যুব সমাজের জন্য আদর্শ স্থাপন করেছে। এসব মুহূর্তে তার প্রতি আল্লাহর করুণা, দয়া-মায়া ও রহমত অনন্তকালের জন্য বিশ্ব যুবকদের চলার পথের পাথেয় হিসাবে কাজ করবে।
আল্লাহর পথে শহীদ - জুলুমের পরিণাম
আল্লাহর পথে শহীদ
শহীদ একটি ইসলামী পরিভাষা। ক্ষমতা দখলের জন্য কিংবা বস্তুগত হীনস্বার্থ উদ্ধারের জন্য নয়, বরং নিঃস্বার্থভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তার নির্দেশ পালনার্থে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য কাফেরদের সাথে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করে যে সব মুসলিম, তারাই কেবল শহীদের মর্যাদা লাভ করতে পারবে। তারা হয়ে থাকে বিনা হিসাবে জান্নাতী। এরূপ শহীদানের সংখ্যা ইসলামের ইতিহাসে কম নয়। ইসলামের জন্য যে সমস্ত যুবক শহীদ হয়েছে তাদের জীবনী আজও ইতিহাসের পাতায় অলংকৃত হয়ে আছে। কিন্ত আমরা যে যুবকের জীবনী চর্চা করছি, তার শাহাদাতের বিষয়টি একটু ভিন্ন ধরণের। এই যুবকের একটি জীবনে অসংখ্য জীবনের সমাগম ঘটেছিল। ফলে একটি জীবনের আত্মদান লক্ষ জীবন উৎসর্গ করার প্রেরণাদায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। যুবক নিজেকে দ্বিধাহীন চিত্তে শাহাদাতের জন্য পেশ করেছে। আত্মহত্যার তাগিদে নয়, আল্লাহর তাকভীনী নির্দেশে। তাই আল্লাহ পাক তাকে স্বীয় সান্নিধ্যে স্থান দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা তার শাহাদাতের মাধ্যমে একটি জাতিকে পৌত্তলিকতার বন্ধন মুক্ত করে একত্ববাদের শীতল ছায়ায় স্থান দান করেছেন। এখানে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেছিলেন তাই হয়েছে। তবে তা হয়েছে বিশ্বের একজন যুবকের মাধ্যমে। যুবক নিজেকে শাহাদাতের মর্যাদায় সমাসীন করেছে তার একটি জাতি তার শাহাদাতের বরকতে একত্ববাদের প্রতি সমর্থন দিয়ে সর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। আজকের যুবকগণ কি ইতিহাসের মহান এই যুবক ভাইয়ের জীবনকে স্মরণ করে? আজকের যুবকরা কি পারে না যুব সমাজের ইতিহাসকে কলঙ্কমুক্ত রাখতে?
জুলুমের পরিণাম
সদাচরণ ও ন্যায়ের পরিণাম হয় শুভ ও সুফলদায়ী। পক্ষান্তরে কুফরী ও জুলুমের পরিণাম হয় অধঃপতন এবং ধ্বংস। প্রকৃতির এই বিধানের কোন ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু ক্ষমতা, বস্তু ও জড়বাদের মোহ মানুষকে এই সত্য অনুধাবনে অন্ধ ও উন্মাদ করে তোলে। আল্লাহ পাকের ওলী ও ওলামা-মাশায়েখদের সাথে এক শ্রেণীর অভিশপ্ত ও হতভাগ্য লোক বেয়াদবীমূলক আচরণ করে নিজেদেরকে ধ্বংস করে থাকে। যখন তাদের উপর আল্লাহ পাকের কঠোর আজাব নাযিল হয় তখন আর তাদের কোন উপায় থাকে না। না আসে কেউ তাদেরকে সাহায্য করতে, না তাদের ক্ষমতা, অর্থ-সম্পদ তাদেরকে রক্ষা করতে পারে। এই যুবককে কেন্দ্র করেও আল্লাহ পাকের সেই বিধান কার্যকর হয়েছে। ফলে কেবল বাদশাই নয়, বরং তার রাজ পরিষদ সহ সমস্ত আপনজন স্বীয় হস্তে তৈরী অগ্নিতে জ্বলে-পুড়ে ধ্বংস হয়েছে। আল্লাহ পাক তার প্রিয় বান্দাদের প্রতি নির্যাতনকারীদের থেকে এভাবেই প্রতিশোধ গ্রহণ করে থাকেন। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ভাইয়ের জন্য কূপ খনন করে যে, সে নিজেই সেই কূপে পড়ে ধ্বংস হয়।
দুই. যুবক যায়েদ ইবনে হারিসা (রাযি.)
