আইএসের ইসলামিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মুসলমান ও অমুসলমান এক সমান নয়। তাদের চোখে সব মুসলমানই সহি মুসলমান নয় আবার সব অমুসলমানও এক সমান নয়। শিয়াদের তারা মুসলমান মনে করেনা। মুসলিম উম্মাহ বলতে তারা যা বোঝে তার মধ্যে শিয়া মুসলমানের স্থান নেই। তারা প্রতিনিধিত্ব করে সুন্নি ইসলামের। কিন্তু দুনিয়ার অধিকাংশ সুন্নি মুসলমান তাদের চোখে আদৌ মুসলমান নয়। বাংলাদেশ এবং ইন্দেনশিয়ার সুন্নি ইসলামকে তারা ইসলাম মনে করে না। একমাত্র সালাফি ইসলামই তাদের কাছে সহি সুন্নি ইসলাম। আবার সব সালাফিরাও তাদের কাছে সহি সালাফি নয়, যে সালাফিরা তাদের জিহাদকে সমর্থন করেনা, সালাফি জিহাদিরা তাদেরকেও সহি সালাফি মনে করে না। নিজেদের মতাদর্শের বাইরে যারা আছে তাদের কাফির ঘোষণা করার তাকফিরি ঐতিহ্য তাদের মধ্যে প্রবল।
অমুসলিমদের তারা ভাগ করেছে “আহলে কিতাব” ও “পৌত্তালিক” এই দুই ভাগে। ইহুদি আর খ্রিষ্টানরা তাদের কাছে আহলে কিতাব আর ইয়াজিদিরা পৌত্তালিক। আহলে কিতাবের মর্যাদা পৌত্তালিকের চেয়ে বেশী। ফলে আহলে কিতাবের নারীরা আইসিসের যৌনদাসী হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু লুটপাট, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ থেকে বাচতে তাদের অধিকাংশই ইরাক ও সিরিয়া থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। মানদিয়ান ধরমাম্বলিরা ইরাক থেকে প্রায় বিলুপ্ত। স্বাভাবিক ভাবেই ইয়াজিদিরা তাদের হাতে সবচেয়ে বেশী নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। তাদের উপর গনহত্যা ও গনধর্ষণ চালানো হয়েছে এবং দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছে।
বর্তমানে পৃথিবীর জঙ্গি সংগঠন আইএস ইসলামের যে মতবাদের উপর ভিত্তি করে নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষণ চালিয়ে ইসলামী খেলাফতের জন্য জিহাদ করছে তা হোল “সালাফিবাদ”। আর এই সালাফিবাদের জন্মদাতা হচ্ছে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব (১৭০৩-১৭৯২)। তাই এর অনুসারীরা সালাফি ও ওয়াহাবি নামে পরিচিত। আবদুল ওহাবের জন্ম মধ্য আরবের নাজদ অঞ্ছলের একটি হাম্বলিবাদী পরিবারে।
অপরদিকে সৌদি আরবের বর্তমানের যে রাজ পরিবার তার প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছে “মুহাম্মদ ইবনে সৌদ” (১৭২৬-১৭৬৫), যিনি ছিলেন আরবের দিরিয়া অঞ্ছলের আমির। আবদুল ওহাব ও ইবনে সৌদ ১৭৪৪ সালে একে অপরের বায়াত গ্রহন করে, যার মাধ্যমে একে অপরকে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে গ্রহন করে। ওহাব ও সৌদ পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে এই ঐক্য আরো মজবুদ হয়।
তখন পর্যন্ত খাতা-কলমে হিজাজ ছিল তুর্কী ওসমানী (অটোম্যান) খেলাফতের অধীন একটি প্রদেশ। এবং মক্কা ও মদীনার রক্ষনাবেক্ষন ও শাসন ভার ন্যাস্ত ছিল নবী করিম (সাঃ) এর বংশ হাশেমীদের হাতে। ১৮০৬ সালে আইএস এর সালাফিবাদের জনক ওহাবির সেনাবাহিনী মদিনার মসজিদে নববির পাশে অবস্থিত জান্নাতুল বাকি গোরস্থানে হামলা চালায় এবং মহানবী (সাঃ) এর পরিবারের সদস্য ও সাহাবীদের বহু কবর গুড়িয়ে দিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়। এরপর তুর্কী ওসমানী (অটোম্যান) খেলাফতের পাঠানো মিশরীয় সেনাবাহিনীর হাতে পরাজিত হয়ে সৌদি রাজতন্ত্রের প্রাথমিক কর্তিত্বের অবসান ঘটে।