স্নেহের কোলে
যায়েদ ইবনে হারিসা ইয়েমেনের সম্ভ্রান্ত পরিবার বনী কুজায়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হারিসা ও মা জননী সু’দা তাকে অত্যন্ত স্নেহ-মমতায় লালন-পালন করেন। দুঃখ-কষ্ট কি জিনিস সে কোনদিন দেখে নাই, অনুভবও করে নাই। মানুষ মানুষকে ভালোবাসে, আদর-যত্ন করে, যায়েদ কেবল তাই জানতো। মানুষ জুলুম নির্যাতন করতে পারে, মানুষের রক্ত চুষতে পারে তা কোনদিনই ভাবে নাই। আন্তরিকতা ও হৃদ্যতার সঙ্গে সে পরিচিত ছিল বটে, কিন্তু ঘৃণা কি জিনিস যায়েদ তা কোন দিন অনুভবও করে নাই।
অপহরণ
কিন্তু হঠাৎ অবস্থার ভয়াবহ পরিবর্তন দেখা দিল। মানবতা বিবর্জিত স্বার্থপরতার এ ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হল যায়েদ ইবনে হারিসা। বনী কাইন গোত্রের দস্যু ও ডাকাতরা বনী কুজায়ার উপর হামলা চালিয়ে তাদের সহা-সম্পদ লুটতরাজ করে নিয়ে গেল। মারামারি ও হত্যাকাণ্ড ঘটালো একদিন। এ সময় অন্যান্য সহায়-সম্পদের সাথে যায়েদকেও অপহরণ করে নিয়ে গেল। তখন তার বয়স ছিল মাত্র আট বছর। মাতা-পিতা, নানা-নানী, দাদা-দাদী ও আত্মীয়-স্বজনের মায়া-মমতার বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় যায়েদ প্রচণ্ড কান্নাকাটি করে, তার কলিজা ফেটে যায়। কিন্তু মানুষ এমন পাষাণ হতে পারে, কাকুতি-মিনতি ও ক্রন্দনের বিপরীতে মায়া-দয়াহীন আচরণ করতে পারে, তা এবারই যায়েদ প্রথমবারের মত লক্ষ্য করলো। যায়েদের চিৎকার শুনে মানুষরূপী জানোয়ারগুলো তাকে বেদম প্রহার করে। তার কোমল মুখমণ্ডল ও কচি দেহ রক্তাক্ত হয়ে যায়। পাপাচারের কারণে তাদের অন্তর নষ্ট হয়ে যায়।, অন্তরের কালিমায় যাদের চেহারা পশুর মত হয়ে পড়ে, যাদের অর্থ লোভের কারণে চোখের দৃষ্টি অঙ্গারের রূপ ধারণ করে, তাদের আচরণ-ব্যবহার যে কত বেদনাদায়ক ও নির্মম হতে পারে প্রথমবারের মত যায়েদ তা উপলব্ধি করল।
উকাযের বাজারে যায়েদ - খাদীজার ঘরে যায়েদ
উকাযের বাজারে যায়েদ
আরবের প্রসিদ্ধ বাজার উকাযে কৃতদাস হিসেবে বিক্রি করার জন্য যায়েদকে আনা হলো। যায়েদ দেখল সেখানে অসংখ্য মানুষের সমাগম। কিন্তু তাদের মধ্যে মানবতা, দয়া-মায়ার কোন কিছুই যায়েদ খুঁজে পায় না। এই মানবতা বিবর্জিত মানুষগুলোর দৃষ্টি কেবল যায়েদের উপরই বিদ্ধ হতে থাকে। যায়েদের হৃষ্টপুষ্ট দেহ, সৃষ্টিগত গঠন-সৌন্দর্য, সুঠাম দেহের সজীবতা, তার দৈহিক শক্তির পরিমাণ ইত্যাদি নিয়ে কতগুলো মানুষ আলোচনা-পর্যালোচনা করতে থাকে, যাতে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে ক্রয় করে যথেষ্ট কাজ তাকে দিয়ে করিয়ে নেয়া যায়। তাকে দাস হিসেবে কিনে নিতে ইচ্ছুক এমন অনেককেই সে দেখতে পায়, কিন্তু তার মনের চিৎকার ও ফরিয়াদ শোনার মত কাউকে খুঁজে পায় না। এই বিশাল বাজারে ক্রেতাদেরকে যায়েদের ব্যথিত আত্মা যেন বার বার চিৎকার করে বলছিল “তোমরা কারা? তোমাদের তো চক্ষু আছে তাহলে তোমরা আমার প্রতি করুণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করছ না কেন? তোমাদের তো কান আছে, তাহলে তোমরা আমার ক্রন্দন এবং ফরিয়াদ শ্রবণে বধির কেন? তোমরা তো আমার পিতৃ তুল্য, সুতরাং আমার এ অসহায় অবস্থার প্রতি তোমাদের দয়া আসে না কেন? তোমরা কি তাহলে ডাকাত দলের সহযোগী? অত্যাচারী মাস্তানদের পক্ষে? এরূপ জুলুম-নির্যাতন আর পাপাচার কি তোমাদের শোভা পায়? কিন্তু যায়েদের এ মর্মস্পর্শী-বেদনা ঝরা হৃদয়ের ধ্বনি শোনার জন্য কাউকে পাওয়া গেল না। যারা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দেয় না, যারা নফরমানীতে কুণ্ঠাবোধ করে না, তারা কি কোনদিন মজলুমের করুণ ধ্বনি শুনে ভরাক্রান্ত হতে পারে? পারে কি সত্য ও ন্যায়নীতি অনুধাবনে সক্ষম হতে?
খাদীজার ঘরে যায়েদ
হযরত খাদীজা যায়েদের মাঝে এমন কিছু গুণ ও বৈশিষ্ট্য দেখতে পান যা অন্য দাসদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তিনি যায়েদকেই হাদিয়া স্বরূপ গ্রহণ করেন। যায়েদ তার প্রতি কৃত আচরণ ও পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক কিছুই ভাবতে শুরু করে। অল্প বয়সের মধ্যেই সে বুঝতে সক্ষম হয় যে, কেউ তার বেদনা ভরা হৃদয়ের আহাজারী শ্রবণ না করলেও মহান পালনকর্তা তার প্রার্থনা অবশ্যই শুনেছেন। সে যেন পুনরায় মা জননীর স্নেহের কোলে ফিরে এসেছে। হযরত খাদীজার স্নেহ-মায়া, আদর-যত্ন পুনরায় তার অন্তরে মানবতা ও মনুষ্যত্বের ধারণা জাগিয়ে তোলে। কিন্তু মাতা-পিতার বিরহ বেদনা এখনও তার হৃদয়কে অশান্তই করে রাখে। এদিকে স্বয়ং হযরত খাদীজা ছিলেন বিধবা, তিনি একাকী জীবন-যাপন করছিলেন। মক্কার সম্ভ্রান্ত পরিবারের যুবকদের পক্ষ থেকে বিবাহ প্রস্তাব আসতে থাকে, কিন্তু হযরত খাদিজা কোন প্রস্তাবেই সম্মত হতে পারেন নি। বিত্তশালী গোত্রীয় প্রধানদের পক্ষ থেকেও প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে, কিন্তু কিছুতেই তিনি সম্মতি জানান নি। তার অন্তর এমন একজনের সন্ধানী ছিল, যে অর্থশালী বা গোত্রের বাদশাহ না হলেও হবে অন্তরের বাদশাহ। উত্তম চরিত্র ও আদর্শের সম্রাট। হযরত খাদীজা এমনই একজন মহান যুবকের অপেক্ষা করছিলেন।
রাসূলের (সঃ) পাশে যায়েদ - যায়েদের ইসলাম গ্রহণ
রাসূলের পাশে যায়েদ
অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়ে গেল এক সময়। রাসূলে কারীমের সাথে হযরত খাদীজার বিবাহ সম্পন্ন হলো। হযরত খাদীজার স্বামী একজন মহান যুবক, যাকে সমগ্র মক্কাবাসী আমীন এবং সত্যবাদী খেতাবে ভূষিত করেছে। বিবাহের পর স্বামীর সহযোগিতা ও সেবার জন্য খাদীজা যায়েদকে স্বামীর কাছে হাদিয়া পেশ করেন। এ সুযোগে যায়েদও এই মহান যুবকের সহচর হতে সক্ষম হয়। কালে খাদীজার এ যুবক স্বামী ওহীপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্ব রাসূলের পদমর্যাদা লাভ করবে তা হয়তো যায়েদ কখনো ভাবতেও পারে নাই, কিন্তু যুবক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরশে যায়েদ এক নতুন জীবন লাভ করে। যায়েদ ভাবে, আমার মনীবা আমাকে তার স্বামী হযরত মুহাম্মদকে দিয়ে আমার কল্যাণই করেছেন। কী মহান উদার এক ব্যক্তির সান্নিধ্য আমি লাভ করেছি। ইনি কি কোন সাধারণ মানুষ? যে দূর্বলের উপর প্রভুত্ব কায়েম করে না, বরং আমানতদার সুলভ আচরণ করে। যখন কারো প্রতি দৃষ্টি আরোপ করে তখন তার চাহনিতে দয়া-মায়া, মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও প্রেম প্রকাশ পায়, যখন কথা বলে তখন তার কথায় মানুষের ভরাক্রান্ত-ব্যথিত হৃদয় প্রশান্ত সাগরে পরিণত হয়। সে যখন মৃদু হাসে তখন জ্বলন্ত অন্তর শীতল হয়ে পড়ে, দুঃখ-বেদনা দূরীভুত হয়ে যায়। যখন কারো আবেদন-নিবেদন শোনে, তখন তা পূরণের জন্য এতটাই উদগ্রীব হয়ে উঠে যে, যেন সে নিজেই আবেদনকারী হয়ে যায়। উপরন্তু যায়েদ তার হৃদয়ে পিতার স্নেহ ও মা জননীর মমতার সন্ধান পায়। তার চেয়েও অধিক কোন কিছু সে এখানে খুঁজে পায়। এই যুবকের সহচর্যে যায়েদের জীবনে নতুন বিপ্লব শুরু হয়। সে তার মাতা-পিতার বিরহ-বেদনা ভুলে যেতে শুরু করে। উকাযের মার্কেটে মানুষরূপী পশুদের আচরণে যে হতাশার অনুভূতি যায়েদকে স্তম্ভিত ও বিমূঢ় করে দিয়েছিলো, এখন যেন যায়েদ তা সম্পূর্ণই ভুলে গিয়েছে। উকাযের মার্কেটে যায়েদ নিলামে বিক্রি হয়েছিল, এখনও যে যুবক মনে-প্রাণে মুহাম্মদের কাছে বিক্রি হয়ে আছে, কিন্তু উভয় বিক্রির মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে, তা যায়েদ অন্তরাত্মা দিয়ে অনুভব করে। হযরত মুহাম্মদের এ মানবতা ও উদারতার কারণ কি? এই অজানা রহস্য যায়েদকে বিচলিত করে তোলে।
যায়েদের ইসলাম গ্রহণ
রহস্য ও তত্ত্ব উদঘাটনের জন্য যায়েদকে আর অধিক কাল অপেক্ষা করতে হয়নি। হযরত মুহাম্মদ হেরা পর্বতে নির্জনতা অবলম্বন শুরু করেন। হঠাৎ একদিন আল্লাহর ওহী নিয়ে এসে জিবরীল তাকে বিশ্বাবসীর প্রতি আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে রাসূল হওয়ার সুসংবাদ শোনান। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখন বিশ্বনবী, শ্রেষ্ঠ রাসূল। যায়েদ এবার সবকিছুই বুঝতে সক্ষম হলো। তাই সে দেরী করা সমীচীন মনে না করে রাসূলের প্রতি ঈমান স্থাপন করে সর্বপ্রথম ঈমান লাভে ধন্য হওয়ার মর্যাদা অর্জন করেন। বিশ্ব রাসূল(সঃ) প্রায়ই বলতেন, “কৃতদাসদের মধ্যে যুবক যায়েদই সর্বপ্রথম আমর প্রতি ঈমান স্থাপন করেছে।”