পরবর্তীতে তুর্কী ওসমানী খেলাফতের পতনের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপের বিভিন্ন শক্তির উপনিবেশে পরিনত হয়। বলাযায় ব্রিটিশদের ছত্রছায়ায় সৌদি রাজবংশ এসময় আরবের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিনত হয়। ১৯১৫ সালের “দারিনের” চুক্তির মাধ্যমে সৌদি রাজত্ব ব্রিটিশদের প্রটেক্টরেটে পরিনত হয় যা বজায় থাকে ১৯২৭ পর্যন্ত।
১৯২৫ সালে আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ মক্কা দখল করে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বংশের ৭০০ বছরের হাশেমি শাসনকে উৎখাত করে ক্ষমতা গ্রহন করেন।
১৯৩২ সালে আবদুল আজিজ আধুনিক সৌদি রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করেন। জ্বালানী তেল আবিস্কারের ফলে তারা রাতারাতি টাকার কুমিরে পরিনত হয়। এবং ১৯৩৮ সাল থেকে আমেরিকার সাথে তেল বাণিজ্য শুরু ও তার অন্যতম প্রধান বন্ধুতে পরিনত হয়। সারা পৃথিবীতে আমেরিকার সাথে মিত্রতার বিচারে ইসরায়েলের পরেই সৌদির অবস্থান। তেল বাণিজ্যের বদৌলতে সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিনত হয়। আর সৌদি রাজবংশের পাশাপাশি তাদের প্রচারিত সালাফি ইসলামও এরপর থেকে শক্তিশালী হয়েছে এবং বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আইএস এর সালাফিবাদের উত্থানে এই রাজবংশ অগ্রনী ভূমিকা পালন করছে।
সৌদি রাজবংশের হাতে ইসলামের প্রাথমিক যুগের যেসব স্মৃতি চিহ্ন ধ্বংস হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, মহানবী (সাঃ) এর চাচা হামজার কবর, কন্যা ফাতিমার মসজিদ, স্ত্রী খাদিজার বসতভিটা, নবী করিম (সাঃ) এর মদিনার বসতভিটা, মহানবীর তৈরি করা প্রথম বিদ্যালয়, মা আমিনার কবর, আলীর বসত ভিটা, সাহাবী সাল্মান আল ফারসির কবর ইত্যাদি। শিরকের জন্ম দিতে পারে এই ফতোয়া দিয়ে আল্লাহর রাসুল ও তার পরিবারের এসব ঐতিহাসিক স্মৃতি চিহ্ন ধ্বংস করা হয়েছে। অথচ শিরক প্রতিরোধের নামে এই ধ্বংসযজ্ঞ হলেও বর্তমানে হজ্ব ব্যেবসার প্রসারের জন্য এই সব স্থাপনা আবার নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে।
সিরিয়া ও ইরাকে, সৌদি সালাফি মতাদর্শে জন্ম নেয়া আইএস, সেখানকার অন্যান্য নবী, সাহাবা অথবা পীর দরবেশদের কবর ও প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন ধ্বংস করায় যে সিদ্ধহস্ত তা মোটেই কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না।
দুনিয়ায় ৬০ ভাগের বেশী মুসলমান বসবাস করে দক্ষিন ও দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায়। আর ২০ ভাগ মুসলমান বাস করে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে। আর দুনিয়ার অধিকাংশ সালাফি বাস করে এই আরব দেশগুলতেই। এবং প্রকিত বাস্তবতা হোল সারা দুনিয়ার মুসলিম জনসংখ্যার নগণ্য একটা অংশই সালাফি মুসলমান। আর তাদের একটা অংশ হোল সালাফি জিহাদি বা আইএস।
আরো একটি মজার ব্যেপার হলো চরম ইসলাম বিদ্বেষী এবং আইএস এই দুই প্রজাতিই শুধু মনে করে সালাফি ইসলাম হোল প্রকৃত ইসলাম। যদিও বাকি দুনিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ও অন্যান্য ধর্মের মানুষ একে ইসলাম হিসেবে মনে করে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও সালাফি জিহাদবাদের মধ্যে এই জটিল সম্পর্ক যথেষ্ট পুরানো। আশির দশকে সৌদি রাজবংশ ও আমেরিকার সহায়তায় ওসামা বিন লাদেল সহ বহু সৌদি নাগরিক আফগানিস্থানে হিজরত করেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য। আমেরিকা ও সৌদির অর্থ সাহায্য পেয়ে মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা জিহাদিরা এসময়ই প্রথমবারের মতো সংগঠিত হয়, যা থেকে পরবর্তীতে আলকায়দার জন্ম হয়। আলকায়দা নামক