যায়েদের অনুসন্ধান - যায়েদের সন্ধান লাভ
যায়েদের অনুসন্ধান
যায়েদ এখন বিশ্বনবীর খাদেম যুবক। নবীজীর খেদমতে থেকে সে তার দুঃখ-কষ্ট সবকিছুই ভুলে গিয়েছে। ভুলে গিয়েছে মাতা-পিতা এবং তাদের বিচ্ছেদ-বেদনাও। কিন্তু তার মাত-পিতা ও আত্মীয়-স্বজন এখনও তাকে ভুলতে পারে নাই। ভুলতে না পারার কারণেই তারা তার অনুসন্ধানে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পিতা হারিসা স্বীয় পুত্রের বিরহ শোকে মুহ্যমান। মরণাপন্ন হয়ে ঘুরা-ফেরা করছে দিন-রাত। আর এই অনুসন্ধানী সফরে কত ধরণের কবিতা যে সে রচনা করেছে তা আজও ইতিহাসে অলংকৃত হয়ে আছে।
যায়েদের সন্ধান লাভ
পিতা হারিসা তার সন্তানের মুখ দেখবে, তার জ্বলন্ত অন্তর প্রশান্ত হবে, এ আশা তার ছিল না। কেবল মনের আবেগেই তার অনুসন্ধান অব্যহত ছিল। এভাবেই সে তার সময় কাটানোর ব্যবস্থা নিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে আশার আলো জ্বলে ওঠে এক ইয়ামেনী হাজীর বক্তব্য শুনে। ইয়ামেনী হাজীর বক্তব্যে তার আবেগে কান্না চলে আসে। ইয়ামেনী তাকে বলেছে, “হে হারিসা! তোমার পুত্র যায়েদ ‘মুহাম্মদ আরাবীর’ নিকট জীবিত এবং নিরাপদে আছে। আমার সাথে তার দেখা ও কথাবার্তা হয়েছে। সে তোমাদের সালাম পেশ করেছে।
রাসূলের দরবারে হারিসা - রাসূলে পাক ও হারিসার সংলাপ ও বৈঠক
রাসূলের দরবারে হারিসা
হারিসার জীবনে এই সংবাদটি ছিল তার জীবনে এক নতুন স্পন্দন। সে তার হারানো মানিক ফিরে পেয়েছে, আনন্দে-খুশীতে তার অন্তর উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। তাই কাল বিলম্ব না করে আপন ভাই কাআবকে সাথে নিয়ে সে মক্কার পথে ছুটে আসে। যে কোন কিছুর বিনিময়ে পুত্রকে পেতে হবে তাই বিরাট অংকের অর্থ-কড়িও সাথে নিয়েছে। হারিসা মক্কায় পৌঁছে অনুসন্ধান করে রাসূলের দরবারে হাজির হয়ে বলে “হে আব্দুল্লাহর পুত্র! হে হাশিম ও আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর! হে স্বীয় গোত্রের স্বনামধন্য প্রধান! আপনি পবিত্র হরম শরীফের অধিবাসী এবং পড়শী! আপনি দুর্বল ও বিপন্নদের প্রতি সহনশীল! অনাহারীকে আহার দিয়ে থাকেন। বিপদগ্রস্তদের প্রতি আপনার অনুকম্পা সর্বজন স্বীকৃত! আমরা আপনার দরবারে বিশেষ আশা-ভরসা নিয়ে হাজির হয়েছি। আপনার মহান দরবারে আমাদের আশা পূরণ হবে বলে মনে করি।
রাসূলে পাক ও হারিসার সংলাপ ও বৈঠক
হযরত রাসূলঃ আমার কাছে তোমাদের কি দাবী তা ব্যক্ত কর।
হারিসাঃ আমার পুত্র আপনার গোলাম, তার মুক্তি কামনা করছি এবং এর জন্য যে কোন পরিমাণ মুক্তিপণ দিতে সম্মত আছি।
হযরত রাসূলে আকরামঃ কে তোমার পূত্র?
হারিসাঃ আপনার গোলাম যায়েদ!
যায়েদ কে! সে বিশ্বনবীর গোলাম! যার গোলামীর বরকতে যায়েদ পৌত্তলিকতার গোলামী থেকে মুক্তি লাভ করে একত্ববাদের শীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছে, যাকে বিশ্বনবী তার স্নেহ-মমতার দ্বারা ক্রয় করে কাছে রেখেছেন, যার ভালোবাসায় যায়েদের অন্তর উদ্ভাসিত, যার পরশে যায়েদ নতুন বিশ্বাস ও জীবন লাভ করেছে, তার থেকেই যায়েদের মুক্তি কামনা করে আরজি পেশ করেছে যায়েদের পিতা হারিসা। পুত্রের মুক্তিতে বিরাট পরিমাণে মুক্তিপণ দানের জন্যও সে তার প্রস্তুতি ব্যক্ত করেছে। আরজির উত্তর কামনা করে হারিসা অধীর চিত্তে অপেক্ষা করছে আর মনে মনে ভাবছে, একজন অপরিচিত লোকের আবেদনে স্বীয় গোলামকে মুক্ত করে দেয়ার ব্যাপারটা অতি সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। উপরন্তু যুবক যায়েদ এখন মুসলমান! সে সর্বপ্রথম ঈমান গ্রহণকারীদের অন্যতম। তাকে একজন কাফেরের হাতে ন্যস্ত করার পরিণাম এখন কি হতে পারে? এটা নিশ্চিত আশংকা ও দুঃশ্চিন্তার বিষয়। কিন্তু ইনিতো মহান রাসূল! অন্যের দুঃখে দুঃখী হওয়া তার স্বাভাব। আগত ব্যথিত পিতার দুঃখ-বেদনা তাকে অবশ্যই ভারাক্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি অতি মহান পরোপকারী।
তাই অত্যন্ত স্নেহ ও দয়ার সুরে হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের আরও কোন দাবী আছে যা আমি পূরণ করতে পারি?
রাসূলের এই মমতা ভরা বাণী থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আবেদনকারীদের উক্ত আবেদনের চেয়ে আরো অধিক কোন দাবী থাকলেও রাসূলে আকরাম তা পূরণে প্রস্তুত ছিলেন।
হারিসাঃ না, হে মহাত্মন! আমাদের আর কোন দাবী নেই, এটাই হবে আমাদের প্রতি চির স্মরণীয় বিরাট ইহসান।
হারিসার এই আবেদন শুনে বিশ্বরাসূল অল্প সময় নীরবতা অবলম্বন করেন। কারণ হযরত রাসূলে আকরাম যায়েদকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। যুবক যায়েদও রাসূলকে শ্রদ্ধা করে ও ভালোবাসে। অপর দিকে হারিসা যায়েদের পিতা। সন্তানের প্রতি পিতার আকর্ষণ অবর্ণনীয়, বিচ্ছেদ-বেদনা অসহনীয়। এটাই হয়তো নীরবে রাসূলের ভাবনা ও চিন্তার বিষয়। তবে বিশ্ব রাসূল আর দেরী না করে পিতার অধিকারকে প্রাধান্য দিয়ে প্রসন্ন হৃদয়ে বললেনঃ যায়েদকে অধিকার দেওয়া হোক! সে যদি তোমাদের সাথে চলে যেতে সম্মত হয় তাহলে আমার পক্ষ থেকে সে মুক্ত। এর জন্য মুক্তিপণেরও প্রয়োজন নেই। আর যদি সে যেতে অসম্মত হয়, তাহলে আমি তার সম্মতির বাইরে নই।
রাসূলের এই বাণী হারিসাকে অবাক করে তুলে। কেননা যায়েদ এখন যুবক, অবুঝ কোন বালক নয়। আট বছর বয়সে সে হারিয়ে গেছে। মাতা-পিতার মায়া-মমতার ছায়ায় আজ স্বাধীন জীবন যাপনের সুযোগ লাভের বিষয়টিতে যায়েদ কি অসম্মত হতে পারে? মোটেই না। হারিসা ভেবে দেখল, একজন মনিবের পক্ষ থেকে আমরা এর চেয়ে অধিক আর কি আশা করতে পারি! সত্যি মহামানব মুহাম্মদ অত্যন্ত ন্যায় বিচার করেছেন, আমি তাতে পরিপূর্ণ সম্মত।
হারিসাঃ আপনার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত। আমরাও তাতে সম্মত। অতঃপর যুবক যায়েদকে দরবারে আনা হল।
পিতার সম্মুখে যায়েদ - যুবক যায়েদের বক্তব্য
পিতার সম্মুখে যায়েদ
যুবক যায়েদ বহুদিন পর তার পিতার সম্মুখে উপস্থিত। পিতার চেহারা অশ্রুসিক্ত। যায়েদ জটিল পরীক্ষার সম্মুখীন। কেননা একদিকে তার পিতা; হারানো সন্তানকে বুকে নিয়ে বহুদিনের বেদনাদগ্ধ অন্তরকে প্রশান্ত করার জন্য অপেক্ষমান। অপরদিকে তার মনিব; তার সাথে রক্ত ও বংশের সম্পর্ক অবশ্য নেই, কিন্তু যুবক যায়েদের অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি এবারও তারই প্রতি নিবদ্ধ, যাকে সে আল্লাহর রাসূল বলে বিশ্বাস করেছে। যুবক যায়েদের চাহনী এবং নীরব দৃষ্টি একান্তভাবে রাসূলের প্রতি তার শ্রদ্ধা-ভক্তি ও গভীর আনুগত্যের প্রমাণ পেশ করে। সে নতশীর হয়ে দরবারে দাড়িয়ে থাকে। যায়েদের এ অবস্থান রাসূলের সম্মুখে অস্পষ্ট ছিল না। কিন্তু তবুও তিনি বললেনঃ
হযরত রাসূলঃ যায়েদ! তুমি তাদেরকে চেনো?