সালাফি জিহাদি সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল সরাসরি সিআইএর সহযোগিতায়। খোদ ওসামা বিন লাদের যার কর্মী ছিলেন। পরবর্তীতে আইসিসের জন্ম হয়েছিলো আল কায়দার ইরাকী শাখা হিসেবে। আশির দশক থেকেই সৌদি আরবের অর্থ সাহায্যে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে সালাফি মসজিদ, সালাফি মাদ্রাসা, সালাফি এনজিও সহ নানা প্রতিষ্ঠান। আর সেই সাথে প্রবেশ করেছে সালাফি জিহাদি মতাদর্শন। বাংলাদেশে সালাফি মতবাদের সবচেয়ে পুরনো সংগঠন হচ্ছে “আহলে হাদিস বাংলাদেশ”। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে যখন ইসলামিক দলগুলো এই দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায়, সেসময় মূলত এরা এদেশে প্রবেশ করে। ৮০ ও ৯০-এর দশকে বিভিন্ন বিদেশী ফান্ড এর মাধ্যমে আহলে হাদিস পন্থীরা শক্তিশালী হয়েছে এবং বহু কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে সেসব মাদ্রাসার শিক্ষাকে সালাফি মতবাদ ও রাজনীতি বিস্তারের কাজে ব্যেবহার করেছে।জঙ্গি সংগঠন জেএমবির প্রধান রিক্রুটমেন্টের উৎস ছিল আহলে হাদিস প্রতিষ্ঠিত সালাফি মাদ্রাসাগুলি।
এখন কিছু প্রশ্ন মনের মধ্যে আনুন। আমাদের এই দেশে শত শত বছর ধরে নিরীহ ধর্মপ্রান মানুষ হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে বসবাস করেছে। কই এতো দিনতো এই ধর্মের নামে হত্যা-হানাহানি এসব ছিল না ! তখনওতো এই দেশের বেশীরভাগ জায়গায় মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল। গত কয়েক বছরে আলকায়দা আর আইএসের উত্থান আর রাজনীতিবিদদের কারনে ৪৭ এর দাঙ্গা ছাড়া আমাদের এই ভূখণ্ডে শত শত বছরের ইতিহাসে ধর্মীয় কারনে হানাহানির খুব একটা দৃষ্টান্ত চোখে পড়েনা।
এখন একজন আরব মুসলমান আর বাঙালী মুসলমান ধর্ম চিন্তা ও আচার আচরণে পুরপুরি একরকম হবে, এরকম ভাবাটা অস্বাভাবিক। যেমন, আরবে বহু বিবাহ বা দাস প্রথা সাধারন বিষয় হলেও আমাদের বাংলাদেশে এটা অস্বাভাবিক। এখানে কোন মানুষ যদি একের অধিক বিয়ে করে সাধারন ভাবে সে সমাজে খারাপ মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। দাসী রাখার ব্যেপার তো কল্পনাই করা যায় না।
সুতরাং সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বহুত্বকে অস্বীকার করে সৌদি বা আইএস যখন তাদের মতামতকে সবার উপর চাপিয়ে দিতে চায় তখনই সাম্প্রদায়িকতার আগুনে মানুষ রক্তাত্ত হয়।
সালাফি জিহাদিরা, মুসলমানদের একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ। তারা কখনই সম্পূর্ণ মুসলমান জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করেনা। তারা হচ্ছে সেই সম্প্রদায় যারা নবীর পরিবারকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখল করে। রাসুলের স্মৃতি চিহ্ন মুছে ফেলতে যাদের হাত কাপেনা। ধর্মের কথা বলে যারা সাধারন মানুষকে হত্যা করে।
এখন যদি প্রশ্ন করা হয় তাহলে সত্যিকারের মুসলমান কারা ? তাহলে আমার উত্তর হবে, সত্যিকারের মুসলমান আমাদের সমাজের সাধারন মানুষ যারা আল্লাহকে ভালোবেসে, আল্লাহর রাসুলকে ভালবেসে নামাজ পড়ে, কোরআন পরে। সারাদিন বাইরে কাজ করে সন্ধ্যায় বাড়িতে পিতা-মাতা ভাই-বোন নিয়ে একসাথে ইফতার করে। আবার ঈদের সময় হিন্দু বন্ধুদের ডেকে এনে সেমাই খাওয়ায়। দুর্গাপূজার নাড়ু বা বড় দিনের খুশি প্রতিবেশিদের সাথে ভাগ করে নেয়। এটাই ইসলাম। ঘৃণা আর হত্যার মাঝে ইসলাম নেই। মানুষকে ভালবাসার মধ্যেই ইসলাম নিহিত... (দ্বিতীয় পর্ব, সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৬ সকাল ১১:৩৬