যুবক যায়েদঃ হ্যাঁ, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি তাদেরকে অত্যন্ত ভালোভাবেই চিনি। একজন আমার পিতা, অপরজন আমার চাচা।
এতটুকু বলেই যায়েদ নীরব হয়ে যায়। অতিরিক্ত কিছু না বলে চুপ থাকে। নতশীর হয়ে দাড়িয়ে থাকে। তার দৃষ্টি বিশ্ব রাসূলের মুবারক কদমের উপর নিবদ্ধ। যুবক যায়েদ তখন ঈমানের পিঞ্জিরায় আবদ্ধ, রূহানী জগতে নিমগ্ন। রক্ত-বংশ, পিতা ও আত্মীয়-স্বজনের বন্ধনকে প্রাধান্য দেয়ার সুযোগ তার কোথায়? তাই পিতা হারিসা এবং চাচা কাআব ব্যাকুল হয়ে উপস্থিত হলেও যুবক যায়েদ তাদের দিকে আকৃষ্ট হতে পারছে না। পিতা হারিসা স্বীয় পুত্রের এ অবস্থা অবলোকন করে হতভম্ব। তার চাচা কাআবও অবাক এবং হতাশ হয়ে পড়ে। তার দু’জনেই রাসূলের বাণীর অপেক্ষা করতে থাকে।
হযরত রাসূলঃ হে যায়েদ! আমি কে তা তুমি জান। তোমার প্রতি আমার কিরূপ আচরণ তাও তোমার খুব ভালো করেই জানা আছে। এখন তোমার জন্য দুটি পথ, ইচ্ছা হলে পিতার সাথে তুমি তোমার বাড়ীতে আত্মীয়-স্বজনদের নিকট ফিরে যেতে পার, আর ইচ্ছা হলে আমার সাথেও থাকতে পার।
রাসূলের এই বাণী শুনেও যায়েদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাড়িয়ে থাকে। তার শেষ কথা শোনার জন্য অধীরচিত্তে পিতা প্রতীক্ষা করছে। যায়েদের চাচা কাআব তাদের দাবীর প্রতি সমর্থন দিতে কাতর সুরে ভাতিজাকে আবেদন জানাচ্ছে। বিশ্ব রাসূল ধীরে সুস্থে সবকিছুই অবলোকন করছেন। আর যুবক যায়েদ এক পবিত্র অনুভূতির সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিল। খানিক বাদে যুবক যায়েদ তার শীর উঁচু করে। মুখে তার মৃদু হাসি। অশ্রুসিক্ত তার দু’ চোখ। তার চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছিল ব্যাকুলতার ছাপ। কিন্তু যুবক যায়েদ ঈমান এবং আত্মীয়তার এই মনস্তাত্তিক যুদ্ধে বিজয় লাভ করে। সে প্রকম্পিত হৃদয়ে যে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে তা কেবল যায়েদের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল।
যুবক যায়েদের বক্তব্য
হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার মুকাবিলায় অন্য কাউকে প্রাধান্য দিতে পারি না। আমার মাতা-পিতা এবং আত্মীয়-স্বজনের তুলনায় আপনি আমার কাছে অধিক কাম্য। তাই আমি আপনার সান্নিধ্য থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।
যুবক যায়েদের উত্তর শুনে রাসূলে পাক মৃদু হাসেন। আর হারিসা ও কাআব যায়েদের সিদ্ধান্ত শুনে অবাক ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে পড়ে। যায়েদ এমন উত্তর দিবে তারা ভাবতেও পারে নি। একি ব্যাপার? এ কোন পবিত্র মমতার বন্ধন, যার মুকাবিলায় মাতা-পিতার রক্তের টানও তুচ্ছ হয়ে গেল?
হারিসা বললঃ হে যায়েদ! তোমার মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটেছে নাকি, তুমি কি করে মাতা-পিতার চেয়েও বর্তমান দাসত্বের জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছ? মাতা-পিতার পরিবর্তে অন্যকে কিরূপে বরণ করেছে? তোমার হল কি?
পিতার কথা শুনে প্রথমবার সে তার মাথা উঁচু করে পিতাকে সঠিকভাবে দর্শন করে। যায়েদের দৃষ্টিতে তখন এক আজন নূর পরিদৃষ্ট হয়। তার অন্তরদৃষ্টি প্রবল হয়ে ওঠে। তার ঈমানী শক্তির সম্মুখে বস্তু ও জড় সম্পর্ক ম্লান হয়ে পড়ে। মনে হচ্ছে, যায়েদের দেহে যেন হারিসার রক্ত নয়, ঈমানের নূর প্রবিষ্ট।
যায়েদ পিতাকে সম্বোধন করে বলেঃ হ্যাঁ, আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা সুস্থ মস্তিষ্কেই নিয়েছি। আমি বিশ্ব রাসূলের মধ্যে যা কিছু অবলোকন করেছি, তা কারো মধ্যে প্রত্যক্ষ করি নাই। আপনারা আমাকে ভুলে যান। আমি এখন আর অন্য কারো নই। আমার জীবন কেবলমাত্র আল্লাহ ও তার রাসূলের জন্য উৎসর্গীকৃত।
যায়েদ নবীর পুত্র - যায়েদের প্রতি স্নেহ-মমতা
যায়েদ নবীর পুত্র
যুবক যায়েদের এ বক্তব্য রাসূলের হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি আবেগে যুবক যায়েদের হাত ধরে হরম শরীফে প্রবেশ করত আল্লাহর ঘরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেনঃ হে মানব সমাজ! তোমাদের সাক্ষী রেখে আমি বলছি, আজ থেকে যুবক যায়েদ আমার পুত্র। হৃদয়স্পর্শী এই দৃশ্য পরিদর্শন করে পিতা হারিসা এবং তার চাচা কাআব প্রশান্ত মনেই বাড়ি ফিরে আসে। তাকে বিশ্ব রাসূলের খিদমতেই রেখে আসতে তারা সম্মত হয়। সেদিন থেকে যায়েদ আর ইবনে হারিসা (হারিসার পুত্র) নয়; বরং যায়েদ ইবনে মুহাম্মদ (মুহাম্মদের পুত্র যায়েদ) হিসেবে পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়।
যায়েদের প্রতি স্নেহ-মমতা
বিশ্ব রাসূলের সাথে একজন কৃতদাস হিসেবে সর্বপ্রথম যুবক যায়েদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। মক্কার মানবতা ও সভ্যতা বিবর্জিত পরিবেশে কেউ তাকে বুকে টেনে নিবে, তাকে স্নেহ-মায়া দিয়ে আপনজন হিসেবে কেউ কোলে টেনে নেবে, যুবক যায়েদ কখনো তা ভাবতে পারে নি। যায়েদের কথা শুনে কেউ ঘর থেকে বের হয়ে তাকে স্বাগত জানাবে, দাসত্বের দাগমুক্ত করে তার কপালে কেউ চুমু খাবে এবং তার সাথে গলা মিলাবে, দাস ও মনিবের মধ্যে যে কোন তফাৎ নেই, সবাই এক আল্লাহর সৃষ্টি-এরূপ বিরল সম্মান লাভে ধন্য হবে, যুবক যায়েদ তা কোনদিনই ভাবতে পারে নাই। হযরত আয়শা (রাঃ) বলেন, “যায়েদ যখনই এসে বিশ্ব রাসূলকে ডাকত, তখন রাসূলে পাক যে অবস্থায়ই থাকতেন, সত্ত্বর বের হয়ে যায়েদের কপালে চুমু খেয়ে তার কুশল জিজ্ঞাসা করতেন।” যায়েদের প্রতি রাসূলের স্নেহ, অনুকম্পা, আকর্ষণ, সদাচরণ ও ইহসানের কারণেই যায়েদ ছিল রাসূলের প্রতি অত্যাধিক আনুগত্যশীল। এ কারণেই মাতা-পিতা ও আত্মীয়-স্বজনের উপর রাসূলকে প্রাধান্য দিতে যুবক যায়েদ কুণ্ঠাবোধ করেনি।
চলবে ইনশাল্লাহ।
১ম পর্বঃ
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ১০:৩২